১৯১৯ সাল। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে তখন চলছে প্রতিবাদ। এমন সময়ই পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে জড়ো হয়েছিলেন বহু মানুষ। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছিল সেটা; নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হয়েছিলেন একসঙ্গে। তার ওপর দিনটি ছিল পাঞ্জাবী নববর্ষ বা বৈশাখীর। খানিক পরেই ছবিটা গেল বদলে। শান্তিপূর্ণ জালিয়ানওয়ালাবাগ বদলে গেল হাহাকার আর আর্তনাদে। চারিদিকে রক্তের গন্ধ। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ঠাণ্ডা মাথায় এক হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়।
রাতারাতি খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। এমন নৃশংসতার নমুনা ভারতবাসী খুব কম দেখেছে। ইংরেজ সরকার এবং তার পুলিশ বাহিনির এত স্পর্ধা! জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসে এমন কথাই মনে করছিলেন আরও একজন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরে ঘনঘন পায়চারি করছেন তিনি। কয়েক বছর আগেই গোটা বিশ্বের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এমনকি ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইটহুড উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগে এত তাজা রক্ত ঝরার পরও কি সেই উপাধি রাখবেন? মন দ্বিধাগ্রস্ত। কিছু বুঝতে পারছেন না। দুই বন্ধুর কাছ থেকে মতামত নিতে চাইলেন। এক বন্ধু, সিএফ অ্যান্ড্রুজের মতে নাইটহুডের মতো এত বড়ো সম্মান না ফেরানোই উচিত। কিন্তু গর্জে উঠলেন অন্যজন— রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এটা কীরকম কথা! ইংরেজরা এসে দেশের মানুষের ওপর এরকম বর্বর আক্রমণ করবে, আর আমরা তাঁদের দেওয়া উপাধি ত্যাগ করতে পারব না! খালি নিজের সম্মানের কথা ভাবব! এক মুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামানন্দ তো ঠিকই বলছেন। তখনই চিঠি লিখলেন ব্রিটিশ সরকারকে। নাইটহুড ত্যাগ করলেন তিনি…
রবীন্দ্রনাথ আর রামানন্দের বন্ধুত্বটা ছিল এমনই। বিশ্বাসের জায়গা থেকে কেউ এক চুলও সরেননি। আর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক বুদ্ধি, মেধা আর জ্ঞান নিয়ে তো কোনো সন্দেহ করা চলে না! হোক না বছর চারেকের ছোটো। আবার রামানন্দবাবুও রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার জায়গায় রাখতেন; কিন্তু কাজের জায়গায় কাউকে রেয়াত করতেন না। তাঁর একটাই কাজ, সত্যের পক্ষে চলা। অনবরত প্রশ্ন করে চলা। রবীন্দ্রনাথের অনেক অনুরোধ, উপদেশও ফিরিয়ে দিয়েছেন একবাক্যে। একবার এক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির সম্পর্কে লেখা একটা চিঠি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তিনি। রামানন্দকে বলার পর সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেন। কবিগুরুর অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন! অবশ্য রামানন্দ আমন কাজ করার পর ‘আরাম বোধ’ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। এতটাই মজবুত ছিল ভরসার জায়গাটি…
আর মজবুত না থাকার তো কোনো কারণ নেই। বাংলার সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনার ইতিহাস কি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে অস্বীকার করতে পারবে? ছোটো বয়স থেকেই তাঁর মেধা সকলের নজর কাড়ত। তার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় ছিল তাঁর নির্ভীক, দৃঢ়চেতা স্বভাব। সেই ছাত্র বয়স থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন। সিটি কলেজ থেকে ইংরেজি নিয়ে প্রথম স্থান অর্জনের পর রিপন স্কলারশিপ পেয়েছিলেন তিনি। সুযোগ এসেছিল ইংল্যান্ডে গিয়ে উচ্চশিক্ষা করার। কিন্তু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছিলেন। ইংরেজদের হয়ে কাজ করবেন তিনি? যারা আমার দেশের মানুষকে এতটা কষ্টে রেখেছে? নৈব নৈব চ…
বহু পত্রিকার সম্পাদকের গুরুদায়িত্বটি সামলেছেন তিনি। প্রথম জীবনে হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। পরে ১৮৯০ সালে ব্রাহ্ম পত্রিকা ‘ধর্মবন্ধু’র হাত ধরে সম্পাদনার জগতে আসা। একে একে ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘দাসী’— যাত্রাটি এগোতেই থাকে। কিন্তু এসব পত্রিকায় অনেককিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না তিনি। চারিদিকে যা ঘটছে; সেটা অর্থনীতি, রাজনীতি হোক বা বিনোদন – সব নিয়ে একটা এমন পত্রিকা তৈরি হোক যা বাঙালির মনন, মেধা আর বুদ্ধিকে প্রতিনিধিত্ব করে। তর্ক হোক, প্রশ্ন হোক, সেসবের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসুক সত্য। সেই ভাবনা থেকেই ১৮৯৭ সালে চালু করেন নিজের পত্রিকা ‘প্রদীপ’। বাংলা ভাষায়ও যে যথেষ্ট ভালোভাবে অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়, তা নিয়ে লেখা যায়, সেটাই প্রথম দেখালেন তিনি।
‘প্রদীপ’-এর প্রকাশের ঠিক চার বছর পর রামানন্দের জীবনে এল আরেক মোড়। তখন বাংলায় বদলের মুখ হয়ে হাজির হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকা। ছবি, অলংকরণ, সেইসঙ্গে একের পর এক সুন্দর লেখা— একটা ঝকঝকে রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল পত্রিকাটি। আর সেই পত্রিকারই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ‘প্রবাসী’র দীর্ঘ যাত্রাপথের অনেকটাই আগলে রেখেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এখানেই প্রকাশিত হয় লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ ‘হারামণি’। আর ছিল রামানন্দের সাহসিকতা। নারীদের অধিকার, নারীদের মর্যাদা নিয়ে একের পর এক লেখা লিখে গেছেন তিনি। ছিল সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোকপাত। তবে এসব করতে গিয়ে লেখকদের দিকে নজর দিতেও ভোলেননি রামানন্দ। সামান্য হলেও লেখকের সম্মানদক্ষিণা যে প্রাপ্য, সেটা তিনি দেখান এখানে। কখনও সেই কাজে ভাটা পড়েননি।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে প্রবাসী ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার স্থান ছিল। ১৯০৭ সাল। ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ‘মডার্ন রিভিউ’য়ের সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে সত্যিকে সামনে আনা, এটাই ছিল তাঁর দৃষ্টি। আর সেই সূত্রেই ভারতীয় সাংবাদিকতার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে ‘মডার্ন রিভিউ’। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তখন ভারতে যথেষ্ট পরিচিত নাম। এমন সময়ই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। এত কৃতি বাঙালি থাকতে কেন তাঁকে বাছা হল, এই প্রশ্ন তোলেন রামানন্দ। আর তার কয়েক বছর পরই রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে ছাত্রের গবেষণাপত্র ‘নকল করার’ গুরুতর অভিযোগ ওঠে। মডার্ন রিভিউয়ে একের পর এক লেখা প্রকাশ করতে থাকেন রামানন্দবাবু। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও কলম ধরতে পিছপা ছিলেন না। এমন নির্ভীক কলমকে যুগে যুগে ভয় করে এসেছে শাসক। ব্রিটিশরাও তার ব্যতিক্রম নয়। সবসময় রামানন্দ ও তাঁর পত্রিকার ওপর নজরদারি চালানো হত। অনেক সময়ই তাঁদের রোষানলে পড়তে হয়েছে; কিন্তু নিজের জায়গায় তিনি ছিলেন অটুট। তাঁকে ভাঙার সাধ্যি কারোর নেই…
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো কেমন অলীক স্বপ্ন লাগে না? ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে যখন এত নিন্দা, তখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা ইতিহাসের পাতায় ‘ব্যতিক্রম’ হয়েই থেকে যান। সাংবাদিকতা, সম্পাদনা যে ছেলেখেলা নয়; বরং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অস্ত্র, সেটাই বারবার দেখিয়েছেন তিনি। আজকের পরিস্থিতি দেখলে তিনি কী বলতেন? জানা নেই, তবে আন্দাজ করতেও বিশেষ বেগ পেতে হয় না…
তথ্যঋণ—
১) ‘রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন রামানন্দ, পরামর্শদাতাও’, সৌমেন রক্ষিত, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘সার্ধশত জন্মবর্ষে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়’, পারমিতা দাশশর্মা, অন্যপত্র
৩) ‘দাসী পত্রিকা ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়’, শম্পা ভট্টাচার্য, পরবাস
৪) www.prohor.in