আলাপন বন্দোপাধ্যায় এর জন্য আজ হঠাৎ করে যারা ‘বাঙালির মেরুদন্ড’ খুঁজে পাচ্ছেন তারা কি কখনো দময়ন্তী সেন, শ্যামাপদ গড়াই, শিলাদিত্য চৌধুরী, প্রিয়াঙ্কা ভরদ্বাজ, অম্বিকেশ মহাপাত্র, মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল এদের নাম শুনেছেন? একটা সর্বভারতীয় আমলাতান্ত্রিক চাকরীর ক্ষেত্রে রদবদল একটি অতি স্বাভাবিক, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া কিন্তু এরমধ্যেও মাননীয়া যে ‘বাঙালি বলে প্রতিহিংসা’ এই তত্ত্ব খাড়া করে আঞ্চলিকতার আগুনে ঘৃতাহুতি করে এক অস্বাভাবিক রাজনীতি করছেন এর কারন বোধগম্য না। কিন্তু হঠাৎ করেই বাঙালির মেরুদন্ড আছে বলে লাফালাফি করছেন যারা তারা আজ হয়তো দুর্ঘটনাবশত নিজের ও বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড অনুভব করতে পারছেন কিন্তু আমি একজন বাঙালি হিসেবে বরাবরই বিশ্বাস করি, বাঙালির রক্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্পৃহা রয়েছে। সুভাষ বোসের মাটির লোকের আন্দোলনটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহসটা মায়ের পেট থেকে নিয়ে জন্মায় ঠিক যেমনটা উপরে বলা লোকগুলো করেছিলো সরকারের বিরুদ্ধে।
দময়ন্তী সেন, মেরুদন্ডী IPS অফিসার, পার্ক স্ট্রিট কেস মনে পরে? মনে পরে সুজেট জর্ডন? খাস কোলকাতায় ধর্ষিতা হন এক মহিলা। পার্ক স্ট্রিট এলাকায় তাকে ধর্ষন করা হয়, ধর্ষনে অভিযুক্ত শাসক ঘনিষ্ঠ এক অভিনেত্রী (যিনি বর্তমানে সাংসদ) র তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড। মিডিয়ায় খবর আসতেই রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন ‘ছোটো ঘটনা, সাজানো ঘটনা’, তারপরই তার দলের বীর বিধায়ক গন এই ধর্ষনের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে একে খরিদ্দারের সাথে ব্যবসায়ীর লেনদেনের সামান্য ঘটনা বলে ধর্ষিতারই চরিত্রহনন শুরু করে দেন। বিধায়করা খাপ পঞ্চায়েত খুলে ফেলেন মিডিয়াতে, এতো রাতে ওই মেয়েটা কি করছিলো? মেয়েটার চরিত্র কি? এমতাবস্থায় সরকার যখন পার্ক স্ট্রিট ধর্ষন মামলা ধামা চাপা দিতে তাদের পীত সাংবাদিকতা করা সাংবাদিক দের দিয়ে মিডিয়ার একটা ন্যারেটিভ সেট করছেন ধর্ষিতার সন্মন্ধে ঠিক তখনই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষন মামলার তদন্তকারী অফিসার দময়ন্তী সেন বললেন এটা একটা ধর্ষনের কেস, ধর্ষনের অভিপ্রায় নিয়েই সুজেট কে গাড়িতে তুলে ধর্ষন করা হয়, তার ওপর অত্যাচার করা হয়। তদন্তপ্রক্রিয়া চালু অবস্থায় তদন্তের দায়িত্বে থাকা দময়ন্তী সেন কে কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো মাত্র দু মাসের মাথায়। শোনা যায় এনিয়ে দময়ন্তী সেনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাগবিতণ্ডাও হয়। পীত সাংবাদিকতার সৌজন্যে আপনি সেদিন বাঙালির মেরুদন্ড খুঁজে পাননি।
শ্যামাপদ গড়াই, একজন মেরুদন্ডী ডাক্তার, নির্বাচনে জেতার পরপরই হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শন শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার মাসেই ২৬ মে স্নায়ু-চিকিৎসার সেরা সরকারি হাসপাতাল বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন) পরিদর্শনে যান মুখ্যমন্ত্রী। আউটডোরের ভরা সময়ে সংবাদমাধ্যমের অসংখ্য প্রতিনিধি-সহ মুখ্যমন্ত্রীর সদলবলে হাসপাতালে ঢুকে পড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন বিআইএন-এর তদনীন্তন ডিরেক্টর শ্যামাপদ গড়াই। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করেন, তাঁর অসুবিধা কোথায়? ডাক্তার গড়াই বলেন, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাসপাতালে আসায় সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রচুর মানুষ হাসপাতালে ঢুকে পড়লে রোগী পরিষেবায় সমস্যা হয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার গড়াইকে পর দিন সচিবালয়ে দেখা করতে বলেন। ডাক্তার গড়াই জানান, তাঁর কয়েকটি অস্ত্রোপচার আছে। ২৬ মে সন্ধ্যাতেই আবার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের প্রধানদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেও হাজির হতে পারেননি ডাক্তার গড়াই। সে রাতেই সাসপেনশনের চিঠি পাঠানো হয় ডাক্তার গড়াইকে। তার পর বিভাগীয় তদন্ত শুরুরও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। ডাক্তার পার্থজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জানানো হয় তদন্তকারী অফিসার হিসাবে। কিন্তু তদন্ত একচুলও এগোয়নি। এমনকী ডাক্তার পার্থজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নিয়ে নেন ২০১৩-র ৩১ মার্চ। তাঁর চাকরির মেয়াদ বেড়ে ৩১ মার্চ ২০১৪ করা হলেও তদন্ত এগোয়নি। সেদিনও দালাল মিডিয়ার পীত সাংবাদিকতার দৌলতে আপনি জানতে পারেননি যে বাঙালির মেরুদন্ড আছে।
শিলাদিত্য চৌধুরী, একজন মেরুদন্ডী কৃষক। পশ্চিম মেদিনীপুরে বেলপাহাড়ির সভায় সারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কৃষিজীবী পরিবারের যুবক শিলাদিত্য চৌধুরীকে ‘মাওবাদী’ বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে কেস চালানো হয়। পরে তিনি আদালতে মুক্তি পান। সেদিনও আপনি বুঝতে পারেননি বাঙালির মেরুদন্ড আছে।
তানিয়া ভরদ্বাজ, মেরুদন্ডী কলেজ ছাত্রী। এক টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সির কলেজছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজ, মুখ্যমন্ত্রীকে মদন মিত্র, আরাবুল ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তাকে সরাসরি মাওবাদী বলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিনও এক কলেজে পড়া ছাত্রীর প্রশ্নের জবাবে একজন মুখ্যমন্ত্রীকে নিউজ স্টুডিও ছেড়ে হনহনিয়ে চলে যেতে হয়েছিলো। পিঠে হাত দিয়েও বাঙালি সেদিন মেরুদন্ড আছে কি বোধ করতে পারেনি।
অম্বিকেশ মহাপাত্র, মেরুদন্ডী অধ্যাপক। তিনি গনতান্ত্রিক রাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর একটি কার্টুন, যেটা এখন বর্তমানে মিমস নামে পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেই কার্টুন শেয়ার করেন, যারমধ্যে কোনো অশ্লীল কন্টেন্ট ছিলো না, ছিলো সরকারকে ব্যঙ্গ করে একটি তামাশা। কিন্তু আমাদের গনতান্ত্রিক রাজ্যের, গনতান্ত্রিক সরকার সেটা সহ্য করতে পারলেন না, অধ্যাপক অম্বিকেশ বাবুকে গ্রেফতার করা হলো। পরে আদালতে তিনি মুক্তি পান। বাঙালি সেদিনও তার পিছনে হাত দিয়ে দেখেনি তার মেরুদন্ড টা আছে কি? নাকি সেটা ক্রমশই মাননীয়ার চেয়ারের সম্মুখে বেঁকে যাচ্ছে।
মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল, মেরুদন্ডী বাঙালি গৃহবধূ। কামদুনি কেস, কামদুনি তে এক কলেজ ছাত্রী কে ধর্ষন করে পা ধরে চিরে ফেলা হয়। গোটা কামদুনি ধর্ষকদের গ্রেফতার করে তাদের শাস্তির দাবীতে রাস্তায় নামে। রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হতে থাকে কামদুনি কান্ডে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তাকে ঘিরে ধরে, দুই গ্রাম্য গৃহবধূ তাদের বাড়ির কাছের মেয়েটাকে এইভাবে জঘন্যভাবে অত্যাচার করে খুনের বিচার চায়। মুখ্যমন্ত্রী তাদের সহানুভূতি ও বিচারের আশ্বাসের পরিবর্তে মাওবাদী তকমা দিয়ে দেন। তবুও তারা লড়ে যান ও এখনো সেই ধর্ষকদের ফাঁসির দাবীতে লড়ছেন। এই দুই গ্রাম্য গৃহবধূর লড়াইয়েও আপনি মেরুদন্ড দেখতে পাননি।
কিন্তু এখন একজন কোলকাতার এলিট ক্লাস, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তির মেরুদন্ড খুঁজছেন, আর বলছেন বাঙালি মেরুদন্ডী। কিন্তু এই সাধারন মানুষ গুলো, যারা তাদের পিছনে কোনো সমর্থন পাননি, তারাও লড়েছিলেন, আর তারা লড়েছিলেন তাদের মেরুদন্ডের জোরেই।
ধন্য আপনার মেরুদন্ড বিচার।
🖋️- অর্ণব