পশ্চিমবঙ্গ ‘সম্প্রীতির আগ্নেয়গিরি’

সন্দেশখালির নামটা গোটা ভারতবর্ষের মানুষ এক নিমেষে জেনে গেছেন। গুলি, বোমা, মারপিট, খুন-জখম—পরিস্থিতি যে ভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে, যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ বলে মনে করছেন, তাতে সন্দেশখালি রাতারাতি নামকরা জায়গা হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই উদ্বেগের প্রকৃত কারণটা ঠিক কী, সেটা বোঝার সময় এসেছে। স্বাধীনতার অনেক দিন পর, বিশেষ করে একুশ শতকের রাজনীতি অনেকখানিই পরিচ্ছন্ন হয়েছে। এতকাল যাদের গো-বলয়। বলে ব্যঙ্গ করে আসা হয়েছে, সেই হিন্দিভাষী এলাকা, এখনও নির্লজ্জের মতো যাদের গুটকাখোর বলে চিহ্নিত করছে পাকি-দালাল তথা বাঙ্গালি’ তকমাধারী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, তাদের রাজনীতি অনেক পরিশীলিত হয়েছে। লালু-মুলায়মদের দাপটে যে জঙ্গলরাজ চলতো, এমনকী একুশ শতকের গোড়াতেও সেখান থেকে বিহার-উত্তরপ্রদেশ এখন মুক্ত।এর কৃতিত্ব অটলবিহারী বাজপেয়ীর এনডিএ সরকারের অবশ্যই প্রাপ্য। গোটা দেশের ছবিটাই এখন পাল্টেছে, ভারতবর্ষ এখনও স্বর্গের সেই দেশ হয়নি, যেখানে খুনোখুনি-জখম-হিংসা থাকবে না, কিন্তু মুড়ি-মুড়কির মতো নরহত্যা, হত্যালীলা দেশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো পশ্চিমবঙ্গ। সৌজন্যে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। বাম আমলে মানুষের লাশ পুঁতে দেওয়া হতো, কিছুদিন আগের সুশান্ত ঘোষের নরকঙ্কাল কাণ্ড সকলেরই মনে আছে। তাই খুনের প্রকৃত হিসেবটা চৌত্রিশ বছরের করা যায়নি।তৃণমূলের
এসব পোতাপুতিতে মাথাব্যথা নেই। জার্সি বদলের বিষয়টা এতদূর গড়িয়েছে যে তৃণমূল মারছে তৃণমূলকেই। আর যে বিরোধীরা তৃণমূলি সন্ত্রাসের কাছে মাথা নোয়ানি, অন্তিম সমাধানটা তৃণমূলি দুষ্কৃতীরাই করে দিয়েছে আক্ষরিক অর্থে এই মাথা না নোয়ানোদের মাথা কেটে। পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই আজব রাজ্যের স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে। সরকারি অপশাসন সত্ত্বেও রাজ্যে পালাবদল ঘটে না দীর্ঘদিন ধরে, এমনই অভিযোগে। এই অভিযোগ মিথ্যে নয়, বামেদের চৌত্রিশ বছরেরশাসনেই তা দেখা গেছে। অন্যদিকে তৃণমূলের ৮ বছরে। এ বছর লোকসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূলকে বাঙ্গলা ছাড়া করার অনবদ্য উদ্যম দেখা গেছে, ভোটের আগে এসব নেহাতই কষ্টকল্পনা ছিল।
দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষায় কোথাও পালাবদলের পালা এলে, রাজনৈতিক সংঘর্ষের মাত্রা বাড়ে এটা জানার জন্য রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। পশ্চিমবঙ্গে তাই রাজনৈতিক হানাহানি বাড়বে, এটা কাম্য না হলেও স্বাভাবিক। এর জন্য কেন্দ্র বিশেষ নজর দিতেই পারে, কিন্তু যেভাবে তাদের উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, যেভাবে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি উঠেছে তাতে পরিস্থিতি যে বেশ ভয়াবহ তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কেন এই ভয়াবহতা? কারণ উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালিতে যা ঘটেছে, তা মোটেও রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়। একটি এগিয়ে থাকা, এগিয়ে রাখা (ওটা সম্ভবত পেছনের দিক দিয়ে) বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম তো বিষয়টিকে আবার ‘মাছের ভেড়ি নিয়ে সংঘর্ষ’ ইত্যাদি বলে নজর ঘোরানোর পুরো ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
বামফ্রন্ট জমানায় আমরা একটি মহৎ শিক্ষা পেয়েছিলাম— ‘সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম হয় না। এই ‘ধর্মহীন সন্ত্রাস’ পশ্চিমবঙ্গকে কাশ্মীরের থেকেও ভয়ংকর জায়গায় নিয়ে গেছে বাম ও তৃণমূল আমলে। কাশ্মীরি পণ্ডিত আর পশ্চিমবঙ্গের মূলনিবাসী হিন্দুর মধ্যে এই মুহূর্তে কোনও তফাত নেই। দু’জনেই নিজভূমে পরবাসী। বাম আমলে রাজ্যে যথেচ্ছ অনুপ্রবেশ হয়েছে, সীমান্ত লাগোয়া এলাকায়; বামফ্রন্ট তাদের সমাদর করে ডেকে আনার পরিবর্তে নিজেদের স্থায়ী ‘ভোটব্যাঙ্ক’ গড়তে চেয়েছিল। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা তার প্রতিদান দিয়েছিল স্থায়ী বাসিন্দা হিন্দুদের বাস্তুচ্যুত করে। পরিণামে মালদা-মুর্শিদাবাদ সমেত সীমান্ত লাগোয়া এলাকাগুলিতে ‘তেনারা’ ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। বামফ্রন্টের তরী ডুবতে, তৃণমূলে আশ্রয় নিয়ে যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথি সইতে হয়’ নীতিতে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়ে, পুলিশ প্রশাসনের নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেগঙ্গা, ধুলাগড়, অশোকনগর, সাম্প্রতিক সন্দে খালি-সহ। সারা পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িকতার যে নগ্নরূপ দেখেছে, ৪৬-এ নোয়াখালির পৈশাচিকতার সঙ্গেই তার তুলনা করা চলে। সন্দেশখালির সৌভাগ্য ঘটনাটা তবু সংবাদমাধ্যমে এসেছে। নচেৎ দেগঙ্গা, ধুলাগড়, অশোকনগর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মহান কর্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম ন্যূনতম গাফিলতি দেখায়নি, অতিথি-পড়শিদের হাতে এ রাজ্যের হিন্দুদের মার খাওয়াকে তারা অতিথি সৎকারের অঙ্গ বলেই মনে করেছিল। শাক দিয়ে ক্রমশ মাছ ঢাকা দিতে দিতে শাক যে। ফুরোচ্ছে তা তাদের খেয়াল ছিল না; এখন আঁশটে গন্ধে টেকা দায়।
তবু তারই মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরক্ষার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যে হিন্দুদের আরও উদার হতে ডাক দিয়েছেন বামপন্থী তৃণমূলি বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু এলাকাবাসীরা বিপদটা বুঝছেন হাড়ে হাড়ে। এই ঔদার্যের ক্ষতটা কতটা গভীর তারা তা জানেন। কারণ নিজেদের চোখে তারা দেখেছেন সন্দেশখালির সরবেড়িয়া অঞ্চল কীভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রাসে চলে গিয়েছে। এখানকার মানুষের খেয়ে পরে এখানকার মানুষেরই দাড়ি ওপড়ানোর ব্যবস্থা মমতা প্রশাসন কীভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে করে দেখিয়েছেন তা এলাকার মানুষ জানেন। আর আমরা জানি, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া, খেতে-পরতে দেওয়া, মায় বঙ্গবাসীর সর্বনাশ করতে দেওয়ার দাবিতে বুদ্ধিজীবীরা সমস্বরে রাস্তায় নেমেছিলেন। সন্দেশখালির ঘটনার পর অবশ্য এ রাজ্যের মানুষ এঁদের অনেক খুঁজেছেন, ‘আনন্দে’কিংবা অন্যত্র যদিও বিফল হয়ে শেষে ‘হারানো, প্রাপ্তি, নিরুদ্দেশ’-এ বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে শেখ সাজাহান বলে একটি ‘মহাত্মা’ এলাকায় যেভাবে মুঘল-শাসন জারি করেছিলেন, তাতে জিজিয়া কর দিয়েও হিন্দুদের রেহাই মিলছিল না। আশপাশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত পাল্টাচ্ছে, তাতে সন্দেশখালিকে সেই ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে কাদের মোল্লা, জিয়াউদ্দিনের মতো কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী থুড়ি তার উজির-আমলাদের দিয়ে প্রদীপ মণ্ডল, সুকান্ত মণ্ডলদের খুন করিয়ে দেয়। নিখোঁজ হয় দেবদাস মণ্ডল। দেবদাসের ভাই নিমাই ছিল একনিষ্ঠ তৃণমূল-সমর্থক। মমতাকে নিয়ে গান বেঁধেছিল ‘ধন্য আমার বঙ্গমাতা, প্রণাম করি পায়ে। নিমাইয়ের আশঙ্কা মুসলমানরা তার দাদাকে খুনই করেছে। হ্যা ঠিকই পড়ছেন, দুষ্কৃতকারীদের এলাকার লোক তৃণমূল কিংবা সিপিএম বলে আর গেরাহ্যির মধ্যেই আনছে না। কারণ এই শেখ সাজাহান এককালে দাপুটে সিপিএম নেতা ছিল, এখন তৃণমূলে। সন্দেশখালিবাসী জানেন সাজাহানের মতো লোকেরা ক্ষমতার সঙ্গেই থাকে, আর কচুকাটা হওয়াটা তাদের ভাগ্যেই জোটে। কারণ সাজাহানরা ভোটব্যাঙ্ক গড়তে জানে, প্রকৃত সন্দেশখালি-বাসিন্দারা এতদিনেও সেই ভোটব্যাঙ্ক গড়ে তুলতে পারেননি। তাঁরাই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দিয়ে এলাকার হিন্দুদের এলাকা-ছাড়া করার পরিকল্পনা সাজাহানের ছিল। বাংলাদেশের জামাতিদের নিরাপদ আশ্রয়েই আপাতত এই সার্থকনামা মুঘল সম্রাটের দিন অতিবাহিত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন।
দেবদাসের ভাই নিমাইয়ের স্বীকারোক্তি অন্তত এইটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে এই সংঘর্ষ মামুলি তৃণমূল-বিজেপির সংঘর্ষ নয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দুধওয়ালা গোরু’ তত্ত্বে আজ সেই বিশেষ ‘গো-প্রজাতিটি তৃণমূলের সম্পদ হয়ে উঠেছে, তাই হিন্দুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার, যা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনিক মদত পাচ্ছিল, তা এবার বেআব্রু হয়ে প্রকাশ্যে এসেছে। সারা রাজ্যেই মমতা ব্যানার্জির ‘দুধেল গাই’থিয়োরি তার এতদিন সযত্নে ঢেকে রাখা মুখোশের আড়ালের মুখটা প্রকাশ করে দিয়েছে। ফলে একদিক ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’রক্ষা করতে গিয়ে, ‘বিজেপি-কে রুখতে তৃণমূলকে ভোট দিন’, কিংবা বিহারি হঠাও, গুটকাখোর হঠাও, হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই এক ঠাই’ ইত্যাদি যে স্লোগান মমতাদৃপ্ত বুদ্ধিজীবীরা আমদানি করেছেন, অন্যদিকে মমতা-পদলেহী সংবাদমাধ্যমেও যেভাবে ‘সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ফোস ফোস করছে, তাতে সম্প্রীতি (পড়ুন হিন্দু নিধন) রক্ষায় এঁদের পুরো চেষ্টাটাই মাঠে মারা যাচ্ছে। আর বামপন্থীদের কথা ছাড়ুন, বেচারিদের দেখলেও কষ্ট! আম-ছালা একসঙ্গে যাবার ব্যথা যে কী দুর্বিসহ, সে কেবল তারাই বুঝবেন। সে যাক, হিন্দুরাও এখন পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শিখেছে তাই কাইয়ুম মোল্লা বলে একজন মারা যায়। এর পেছনে তৃণমূলেরই ‘হঠাৎ হয়ে যাওয়া’ হাতের ছায়া স্থানীয়রা দেখছেন, যে কোনও মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু তারপরও যেভাবে হিন্দুদের সন্ত্রস্ত করতে ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও পুলিশের নাকের ডগায় সাজাহান বাহিনী সশস্ত্র বাইক মিছিল করলো, তা নিন্দনীয়।
বুদ্ধিজীবীদের দৌলতে মমতা প্রশাসনের মাথায় সুবুদ্ধি না থাক, দুবুদ্ধি যথেষ্টই আছে। সন্দেশখালির মৃতদের দেহ কলকাতায় এলে তোষণের বীভৎসতার আঁচ এসি ঘরে বসে হিসেব কষা রাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্যই পেতেন। যাঁদের অনেকে মুসলমান-দলিত ঐক্যের নামে হিন্দু সমাজকে ভাঙতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একটা খটকা তো থেকেই যাচ্ছে যে ১৯৫১ থেকে আজ পর্যন্ত (২০১৬) সন্দেশখালির সবকটা বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুরা, যাঁরা তথাকথিত পিছিয়ে পড়া (যেহেতু কেন্দ্রটি এখন তপশিলি তালিকাভুক্ত) তারাই জিতে এসেছেন, অথচ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুদের ওপরই মুসলমানদের ভয়াবহ অত্যাচার ন্যাজাট-সহ সন্দেশখালির বিভিন্ন অংশ দেখে এসেছে। কিছুদিন আগেও একদা সিপিএম নেতা কান্তি বিশ্বাসের খাসতালুক ছিল এই এলাকা অতঃপর দলিত -মুসলমান ঐক্য ঠিক জমলো কি ? সর্বভারতীয় ও প্রাদেশিক ধান্দাসর্বস্ব থুড়ি বুদ্ধিসম্পন্ন মানে বুদ্ধি ভাঙানো বুদ্ধিজীবীগণ কী বলেন ?
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.