“কাঁচা মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করলে তা ভেঙে যাচ্ছে, টাকাও জলে চলে যাচ্ছে। ঘাসের মতো শক্ত কিছু দিয়ে বাঁধ করলে তা শক্ত হবে। সেটা করা যায় কি না, দেখুন।“ শুক্রবার বন্যা-পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের পরামর্শ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সমস্যাটা কোথায়? কংক্রিটের বাঁধ তৈরিতে প্রচুর খরচ। এর পরেও যে সব কংক্রিটের বাঁধ সুন্দরবনে তৈরি হচ্ছে, নির্মাণকাজে থাকছে গাফিলতি। ফলে কমে যাচ্ছে স্থায়ীত্ব।
বাঁধ-বিশেষজ্ঞ অনীশ ঘোষ ৩৪ বছর কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে। এর মধ্যে প্রায় দু‘দশক ছিলেন সুন্দরবনের সঙ্গে যুক্ত। অবসরের পর এখন একটি নামী টেলিযোগাযোগ সংস্থার প্রযুক্তি পরামর্শদাতা। তাঁর মতে, “সুন্দরবনে স্থায়ী বাঁধ তৈরির অন্যতম বড় বাধা রাজ্যের জমি সমস্যা।“ একই মন্তব্য কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের, যিনি সুন্দরবনকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মত। তাঁর মতে, “জমি নীতিটাই ঠিক নয়।“
কিন্তু রাজ্যের জমি-সমস্যা কীভাবে বাধা তৈরি করছে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের? অনীশবাবুর কথায়, সুন্দরবনের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার উপকূল এলাকায় বাঁধ এখনও মূলত মাটির। দিনে দু’বার জোয়ার ভাঁটা খেলে। পূর্ণিমা-অমাবস্যার কটালে জলস্তর বেড়ে যায়। সমুদ্রের এই লোনা জল ঠেকাতে বাঁধ দিতে হয়। কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করতে গেলে বর্তমান বাঁধের একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে করতে হবে। বড় নদি বা সমুদ্রের ধারে এই বাঁধের উচ্চতা এবং ভিত্তি (বেস) হয় যথাক্রমে প্রায় ২৫ ফুট ও ১৫০ ফুট। ছোট নদীর ধারে এই ভিত্তি হয়ত দাঁড়ায় ১০০ ফুটে। এর জন্য সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যায় না। ফলে, অনেকটা জোর করে বাঁধ তৈরি করতে হয়। যতটা পোক্ত হওয়ার কথা ততটা পোক্ত হয়না।“ এই সঙ্গে নির্মানকাজে দুর্নীতির প্রশ্নটা কমবেশি সব সময়ই থাকে বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে।
কেন জমি পাওয়া যায় না? অনীশবাবুর কথায়, “আগে বাম আমলে কিছুটা জোর করেই উন্নয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হত। আমরা বিশদ হিসেব পাঠিয়ে দিতাম ভূমি সংস্কার দফতরে। এতে কিছু ক্ষেত্রে মামলা মোকদ্দমা হত। তৃণমূল আমলে ভূমিহারাদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। এতে আর্থিক বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবারের একজনকে চাকরির কথা বলা হয়েছে। এটা পূরণ করা খুব জটিল।“
কান্তিবাবুর মতে, “এই জনমোহিনী নীতির জন্য জমি নিতে সমস্যা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে সমস্যাগুলো সেভাবে কেউ বোঝাতে পারছেন না।“ যদিও রাজ্যের জমি নীতির জন্য বাঁধ তৈরির কাজ মার খাচ্ছে, এটা সত্যি বলে মানতে রাজি নন আজন্ম সুন্দরবনে বড় হওয়া, পাঁচ দশকের ওপর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পাথরপ্রতিমার সমীর কুমার জানা। তিনবারের তৃণমূল বিধায়ক সমীরবাবু গত মেয়াদে ছিলেন বিধানসভার সেচ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর মতে, “সদিচ্ছাটাই আসল। গত কয়েক বছরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন অংশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে কংক্রিটের বাঁধ সয়েছে। উন্নয়নের জন্য জমি নিতে গেলে জমিদাতা পরিবার-সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে। আমরা সেটাই করি।“
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, এটা আপাতত ভালোরকম ভাবেই জানা হয়ে গেছে উত্তর বঙ্গোপসাগর, যা ট্রপিকাল সাইক্লোনের একেবারের ‘টেক্সট বুক’ অঞ্চল বলে বিবেচিত হয়, তার উষ্ণতা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে এমন ঘূর্ণিঝড় দুর্লভ তো নই-ই, বরং বছরে দুটো করে হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার অর্থ হল, এই ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে না-সামলাতেই আরেকটা প্রবল ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ফের সুন্দরবনের মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, এমনকি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে যাবতীয় কর্মকাণ্ড। না এসব কর্তারা, সাধারণ মানুষ কেউ জানেন না এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এই মাটির বাঁধের নির্মাণ, তার নিয়মিত ভাঙন, ত্রাণ এসবই হল গত পঞ্চাশ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের এক আশ্চর্য সমান্তরাল অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার একটা সুযোগ মাত্র, আর একথা সব সুন্দরবন বিশেষজ্ঞই মনে করেন।
সমাধানের পথটা তাহলে কী? অনীশ ঘোষের মতে, “সুন্দরবনের ভৌগলিক বৈচিত্র্য অনন্য। তাই দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে নয়, তুলনা করতে হয় বাংলাদেশের বাঁধের সঙ্গে। ওরা পুরো বাঁধটা যেভাবে কংক্রিটে বাঁধায়, সেটা অনেক বেশি স্থায়ী হয়। এখানে সেটা হয় না। কারণ, এখানে ওই বাঁধকে ঢাল করে চলছে হাজার হাজার বেআইনি ফিশারিজ। সমুদ্রের লোনা জলে ভাল মাছ চাষ হয়। সর্বক্ষণ বাঁধের ভিতে ক্রমাগত জলের স্পর্শে বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে।“ অনীশবাবুর মতে, “এক কিলোমিটার কংক্রিটের বাঁধ দিতে খরচ হবে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। আজকাল বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এর প্রায় ১০০ গুন কম খরচে ভাল মানের মাটির বাঁধ করা যায়। সুন্দরবনের মাটির চরিত্র ভাল। সুন্দরবনকে বাঁচাতে পারত নির্বিচারে ফিশারিজের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ আর ম্যানগ্রোভ। এই দুটো পথই প্রায় বন্ধ।“ কেন এই হাল, আগামীতে তার বিস্তারিত আলোচনা।
2021-05-30