দক্ষিণেশ্বর মন্দির পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা পৃথিবীর কাছে এক জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র। সারা ভারতে গঙ্গার ধারে যত মন্দির রয়েছে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাদের মধ্যে এক অন্যতম জায়গা করে নিয়েছে। ভাষ্কর্য্য স্থাপত্য মহিমা ইতিহাস সৌন্দর্য্য ইত্যাদি প্রতি ক্ষেত্রেই এই মন্দির বিশ্বের মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে। শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষেরাই নয়, ছোট বড় সকল রকমের মানুষ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গিয়ে এর মনোরম পরিবেশের স্বাদ নিতে সক্ষম।
হুগলী নদীর তীরে কলকাতার খুব কাছেই উত্তর ২৪ পরগণার কামারহাটি অঞ্চলে দক্ষিণেশ্বর অবস্থিত। গরীব দরদী রূপে পরিচিত রানি রাসমণি ১৮৫৫ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী কালী এই মন্দিরে ভবতারিনী রূপে অধিষ্ঠিত, কেউ কেউ একে দক্ষিণাকালী নামেও অভিহিত করে থাকে।
মূল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরটি নবরত্ন মন্দিরের আদলে গঠিত। এই আদলটি একেবারে বঙ্গীয় স্থাপত্যের একটি আদর্শ নিদর্শন। মন্দিরটি তিনতলা এবং এর মুখ দক্ষিণ দিকে, যেদিকে গঙ্গার ঘাট। উপরের দুই তলায় মন্দিরের চুড়াগুলি বসানো রয়েছে। মধ্যিখানে একটি সর্বব্ররহৎ চুড়া এবং তাকে ঘিরে আরো আটটি চুড়া। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মোট নয়টি চুড়া বিদ্যমান। একটি উত্তোলিত দালানের উপর মূল গর্ভগৃহটি নির্মিত। দালানটি ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত এবং ১০০ ফুট উঁচু। মূল মন্দিরের পাশেই বারোটি আটচালা রয়েছে, এই আটচালা গুলি পূর্বমুখী। প্রতিটি মন্দিরেই একই রকম দেখতে শিবলিঙ্গ রয়েছে। ১৮৪৭ সালে বিধবা জমিদার গিন্নী রানি রাসমণি সদলবলে কাশী যাওয়ার আয়োজন করেছিলেন, যাত্রার পূর্বে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে স্বয়ং মা কালী তাকে বলছেন যে অন্য কোথাও বা দূরে যাওয়ার দরকার নেই, গঙ্গার ধারেই মন্দির গড়ে সেখানে মা-কে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে। স্বপ্ন দেখা মাত্রি রানি রাসমণি মন্দির নির্মাণের যোগার শুরু করে দেন। জন হেস্টি নামে এক ইংরেজের থেকে ২০ একর জমি কিনে আট বছর ধরে প্রায় নয় লক্ষ টাকা খরচ করে এই মন্দির নির্মিত হয়। ১৮৫৫ সালে স্নানযাত্রার দিন মহা ধুমধাম করে এই মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির এখন বিখ্যাত হলেও এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কম নাজেহাল হননি রানি রাসমণি৷ এটা ঘটনা শ্রীরামকৃষ্ণ না থাকলে জানবাজারের রানির তৈরি এই মন্দির কতটা পাদপ্রদীপে আসত তাতে সন্দেহ রয়েছে।
তবে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রানি রাসমণি বাংলার ব্রাহ্মণ সমাজের কাছ থেকে অসহযোগিতা পেয়েছিলেন৷ তবে তাতেও তখন তিনি দমে যাননি। আত্মবিশ্বাসে ভর করে এগিয়েছিলেন ছিলেন এই নারী এবং পাশে পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণের বড়ভাই রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে৷
কথিত আছে কাশী যাওয়ার পথে স্বয়ং দেবী কালী স্বপ্নে রানি রাসমণিকে এই মন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্দিরটি তৈরি করতে তখনকার দিনে তাঁর খরচ হয়েছিল ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। ১৮৪৭-তে মন্দির নির্মাণ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৫৫সালে। ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের স্থাপত্য দেখার মতো। গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য-পদ্মের উপর শায়িত শিবের বুকে দেবী কালী দাঁড়িয়ে। এক খণ্ড পাথর কুঁদে তৈরি এই মন্দিরের দেবীমূর্তি।
জাতে রাসমণি কৈবর্ত হওয়ায় নিচু জাতের লোকের গড়া এই মন্দির এই অজুহাতে তখনকার ব্রাহ্মণ সমাজ দক্ষিনেশ্বরের তৈরি মন্দিরটিকে একেবারে বয়কট করেন। কোনও ব্রাহ্মণই রাজি ছিলেন না ওই মন্দিরের পূজারী হতে। ফলে এক জটিল সমস্যার পড়েন জানবাজারের রানি মা৷ তাছাড়াও , এখন যেখানে মন্দির, সেই যায়গাটি আগে সাহেবান বাগিচা নামে পরিচিত ছিল। এখানে একটি কচ্ছপাকার খ্রিস্টান ও মুসলমান কবরখানা ছিল, তাই তন্ত্রমতে স্থানটি তন্ত্রসাধনার উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়। তা নিয়েও কম গোলযোগ হয় নি।
এই পরিস্থিতিতে হুগলির কামারপুর থেকে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামে এক সাহসী যুবক রাজি হন এমন মন্দিরের পূজারী হতে। রামকুমারের পর অবশ্য তাঁর ভাই গদাধর এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই গদাধরই পরিচিত হন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বলে। সাধক রামকৃষ্ণের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের এই মন্দির। তাঁর সারল্য ও মানবিক বোধের সংমিশ্রণে তিনি এখানে দেবী কালিকে ভবতারিণী রূপে উপাসনা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এই মন্দিরে ছড়িয়ে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের নানা স্মৃতি যা আজ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে৷