বিপ্লবী রাসবিহারী বসু

জাপানে প্রতিদিন শোবার জন্য দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে ঘুমোতে দেখে এক বন্ধু বলে যে,বেহারী (এই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন) তুমি দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে ঘুমাও –সেটা ঠিক নয়। ভারাক্রান্ত স্বরে সেই ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘তুমি রুষ্ট হয়ো না। আমি সারা দিনের শেষে ঐদিকে ভারত মায়ের কোলে মাথা রেখে নিজেকে প্রাণবন্ত করি।
এই দেশপ্রেমিক ছিলেন রাসবিহারী বসু। তিনি বলতেন,” বিপ্লবীদের মন এতটাই নিয়ন্ত্রিত হবে যে ডান হাত কি করছে বাঁহাত জানবে না। “
রাসবিহারী বসু ছিলেন বিনোদ বিহারী বসু ও ভুবনেশ্বরী দেবীর সন্তান।পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেন। সাথে সাথে চলে লাঠিখেলা শিক্ষাও। শিক্ষকদের কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প ছিল তার পরবর্তী কালের বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। স্কুলের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বদলে দেশপ্রেমের কথা বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের কথা আছে এমন সব বই পড়ার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ”, নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” তাঁর মনকে নাড়া দিত। স্বামী বিবেকানন্দ ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেশাত্মবোধক লেখাগুলিও তাকে উদ্বুদ্ধ করে। রাসবিহারী বসু সহ চন্দননগরের বহু তরুণ বিপ্লবীরা নিরালম্ব স্বামীর দ্বারা প্রচারিত সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠে। নিরালম্ব স্বামী (যার সংসার জীবনের নাম ছিল যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), শ্রী অরবিন্দ ঘোষের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ওই একই সময়ে রাসবিহারী চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজ এর অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে আসেন। অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায় চন্দননগরের বিপ্লবী চিন্তাধারার পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি তাঁর বাসভবনে ‘সুহৃদ সম্মিলনী’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। লাঠি খেলা,ছোরা খেলা, শারীরিক ব্যায়াম চর্চা, ইতিহাস ও বিপ্লব মূলক বই পত্র পাঠ, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি ছাত্র ও যুব দের দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করতেন। তার সাক্ষাৎ শিষ্য ছিল কানাইলাল দত্ত উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায়, শ্রীশ চন্দ্র ঘোষের মতো বিপ্লবীরা। অধ্যাপক রায়ের বাড়িতে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ,সখারাম দেউস্কর প্রমুখ বিপ্লবীদের যাতায়াত ছিল। রাসবিহারী বসু ‘সুহৃদ সম্মেলনী’তে যোগ দিয়ে জীবনের এক নতুন দিশা পায়।
কলেজ স্তরের পড়াশোনার নিয়মমাফিক সমাপ্তি ঘটার আগেই রাসবিহারী বসুর জীবনধারা অন্যদিকে বাঁক নেয়। কলেজে পড়াশোনার বদলে অন্য দিকে মনোযোগ, তার অস্থিরচিত্ততা লক্ষ্য করে চন্দননগরের তার বাবার এক আত্মীয় ফোর্ট উইলিয়ামে তাকে কেরানি হিসেবে ঢুকিয়ে দেন। এরপর রাসবিহারীর বাবার অনুরোধে তাকে সিমলার সরকারি ছাপাখানায় তাকে বদলি করা হয়। পরবর্তীকালে বিখ্যাত দেরাদুন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে তিনি যোগ দেন।
দেরাদুনে থাকাকালীন তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁরই হাত ধরে বাঘা যতীনের নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজকর্মের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন। যোগাযোগ হল আর্য সমাজের বিপ্লবী সদস্যদের সঙ্গে, যাদের কাজের জায়গা ছিল উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব। কাজেই কর্মসূত্রে দেরাদুনে থাকলেও বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জাল তিনি বাংলা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশে বিস্তার করেছিলেন। রাসায়নিক ব্যবহার ও তার প্রয়োগ এর প্রতি তার এত আগ্রহ ছিল যে তিনি ‘ক্রুড ‘বোমা তৈরি শিখেছিলেন।
১৯২৩সালে ২৩শে ডিসেম্বর ভারতবর্ষের রাজধানী স্থানান্তরিত হচ্ছে কলকাতা থেকে দিল্লিতে। ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ কে স্বাগত জানাতে দিল্লি তৈরি। রাসবিহারী বোস এর পরিকল্পনা ও নির্দেশে চাঁদনী চকের এক বাড়িতে রোগা চেহারার মহিলার ছদ্মবেশে 16 বছরের বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস হার্ডিঞ্জ কে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ভাইসরয় জখম হন। বিস্ফোরণের পর দিনই দেরাদুনে ফিরে এসে রাসবিহারী স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকেন। গদর আন্দোলনের সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
দেরাদুনে থাকলেও ছদ্মবেশে বিভিন্ন কাজে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। যখন তাঁর মাথার দাম ওঠে এক লক্ষ টাকা, সে সময় পুলিশের চীফ কমিশনারের ঠিক উল্টো দিকে বসে ছদ্মবেশে তিনি ট্রেনে সফর করেছিলেন। ছদ্দবেশেই ১৯১৩ সালের বন্যা বিধ্বস্ত সুবলদহে ত্রাণ বিলির জন্যআসেন। বৈপ্লবিক কাজের জন্য এত বেশি ছদ্মবেশ সম্ভবত আর কোন বিপ্লবী কে ধারণ করতে হয়নি। ভারতের সেনাবাহিনীতে বিপ্লবীদের প্রবেশ করিয়ে হাজার ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত ব্যাপী একটি বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা ব্যর্থ হয়।
লর্ড হার্ডিঞ্জ এর উপর হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এবং আরো অন্যান্য অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। হাজার ১৯১৫ সালের ১২ই মে কোলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি- মারু’তে করে নিজেই পাসপোর্ট অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ভারত বর্ষ ত্যাগ করেন।

তাঁর অসাধারন কূটনৈতিক বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা জাপানি নেতৃবৃন্দের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। এটা ছিল ভিন্ন দুই দেশ, দুটি জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় রক্ষার্থে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ, যাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। জাপানে তিনি খুঁজে পেলেন বিভিন্ন এশিয় গ্রুপের ছত্রছায়া। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর প্রত্যার্পণ এর ব্যাপারে জাপান সরকারকে চাপ দিতে থাকে। ১৯২৩ সালে তিনি জাপানের নাগরিক হন। সেখানে তিনি সাংবাদিক তথা লেখক হিসেবে বাস করতে থাকেন। ওই বছরই ২৭শে নভেম্বর টোকিওতে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে তিনি সভা করলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে খবর গেল। এরপর ব্রিটিশ সরকারের চাপে জাপান মারফত জারি হল নির্বাসনের আদেশ। তাঁরই তৎপরতায় জাপানি কর্তৃপক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পাশে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন যোগায়।
১৯৪২ সালের ২৮-২৯ শে মার্চ টোকিওতে তাঁর ডাকে অনুষ্ঠিত হয় একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সেই সম্মেলনে একটি সেনা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ নামক বৈপ্লবিক সংগঠনটি পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভারতকে মুক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠে।
১৯৪২ সালের ২২শে জুন ব্যাংককে তিনি লিগের দ্বিতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুকে লীগে যোগদান ও এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্ব ও পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেছিলেন রাসবিহারী বসু।
১৯৪২ সালে রাসবিহারী বসু পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তৈরি করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি)। এই সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল জাপানের সহায়তায় ভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ্যের উচ্ছেদ। এই বাহিনী মূলতঃ গঠিত হয় জাপানের হাতে ধরা পড়া ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে।এরা মালয় অভিযান ও সিঙ্গাপুরের যুদ্ধের সময় জাপানের হাতে ধরা পড়েছিল। এছাড়াও মালয় ও ব্রহ্মদেশের ভারতীয় প্রবাসীদের একটি বিরাট অংশ এই বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক রূপে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি এই আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে অর্পণ করেন।
জাপান সরকার তাঁকে সেখানকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য রাইজিং সান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।রাসবিহারী ছিলেন একনিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমে তেজস্বী। নিয়ম ও সময় জ্ঞান ছিল তার অত্যন্ত প্রখর। তাঁর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনা বোধ তাকে আজীবন সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস যুগিয়েছিল।
প্রিয়তম কবি রবার্ট ব্রাউনিং এর “Prospice”কবিতার দুটি লাইন খুব প্রিয় ছিল —
” I was ever a fighter,
So– one fight more
The best and the last!”
এই লাইনগুলি মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল।

শ্রী রাজদীপ মিশ্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.