জলের ধাক্কায় প্রায়ই ভাঙে নদীবাঁধ। সামাল দিতে ভাঙা বাঁধের একটু দূর থেকে গোল করে আরও বাঁধ দেওয়া হয়। যাকে বলা হয় রিং বাঁধ। কিন্তু তাতেও ভরসা পেলেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। আয়লা, আমপানের মত সুন্দরবনও বিদ্ধস্ত। প্রায় একাই সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কুম্ভের মত সুন্দরবনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়।
আমফানে বিপর্যস্ত সুন্দরবনের বেশির ভাগ জায়গাতেই পোক্ত বাঁধ নেই। এলাকায় রয়েছে অগণিত নদী। আর তার ধারেই মানুষের বাস। ফলে নদীর জল বাড়লে চিন্তা বাড়ে বাসিন্দাদের। ইয়াসেও যা হয়েছিল। গোসাবা, কুলতলি-সহ একাধিক এলাকায় দেখা গিয়েছে সেই বাঁধ ভাঙার ছবি। জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে গোসাবা, কালিবাসপুর, রাঙাবেলিয়া, কৈখালি, হালদারভেড়ি-সহ একাধিক এলাকার বাঁধ।
চার দিন ধরে সুন্দরবনে পড়ে আছেন কান্তিবাবু। তাঁর মতে, “গত এক দশকের সরকারি অবহেলার মাসুল দিতে হচ্ছে সুন্দরবনকে। যে সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতা থাকলে সুন্দরবনকে বাঁচানো সম্ভব, তা এঁদের নেই। এর জন্য কেবল সুন্দরবনের ৪৬ লক্ষ মানুষ নয়, বিপদে পড়বে বৃহত্তর কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চল। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে আস্থা নিয়ে দায়িত্ব দিন। রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে সুন্দরবনকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করব।“
২০০১ থেকে ২০১০— টানা ১০ বছর ছিলেন কান্তিবাবু রাজ্যের সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী। বাম আমলে এমন কিছু করতে পারেননি যার মাধ্যমে সুন্দরবনকে বাঁচানো যেত? উত্তরে ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে তিনি বলেন, “১৯৭২ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় প্রথম সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করেন। বাজেট ছিল এক লক্ষ টাকা। ’৭৭-এ আমরা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পৃথক মন্ত্রকও তৈরি হয়। বাম আমলের শেষ ১০ বছরে সুন্দরবনে কী কী হয়েছে সেই ফিরিস্তি দিয়ে লাভ নেই। যেটা দুঃখের, আমরা অনেক চেষ্টা করে ৫,০৩২ কোটি টাকার বরাদ্দ কেন্দ্র কাছ থেকে আদায় করেছিলাম। ২০১০-এ তা মঞ্জুর হয়। পরিকল্পনামাফিক কাজও শুরু হয়। কিন্তু তার পরেই এসে যায় ’১১-র বিধানসভা নির্বাচন। আমরা ভোটে হেরে যাই। সেই কাজ করতে না পারায় ৪,০০০ কোটি টাকা ফেরৎ চলে যায় দিল্লিতে।“
আয়লায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবন লাগোয়া এই সব এলাকা। ভেসে গিয়েছিল প্রায় গোটা জনপদটাই। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ গণেশ জোদ্দার লিখেছেন, ”ঠিক কথা। সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গলে গাছ লাগানোর যেমন বিকল্প নেই। কংক্রিটের বাঁধ ছাড়াও তেমনি সুন্দরবনবাসীকে বাঁচানোর বিকল্প পথ নেই। প্রাকৃতিক বাঁধ গা জোয়ারি ভাবনা। অনেকে বলছেন পূনর্বাসন দরকার। তাই বলে তো আর দ্বিতীয় মরিচঝাঁপি হতে দেওয়া যায় না। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার উপায় একটা হয় কংক্রিটের বাঁধের নদীর উল্টো কোলে ব্যাপক হারে ম্যানগ্রোভ লাগানো। শুধু তাই নয় পুরাতন ভেড়ি আর প্রায় ১০০ গজ দূরত্বে তৈরি কংক্রিটের বাঁধের মাঝের এই বিস্তৃত জায়গায় গাছ লাগানো।
তাছাড়াও সরকার চাইলে নদী সংলগ্ন জমি সাধারণের থেকে বাজার মূল্যের অধিক দাম দিয়ে কিনে সেই জমিতে প্লানটেশন করতে পারেন। বাঁশের খাঁচাও যদি দু-এক জায়গায় না দিয়ে সর্বত্র বসানো হয় তাহলে তার মধ্যে ভেসে আসা ফল আটকে গিয়ে যে পলিস্তর জমবে তার উপর গাছ জন্মাবে। তখন বাঁধের ক্ষয় অনেকটা সামলানো যাবে। সবশেষে বলা দুটোই জরুরী। সুন্দরবন ও সুন্দরবনের মানুষজন। এখন যেহেতু দুটোই আবার সরকারি সম্পত্তি।
চাইলেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কিছু করতে গেলে নানান আইনি বেআইনি বাধা আসবেই। তাই সুন্দরবন বাঁচানো বলি আর নদী বাঁধ আদায় বলি, এতকাল যথন সোজা পথে হেঁটে হয়নি, তখন তো বাঁকা পথে হাটতেই হবে। তার জন্য যারা সুন্দরবনেই প্রতিদিন ১৭ ফুট জলের নীচে ঘুমায় তাদের অধিকারের বাঁধ আদায়ের গণ আন্দোলনে সামিল হওয়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই।“
কেন কেন্দ্রে ফেরৎ গিয়েছিল সুন্দরবনের টাকা? এ প্রসঙ্গে কান্তিবাবু বলেন, “আয়েলার পর যোজন কমিশনের মন্টেক সিং আহলুওয়ালিয়া নিজে এসেছিলেন। রাজ্যের প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদল সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙেছিল। ঠিক হয় এর মধ্যে সংবেদনশীল ৭৭৩ কিলোমিটারে তৈরি হবে স্থায়ী বাঁধ। কেন্দ্রের টাকায় আমরা ৭০ কিলোমিটারে কংক্রিটের তৈরি করি। যে কোনও নতুন প্রকঢ়্পে গতি আসতে একটু সময় লাগে। কয়েক বছর সময় পেলে পুরোটা হয়ে যেত। কাজে যখন গতি এল ভোট এসে গেল! তৃণমূল সরকার কাজ করতে না পারায় ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে সুন্দরবনে স্থায়ী বাঁধ তৈরির জন্য বরাদ্দ টাকা ফেরৎ চলে গেল।“
সুন্দরবনের গ্রামের মানুষগুলির মনে বাঁধের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। ভোটের আগে প্রার্থীদের কাছে সবার আবেদন ছিল, আর যাই হোক, বাঁধ যেন না ভাঙে। কিন্তু মাটির বাঁধের স্থায়িত্ব যে বেশি নয় তাও বিলক্ষণ জানেন তাঁরা। ছোট খাটো জল ঢোকার ঘটনা তো প্রায় নিত্যই ছিল। ইয়াসে গ্রামবাসীদের আশঙ্কা ফের সত্যি হল। আবার ভাসল গ্রাম।
প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছিল, নদীর ধার ধরে কংক্রিটের বাঁধ হবে। কিন্তু কবে তা জানেন না এলাকাবাসী। সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা বলেন, ‘‘আয়লার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকাকালীন সুন্দরবন এলাকায় স্থায়ী কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণের জন্য ৩০০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আসেন। তার একটা অংশ এসেছিল। তা দিয়ে প্রাথমিক কিছু কাজকর্ম হয়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। তারা ওই প্রকল্পের টাকা দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন না। সে কারণেই কাজটা থমকে আছে।’’ এবার নয়া মন্ত্রিসভায় মন্টুরামবাবুর বদলে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বঙ্কিম চন্দ্র হাজরাকে। তাঁর বক্তব্য, “আমি সবে দায়িত্ব নিয়েছি। যা যা করার সবই হবে।“
কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়