কাটমানি, কালমাডি, কানিমোজি…মনমোহন সরকারের পরিণতি মনে আছে তো!

কাটমানি প্রশ্নে এখন বাংলা বাজার গরম। খুব গরম।

ভোটে বিপর্যয়ের পর কদিন আগে দলের কাউন্সিলরদের মিটিংয়ে ডেকেছিলেন দিদি। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি প্রকল্প থেকে যে কাটমানি নিয়েছেন, ফেরত দিন। কোনও কথা নয়। চোরেদের দলে রাখব না। দিদি এও বলেছেন, দলে কাটমানি নেওয়ার প্রবণতা এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, দয়া-মায়া-চক্ষুলজ্জা সব জলে দিয়েছে অনেকেই। সমব্যথী প্রকল্পে মৃত মানুষের সৎকারের জন্য গরিব পরিবারকে যে দু’হাজার টাকা দেয় সরকার, তা থেকেও দু’শ টাকা কেটে নিচ্ছে। এতটাই বেহায়া!

দিদি যে এখন খোলাখুলি এ সব কথা বলছেন, তারও রাজনীতি রয়েছে। আঠারো আনা রয়েছে। হয়তো আশঙ্কা হচ্ছে, তিল তিল করে গড়ে তোলা পার্টি কাটমানির চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে! বুঝতে পারছেন, সাধারণ মানুষ রেগে আছেন। খুব রেগে আছেন। তাই হয়তো ভাবছেন, শুদ্ধিকরণের বার্তা দেওয়া দরকার। বাংলার মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তিনিই পারেন চোরেদের শায়েস্তা করতে। তার উপর যেন ভরসা চলে না যায়। এর আগেও তা কয়েক বার করেছেন দিদি, “কখনও বলেছেন কে কী করছে দেখবেন না, ২৯৪ টা আসনে আমিই প্রার্থী”। কখনও বা বলেছেন, “চোর বদনাম দেবেন না, দরকার হলে বাড়িতে গিয়ে বাসন মেজে দেব”। মোদ্দা বক্তব্য একই ছিল এবং রয়েছে। শুধু শব্দগুলো বদলে বদলে গেছে।

আর এ সব যখন হচ্ছে, তখন চোখে ভেসে উঠছে আট-ন’বছর আগে দিল্লির রাজনীতির কথা। কমনওয়েলথ, টুজি বিতর্ক, আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি, কয়লা খনি কেলেঙ্কারির মতো একটার পর একটা দুর্নীতি ফাঁস হচ্ছে। সুরেশ কালমাডি, কানিমোজি, এ রাজার নাম সামনে আসছে। আর মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলছেন, ওঁদের তাড়াতেই হবে। যে যাই বলুন, মন্ত্রিসভা ছাড়তে হবে এ রাজা-কে। কালমাডিকে জেলে ঢোকাতে হবে, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অশোক চহ্বাণকে সরাতে হবে। করুণানিধি সমর্থন তুলে নিলেও আপত্তি নেই, তাঁর মেয়ে কানিমোজিকে আড়াল করতে পারব না ইত্যাদি।

মনমোহনের সততা ও নিষ্ঠা সে দিনও প্রশ্নাতীত ছিল, আজও তাই। তাঁর উপদেষ্টারা তখন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ডেকে সাংবাদিকদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন, উনি দুর্নীতি বরদাস্ত করবেন না। কাম হোয়াট মে। নিজের ও সরকারের ভাবমূর্তি সম্পর্কে উনি এতটাই সচেতন।

কিন্তু তাতে কী হল? সরকার বাঁচল, না মনমোহন নিজের গদি বাঁচাতে পারলেন! এমন নয় যে, শাসক শিবিরের এক শ্রেণীর নেতা দুর্নীতি করছেন তিনি আগে জানতেন না। কারা করছেন, কী ভাবে করছেন, তাতে সরকারের শীর্ষ সারির কোন মন্ত্রী বা আমলা জড়িত সবই হয়তো মনমোহনের নখদর্পণে ছিল। কিন্ত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্যই হোক বা দশ নম্বর জনপথের নির্দেশে, চুপ ছিলেন মনমোহন। শেষমেশ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন তাঁর গায়ে আঁচ লাগার যখন উপক্রম হল, একমাত্র তখনই নড়ে বসেছিলেন মনমোহন। সরকার ও দলের নেতাদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছিলেন, এবং তার মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অথচ তার ফল হয়েছিল উল্টো। লোকে ততদিনে বলতে শুরু করে দিয়েছিল, চোরেদের সরকার। দুর্নীতিবাজদের সরকার। মনমোহন তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও নিষ্ঠা দিয়েও সেই প্রচার ঠেকাতে পারেননি। বরং পাল্টা প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন, এতদিন সব জেনেবুঝেও অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো কেন ছিলেন তিনি? অনেকে বলেছিল, দায় তো আপনারও রয়েছে।

বাংলার রাজনীতিতে গোড়া থেকেই তাঁর সততা ও নিষ্ঠাকে রাজনৈতিক পুঁজি করতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যক্তিগত জীবনশৈলীতে সংযত থাকার মধ্যে দিয়ে মা-মাটি ও মানুষের মধ্যে মিশে থাকতে চেয়েছেন। কখনওই বাহুল্য করেননি। কিন্তু কাটমানি প্রশ্নে সরব হওয়া সত্ত্বেও সেই দিদিকেই এখন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। মানুষের সন্দেহ হচ্ছে, এ সব কথা কতটা আসল, কতটা নকল!

সাধারণ মানুষকে এ জন্য দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, এমন নয় যে এই প্রথমবার এ সব কথা বলছেন দিদি। আগেও বলেছেন। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশে বিপর্যয়ের পরেও সে কথা বলেছিলেন তিনি। খোলাখুলি তিনি একাধিক বার বলেছেন, “কে কে টাকা তুলছেন আমি জানি। বেঁচে থাকার জন্য কি হীরে চিবিয়ে খেতে হবে নাকি! ইত্যাদি।

প্রশ্ন হল, (১) সরকারি প্রকল্পের টাকা থেকে তৃণমূলের কেউ যদি কাটমানি খেয়ে থাকেন, এবং তা সরকার তথা শাসক দল যদি জেনে থাকে, তা হলে তছরূপের অভিযোগে থানায় এফআইআর দায়ের করা প্রয়োজন। তা কি এখনও কারও বিরুদ্ধে হয়েছে?

(২) তোলাবাজি, ভয় দেখিয়ে বা জুলুম করে কোনও মানুষের থেকে টাকা আদায় করা,- ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধ। সরকার কি শাসক দলের কোনও ছোট নেতার বিরুদ্ধেও সেই ব্যবস্থা নিয়েছে? কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার কি কোনও তালিকা প্রকাশ হয়েছে?

(৩) মুখ্যমন্ত্রী তো সরকারের পুলিশ মন্ত্রী। তিনি বলছেন, ‘কারা চুরি করছেন আমি জানি, চোরেদের দলে রাখব না!’- এ কথা না বলে তিনি কি পুলিশ দিয়ে চোরদের ধরার ব্যবস্থা করেছেন?

(৪) কাটমানি ফেরত দিন বলে হুলিয়া জারি করে দেওয়ার পর জেলায় জেলায় যে সব ঘটনা শুরু হয়েছে, তা মাৎস্যন্যায় তৈরি করবে না তো!

মনমোহন সিং তবু কালমাডি-কানিমোজিকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাংলায় সরকার ও তার নেতা যা বলছেন, মানুষ বিশ্বাস করবে কেন? কী গ্যারান্টি রয়েছে যে শাসক দলের একাংশ ফের টাকা তুলবেন না?

আরও একটা ব্যাপার রয়েছে। অতীতে বামেরা যে সুবিধা পেয়ে এসেছে তা তৃণমূলের এখন পাওয়ার সুযোগ নেই। আগে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায়, মিটিংয়ে, মিছিলে কোনও কথা বললে কদিনের মধ্যে তা হারিয়ে যেত। এ সব ব্যাপারে সব মানুষের স্মৃতিও প্রখর নয়। কিন্তু এখন কোনও কথাই হারায় না। মোবাইলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে ফিরে আসে। কাটমানি নিয়ে যখন এক দিকে দিদি সরব হচ্ছেন, শুদ্ধিকরণের বার্তা দিচ্ছেন, তখন টুকরো ভিডিও মোবাইলে মোবাইলে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের কয়েক জন শীর্ষ নেতাই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, সব একা খাবে নাকি। ভাগাভাগি করে খাও। একশ টাকা তুললে ২৫ পার্সেন্ট নিজে রাখো দলকে ৭৫ পার্সেন্ট দাও। এ সব পুরনো ছবি-ভিডিও হয়তো গোটা চেষ্টাতেই জল ঢেলে দিচ্ছে।

আর তাই কাটমানি বন্ধ করতে দিদি যখন উদ্যোগের কথা বলছেন, প্রত্যয় দেখাচ্ছেন… হয়তো বহু মানুষের কাছে তা ২৫ পার্সেন্টও বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না!

শঙ্খদীপ দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.