শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: কাশ্মীর নিয়ে লোকসভা ভাষন

১৯৫২ সালের ২৬শে জুন, কাশ্মীরকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সম্পূর্ণভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন।

উৎস: ভারতীয় পার্লামেন্ট, লোকসভা ডিজিট‍্যাল লাইব্রেরী

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: রাজ্য মন্ত্রকের কার্যাবলী সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে এবং সেটা নিয়ে কারো না কারো কথা বলা উচিৎ। তবে আমার নির্ধারিত সীমিত সময়ের মধ্যে আমি কাশ্মীর সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। কেউ যখন কাশ্মীরের বিষয়ে কথা বলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা দ্বিধা ও বিবেচনার সাথে কথা বলতে চান, কারণ আমাদের এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয় যা পাকিস্তানের হাতকে শক্তিশালী করবে এবং সুরক্ষা কাউন্সিলের কাছে তা যেন কখনোই পক্ষপাতমূলক বক্তব্য বলে বিবেচিত না হয়। তবে​ কারো মনে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং সেখানকার উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং এই ব‍্যাপারে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া জরুরী যাতে সেটা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির​ সৃষ্টি না হয়। আমি বিশেষত প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি যাঁরা কাশ্মীরের ব্যাপারে তাঁর নীতি থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের কথা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। একে অপরের দিকে পাথর ছুঁড়ে তো কোনো লাভ হবে না এইক্ষেত্রে। একে অপরকে সাম্প্রদায়িক বা প্রতিক্রিয়াশীল বলাটাও আমাদের কোনও কাজে লাগছে না। তাঁকেও বুঝতে হবে যে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এবং পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ও
একটা জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। আবার এটাও হতে পারে যে আমরা বিষয়টি কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের সাথেও বিশদভাবে আলোচনা করার পরে আমরা একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসতে পারি। তাই আমি যা কিছু বলব, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলব।

আমরা এমন একটা সন্তোষজনক সমাধান খুঁজছি যাতে কাশ্মীর ভারতের মধ্যেই থেকে যায়। ভারত কাশ্মীরের জনগণের সাথে গত পাঁচ বছরে যে চূড়ান্ত ত্যাগ করেছে, তা যেন ফলপ্রসূ হয় এবং সমগ্ৰ জাতি যাতে উপকৃত হয়, এটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা। সাংবিধানিক দিকটি সম্পর্কে, আমার বন্ধু মিঃ এন. সি. চ্যাটার্জি কথা বলেছেন, এবং আমি তার যুক্তিগুলির আর পুনরাবৃত্তি করবোনা। সংবিধানের অধীনে কাশ্মীর বিধানসভার সাম্প্রতিক কাজকর্ম, এবং এই সংস্থার সুপারিশগুলি সংবিধানের নিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে সে সম্পর্কে ডঃ কাটজুর উত্তর দেওয়া উচিত। তবে আমি আপাতত সংবিধানের বাইরে বেরিয়ে কিছু বলবো।

এই তালিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হ’ল পতাকা নিয়ে। একদিন প্রধানমন্ত্রী সংবাদিক​ সম্মেলনে গণপরিষদের গৃহীত এই সিদ্ধান্তকে লঘু করার চেষ্টা করেছিলেন। শেখ আবদুল্লাহ দু’দিন আগে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, “ওহ, আমরা অবশ্যই ইউনিয়নের​ পতাকাটিকে স্বীকৃতি দেব”। ইউনিয়ন পতাকাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ইউনিয়নের​ পতাকাই সেখানে থাকবে এবং তা হ’ল স্বাধীন ভারতের পতাকা। কোনও রাজ্যের নিজস্ব পতাকা থাকার নীতিটি যদি আপনি গ্রহণ করতে চান তবে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু অসুবিধা তৈরি করেন এবং তার শেষ কোথায় সেটাও আপনি জানেন না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাশ্মীরের মহারাজের​ নিজস্ব পতাকা ছিল। আমি জানি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মহারাজদের পতাকা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব গভর্নরদের পতাকা রয়েছে। এবার আমার প্রশ্ন হ’ল: কোনও রাজ‍্যের কি নিজস্ব পতাকা থাকতে পারে? ভারতের নিজস্ব পতাকা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনও পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া কি উচিৎ? এই বিষয়ে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করা একান্ত প্রয়োজন। আমাকে যদি আমার মতামত জানাতে বলা হয় তাহলে বলবো যে একগামিতা’র নীতি অনুযায়ী সমগ্ৰ ভারতের একটিই পতাকা ব্যবহার করা উচিত। কোনোভাবেই আনুগত্য ভাগ করতে দেওয়া যাবে না। শেখ আবদুল্লাহ বলেছেন: “আমরা দুটি পতাকাকে​ই সমান গুরুত্ব দোবো”, আপনি কোনোভাবেই এটা করতে পারবেন না। এটা সমানভাবে ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্ন নয়। এটা সমমর্যাদার প্রশ্ন নয়। সমগ্র ভারতে একটি পতাকা ব্যবহারের​ প্রশ্ন, আর সেই ভারতের মধ্যে কাশ্মীরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কাশ্মীরের পৃথক পতাকা রয়েছে বলেই সেখানে আলাদা প্রজাতন্ত্র থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। এটা কোনও সামান্য বিষয় নয়। আমার কাছে বেশী সময় নেই, নাহলে, আমি গণপরিষদে পণ্ডিত নেহেরু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা থেকে কিছু বুদ্ধিদৃপ্ত উদ্ধৃতি এখানে শোনাতাম। যখন তিনি ভারতের বর্তমান পতাকাটি দেশের জাতীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি সেখানে এমন ভাষায় প্রয়োগ করেছিলেন যা আপনি কখনো এড়িয়ে যেতে পারবেন না, আত্মত্যাগ এবং পতাকাটির আসল তাৎপর্য কোনও একটা রাজ্যের নয়, ভারতের কোনো একটি বিশেষ অংশ বা অঞ্চলের জন্য নয়, পুরো ভারতের মানুষ তথা সমগ্র স্বাধীন জাতির জন্য। সুতরাং এমন একটি বিষয়ে ভারত সরকারের উচিত দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করা। জাতীয় সম্মেলনে একটি পতাকা থাকতে পারে। এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। শেখ আবদুল্লাহর যুক্তি হ’ল আমরা এত রক্ত ​​ঝরিয়েছি, অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয়েছে এই পতাকার জন্য। নিঃসন্দেহে। তারা কাশ্মীরের​ জাতীয় সম্মেলনে নিজেদের পতাকা রাখুক। এতে কারও আপত্তি নেই, তবে আপনি যখন সরকারীভাবে কাজ করবেন, সে আপনি যেখানেই কাজ করুন না কেন, সেখানে কেবল একটি পতাকাই উড়বে এবং উড়বেই, আর সেটা হ’ল স্বাধীন দেশের পতাকা, স্বাধীন ভারতের পতাকা।

যতক্ষণ না মহারাজ সম্পর্কিত প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষন ওখানে সাংবিধানিক অসুবিধা থাকবে। আপনাদের মহারাজ পদাধিকারের বিলুপ্তি ঘটানোর কোনো প্রয়োজনই নেই। এটা ভাগ্যের পরিহাস যে এই​ মহারাজা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে পাঠিয়েছিলেন যাতে শেখ আবদুল্লাহ সেখানে সাচ্ছ‍্যন্দে মহান রাজা হিসাবে রাজত্ব করতে পারেন। মহারাজা যদি কোনও কারণে কাশ্মীর থেকে পালিয়ে যেতেন, তবে ভারতীয় সৈন্যদের​ আর ওখানে পাঠানো হতোনা, আর তখন ওখানে না তো স্বাধীন ভারতের পতাকা উড়তো না মহারাজার। সেখানে শুধু উড়তো পাকিস্তানের​ পতাকা।

একজন মাননীয় সদস্য: শুধুমাত্র মহারাজার​ জন‍্যই কি পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল!

ডঃ এস. পি. মুখার্জি: মাননীয় সদস্য যা বললেন সেটা তিনি কিছু না জেনেই বলছেন। ১৯৮৮ সালের ২৭শে অক্টোবরে​ কাশ্মীরের অবস্থান ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যা এখন ইতিহাসে পরিনত হয়েছে। মিঃ জিন্নাহ্​ কাশ্মীরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা যদি আর ২৪ ঘন্টা দেরিতে আসতাম তাহলে শ্রীনগর ধ্বংস হয়ে যেত এবং কে জানে ইতিহাস তখন হয়তো অন্যভাবে লেখা হত। যাইহোক, মহারাজা চলে গেলেন। তার স্বৈরাচারী প্রশাসনের ধারাবাহিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মর্যাদা ঐ সাম্মানিক সুতোয় হাত বাঁধা অবস্থায় তিনি কাশ্মীরের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে কাজ চালিয়ে গেছেন। তবে আপনি যদি চান যে মহারাজা কোনও নির্দিষ্ট ইউনিটের সাংবিধানিক প্রধান হয়ে ভারতের কোনও অংশে যেন না থাকেন তাহলে সেই প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে, সঠিকভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে সম্পন্ন করা উচিত। চলুন বিষয়টিকে​ অন্য কোনও ইস্যু থেকে স্বতন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করি। ভারতীয় সংসদ যদি বিবেচনা করে যে ভারতের সংবিধান সংশোধন করা উচিত এবং ভারতের কোনো অংশে কোনও মহারাজার শাসন না থাকা উচিত, তাহলে আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করব। এর পক্ষে যেমন যুক্তি রয়েছে ঠিক তেমন বিপক্ষেও রয়েছে। আসুন আমরা সেইসব​ ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে দেখি এমন কোনও উপায় খুঁজে বের করতে পারি কিনা যা শেষ পর্যন্ত ভারতকে এই মহারাজের শাসন মুক্ত করবে।

রাজকুমারী সম্পর্কে – আপনি তাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই​ বলতে পারেন, তবে এই শ্বেতপত্রটি পড়ুন যা রাজ্যগুলির বিষয়ে ভারত সরকারের নীতির প্রতিনিধিত্ব করে। আশাকরি আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি সেগুলি ভুলে যাব না। ব্রিটিশরা যখন চলে গেল, তারা দুটি অদ্ভুত কাজ করেছিল। একটি ছিল দেশভাগ, এবং অন্যটি হ’ল হঠাৎ করে প্রায় ৫০০ রাজ্য থেকে সর্বভারতীয়তা প্রত্যাহার করা, যা ভারতের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ছিল। কোনও দেশকে আমাদের মতো ১৯৪৭ সালের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে বলা হয়নি। এটা কার্যত এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। দেশভাগের কারণে, বিভিন্ন বাহিনী কার্যকর হয়েছিল যাদের কথা আমার উল্লেখ করার দরকার নেই, তবে এই পরবর্তী কাজের জন্য, হঠাৎ করে সর্বস্বত্বের অবসান ঘটে এবং দেশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে ৫০০ অংশকে সার্বভৌম রাজ্য তৈরি করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে কেউ বুঝতে পারছিলো না যে কিভাবে এগোতে হবে। এবং তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের স্বাধীনতার এক মহান স্থপতি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নাম স্মরণ করা হয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক নীতিমালা ছিল প্রশংসনীয় — তিনি ছিলেন অকুতোভয়, বাস্তববাদী, নম্র, তেজস্বী এবং তিনিই এই সময়ের অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ৪৯৭ টি রাজ্যকে স্বাধীন ভারতের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি সফল হন। তারা কী কী ক্ষমতা পেলো? কেবলমাত্র তিনটি বিষয়, বৈদেশিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত— যেহেতু ব্রিটিশরা ঘোষণা করেছিল যে রাজ্যগুলি কেবলমাত্র এই তিনটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েই ভারত বা পাকিস্তানে থাকতে পারবে। এটা আমাদের সমস্যাগুলিকে বাড়ানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছিল, তবে যে কোনও ক্ষেত্রে হায়দরাবাদ, জুনাবাদ এবং কাশ্মীরকে বাদ দিয়ে এই ৪৯৭ টি রাজ্যই কেবল এই তিনটি বিষয়ের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের কাঠামোর আওতায় আসতে পেরেছিল। আজ শেখ আবদুল্লাহ ৩৭০নং অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কথা বলেছেন। সংবিধানের আওতাধীন ৩৭০-এর ইতিহাস কী? এই নির্দিষ্ট নিবন্ধটি গৃহীত হওয়ার সময়ে আমি শ্রী গোপালস্বামী আয়ঙ্গার দেওয়া ভাষণটি পেয়েছি। পুরো বক্তব্যটি শোনানোর মতো আমার কাছে সময় নেই, তবে শেখ আবদুল্লাহ যেহেতু গতকালের আগের দিন তার সম্প্রচারিত ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি গণপরিষদের জনাব গোপালস্বামী আয়ঙ্গার যা বলেছিলেন তার থেকে তিনি সনদ পেয়েছিলেন, তাই আমাদের উচিত বক্তব্যটি পুনরায় পড়া, যাতে আমাদের সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ গৃহীত হওয়ার আসল উদ্দেশ্যটি আমরা বুঝতে পারি।

ভুলে যাবেন না আগে ভারতের ছবিটা ঠিক কেমন ছিল। তখন কি এই সমস্ত রাজ্যের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের কোনো সম্পর্ক ছিল? এই তিনটি রাজ্যই কেবল এই তিনটি বিষয়ের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে ছিল সর্দার প্যাটেলের আরও একটি দুর্দান্ত অবদান। এখানে কাওকে জোর করার কোনো প্রশ্নই নেই। তিনি নেতাদের পাঠিয়েছিলেন, কারণ ভারত সরকার তখন স্বীকার করে নিয়েছিল যে সার্বভৌমত্ব, বাকী সার্বভৌমত্ব এবং অবশিষ্টাংশগুলি এই ব্যক্তিদের হাতেই ন্যস্ত করা হবে। তিনি তাদের সাথে তর্ক করেছিলেন, তাদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সংবিধান গঠনের সময়কালে প্রায় সমস্ত রাজ্যই এগিয়ে এসেছিল এবং এক নতুন ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। সমস্ত ইউনিটের​ সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে ব‍্যবস্থা নিতে হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এখানে অনেকগুলো রাজ‍্য রয়েছে। পার্ট এ, পার্ট বি এবং পার্ট সি-এর তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলি। এবং এখন যদিও তারা সকলেই এক ছাতার তলায় এসেছে কিন্তু তবুও অনেক ধরনের অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। আমরা গত এক ঘন্টার মধ্যে দেখেছি কীভাবে এক অঞ্চল থেকে একজন সদস্য এবং অন্য অঞ্চল থেকে আরেকজন উঠে এসে নিজেদের অসুবিধাগুলি তুলে ধরেছেন। আমি অস্বীকার করছি না তাদের সমস্যাগুলকে। পার্ট বি এবং সি-এর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিল। তা হলেও তারা সবাই কিন্তু ভারতের ঐক‍্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
আর তাই যখন গণপরিষদে এই বিশেষ অনুচ্ছেদ গৃহীত হওয়ার কথা উঠেছিল তখন মাননীয় সদস্য মাঝপথে বাধা দিয়ে বলেছিলেন যে “কেন এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে শুধুমাত্র কাশ্মীরের​ জন্য”। এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে গোপালাস্বামী আইঙ্গার বলেছিলেন—
“এই পক্ষপাতিত্ব শুধুমাত্র কাশ্মীরের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য​। এইরকম​ সংহতকরণের জন্য এই নির্দিষ্ট রাজ্য এখনও প্রস্তুত হয়নি। এটা এখানে সবার আশা যে ( আশা শব্দটিকে চিহ্নিত করুন) এই তালিকায় থাকা সবাই যথাযথভাবে, এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরও এই একীকরণের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবে যেমনটি অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ঘটেছে। (চিয়ার্স) “

তাঁর বক্তব্যের পরে ‘চিয়ার্স’ শব্দটি​ রয়েছে। সম্ভবত কংগ্রেস সদস্যদের মতো, যাদের মধ্যে অনেকেই এই তিনটি বিষয় বাদে শেখ আবদুল্লাহর ভারত থেকে পৃথক থাকার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করছিলেন।

মিঃ গোপালস্বামী আয়ঙ্গার তখন এই বিষয়টিকে আরও বিস্তারিতভাবে​ ব‍্যাখ‍্যা করে প্রকৃত কারনগুলি জানিয়েছেন— প্রথমত স্বাভাবিকভাবেই, যুদ্ধ চলছে, দ্বিতীয়ত বিষয়টি সুরক্ষা কাউন্সিলের অধীনে এবং তৃতীয়ত গণপরিষদ জম্মু ও কাশ্মীরে বসবে। তারপরে আবার তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন:

“আমি হাউসকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা এখন শুধুমাত্র একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্ৰহন করতে পারি।”

তিনি আরও বলেন: “বর্তমানে অন্যান্য বিধানগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য নয়।”

তারপরে আরও​ একটি অনুচ্ছেদে রয়েছে যার জন‍্য আমি বিশেষ করে জম্মু কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মিঃ গোপালস্বামী আয়ঙ্গার বক্তব্যের​ কিছু অংশ তুলে ধরা হ’ল :

“খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার আগে আমি কাশ্মীর সরকারের যে সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম তাদের উদ্দেশ্য সংবিধানের অন্যান্য বিধানগুলির প্রয়োগ না করা নয়। তারা শুধু চায় যে এই বিধানগুলি কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত যেখানে এগুলোকে​ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যাবে, এবং যদি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জন্য এই বিশেষ শর্তগুলির প্রয়োজন হয় তবেই কেবলমাত্র এই ধরনের পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম প্রয়োজনীয় “

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনকি সেই পর্যায়েও কাশ্মীর সরকারের সদস্যরা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে যদিও কিছুটা সময় দেওয়া যেতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত তারা ভেবেছিল ভারতের সাথে একরকম সম্পূর্ণ সংহতকরণের কথা। এটাই বড় প্রশ্ন। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন বলে আমি ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। মহারাজার চিন্তাভাবনা ছিল, পতাকা ছিল​, এবং আমরা সহজেই তাঁর সাথে ডিল করতে পারি। যদিও এটা একটা তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো বিষয় কিন্তু আমি কোনোভাবেই তাদের গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারি না। তবে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে কীভাবে কাশ্মীর ভারতের সাথে সংহত হতে চলেছে? কাশ্মীর কি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে অন‍্য একটি প্রজাতন্ত্র হতে চলেছে? আমরা কি এই সার্বভৌম সংসদকে বাদ দিয়ে ভারতের চার কোণে আরেকটি সার্বভৌম সংসদের কথা ভাবছি?

এটাই ছিল শেখ আবদুল্লাহর দাবি এবং আমরা এর বিরোধিতা করি। আমরা কি কাশ্মীরের অধিকারের কথায় আগে ভেবেছিলাম​ যে তারা ভারত থেকে কিছু নেবে এবং পরিবর্তে কিছুই​ দেবে না? অর্থ, সংস্থান, রাস্তা, সেতু সবই কি নেওয়া হবে? এটা কি শুধুই ‘দেওয়া এবং নেওয়া’ এর প্রশ্ন, নাকি শুধুই ‘নেওয়া’, পরিবর্তে কিছু ‘দেওয়া’ হবে না? এই বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর এটা নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের মনোভাব ই বা ঠিক কী? আমরা এই ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত এতটা এগিয়েছি যাতে আমরা আমাদের​ সাথে জনগণকে রাখতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ব‍্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করব। নিজের প্রশাসনিক ক্ষমতা, ইচ্ছাশক্তি এবং সর্দার প্যাটেলের মতো দৃঢ় সংকল্প প্রয়োগের​ মাধ‍্যমে এবার ওনাকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আসুন এবার একটু জানার চেষ্টা করি যে আমাদের মনের মধ্যে কী আছে। প্রথমতঃ আমরা কী চাই, আপনি যদি কেবল বাতাসের সাথে খেলতে চান এবং আর বলতে চান, “আমরা অসহায় এবং শেখ আবদুল্লাহকে তাঁর পছন্দমতো কাজ করতে দিন,” তবে কাশ্মীর হারিয়ে যাবে। আমি অত্যন্ত বিবেচনার সাথে এটি বলছি যে কাশ্মীর হারিয়ে যাবেই। অন্যদিকে, আমরা যদি মনে মনে এটা পরিষ্কার করা ফেলি যে আমরা কাশ্মীরের জন্য কোনও স্বতন্ত্র পরিকাঠামো চাই না, তাহলে আমরা কেবলমাত্র এমন এক পরিকাঠামোর কথা ভাবতে পারি যা আমাদের সংবিধানে মহান চিন্তা-চেতনার পরে বিবর্তিত হয়েছিল, তবে এইসব কিছু বাস্তবায়িত করার জন্য সবচেয়ে আগে একটি শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের কাশ্মীরের​ বন্ধুদের বোঝাতে হবে যে তাদের সুরক্ষা, আমাদের সুরক্ষা এবং আমাদের ও কাশ্মীরের জন্য যেটা মঙ্গলজনক হবে এরপর থেকে সেটাই করা হবে। কাশ্মীরের​ সাথে শুধুমাত্র​ ঐ তিনটি বিষয়ের জন্য সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটা আমরা চাই না। এই প্রসঙ্গে, আমি কেবল রাজ্য ও প্রদেশগুলিকে ভারতের সাথে সংহত করার উপায় সম্পর্কিত এবং রাজ্যগুলির বিষয়ে সরকারের নীতি সম্বলিত শ্বেতপত্র থেকে একটি ছোট্ট সূত্র উদ্ধৃত করব। এই উদ্ধৃতিটি মূলত সর্দার প্যাটেলের ভাষণ থেকে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি দাবিকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হয়েছে যেটাকে আমরাও অগ্ৰাধিকার দিচ্ছি। এই বিবৃতিতে সরকারী নীতি রয়েছে। ভারতীয় রাজ‍্যগুলির জন্য তৈরী করা নীতির শ্বেতপত্রের ২৪৩ এবং ২৪৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে:

“কংগ্রেস একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেশকে দেওয়া হুমকির বিপর্যয় এড়াতে কেবল রাজ্যগুলিতে নয়, প্রদেশগুলিতেও সমস্ত রকম রেসিড‍্যুয়ারী পাওয়ার ন্যস্ত করতে হবে। ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির মন্দার সাথে সাথে, প্রদেশগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক যতটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটাও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। রাজ্যগুলিতে এইরকম পটপরিবর্তনের মাধ‍্যমে প্রদেশগুলোর সাথে তাদের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং তাএকটি সংঘবদ্ধ পক্ষপাতমূলক​ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিনত হয়। দেশের সংস্থাগুলিকে উন্নত করা এবং জালিয়াতি বন্ধ করার মাধ্যমে কেন্দ্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে”।

এইভাবেই, ছয় বা সাত বাক্যে পুরো নীতিটি মূর্ত হয়েছে। আমি দাবি করছি যে ভারতীয় সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত মতাদর্শই জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে এক প্রান্তের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি অন্য প্রান্তের নাগরিকের চেয়ে আলাদা হতে পারে না। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর​ আওতায় থাকা দেশে ভিন্ন ভিন্ন সাংবিধানিক বিধান চলবে না, এখানে বৈষম্যের কোনও সুযোগ নেই। রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যে প্রশাসনিক এবং কার্যনির্বাহী ব‍্যবস্থা নেওয়া হবে তা প্রদেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও​ কেন্দ্র-রাজ‍্য-প্রদেশগুলোর মধ্যে সামঞ্জস বজায় থাকবে এবং তারা একক কর্তৃত্বের মধ্যে থাকবে।
ভারতের অডিটর-জেনারেলকে অবশ্যই রাজ্যগুলিতে এবং প্রদেশগুলির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তাদের উপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। রাজ‍্য ও প্রদেশগুলি হবে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রনাধীন। রাজ্যগুলিতে উচ্চ আদালত গঠন করতে হবে যেখানে তারা প্রাদেশিক উচ্চ আদালতগুলির মতোই কাজকর্ম চলবে। ভারতের সমস্ত নাগরিক, তারা যেকোনো রাজ্য বা প্রদেশে বাস করুক না কেন একইরকম মৌলিক অধিকার থাকবে এবং একই ধরনের আইনী প্রতিকার উপভোগ করতে পারবে। কেন্দ্রের সাথে সাংবিধানিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে অবশ্যই প্রদেশগুলির সাথে সমান হতে হবে।
আমরা আমাদের যেসব নীতি ঘোষণা করেছি তাদের এবার স্থাপনা করা আবশ্যক। আপনি জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়গুলির ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে তাদের আলাদাভাবে দেখতেই পারেন। আমি এটা নিয়ে চিন্তা করছি না। তবে প্রধান কাজ এটাই হবে যে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও​ প্রযোজ্য করা। এই বিষয়ে কোনও আপস করা হবে না। সুপ্রিম কোর্টকে পুরো ভারত, জম্মু ও কাশ্মীর সহ পুরো ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল হিসাবে কাজ করতে হবে। অডিটর-জেনারেলের রিট্ জম্মু ও কাশ্মীর সহ পুরো ভারতেই কাজ করবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো​ স্বীকার করে নেওয়া উচিত। শেখ আবদুল্লাহ কে কাশ্মীরের রাজাধিরাজ​ বানিয়েছিলেন? কে শেখ আবদুল্লাহকে মহান কর্তৃত্বের​ অংশীদার বানিয়েছেন​? কারণ ভারতীয় সেনারা সেখানে গিয়ে কাশ্মীরের জনগণকে সাহায্য করেছিল। একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের মধ্যে থেকে আরেকটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে চলছে, আমরা এটা কি করছি? আমাকে এই প্রশ্নগুলো স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করা হোক? আমরা জানতে চাই যে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের অনুভূতি ঠিক কী। আমি কিছু প্রতিবেদন সেটা জানতে পেরেছি — কিন্তু সময়ের​ অভাবে আমি সেসবের বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবো না – এগুলি মূলতঃ জম্মু ও কাশ্মীরে​ বৈষম্যমূলক পদ্ধতিতে সরকারবিরোধী যে কাজগুলি চলছে বা যিনি চালাচ্ছেন সেই সম্পর্কিত। আমার পক্ষে এই অভিযোগগুলি সংসদ ভবনে প্রকাশ করা ভীষণ বেদনাদায়ক, কিন্তু আমি এটা শুধু এই কারণে করছি যাতে প্রধানমন্ত্রী অন্তত এটা নিয়ে তদন্ত করেন এবং আশা করি সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলরা এর বিরুদ্ধে​ কিছু যুক্তি দেবে বলেই এগুলি তিনি কোথাও সরিয়ে রাখবেন না বা উপেক্ষা করবেন না। তাঁকে অবশ্যই এই প্রশ্নগুলি বা অভিযোগগুলোকে তলিয়ে দেখতে হবে এগুলো কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে।

আমি যদি কিছু বিষয় উল্লেখ করতে চাই তাহলে কি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো? আমাদের সংসদ ভবন কি এটা নিয়ে ভেবে দেখেছেন​ যে ব্রিটিশ এবং পাবলিক সিকিউরিটি অ‍্যাক্টের মাধ্যমে প্রবর্তিত পুরানো ভারতীয় সুরক্ষার নিয়মনীতি যা বিশেষত এই দেশের জনগণের স্বাধীনতা নষ্ট করার জন্য লাগু করা হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত একটিও কমা বা সেমিকোলন পরিবর্তন না করেই ব‍্যবহার করা হচ্ছে, এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরের মতো স্বাধীন রাজ‍্যেও তা চালু রয়েছে। কত শত মানুষকে এই আইনের প্রভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? তাদের কাউকে কি কোনও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল? কোনও একজন ব্যক্তিরও মামলা কি কোনও উপদেষ্টা কমিটির সামনে আনা হয়েছিল? যারা অভিযোগ করে যে মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হয় এবং কাশ্মীরের আদালতও তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না কারণ এই ব‍্যাপারে জন সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করা যায় না। জম্মু-কাশ্মীরে যে সংবাদপত্রগুলির কন্ঠরোধ করা হয়েছে এবং ভারত থেকে জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার অনুমতি নেই এমন সংবাদপত্রের অনেক নাম আমি এখানে পেয়েছি।

পড়াশুনার কি হবে? অভিশপ্ত মহারাজার সময়ে অন্তত সেখানে উর্দু এবং হিন্দি ভাষা চালু ছিল। দুটো ভাষারই সমান মর্যাদা ছিল। কিন্তু বর্তমানে হিন্দি জম্মু ও কাশ্মীর থেকে উধাও হয়ে গেছে। আর শুধুমাত্র হিন্দুস্থানেই যে দেবনাগরি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু যদি বিষয়বস্তু নিয়ে বলা হয় তাহলে তার উৎস হ’ল পারসিক উর্দু। আমি এই বইয়ের একটি অনুলিপি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে উপস্থাপন করব। আমি গত তিন দিন ধরে এই বইটি আমার বেশ কিছু বন্ধুর হাতে দেখেছি, যারা হিন্দুস্থান সম্পর্কে জানে, কিন্তু হিন্দি জানে না। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এই বইটি পড়তে পেরেছেন, যদিও এটা জম্মু কাশ্মীরের একটি বাধ‍্যতামূলক পাঠ‍্যপুস্তক। জম্মু ও কাশ্মীরে শ্রী আব্দুল্লাহর শাসনকালে হিন্দি সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি পন্ডিতজীকে এর একটা প্রতিলিপি দিতে চাই, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন কোন কোন শব্দগুলো বুঝতে আমার বন্ধুদের অসুবিধা হয়েছে। এটা একটা বই(বাধা)— আমি আনন্দিত যে আমাকে বাধা দেওয়া হ’ল— জম্মু কাশ্মীরের যে পাঠ‍্যপুস্তক সংস্থা থেকে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে, শেখ আব্দুল্লাহ সেই সংস্থার চেয়ারম্যান এবং এই সংস্থা জম্মু কাশ্মীরের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিভূ, তবুও সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো একজন সদস্যের​ও জায়গা হয়নি। দু’একজন ইউরোপীয় সদস্য থাকলেও বাকি সমস্ত সদস্যই ছিলেন মুসলিম। এই বইটির​ মূল বিষয়বস্তু হ’ল ” নারীদের অধিকার”, আওরত কো তালাক অউর খুলা লেনে কা হক হোগা

এটি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক একটি পাঠ্যপুস্তক, যেখানে জম্মু ও কাশ্মীরের নারীদের অধিকারের​ মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে — (বাধা)। অবশ্যই যাঁরা এটা চান, তাদের যতগুলো ইচ্ছে বিবাহ করতে এবং বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে (বাধা)। আপনি এটা পড়বেন এবং হজম করবেন। বিবাহ সম্পর্কিত এই বিষয়ে আমাকে বলা হয়েছে যে তারা কিছুটা চুক্তিবদ্ধ বিবাহ করেছেন আমেরিকান ভাষায় যাকে বলে ‘কমপেনিয়নেট’ বিবাহ — যেখানে আপনি স্বামী-স্ত্রী হয়ে কম সময়ের জন্য একসাথে থাকতে পারেন এবং তারপরে আলাদা হয়েও যেতে পারেন। জম্মু ও কাশ্মীরের নারীদের কাছে এটা একটা মহান অধিকার।

শিক্ষামন্ত্রী (মৌলানাআজাদ): আপনি কি জানেন যে খুলা বলতে কী বোঝায়?

ডাঃ এস পি মুখোপাধ্যায়: আমি জানি না।

মৌলনা আজাদ: আপনি সম্পূর্ণ ভুল কথা বলছেন।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: আমি এখানে তাদের হয়ে কথা বলছি যারা এই বিষয়ে জানে। আমি যদি ভুল হয়ে থাকি তবে মাননীয় মন্ত্রী আমাকে সংশোধন করবেন। তিনি এটিকে ভারতের​ শিক্ষামূলক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন! আর পাঁচ মিনিট। স্যার আমি আপনাকে সীমানা সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।

মিঃ ডেপুটি স্পিকার: মাননীয় সদস্য অনেক সময় নিয়েছেন।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: এই অধিবেশনকালে আমার আর কাশ্মীর নিয়ে কথা বলার সুযোগ হবে না, তাই আর কয়েক মিনিট সময় দেওয়ার অনুরোধ করছি।

সীমানা সম্পর্কে এখন জম্মু প্রদেশের উধমপুর জেলা হঠাৎ করে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি বছরের পর বছর ধরে একটি জেলা হিসাবেই​ ছিল এবং সেখানে হিন্দুরা​ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কিন্তু তাকে বিভক্ত করে এর একটি অংশকে কাশ্মীর উপত্যকার মুখোমুখি করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে মুসলিমরা​ সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এটা জনগণের মতামত না নিয়েই করা হয়েছে। আঞ্চলিক ভিত্তিতে যদি কোনও মতামত থাকে তবে কমপক্ষে উধমপুর জেলার যে অঞ্চলটি খুব উর্বর সেগুলি কাশ্মীর উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত করা যেতো।

শ্রী এম. শফি চৌধুরী (জম্মু ও কাশ্মীর): আমি কি জানতে পারি তিনি নতুন পাকিস্তান তৈরি করতে চাইছেন কিনা?

ডঃ এস.পি. মুখোপাধ্যায়: আমি জানি যে আমার মাননীয় বন্ধু এই প্রশ্নটি খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করলেন। তবে আমি নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। এই বিষয়ে আমি পরে আলোচনা করবো। (বাধা)

মিঃ ডেপুটি স্পিকার: মাননীয় সদস্য এই বক্তব্য মানতে চাইবেন না। কিন্তু আমি মাননীয় সদস্যকে এর উত্তর দেওয়ার একটি সুযোগ দোবো।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: এখন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর​ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই (বাধা)। আমি জানি তিনি অধৈর্য হয়ে উঠছেন। আমি দুঃখিত সেইজন্য। কিন্তু আমাদের এই বিষয়ে আলোকপাত করতেই হবে। স্যার, মহারাজা গুলাব সিং লাখ লাখ টাকা খরচ করে “ধর্মার্থ ট্রাস্ট” নামক একটি ট্রাস্ট বানিয়েছিলেন। এখানে ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি, শিক্ষা এবং দরিদ্র লোকদের সহায়তা করা হত। কিন্তু এখন, সেই ট্রাস্টের অবস্থা কি হয়েছে? ট্রাস্টের​ বেশিরভাগ জমি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

সরকারী চাকরি এবং পদগুলি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করা হচ্ছে। আর কি অন্য কোন রাজ্য বা প্রশাসন আছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করা হয়? এটাই​ কি ধর্মনিরপেক্ষতা? এমনকি অফিসারদের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। একদিকে তাদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসাবে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অন‍্যদিকে তারাই আবার প্রশাসনিক পদেও বহাল থাকছেন। এইরকম তো আর কোথাও হয় না। যদি সরকারী আধিকারিকরা সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে ফলাফল যে কি হবে সেটা আশা করি বুঝতেই পারছেন।

স্যার, এই প্রসঙ্গে শরণার্থীদের​ প্রশ্ন আবার উঠে আসছে। আপনি জানেন যে আমরা এটা নিয়ে আগেও আলোচনা করেছি। জম্মু ও কাশ্মীরের হাজার হাজার হিন্দু শরণার্থী ভারতে বসবাস করছে। কেন তাদের জম্মু বা কাশ্মীরে জমি দেওয়া যাবে না? কেন বাইরের মানুষ সেখানে গিয়ে জমি কিনে বসতি স্থাপন করতে পারবে না? এটা কি বৈষম্যমূলক নীতির দিকে নির্দেশ করে না?

তারপরে আপনার পারমিট সিস্টেম রয়েছে। এবং বহিঃশুল্কের ব‍্যাপার আছে। মহারাজার সময়ের​ পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী সেখানে অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা গ্ৰহনে অনেক সীমাবদ্ধতা​ রয়েছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী কোনও ভারতীয় সেখানে গিয়ে সমানাধিকারের​ ভাগিদার হতে পারবে না এবং এই নিয়মনীতি এখনও অব্যাহত রয়েছে – কেন ভারতীয় নাগরিকদের সেই অঞ্চলে প্রবেশ ও বসতি স্থাপনের সীমাবদ্ধতা থাকবে?

শ্রীনগরে ৯ ই মে শেখ আবদুল্লাহর দেওয়া বক্তৃতার দুটি ভিন্ন সংস্করণ আমি এখানে পেয়েছি। এটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়; আমার কাছে দুটি কপিই রয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করা সংস্করণটি এবং ভারত সম্বন্ধীয় বিষয়ের সংস্করণটি অনেক আলাদা। স্বাভাবিকভাবেই এর কিছু অংশ ভারতের মানুষজন পছন্দ করবে না। এটা খুব চালাকভাবে করা হয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের​ জারি করা এই দ্বৈত কৌশলটির অনুলিপি আমার কাছে রয়েছে — একটি ভারতীয়দের​ ব্যবহারের জন্য এবং একটি বাড়িতে ব্যবহারের জন্য।

আমি আমার বক্তব্যটি আর দীর্ঘ​ করতে চাইনা কারণ আমি আমার নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেছি, তবে আমি শেষে যা বলতে চাই তা হল: এর প্রতিকার কী? বিকল্প পথ ই বা কি? সংবিধান অনুযায়ী আমরা জম্মু ও কাশ্মীরকে এই বিষয়ে কিছু করার জন্য বাধ্য করতে পারিনা যতক্ষণ না পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর তাতে সম্মতি দিচ্ছে এবং , গণপরিষদ সম্মত হচ্ছে। আমি আমার কমিউনিস্ট ভাইদের চিনি। তারা এখানে রাজাজী’র ফর্মুলাকে সমর্থন করবে। তারা মুসলিম লীগকে সমর্থন করে, পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আমি তাদের দোষ দিচ্ছিনা। আসলে আমার একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আছি যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির ডঃ কাটজু এবং শেখ আব্দুল্লাহ একইদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। গতকাল ডঃ কাটজু আমায় বলেছিলেন যে, একজনের বন্ধুমহল দেখে তাকে চেনা যায়। ডঃ কাটজু জানেন যে কমিউনিস্ট পার্টি আজ শেখ আব্দুল্লাহকে সমর্থন করছে।

শেরী মহম্মদ আকবর: আপনি একটি নতুন পাকিস্তান তৈরী করতে চাইছেন; জেলাভিত্তিক পাকিস্তান।

ডঃ এস.পি. মুখার্জি: ……….. লাদাখের নেতার কাছ থেকে পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কাছে একটা চিঠি এসেছিল। মহাবোধি সোসাইটির সভাপতি থাকার দরুণ সেই চিঠির একটা কপি আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি সেখানে স্পষ্ট ভাষায় দাবি করে বলেছেন যে— যদি কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হতে না চায় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অধিকার যেন তাদের দেওয়া হয়। ভারতের সাথে যুক্ত থাকার মধ‍্যেই তাদের সুরক্ষার বিষয়টি ন‍্যস্ত আছে। ঠিক এই বিকল্পটির কথাই আমি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুকে বলেছিলাম। প্রথমতঃ একটা প্রকল্প চালু করা দরকার যেখানে কাশ্মীরকে ভাগাভাগি করার কোনো প্রশ্নই থাকবে না। আমরাও চাই না জম্মু কাশ্মীরেরকে ভাঙতে। এক্ষেত্রে শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্তানের হাতে জম্মু কাশ্মীরের যে অংশটি রয়েছে সেটা যেন জম্মু কাশ্মীরের মধ‍্যেই থাকে।

এবার যদি শেখ আব্দুল্লাহ তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলেন যে “আমি ঐ তিনটি বিষয় ছাড়া, কোনোভাবেই ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হবনা”, তাহলে জম্মু এবং লাদাখের মানুষদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিৎ যে তারা ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। আমি বারবার বলেছি যে আমি ভাগাভাগি চাইনা। পন্ডিত নেহেরু যদি তাঁর সুচিন্তিত মতামত, সুনিপুণ নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ প্রভাব এবং বিশ্বাসযোগ্যতার মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের উদারতা, বিশালতা এবং গ্ৰহনযোগ‍্যতার বিষয়ে শেখ আব্দুল্লাহকে আশ্বস্ত করতে পারেন তাহলে তো ভীষণ ই ভালো হয় এবং তাতে আমারও কোনো আপত্তি থাকবে না। যদি তা না হয় তাহলে যে বিশাল সংখ্যক মানুষ ভারতীয় সুরক্ষার ছত্রছায়ায় থাকতে চাইছে তাদের কোনোভাবেই শেখ আব্দুল্লাহ’র তৈরী করা ভাগ‍্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

১৯৫২ সালের ২৬শে জুন, কাশ্মীরকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সম্পূর্ণভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন।

উৎস: ভারতীয় পার্লামেন্ট, লোকসভা ডিজিট‍্যাল লাইব্রেরী

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: রাজ্য মন্ত্রকের কার্যাবলী সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে এবং সেটা নিয়ে কারো না কারো কথা বলা উচিৎ। তবে আমার নির্ধারিত সীমিত সময়ের মধ্যে আমি কাশ্মীর সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। কেউ যখন কাশ্মীরের বিষয়ে কথা বলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা দ্বিধা ও বিবেচনার সাথে কথা বলতে চান, কারণ আমাদের এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয় যা পাকিস্তানের হাতকে শক্তিশালী করবে এবং সুরক্ষা কাউন্সিলের কাছে তা যেন কখনোই পক্ষপাতমূলক বক্তব্য বলে বিবেচিত না হয়। তবে​ কারো মনে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং সেখানকার উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং এই ব‍্যাপারে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া জরুরী যাতে সেটা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির​ সৃষ্টি না হয়। আমি বিশেষত প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি যাঁরা কাশ্মীরের ব্যাপারে তাঁর নীতি থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের কথা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। একে অপরের দিকে পাথর ছুঁড়ে তো কোনো লাভ হবে না এইক্ষেত্রে। একে অপরকে সাম্প্রদায়িক বা প্রতিক্রিয়াশীল বলাটাও আমাদের কোনও কাজে লাগছে না। তাঁকেও বুঝতে হবে যে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এবং পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ও
একটা জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। আবার এটাও হতে পারে যে আমরা বিষয়টি কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের সাথেও বিশদভাবে আলোচনা করার পরে আমরা একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসতে পারি। তাই আমি যা কিছু বলব, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলব।

আমরা এমন একটা সন্তোষজনক সমাধান খুঁজছি যাতে কাশ্মীর ভারতের মধ্যেই থেকে যায়। ভারত কাশ্মীরের জনগণের সাথে গত পাঁচ বছরে যে চূড়ান্ত ত্যাগ করেছে, তা যেন ফলপ্রসূ হয় এবং সমগ্ৰ জাতি যাতে উপকৃত হয়, এটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা। সাংবিধানিক দিকটি সম্পর্কে, আমার বন্ধু মিঃ এন. সি. চ্যাটার্জি কথা বলেছেন, এবং আমি তার যুক্তিগুলির আর পুনরাবৃত্তি করবোনা। সংবিধানের অধীনে কাশ্মীর বিধানসভার সাম্প্রতিক কাজকর্ম, এবং এই সংস্থার সুপারিশগুলি সংবিধানের নিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে সে সম্পর্কে ডঃ কাটজুর উত্তর দেওয়া উচিত। তবে আমি আপাতত সংবিধানের বাইরে বেরিয়ে কিছু বলবো।

এই তালিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হ’ল পতাকা নিয়ে। একদিন প্রধানমন্ত্রী সংবাদিক​ সম্মেলনে গণপরিষদের গৃহীত এই সিদ্ধান্তকে লঘু করার চেষ্টা করেছিলেন। শেখ আবদুল্লাহ দু’দিন আগে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, “ওহ, আমরা অবশ্যই ইউনিয়নের​ পতাকাটিকে স্বীকৃতি দেব”। ইউনিয়ন পতাকাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ইউনিয়নের​ পতাকাই সেখানে থাকবে এবং তা হ’ল স্বাধীন ভারতের পতাকা। কোনও রাজ্যের নিজস্ব পতাকা থাকার নীতিটি যদি আপনি গ্রহণ করতে চান তবে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু অসুবিধা তৈরি করেন এবং তার শেষ কোথায় সেটাও আপনি জানেন না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাশ্মীরের মহারাজের​ নিজস্ব পতাকা ছিল। আমি জানি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মহারাজদের পতাকা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব গভর্নরদের পতাকা রয়েছে। এবার আমার প্রশ্ন হ’ল: কোনও রাজ‍্যের কি নিজস্ব পতাকা থাকতে পারে? ভারতের নিজস্ব পতাকা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনও পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া কি উচিৎ? এই বিষয়ে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করা একান্ত প্রয়োজন। আমাকে যদি আমার মতামত জানাতে বলা হয় তাহলে বলবো যে একগামিতা’র নীতি অনুযায়ী সমগ্ৰ ভারতের একটিই পতাকা ব্যবহার করা উচিত। কোনোভাবেই আনুগত্য ভাগ করতে দেওয়া যাবে না। শেখ আবদুল্লাহ বলেছেন: “আমরা দুটি পতাকাকে​ই সমান গুরুত্ব দোবো”, আপনি কোনোভাবেই এটা করতে পারবেন না। এটা সমানভাবে ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্ন নয়। এটা সমমর্যাদার প্রশ্ন নয়। সমগ্র ভারতে একটি পতাকা ব্যবহারের​ প্রশ্ন, আর সেই ভারতের মধ্যে কাশ্মীরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কাশ্মীরের পৃথক পতাকা রয়েছে বলেই সেখানে আলাদা প্রজাতন্ত্র থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। এটা কোনও সামান্য বিষয় নয়। আমার কাছে বেশী সময় নেই, নাহলে, আমি গণপরিষদে পণ্ডিত নেহেরু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা থেকে কিছু বুদ্ধিদৃপ্ত উদ্ধৃতি এখানে শোনাতাম। যখন তিনি ভারতের বর্তমান পতাকাটি দেশের জাতীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি সেখানে এমন ভাষায় প্রয়োগ করেছিলেন যা আপনি কখনো এড়িয়ে যেতে পারবেন না, আত্মত্যাগ এবং পতাকাটির আসল তাৎপর্য কোনও একটা রাজ্যের নয়, ভারতের কোনো একটি বিশেষ অংশ বা অঞ্চলের জন্য নয়, পুরো ভারতের মানুষ তথা সমগ্র স্বাধীন জাতির জন্য। সুতরাং এমন একটি বিষয়ে ভারত সরকারের উচিত দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করা। জাতীয় সম্মেলনে একটি পতাকা থাকতে পারে। এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। শেখ আবদুল্লাহর যুক্তি হ’ল আমরা এত রক্ত ​​ঝরিয়েছি, অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয়েছে এই পতাকার জন্য। নিঃসন্দেহে। তারা কাশ্মীরের​ জাতীয় সম্মেলনে নিজেদের পতাকা রাখুক। এতে কারও আপত্তি নেই, তবে আপনি যখন সরকারীভাবে কাজ করবেন, সে আপনি যেখানেই কাজ করুন না কেন, সেখানে কেবল একটি পতাকাই উড়বে এবং উড়বেই, আর সেটা হ’ল স্বাধীন দেশের পতাকা, স্বাধীন ভারতের পতাকা।

যতক্ষণ না মহারাজ সম্পর্কিত প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষন ওখানে সাংবিধানিক অসুবিধা থাকবে। আপনাদের মহারাজ পদাধিকারের বিলুপ্তি ঘটানোর কোনো প্রয়োজনই নেই। এটা ভাগ্যের পরিহাস যে এই​ মহারাজা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে পাঠিয়েছিলেন যাতে শেখ আবদুল্লাহ সেখানে সাচ্ছ‍্যন্দে মহান রাজা হিসাবে রাজত্ব করতে পারেন। মহারাজা যদি কোনও কারণে কাশ্মীর থেকে পালিয়ে যেতেন, তবে ভারতীয় সৈন্যদের​ আর ওখানে পাঠানো হতোনা, আর তখন ওখানে না তো স্বাধীন ভারতের পতাকা উড়তো না মহারাজার। সেখানে শুধু উড়তো পাকিস্তানের​ পতাকা।

একজন মাননীয় সদস্য: শুধুমাত্র মহারাজার​ জন‍্যই কি পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল!

ডঃ এস. পি. মুখার্জি: মাননীয় সদস্য যা বললেন সেটা তিনি কিছু না জেনেই বলছেন। ১৯৮৮ সালের ২৭শে অক্টোবরে​ কাশ্মীরের অবস্থান ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যা এখন ইতিহাসে পরিনত হয়েছে। মিঃ জিন্নাহ্​ কাশ্মীরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা যদি আর ২৪ ঘন্টা দেরিতে আসতাম তাহলে শ্রীনগর ধ্বংস হয়ে যেত এবং কে জানে ইতিহাস তখন হয়তো অন্যভাবে লেখা হত। যাইহোক, মহারাজা চলে গেলেন। তার স্বৈরাচারী প্রশাসনের ধারাবাহিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মর্যাদা ঐ সাম্মানিক সুতোয় হাত বাঁধা অবস্থায় তিনি কাশ্মীরের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে কাজ চালিয়ে গেছেন। তবে আপনি যদি চান যে মহারাজা কোনও নির্দিষ্ট ইউনিটের সাংবিধানিক প্রধান হয়ে ভারতের কোনও অংশে যেন না থাকেন তাহলে সেই প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে, সঠিকভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে সম্পন্ন করা উচিত। চলুন বিষয়টিকে​ অন্য কোনও ইস্যু থেকে স্বতন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করি। ভারতীয় সংসদ যদি বিবেচনা করে যে ভারতের সংবিধান সংশোধন করা উচিত এবং ভারতের কোনো অংশে কোনও মহারাজার শাসন না থাকা উচিত, তাহলে আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করব। এর পক্ষে যেমন যুক্তি রয়েছে ঠিক তেমন বিপক্ষেও রয়েছে। আসুন আমরা সেইসব​ ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে দেখি এমন কোনও উপায় খুঁজে বের করতে পারি কিনা যা শেষ পর্যন্ত ভারতকে এই মহারাজের শাসন মুক্ত করবে।

রাজকুমারী সম্পর্কে – আপনি তাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই​ বলতে পারেন, তবে এই শ্বেতপত্রটি পড়ুন যা রাজ্যগুলির বিষয়ে ভারত সরকারের নীতির প্রতিনিধিত্ব করে। আশাকরি আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি সেগুলি ভুলে যাব না। ব্রিটিশরা যখন চলে গেল, তারা দুটি অদ্ভুত কাজ করেছিল। একটি ছিল দেশভাগ, এবং অন্যটি হ’ল হঠাৎ করে প্রায় ৫০০ রাজ্য থেকে সর্বভারতীয়তা প্রত্যাহার করা, যা ভারতের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ছিল। কোনও দেশকে আমাদের মতো ১৯৪৭ সালের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে বলা হয়নি। এটা কার্যত এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। দেশভাগের কারণে, বিভিন্ন বাহিনী কার্যকর হয়েছিল যাদের কথা আমার উল্লেখ করার দরকার নেই, তবে এই পরবর্তী কাজের জন্য, হঠাৎ করে সর্বস্বত্বের অবসান ঘটে এবং দেশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে ৫০০ অংশকে সার্বভৌম রাজ্য তৈরি করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে কেউ বুঝতে পারছিলো না যে কিভাবে এগোতে হবে। এবং তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের স্বাধীনতার এক মহান স্থপতি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নাম স্মরণ করা হয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক নীতিমালা ছিল প্রশংসনীয় — তিনি ছিলেন অকুতোভয়, বাস্তববাদী, নম্র, তেজস্বী এবং তিনিই এই সময়ের অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ৪৯৭ টি রাজ্যকে স্বাধীন ভারতের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি সফল হন। তারা কী কী ক্ষমতা পেলো? কেবলমাত্র তিনটি বিষয়, বৈদেশিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত— যেহেতু ব্রিটিশরা ঘোষণা করেছিল যে রাজ্যগুলি কেবলমাত্র এই তিনটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েই ভারত বা পাকিস্তানে থাকতে পারবে। এটা আমাদের সমস্যাগুলিকে বাড়ানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছিল, তবে যে কোনও ক্ষেত্রে হায়দরাবাদ, জুনাবাদ এবং কাশ্মীরকে বাদ দিয়ে এই ৪৯৭ টি রাজ্যই কেবল এই তিনটি বিষয়ের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের কাঠামোর আওতায় আসতে পেরেছিল। আজ শেখ আবদুল্লাহ ৩৭০নং অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কথা বলেছেন। সংবিধানের আওতাধীন ৩৭০-এর ইতিহাস কী? এই নির্দিষ্ট নিবন্ধটি গৃহীত হওয়ার সময়ে আমি শ্রী গোপালস্বামী আয়ঙ্গার দেওয়া ভাষণটি পেয়েছি। পুরো বক্তব্যটি শোনানোর মতো আমার কাছে সময় নেই, তবে শেখ আবদুল্লাহ যেহেতু গতকালের আগের দিন তার সম্প্রচারিত ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি গণপরিষদের জনাব গোপালস্বামী আয়ঙ্গার যা বলেছিলেন তার থেকে তিনি সনদ পেয়েছিলেন, তাই আমাদের উচিত বক্তব্যটি পুনরায় পড়া, যাতে আমাদের সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ গৃহীত হওয়ার আসল উদ্দেশ্যটি আমরা বুঝতে পারি।

ভুলে যাবেন না আগে ভারতের ছবিটা ঠিক কেমন ছিল। তখন কি এই সমস্ত রাজ্যের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের কোনো সম্পর্ক ছিল? এই তিনটি রাজ্যই কেবল এই তিনটি বিষয়ের সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে ছিল সর্দার প্যাটেলের আরও একটি দুর্দান্ত অবদান। এখানে কাওকে জোর করার কোনো প্রশ্নই নেই। তিনি নেতাদের পাঠিয়েছিলেন, কারণ ভারত সরকার তখন স্বীকার করে নিয়েছিল যে সার্বভৌমত্ব, বাকী সার্বভৌমত্ব এবং অবশিষ্টাংশগুলি এই ব্যক্তিদের হাতেই ন্যস্ত করা হবে। তিনি তাদের সাথে তর্ক করেছিলেন, তাদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সংবিধান গঠনের সময়কালে প্রায় সমস্ত রাজ্যই এগিয়ে এসেছিল এবং এক নতুন ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। সমস্ত ইউনিটের​ সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে ব‍্যবস্থা নিতে হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এখানে অনেকগুলো রাজ‍্য রয়েছে। পার্ট এ, পার্ট বি এবং পার্ট সি-এর তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলি। এবং এখন যদিও তারা সকলেই এক ছাতার তলায় এসেছে কিন্তু তবুও অনেক ধরনের অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। আমরা গত এক ঘন্টার মধ্যে দেখেছি কীভাবে এক অঞ্চল থেকে একজন সদস্য এবং অন্য অঞ্চল থেকে আরেকজন উঠে এসে নিজেদের অসুবিধাগুলি তুলে ধরেছেন। আমি অস্বীকার করছি না তাদের সমস্যাগুলকে। পার্ট বি এবং সি-এর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিল। তা হলেও তারা সবাই কিন্তু ভারতের ঐক‍্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
আর তাই যখন গণপরিষদে এই বিশেষ অনুচ্ছেদ গৃহীত হওয়ার কথা উঠেছিল তখন মাননীয় সদস্য মাঝপথে বাধা দিয়ে বলেছিলেন যে “কেন এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে শুধুমাত্র কাশ্মীরের​ জন্য”। এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে গোপালাস্বামী আইঙ্গার বলেছিলেন—
“এই পক্ষপাতিত্ব শুধুমাত্র কাশ্মীরের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য​। এইরকম​ সংহতকরণের জন্য এই নির্দিষ্ট রাজ্য এখনও প্রস্তুত হয়নি। এটা এখানে সবার আশা যে ( আশা শব্দটিকে চিহ্নিত করুন) এই তালিকায় থাকা সবাই যথাযথভাবে, এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরও এই একীকরণের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবে যেমনটি অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ঘটেছে। (চিয়ার্স) “

তাঁর বক্তব্যের পরে ‘চিয়ার্স’ শব্দটি​ রয়েছে। সম্ভবত কংগ্রেস সদস্যদের মতো, যাদের মধ্যে অনেকেই এই তিনটি বিষয় বাদে শেখ আবদুল্লাহর ভারত থেকে পৃথক থাকার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করছিলেন।

মিঃ গোপালস্বামী আয়ঙ্গার তখন এই বিষয়টিকে আরও বিস্তারিতভাবে​ ব‍্যাখ‍্যা করে প্রকৃত কারনগুলি জানিয়েছেন— প্রথমত স্বাভাবিকভাবেই, যুদ্ধ চলছে, দ্বিতীয়ত বিষয়টি সুরক্ষা কাউন্সিলের অধীনে এবং তৃতীয়ত গণপরিষদ জম্মু ও কাশ্মীরে বসবে। তারপরে আবার তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন:

“আমি হাউসকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা এখন শুধুমাত্র একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্ৰহন করতে পারি।”

তিনি আরও বলেন: “বর্তমানে অন্যান্য বিধানগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য নয়।”

তারপরে আরও​ একটি অনুচ্ছেদে রয়েছে যার জন‍্য আমি বিশেষ করে জম্মু কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মিঃ গোপালস্বামী আয়ঙ্গার বক্তব্যের​ কিছু অংশ তুলে ধরা হ’ল :

“খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার আগে আমি কাশ্মীর সরকারের যে সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম তাদের উদ্দেশ্য সংবিধানের অন্যান্য বিধানগুলির প্রয়োগ না করা নয়। তারা শুধু চায় যে এই বিধানগুলি কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত যেখানে এগুলোকে​ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যাবে, এবং যদি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জন্য এই বিশেষ শর্তগুলির প্রয়োজন হয় তবেই কেবলমাত্র এই ধরনের পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম প্রয়োজনীয় “

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনকি সেই পর্যায়েও কাশ্মীর সরকারের সদস্যরা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে যদিও কিছুটা সময় দেওয়া যেতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত তারা ভেবেছিল ভারতের সাথে একরকম সম্পূর্ণ সংহতকরণের কথা। এটাই বড় প্রশ্ন। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন বলে আমি ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। মহারাজার চিন্তাভাবনা ছিল, পতাকা ছিল​, এবং আমরা সহজেই তাঁর সাথে ডিল করতে পারি। যদিও এটা একটা তুলনামূলকভাবে ছোটখাটো বিষয় কিন্তু আমি কোনোভাবেই তাদের গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারি না। তবে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে কীভাবে কাশ্মীর ভারতের সাথে সংহত হতে চলেছে? কাশ্মীর কি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে অন‍্য একটি প্রজাতন্ত্র হতে চলেছে? আমরা কি এই সার্বভৌম সংসদকে বাদ দিয়ে ভারতের চার কোণে আরেকটি সার্বভৌম সংসদের কথা ভাবছি?

এটাই ছিল শেখ আবদুল্লাহর দাবি এবং আমরা এর বিরোধিতা করি। আমরা কি কাশ্মীরের অধিকারের কথায় আগে ভেবেছিলাম​ যে তারা ভারত থেকে কিছু নেবে এবং পরিবর্তে কিছুই​ দেবে না? অর্থ, সংস্থান, রাস্তা, সেতু সবই কি নেওয়া হবে? এটা কি শুধুই ‘দেওয়া এবং নেওয়া’ এর প্রশ্ন, নাকি শুধুই ‘নেওয়া’, পরিবর্তে কিছু ‘দেওয়া’ হবে না? এই বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর এটা নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের মনোভাব ই বা ঠিক কী? আমরা এই ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত এতটা এগিয়েছি যাতে আমরা আমাদের​ সাথে জনগণকে রাখতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ব‍্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করব। নিজের প্রশাসনিক ক্ষমতা, ইচ্ছাশক্তি এবং সর্দার প্যাটেলের মতো দৃঢ় সংকল্প প্রয়োগের​ মাধ‍্যমে এবার ওনাকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আসুন এবার একটু জানার চেষ্টা করি যে আমাদের মনের মধ্যে কী আছে। প্রথমতঃ আমরা কী চাই, আপনি যদি কেবল বাতাসের সাথে খেলতে চান এবং আর বলতে চান, “আমরা অসহায় এবং শেখ আবদুল্লাহকে তাঁর পছন্দমতো কাজ করতে দিন,” তবে কাশ্মীর হারিয়ে যাবে। আমি অত্যন্ত বিবেচনার সাথে এটি বলছি যে কাশ্মীর হারিয়ে যাবেই। অন্যদিকে, আমরা যদি মনে মনে এটা পরিষ্কার করা ফেলি যে আমরা কাশ্মীরের জন্য কোনও স্বতন্ত্র পরিকাঠামো চাই না, তাহলে আমরা কেবলমাত্র এমন এক পরিকাঠামোর কথা ভাবতে পারি যা আমাদের সংবিধানে মহান চিন্তা-চেতনার পরে বিবর্তিত হয়েছিল, তবে এইসব কিছু বাস্তবায়িত করার জন্য সবচেয়ে আগে একটি শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের কাশ্মীরের​ বন্ধুদের বোঝাতে হবে যে তাদের সুরক্ষা, আমাদের সুরক্ষা এবং আমাদের ও কাশ্মীরের জন্য যেটা মঙ্গলজনক হবে এরপর থেকে সেটাই করা হবে। কাশ্মীরের​ সাথে শুধুমাত্র​ ঐ তিনটি বিষয়ের জন্য সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটা আমরা চাই না। এই প্রসঙ্গে, আমি কেবল রাজ্য ও প্রদেশগুলিকে ভারতের সাথে সংহত করার উপায় সম্পর্কিত এবং রাজ্যগুলির বিষয়ে সরকারের নীতি সম্বলিত শ্বেতপত্র থেকে একটি ছোট্ট সূত্র উদ্ধৃত করব। এই উদ্ধৃতিটি মূলত সর্দার প্যাটেলের ভাষণ থেকে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি দাবিকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হয়েছে যেটাকে আমরাও অগ্ৰাধিকার দিচ্ছি। এই বিবৃতিতে সরকারী নীতি রয়েছে। ভারতীয় রাজ‍্যগুলির জন্য তৈরী করা নীতির শ্বেতপত্রের ২৪৩ এবং ২৪৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে:

“কংগ্রেস একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেশকে দেওয়া হুমকির বিপর্যয় এড়াতে কেবল রাজ্যগুলিতে নয়, প্রদেশগুলিতেও সমস্ত রকম রেসিড‍্যুয়ারী পাওয়ার ন্যস্ত করতে হবে। ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির মন্দার সাথে সাথে, প্রদেশগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক যতটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটাও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। রাজ্যগুলিতে এইরকম পটপরিবর্তনের মাধ‍্যমে প্রদেশগুলোর সাথে তাদের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং তাএকটি সংঘবদ্ধ পক্ষপাতমূলক​ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিনত হয়। দেশের সংস্থাগুলিকে উন্নত করা এবং জালিয়াতি বন্ধ করার মাধ্যমে কেন্দ্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে”।

এইভাবেই, ছয় বা সাত বাক্যে পুরো নীতিটি মূর্ত হয়েছে। আমি দাবি করছি যে ভারতীয় সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত মতাদর্শই জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে এক প্রান্তের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি অন্য প্রান্তের নাগরিকের চেয়ে আলাদা হতে পারে না। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর​ আওতায় থাকা দেশে ভিন্ন ভিন্ন সাংবিধানিক বিধান চলবে না, এখানে বৈষম্যের কোনও সুযোগ নেই। রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যে প্রশাসনিক এবং কার্যনির্বাহী ব‍্যবস্থা নেওয়া হবে তা প্রদেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও​ কেন্দ্র-রাজ‍্য-প্রদেশগুলোর মধ্যে সামঞ্জস বজায় থাকবে এবং তারা একক কর্তৃত্বের মধ্যে থাকবে।
ভারতের অডিটর-জেনারেলকে অবশ্যই রাজ্যগুলিতে এবং প্রদেশগুলির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং তাদের উপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। রাজ‍্য ও প্রদেশগুলি হবে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রনাধীন। রাজ্যগুলিতে উচ্চ আদালত গঠন করতে হবে যেখানে তারা প্রাদেশিক উচ্চ আদালতগুলির মতোই কাজকর্ম চলবে। ভারতের সমস্ত নাগরিক, তারা যেকোনো রাজ্য বা প্রদেশে বাস করুক না কেন একইরকম মৌলিক অধিকার থাকবে এবং একই ধরনের আইনী প্রতিকার উপভোগ করতে পারবে। কেন্দ্রের সাথে সাংবিধানিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে অবশ্যই প্রদেশগুলির সাথে সমান হতে হবে।
আমরা আমাদের যেসব নীতি ঘোষণা করেছি তাদের এবার স্থাপনা করা আবশ্যক। আপনি জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়গুলির ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে তাদের আলাদাভাবে দেখতেই পারেন। আমি এটা নিয়ে চিন্তা করছি না। তবে প্রধান কাজ এটাই হবে যে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও​ প্রযোজ্য করা। এই বিষয়ে কোনও আপস করা হবে না। সুপ্রিম কোর্টকে পুরো ভারত, জম্মু ও কাশ্মীর সহ পুরো ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল হিসাবে কাজ করতে হবে। অডিটর-জেনারেলের রিট্ জম্মু ও কাশ্মীর সহ পুরো ভারতেই কাজ করবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো​ স্বীকার করে নেওয়া উচিত। শেখ আবদুল্লাহ কে কাশ্মীরের রাজাধিরাজ​ বানিয়েছিলেন? কে শেখ আবদুল্লাহকে মহান কর্তৃত্বের​ অংশীদার বানিয়েছেন​? কারণ ভারতীয় সেনারা সেখানে গিয়ে কাশ্মীরের জনগণকে সাহায্য করেছিল। একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের মধ্যে থেকে আরেকটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে চলছে, আমরা এটা কি করছি? আমাকে এই প্রশ্নগুলো স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করা হোক? আমরা জানতে চাই যে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের অনুভূতি ঠিক কী। আমি কিছু প্রতিবেদন সেটা জানতে পেরেছি — কিন্তু সময়ের​ অভাবে আমি সেসবের বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবো না – এগুলি মূলতঃ জম্মু ও কাশ্মীরে​ বৈষম্যমূলক পদ্ধতিতে সরকারবিরোধী যে কাজগুলি চলছে বা যিনি চালাচ্ছেন সেই সম্পর্কিত। আমার পক্ষে এই অভিযোগগুলি সংসদ ভবনে প্রকাশ করা ভীষণ বেদনাদায়ক, কিন্তু আমি এটা শুধু এই কারণে করছি যাতে প্রধানমন্ত্রী অন্তত এটা নিয়ে তদন্ত করেন এবং আশা করি সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলরা এর বিরুদ্ধে​ কিছু যুক্তি দেবে বলেই এগুলি তিনি কোথাও সরিয়ে রাখবেন না বা উপেক্ষা করবেন না। তাঁকে অবশ্যই এই প্রশ্নগুলি বা অভিযোগগুলোকে তলিয়ে দেখতে হবে এগুলো কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে।

আমি যদি কিছু বিষয় উল্লেখ করতে চাই তাহলে কি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো? আমাদের সংসদ ভবন কি এটা নিয়ে ভেবে দেখেছেন​ যে ব্রিটিশ এবং পাবলিক সিকিউরিটি অ‍্যাক্টের মাধ্যমে প্রবর্তিত পুরানো ভারতীয় সুরক্ষার নিয়মনীতি যা বিশেষত এই দেশের জনগণের স্বাধীনতা নষ্ট করার জন্য লাগু করা হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত একটিও কমা বা সেমিকোলন পরিবর্তন না করেই ব‍্যবহার করা হচ্ছে, এমনকি জম্মু ও কাশ্মীরের মতো স্বাধীন রাজ‍্যেও তা চালু রয়েছে। কত শত মানুষকে এই আইনের প্রভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? তাদের কাউকে কি কোনও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল? কোনও একজন ব্যক্তিরও মামলা কি কোনও উপদেষ্টা কমিটির সামনে আনা হয়েছিল? যারা অভিযোগ করে যে মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হয় এবং কাশ্মীরের আদালতও তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না কারণ এই ব‍্যাপারে জন সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করা যায় না। জম্মু-কাশ্মীরে যে সংবাদপত্রগুলির কন্ঠরোধ করা হয়েছে এবং ভারত থেকে জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার অনুমতি নেই এমন সংবাদপত্রের অনেক নাম আমি এখানে পেয়েছি।

পড়াশুনার কি হবে? অভিশপ্ত মহারাজার সময়ে অন্তত সেখানে উর্দু এবং হিন্দি ভাষা চালু ছিল। দুটো ভাষারই সমান মর্যাদা ছিল। কিন্তু বর্তমানে হিন্দি জম্মু ও কাশ্মীর থেকে উধাও হয়ে গেছে। আর শুধুমাত্র হিন্দুস্থানেই যে দেবনাগরি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু যদি বিষয়বস্তু নিয়ে বলা হয় তাহলে তার উৎস হ’ল পারসিক উর্দু। আমি এই বইয়ের একটি অনুলিপি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে উপস্থাপন করব। আমি গত তিন দিন ধরে এই বইটি আমার বেশ কিছু বন্ধুর হাতে দেখেছি, যারা হিন্দুস্থান সম্পর্কে জানে, কিন্তু হিন্দি জানে না। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এই বইটি পড়তে পেরেছেন, যদিও এটা জম্মু কাশ্মীরের একটি বাধ‍্যতামূলক পাঠ‍্যপুস্তক। জম্মু ও কাশ্মীরে শ্রী আব্দুল্লাহর শাসনকালে হিন্দি সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি পন্ডিতজীকে এর একটা প্রতিলিপি দিতে চাই, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন কোন কোন শব্দগুলো বুঝতে আমার বন্ধুদের অসুবিধা হয়েছে। এটা একটা বই(বাধা)— আমি আনন্দিত যে আমাকে বাধা দেওয়া হ’ল— জম্মু কাশ্মীরের যে পাঠ‍্যপুস্তক সংস্থা থেকে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে, শেখ আব্দুল্লাহ সেই সংস্থার চেয়ারম্যান এবং এই সংস্থা জম্মু কাশ্মীরের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিভূ, তবুও সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো একজন সদস্যের​ও জায়গা হয়নি। দু’একজন ইউরোপীয় সদস্য থাকলেও বাকি সমস্ত সদস্যই ছিলেন মুসলিম। এই বইটির​ মূল বিষয়বস্তু হ’ল ” নারীদের অধিকার”, আওরত কো তালাক অউর খুলা লেনে কা হক হোগা

এটি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক একটি পাঠ্যপুস্তক, যেখানে জম্মু ও কাশ্মীরের নারীদের অধিকারের​ মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে — (বাধা)। অবশ্যই যাঁরা এটা চান, তাদের যতগুলো ইচ্ছে বিবাহ করতে এবং বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে (বাধা)। আপনি এটা পড়বেন এবং হজম করবেন। বিবাহ সম্পর্কিত এই বিষয়ে আমাকে বলা হয়েছে যে তারা কিছুটা চুক্তিবদ্ধ বিবাহ করেছেন আমেরিকান ভাষায় যাকে বলে ‘কমপেনিয়নেট’ বিবাহ — যেখানে আপনি স্বামী-স্ত্রী হয়ে কম সময়ের জন্য একসাথে থাকতে পারেন এবং তারপরে আলাদা হয়েও যেতে পারেন। জম্মু ও কাশ্মীরের নারীদের কাছে এটা একটা মহান অধিকার।

শিক্ষামন্ত্রী (মৌলানাআজাদ): আপনি কি জানেন যে খুলা বলতে কী বোঝায়?

ডাঃ এস পি মুখোপাধ্যায়: আমি জানি না।

মৌলনা আজাদ: আপনি সম্পূর্ণ ভুল কথা বলছেন।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: আমি এখানে তাদের হয়ে কথা বলছি যারা এই বিষয়ে জানে। আমি যদি ভুল হয়ে থাকি তবে মাননীয় মন্ত্রী আমাকে সংশোধন করবেন। তিনি এটিকে ভারতের​ শিক্ষামূলক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন! আর পাঁচ মিনিট। স্যার আমি আপনাকে সীমানা সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।

মিঃ ডেপুটি স্পিকার: মাননীয় সদস্য অনেক সময় নিয়েছেন।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: এই অধিবেশনকালে আমার আর কাশ্মীর নিয়ে কথা বলার সুযোগ হবে না, তাই আর কয়েক মিনিট সময় দেওয়ার অনুরোধ করছি।

সীমানা সম্পর্কে এখন জম্মু প্রদেশের উধমপুর জেলা হঠাৎ করে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি বছরের পর বছর ধরে একটি জেলা হিসাবেই​ ছিল এবং সেখানে হিন্দুরা​ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কিন্তু তাকে বিভক্ত করে এর একটি অংশকে কাশ্মীর উপত্যকার মুখোমুখি করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে মুসলিমরা​ সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এটা জনগণের মতামত না নিয়েই করা হয়েছে। আঞ্চলিক ভিত্তিতে যদি কোনও মতামত থাকে তবে কমপক্ষে উধমপুর জেলার যে অঞ্চলটি খুব উর্বর সেগুলি কাশ্মীর উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত করা যেতো।

শ্রী এম. শফি চৌধুরী (জম্মু ও কাশ্মীর): আমি কি জানতে পারি তিনি নতুন পাকিস্তান তৈরি করতে চাইছেন কিনা?

ডঃ এস.পি. মুখোপাধ্যায়: আমি জানি যে আমার মাননীয় বন্ধু এই প্রশ্নটি খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করলেন। তবে আমি নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। এই বিষয়ে আমি পরে আলোচনা করবো। (বাধা)

মিঃ ডেপুটি স্পিকার: মাননীয় সদস্য এই বক্তব্য মানতে চাইবেন না। কিন্তু আমি মাননীয় সদস্যকে এর উত্তর দেওয়ার একটি সুযোগ দোবো।

ডঃ এস. পি. মুখোপাধ্যায়: এখন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর​ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই (বাধা)। আমি জানি তিনি অধৈর্য হয়ে উঠছেন। আমি দুঃখিত সেইজন্য। কিন্তু আমাদের এই বিষয়ে আলোকপাত করতেই হবে। স্যার, মহারাজা গুলাব সিং লাখ লাখ টাকা খরচ করে “ধর্মার্থ ট্রাস্ট” নামক একটি ট্রাস্ট বানিয়েছিলেন। এখানে ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি, শিক্ষা এবং দরিদ্র লোকদের সহায়তা করা হত। কিন্তু এখন, সেই ট্রাস্টের অবস্থা কি হয়েছে? ট্রাস্টের​ বেশিরভাগ জমি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

সরকারী চাকরি এবং পদগুলি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করা হচ্ছে। আর কি অন্য কোন রাজ্য বা প্রশাসন আছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করা হয়? এটাই​ কি ধর্মনিরপেক্ষতা? এমনকি অফিসারদের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। একদিকে তাদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসাবে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অন‍্যদিকে তারাই আবার প্রশাসনিক পদেও বহাল থাকছেন। এইরকম তো আর কোথাও হয় না। যদি সরকারী আধিকারিকরা সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে ফলাফল যে কি হবে সেটা আশা করি বুঝতেই পারছেন।

স্যার, এই প্রসঙ্গে শরণার্থীদের​ প্রশ্ন আবার উঠে আসছে। আপনি জানেন যে আমরা এটা নিয়ে আগেও আলোচনা করেছি। জম্মু ও কাশ্মীরের হাজার হাজার হিন্দু শরণার্থী ভারতে বসবাস করছে। কেন তাদের জম্মু বা কাশ্মীরে জমি দেওয়া যাবে না? কেন বাইরের মানুষ সেখানে গিয়ে জমি কিনে বসতি স্থাপন করতে পারবে না? এটা কি বৈষম্যমূলক নীতির দিকে নির্দেশ করে না?

তারপরে আপনার পারমিট সিস্টেম রয়েছে। এবং বহিঃশুল্কের ব‍্যাপার আছে। মহারাজার সময়ের​ পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী সেখানে অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা গ্ৰহনে অনেক সীমাবদ্ধতা​ রয়েছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী কোনও ভারতীয় সেখানে গিয়ে সমানাধিকারের​ ভাগিদার হতে পারবে না এবং এই নিয়মনীতি এখনও অব্যাহত রয়েছে – কেন ভারতীয় নাগরিকদের সেই অঞ্চলে প্রবেশ ও বসতি স্থাপনের সীমাবদ্ধতা থাকবে?

শ্রীনগরে ৯ ই মে শেখ আবদুল্লাহর দেওয়া বক্তৃতার দুটি ভিন্ন সংস্করণ আমি এখানে পেয়েছি। এটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়; আমার কাছে দুটি কপিই রয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করা সংস্করণটি এবং ভারত সম্বন্ধীয় বিষয়ের সংস্করণটি অনেক আলাদা। স্বাভাবিকভাবেই এর কিছু অংশ ভারতের মানুষজন পছন্দ করবে না। এটা খুব চালাকভাবে করা হয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের​ জারি করা এই দ্বৈত কৌশলটির অনুলিপি আমার কাছে রয়েছে — একটি ভারতীয়দের​ ব্যবহারের জন্য এবং একটি বাড়িতে ব্যবহারের জন্য।

আমি আমার বক্তব্যটি আর দীর্ঘ​ করতে চাইনা কারণ আমি আমার নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেছি, তবে আমি শেষে যা বলতে চাই তা হল: এর প্রতিকার কী? বিকল্প পথ ই বা কি? সংবিধান অনুযায়ী আমরা জম্মু ও কাশ্মীরকে এই বিষয়ে কিছু করার জন্য বাধ্য করতে পারিনা যতক্ষণ না পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর তাতে সম্মতি দিচ্ছে এবং , গণপরিষদ সম্মত হচ্ছে। আমি আমার কমিউনিস্ট ভাইদের চিনি। তারা এখানে রাজাজী’র ফর্মুলাকে সমর্থন করবে। তারা মুসলিম লীগকে সমর্থন করে, পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আমি তাদের দোষ দিচ্ছিনা। আসলে আমার একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আছি যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির ডঃ কাটজু এবং শেখ আব্দুল্লাহ একইদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। গতকাল ডঃ কাটজু আমায় বলেছিলেন যে, একজনের বন্ধুমহল দেখে তাকে চেনা যায়। ডঃ কাটজু জানেন যে কমিউনিস্ট পার্টি আজ শেখ আব্দুল্লাহকে সমর্থন করছে।

শেরী মহম্মদ আকবর: আপনি একটি নতুন পাকিস্তান তৈরী করতে চাইছেন; জেলাভিত্তিক পাকিস্তান।

ডঃ এস.পি. মুখার্জি: …….. লাদাখের নেতার কাছ থেকে পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কাছে একটা চিঠি এসেছিল। মহাবোধি সোসাইটির সভাপতি থাকার দরুণ সেই চিঠির একটা কপি আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি সেখানে স্পষ্ট ভাষায় দাবি করে বলেছেন যে— যদি কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হতে না চায় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অধিকার যেন তাদের দেওয়া হয়। ভারতের সাথে যুক্ত থাকার মধ‍্যেই তাদের সুরক্ষার বিষয়টি ন‍্যস্ত আছে। ঠিক এই বিকল্পটির কথাই আমি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুকে বলেছিলাম। প্রথমতঃ একটা প্রকল্প চালু করা দরকার যেখানে কাশ্মীরকে ভাগাভাগি করার কোনো প্রশ্নই থাকবে না। আমরাও চাই না জম্মু কাশ্মীরেরকে ভাঙতে। এক্ষেত্রে শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্তানের হাতে জম্মু কাশ্মীরের যে অংশটি রয়েছে সেটা যেন জম্মু কাশ্মীরের মধ‍্যেই থাকে।

এবার যদি শেখ আব্দুল্লাহ তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলেন যে “আমি ঐ তিনটি বিষয় ছাড়া, কোনোভাবেই ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হবনা”, তাহলে জম্মু এবং লাদাখের মানুষদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিৎ যে তারা ভারতের সাথে ঐক‍্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। আমি বারবার বলেছি যে আমি ভাগাভাগি চাইনা। পন্ডিত নেহেরু যদি তাঁর সুচিন্তিত মতামত, সুনিপুণ নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ প্রভাব এবং বিশ্বাসযোগ্যতার মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের উদারতা, বিশালতা এবং গ্ৰহনযোগ‍্যতার বিষয়ে শেখ আব্দুল্লাহকে আশ্বস্ত করতে পারেন তাহলে তো ভীষণ ই ভালো হয় এবং তাতে আমারও কোনো আপত্তি থাকবে না। যদি তা না হয় তাহলে যে বিশাল সংখ্যক মানুষ ভারতীয় সুরক্ষার ছত্রছায়ায় থাকতে চাইছে তাদের কোনোভাবেই শেখ আব্দুল্লাহ’র তৈরী করা ভাগ‍্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.