জল কবে নামবে, এই চিন্তার চেয়েও জলমগ্ন সুন্দরবনের মানুষের কাছে বড় হয়ে উঠেছে আগামী কটালে ফের সমুদ্রের জল ঢোকা নিয়ে। দুর্যোগে এই দুশ্চিন্তায় প্রায় নিদ্রাহীন সুন্দরবনের ৪৬ লক্ষ মানুষের সিংহভাগ।
এবারের ঝড়ে প্রাণহানি না ঘটলেও উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে, বিশেষ করে সুন্দরবনে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে অসংখ্য স্থানে নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতির সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া অনেককে উদ্বেগে রেখেছে। প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামে বহু ঘরবাড়ি, আসবাবপত্রের ক্ষতির পাশাপাশি হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল, পুকুর এবং মৎস্যচাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সুসংহত পরিকল্পনায় শুখা মরসুমে উঁচু, শক্ত ও স্থায়ী নদীবাঁধ নির্মাণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি আজও উপেক্ষিত।
ইয়াসের দুর্যোগের মাঝেই পূর্ণিমার কটালে জলমগ্ন হয়েছে সুন্দরবনের বেশ কয়েক লক্ষ একর জমি। লোনা জল ঢুকে অজস্র জলাশয়ে মাছ মারা গিয়েছে। ঘরছাড়া গ্রামবাসীরা প্রায় সকলেই আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি নানা আশ্রয়কেন্দ্রে। ঢুকে যাওয়া লোনা জল বার করে ভেঙে যাওয়া অস্থায়ী বাঁধগুলো অবিলম্বে সারাইয়ের কাজ না করলে মুস্কিল। কারণ, আগামী ১০ জুন অমাবস্যার কটাল। তার আগে বাঁধগুলো সারাই না হলে সেদিনও সাগরের জল ফুলে উঠে ডুবিয়ে দেবে বিস্তীর্ণ এলাকা।
এই অবস্থায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা কতটা সক্রিয়? রাজ্যের সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলি ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে বলেন, “স্থানীয় গ্রামবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছি। বৃষ্টির জন্য এখনই এই বাঁধ মেরামতির কাজে ভালভাবে হাত দেওয়া যাবে না। সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগকে এখনই তৎপর হতে হবে। অন্যথায় গ্রামবাসীদের সমূহ সঙ্কটে পড়তে হবে।“
সুন্দরবন অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা পাথরপ্রতিমায় উপর্যুপরি তৃতীয়বার নির্বাচনে হারার পর উপর্যুপরি তৃতীয়বার নির্বাচনে জিতেছেন সমীর কুমার জানা। পরাজয়ের সময়েও তিনি পঞ্চায়েতের পদাধিকারী ছিলেন। গত পাঁচ বছর রাজ্যের সেচ বিভাগের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তৃণমূলের এই নেতা। আগামী কটালে সুন্দরবনের সম্ভাব্য সঙ্কটের কথা তিনিও স্বীকার করেছেন।
এই অবস্থায় প্রশাসনিক কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? উত্তরে সমীরবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “ইয়াসে কেবল পাথরপ্রতিমাতেই শতাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। জলমগ্ন হয়ে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বৃষ্টি থামলেই আমরা গ্রামবাসীদের নিয়ে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে আমরা জমা লোনা জল সরিয়ে বাঁধ সারাইয়ের কাজ শুরু করে দেব। আর যেগুলোর একটু বড় সংস্কার দরকার, সেচ ইঞ্জিনিয়ারেরা যাতে দ্রুততার সঙ্গে করতে পারেন, সেদিকে নজর দেওয়া হবে। আমপানেও ঠিক এরকম অবস্থা হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন বাঁধের ভাঙা অংশ আট দিনের মধ্যে মেরামত করে ফেলতে পেরেছিলাম। প্রকৃতি বিরূপ না হলে এবারেও আমরা এই বাঁধ সংস্কারে অল্প সময়ের মধ্যে সফল হব।
সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে এসইউসিআই (সি)-র প্রভাব আছে। এই অবস্থায় এসইউসিআই (সি)-র প্রাক্তন সাংসদ তরুণ নস্কর এই প্রতিবেদককে শুক্রবার বলেন, দলের রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এদিন একটি চিঠি দিয়েছেন। তাতে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও নদী বাঁধের স্থায়ী মেরামত সম্পর্কিত বিষয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ করেছেন, ইয়াস ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে বিপদগ্রস্ত এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ব্যাপক প্রাণহানি আটকানো সম্ভব হলেও ফ্লাড সেন্টার এবং ত্রাণ কেন্দ্রগুলিতে থাকা সাধারণ মানুষের খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। চিঠিতে চন্ডীদাসবাবু লিখেছেন, “পরিশেষে বর্তমান ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত জনসাধারণের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ক্ষতিপূরণে সমস্ত রকম দুর্নীতি রোধ করতে সরকারি প্রশাসনের সাথে প্রতিটি অঞ্চলে ও ব্লকে সর্বদলীয় প্রতিনিধি, স্থানীয় ক্লাব ও বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থার প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে ‘কমিটি’ গঠন করে সেই কমিটির তত্ত্বাবধানে ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ বন্টনের দাবি জানাচ্ছি।“
2021-05-30