সুন্দরবন ৭ : সুন্দরবনের সঙ্কট, শঙ্কা কলকাতার

বদলাচ্ছে আবহাওয়া। বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। দ্রুত লোপ পাচ্ছে ম্যানগ্রোভের অরন্য। সব মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমগ্র সুন্দরবনের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা। আর সেই সঙ্গে বিপদ বাড়ছে কলকাতা মহানগরীর। শুধু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নয়, ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের দাম চুকোতে হচ্ছে কলকাতাকেও। 

আবহাওয়ার যা গতি প্রকৃতি, ২০৭০ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলস্তর এক ফুট বেড়ে যাওয়ার অর্থ জলের নীচে চলে যাবে গোটা সুন্দরবনটাই। বিশাল ওই অঞ্চলটা কলকাতার প্রকৃতিবান্ধব একটা তল্লাট। 

২০০৪ সালের শেষ ডিসেম্বরে সুনামির তাণ্ডব থেকে বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্র লাগোয়া বেশ কিছু এলাকা। তামিলনাড়ু, আন্দামান আর শ্রীলঙ্কা উপকূলের যে অংশে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ছিল, সেগুলি ধ্বংস করতে পারেনি ওই প্রাকৃতিক তাণ্ডব। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বিপুল জলরাশিকে আটকে দিয়েছিল। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য কলকাতা শহরে ঢোকার পথে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে বরাবর। শুধু ঝড়ের গতি আটকানোই নয়, ফুলেফেঁপে ওঠা সমুদ্রের জল থেকে ভূমিক্ষয় রোধের একমাত্র প্রতিবিধান এই ম্যানগ্রোভ।  

কেন এই অবস্থা? পরিবেশবিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক শুভশ্রী ঠাকুর এই প্রতিবেদককে জানালেন, “সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। মেরু অঞ্চলের বরফের স্তুপ দ্রুত গলছে। যত দিন যাচ্ছে পরিমাণটা বাড়ছে। আর, ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ঘনত্ব কমে যাওয়াতেই প্রাকৃতিক ঝড় তেমন ভাবে প্রতিহত করতে পারছেনা এই প্রাকৃতিক দেওয়াল। এই ম্যানগ্রোভের শক্ত শিকড় মাটিকে টেনে রাখে। তাই এই গাছ যত কমে গিয়েছে মাটি ক্ষয়ে জলের তোড়ে ধুয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে জলের নিচে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের স্থলভূমি।“

পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়ার অর্থ বহু দুষ্প্রাপ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির সঙ্গে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে ভীষণ সুন্দর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও। এই অশনি সংকেতের ইঙ্গিত দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনল ইউনিয়ন ফর কনসার্ভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন)। ভারত মহাসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত এই ব-দ্বীপের ম্যানগ্রোভ অরণ্যেই রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঘ পপুলেশন।

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, ওখানকার বহু এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে তাতে নুনের ভাগ বেড়ে গিয়ে টাকের মতন হয়েছে। সেখানে কখনও সোয়েডা নামক এক প্রকার নোনা টক শাক ছাড়া কিছুই গজায় না। সুন্দরবনে প্রায় ৭০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ ও বাদাবনের প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায় আর তার ৩৫টি হল প্রকৃত ম্যানগ্রোভ। এর মধ্যে অন্তত দুটো প্রজাতি এই লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এ দেশের সুন্দরবন থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে, আর সে দুটি হল সুন্দরী (হেরিটিয়েরা ফোমিস) ও গোলপাতা (নিপা ফ্রুটিকানস)। অত্যাধিক ভাবে কমে গেছে সবচেয়ে ক্ষয়রোধী গর্জন (রাইজোফোরা), যা মূলত খাড়ির ধারে দেখা যায়। ধুঁধুল, পশুর (জাইলোকারপাস), এমনকি কাঁকড়া (ব্রুগয়রা), গরিয়া (ক্যানডেলিয়া ক্যানডেল)- এর মতো গাছ যথেষ্ট সংখ্যায় আর নেই। 

তাহলে ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে কেন সুন্দরবন বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে না? এর জন্য মানুষকেই দায়ী করেছেন রাজ্যের সেচ দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক অনীশ ঘোষ। যিনি কর্মসূত্রে প্রায় দু’দশক ছিলেন সুন্দরবনে। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “ম্যানগ্রোভ লাগানোর জায়গা কোথায়? তটে গাছ কেটে একে একে ফিশারিজ তৈরি হয়েছে। সমুদ্রের জলে ভাল মাছ চাষ হয়। হোটেল হয়েছে। সুন্দরবনের স্থায়ী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকে বলছেন, কিন্তু সমন্বয়টা হবে কী করে?“

সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের এক দশকের মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কাটা এবং বেআইনি চিংড়ি ও মাছ চাষের জন্য মানুষই দায়ী। প্রশাসন শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিলে যদি কিছু হত।  মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখভাল করার কমিটির চেয়ারম্যান করে দিয়েছেন। কিন্তু উনি নিজেই জানেন কি কত কমিটি আর টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান?“

জেলা পুলিশ ও প্রশাসন, মৎস্য, বন, সুন্দরবন উন্নয়নের মতো সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ফাঁক গলে চলছে সুন্দরবনের ধ্বংশলীলা। ম্যানগ্রোভ গাছ নয়। গাছের একটি প্রজাতি। এরা লবণাম্বু উদ্ভিদ। অর্থাৎ, যে জমিতে নুনের ভাগ বেশি, এরা সেখানে জীবনধারণ করতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য এই জাতীয় গাছের প্রজাতির বেশ কিছু অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য আছে। সমুদ্রের তীরবর্তী যে সব জমি দিনের অর্ধেক সময় জোয়ারের জলে ডুবে থাকে এবং বাকি সময়ে জল নেমে যায়, সেখানেই জন্মায় ম্যানগ্রোভ। সুন্দরবনেও তেমনই হয়। কথিত যে, সুন্দরবনের নাম একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ থেকে এসেছে। সুন্দরী ছাড়াও গর্জন, গেঁওয়া, বাইনের মতো লবণাম্বু উদ্ভিদ নিয়েই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই প্রজাতি মাটি থেকে অতিরিক্ত নুন শোষণ করে তা পাতায় সঞ্চয় করে রাখে। নুনের পরিমাণ সম্পৃক্ত হয়ে গেলে সেই পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে। এই ভাবে ম্যানগ্রোভ মাটিতে নুনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল যত ঘন থাকবে, তার প্রচণ্ড বেগের ঝড় বা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বাড়বে।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছড়িয়েছে অসুখ। একটি অসুখ পুরোপুরি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের তৈরি। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে উঁচু হচ্ছে ঢেউ। জলোচ্ছাসে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই ঢেউ এসে পড়েছে সুন্দরবনেও। গত ১০-১৫ বছরে ঘোড়ামাড়া দ্বীপ পুরোপুরি চলে গিয়েছে সমুদ্রবক্ষে। জম্বুদ্বীপের বড় এলাকা বিলীন। ওই দুই দ্বীপের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল পুরোপুরি বিনষ্ট। তাই ওই এলাকা দিয়ে জোরালো বাতাস চলে আসছে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার লোকালয় ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে।

 সব জানা সত্ত্বেও ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কেটে লোকালয় তৈরির কাজ চলছে নদী সংলগ্ন কিছু অংশে। সুন্দরবনের গভীরতম এলাকার সুন্দরীর গাছের আকৃতি দেখলেই পরিষ্কার যে, গাছের ঘনত্ব কী বিপজ্জনক ভাবে কমছে। উপগ্রহে চিত্রে সুন্দরবনের মাঝখানটা দেখলে মনে হবে টাক পড়ে গিয়েছে। আসলে মাটিতে অত্যাধিক নুনের উপস্থিতি সুন্দরী গাছের অভিযোজনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। গাছগুলি বেঁটে হয়ে গিয়েছে। ঝাঁকড়া হচ্ছে না। ঠেসমূলের বুনোটও জমাট হচ্ছে না। ঝড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

ম্যানগ্রোভের এই অভিযোজন এবং ব্যাপক হারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হওয়ায় সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র বদলে যেতে বসেছে। খাদ্য-খাদক সকলেরই বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সঙ্কটে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসে শুধুমাত্র যে উপকূল এলাকারই ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, বিপন্ন হচ্ছে পারশে, তোপসে, গুর্জালি, ট্যাংরা, খোলসে, ফলুইয়ের মতো বহু প্রজাতির দেশিয় মাছ৷ ওই এলাকায় মীন ধরতে গিয়ে শুধুমাত্র যে বাগদার মীনই ধরা হচ্ছে তাই নয়, নির্বিচারে ধরা পড়ছে দেশিয় ওই প্রজাতিগুলির মাছের চারাও৷ মানুষের এই কাজ-কারবারে ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা দেশিয় এই মাছগুলি৷ 

সুন্দরবন সামুদ্রিক মৎস্যজীবী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সতীনাথ পাত্র জানান, গোসাবা , কুলতলি, ঝড়খালি, রায়দিঘি, পাথরপ্রতিমা, দুর্বাচটির মতো এলাকাগুলিতে ডিঙি নৌকা ব্যবহার করে মাছ এবং মীন ধরার ওপর নির্ভরশীল প্রায় এক লক্ষ প্রান্তিক মানুষ৷ তিনি জানান, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে সেই প্রবণতা অনেকটাই কমবে বলে মনে করেন তিনি৷ একই সঙ্গে বড় ট্রলারদের উপরও কিছু বিধিনিষেধ জারি এবং মৎস্যজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি৷

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, প্রায় ১৭৫ বছর আগে ইংরেজরা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ইজারা দেয়, আর মেদিনীপুর ও অধুনা বাংলাদেশের যশোর, খুলনা থেকে শয়ে শয়ে ভূমিহীন মানুষ সুন্দরবনে বসত গড়ে তোলেন। প্রথমেই তাঁরা যেটা করেন সেটা হল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সাফ করে, যাবতীয় বন্য প্রাণীদের বিতারণ করা আর তারপর ভরা জোয়ার আর কোটালের জল যাতে দ্বীপে দিনে দু’বার ঢুকে পড়ে চাষবাস আর বসবাসের জমি ভাসিয়ে না দেয় তাই নদীর তীর বরাবর বাঁধ তৈরি করা হয়। এটার কারণ যেখানে তাঁরা বসত গড়েছিলেন সেই জায়গাগুলো কোনোদিনই মাটি ফেলে এত উঁচু করা হয়নি বা যায়নি যাতে জোয়ারের জল ঢোকা আটকানো যায়, আর নদীর নোনা জল ঢুকলে তো চাষাবাদ কিছু করা যাবে না, খাওয়ার জল পাওয়া, জীবন কাটানোই মুশকিল হবে। তাই যত দ্বীপে মানুষ বসবাস করতে শুরু করল, ১০২টা  দ্বীপের মধ্যে ৫৪ খানা দ্বীপে এরকমই মাটির দেওয়াল বা বাঁধ দেওয়া হল। আর সেটা করতে গিয়ে আর মানুষের বসতি ও জীবনধারণের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে প্রায় পুরোটাই সরিয়ে দেওয়া হল ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। 

ফল হয়েছে এই স্বাভাবিক জোয়ার ভাটায় পলি আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল এলাকার তুলনায় এই মানুষের বসবাসকারী দ্বীপগুলো হয়ে গেল আরও নিচু, আর স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার বাধা পাওয়ায় নদীখাতেও নানান বদল দেখা দেয়, কোথাও তা পাশের দিকে চওড়া হয়, কোথাও হয় সরু। কিন্তু বছরে ২০ মিলিয়ন টন পলি বহন করে নিয়ে আসছে যে গঙ্গা নদী সেটা এই হুগলি মাতলা মোহনা অঞ্চলে এই ভাবে বাধা প্রাপ্ত হয়ে আঁকাবাকা পথে নদীখাতের নানান অংশে জমতে থাকে, আর তার উল্টোদিকেই জলের তোড়ে বাঁধের মাটি তলা থেকে সরে গিয়ে ভাঙ্গতে থাকে পাড়। এমন করেই গড়ে উঠেছে ৩৫০০ কিমি ব্যাপী এক নদী বাঁধ যা সুন্দরবনের মানুষের জীবন, জীবিকা, রাজনীতি আর অর্থনীতির এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।“

প্রতিদিন যে হারে গাছ কাটা হয়, তার ফলে ঝড়ের আঘাত এবার সরাসরি জনবসতিতে পড়তে শুরু করেছে ৷ ফলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করেন উপকূলের বাসিন্দারা। এর মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে সুন্দরবনের বাঁধজনিত জটিলতা। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দরবনে গিয়ে বলেন, “দরিদ্ররা যেন ঠিকমতো ত্রাণ পায়, দেখতে হবে। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়।’’ কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারাই যে প্রতিদিন একটু একটু করে সুন্দরবনকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছেন, এই রূঢ় বাস্তবটা আমরা দেখিনা। বা দেখলেও না বোঝার ভান করি। যেহেতু ওরা ভোটদাতা। বছরভর গাছ কেটে সাফ করে দিক ক্ষতি নেই, ভোটব্যাঙ্ক যেন অটুট থাকে। 

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কংক্রিটের বাঁধ তৈরিতে প্রচুর খরচ। এর পরেও যে সব কংক্রিটের বাঁধ সুন্দরবনে তৈরি হচ্ছে, নির্মাণকাজে থাকছে গাফিলতি। ফলে কমে যাচ্ছে স্থায়ীত্ব। কাঁচা মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করলে তা ভেঙে যাচ্ছে, টাকাও জলে চলে যাচ্ছে। ঘাসের মতো শক্ত কিছু দিয়ে বাঁধ করলে তা শক্ত হবে। সেটা করা যায় কি না, দেখুন।“ সাগরে মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রশাসনিক বৈঠকে ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা। তাঁর সামনেই তিনি জেলা আধিকারিকদের বাঁধ নিয়ে তাঁর ক্ষোভের কথা জানান ও বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে বলেন।

বাঁধ-বিশেষজ্ঞ অনীশ ঘোষ ৩৪ বছর কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে। এর মধ্যে প্রায় দু‘দশক ছিলেন সুন্দরবনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর মতে, “সুন্দরবনে স্থায়ী বাঁধ তৈরির অন্যতম বড় বাধা রাজ্যের জমি সমস্যা।“ একই মন্তব্য কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের, যিনি সুন্দরবনকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মত। তাঁর মতে, “জমি নীতিটাই ঠিক নয়।“

কিন্তু রাজ্যের জমি-সমস্যা কীভাবে বাধা তৈরি করছে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের? অনীশবাবুর কথায়, সুন্দরবনের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার উপকূল এলাকায় বাঁধ এখনও মূলত মাটির। দিনে দু’বার জোয়ার ভাঁটা খেলে। পূর্ণিমা-অমাবস্যার কটালে জলস্তর বেড়ে যায়। সমুদ্রের এই লোনা জল ঠেকাতে বাঁধ দিতে হয়। কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করতে গেলে বর্তমান বাঁধের একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে করতে হবে। বড় নদি বা সমুদ্রের ধারে এই বাঁধের উচ্চতা এবং ভিত্তি (বেস) হয় যথাক্রমে প্রায় ২৫ ফুট ও ১৫০ ফুট। ছোট নদীর ধারে এই ভিত্তি হয়ত দাঁড়ায় ১০০ ফুটে। এর জন্য সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যায় না। ফলে, অনেকটা জোর করে বাঁধ তৈরি করতে হয়। যতটা পোক্ত হওয়ার কথা ততটা পোক্ত হয়না।“ এই সঙ্গে নির্মানকাজে দুর্নীতির প্রশ্নটা কমবেশি সব সময়ই থাকে বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে। 

কেন জমি পাওয়া যায় না? অনীশবাবুর কথায়, “আগে বাম আমলে কিছুটা জোর করেই উন্নয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হত। আমরা বিশদ হিসেব পাঠিয়ে দিতাম ভূমি সংস্কার দফতরে। এতে কিছু ক্ষেত্রে মামলা মোকদ্দমা হত। তৃণমূল আমলে ভূমিহারাদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। এতে আর্থিক বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবারের একজনকে চাকরির কথা বলা হয়েছে। এটা পূরণ করা খুব জটিল।“

কান্তিবাবুর মতে, “এই জনমোহিনী নীতির জন্য জমি নিতে সমস্যা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে সমস্যাগুলো সেভাবে কেউ বোঝাতে পারছেন না।“ যদিও রাজ্যের জমিনীতির জন্য বাঁধ তৈরির কাজ মার খাচ্ছে, এটা সত্যি বলে মানতে রাজি নন আজন্ম সুন্দরবনে বড় হওয়া, পাঁচ দশকের ওপর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পাথরপ্রতিমার সমীর কুমার জানা। তিনবারের তৃণমূল বিধায়ক সমীরবাবু গত মেয়াদে ছিলেন বিধানসভার সেচ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর মতে, “সদিচ্ছাটাই আসল। গত কয়েক বছরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন অংশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে কংক্রিটের বাঁধ সয়েছে। উন্নয়নের জন্য জমি নিতে গেলে জমিদাতা পরিবার-সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে। আমরা সেটাই করি।“

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, এটা আপাতত ভালোরকম ভাবেই জানা হয়ে গেছে উত্তর বঙ্গোপসাগর, যা ট্রপিকাল সাইক্লোনের একেবারের ‘টেক্সট বুক’ অঞ্চল বলে বিবেচিত হয়, তার উষ্ণতা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে এমন ঘূর্ণিঝড় দুর্লভ তো নই-ই, বরং বছরে দুটো করে হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার অর্থ হল, এই ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে না-সামলাতেই আরেকটা প্রবল ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ফের সুন্দরবনের মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, এমনকি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে যাবতীয় কর্মকাণ্ড। না এসব কর্তারা, সাধারণ মানুষ কেউ জানেন না এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এই মাটির বাঁধের নির্মাণ, তার নিয়মিত ভাঙন, ত্রাণ এসবই হল গত পঞ্চাশ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের এক আশ্চর্য সমান্তরাল অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার একটা সুযোগ মাত্র, আর একথা সব সুন্দরবন বিশেষজ্ঞই মনে করেন।

সমাধানের পথটা তাহলে কী? অনীশ ঘোষের মতে, “সুন্দরবনের ভৌগলিক বৈচিত্র্য অনন্য। তাই দেশের  অন্য অঞ্চলের সঙ্গে নয়, তুলনা করতে হয় বাংলাদেশের বাঁধের সঙ্গে। ওরা পুরো বাঁধটা যেভাবে কংক্রিটে বাঁধায়, সেটা অনেক বেশি স্থায়ী হয়। এখানে সেটা হয় না। কারণ, এখানে ওই বাঁধকে ঢাল করে চলছে হাজার হাজার বেআইনি ফিশারিজ। সমুদ্রের লোনা জলে ভাল মাছ চাষ হয়। সর্বক্ষণ বাঁধের ভিতে ক্রমাগত জলের স্পর্শে বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে।“ 

সুন্দরবনের অনিশ্চয়তা মানে কলকাতার অনিশ্চয়তা। এখনও সতর্ক না হলে, সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে না পারলে, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস আটকাতে না পারলে একদিন আমপানের থেকেও শক্তিশালী কোনও ঝড় ধ্বংস করে দিতে পারে সাধের কলকাতাকে। ধ্বংস হওয়া ইউরোপীয় শহর পম্পেইয়ের পাশে লেখা হতে পারে কলকাতার নাম। অধ্যাপক-বিজ্ঞানী শুভশ্রী ঠাকুরের সতর্কতা— এ সবের জন্য আমরা সবাই দায়ী। প্রকৃতির রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের ফল তো পেতেই হবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.