রাধানাথ শিকদার (১৮১৩ – ১৮৭০) একজন বাঙালি গণিতবিদ ছিলেন যিনি হিমালয় পর্বতমালার ১৫ নং শৃঙ্গের (চূড়া-১৫) উচ্চতা নিরূপণ করেন, এবং প্রথম আবিষ্কার করেন যে, এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এই পর্বত শৃঙ্গটিকেই পরে মাউন্ট এভারেস্ট নামকরণ করা হয়।
হিমালয়ের কোলে মুসৌরী, দেরাদুন কিংবা এই বঙ্গের ফরাসডাঙা— সর্বত্রই তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য গল্প প্রচলিত।কথিত আছে, ১৮৫০-এর পর থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী এমন কোনও শিক্ষিত বাঙালি ছিলেন না, যাঁর কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু কাহিনি জানা যেত না। এটা অতিশয়োক্তি হলেও, সে কালে শিক্ষিত বঙ্গজন মাত্রেই গণিতশাস্ত্রে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি এবং শারীরিক বলের প্রশংসা করে থাকতেন। ব্যক্তিত্বটি সম্ভ্রমের যোগ্যও বটে। ইংরেজ বা ফরাসি হোন অথবা বাঙালি, কোনও ভাবে আলাপ হলেই তাঁকে হয় ভয়-ভক্তি করতেন, নয়তো মনে মনে পুজো করতেন। ১৮৭০ সালের ২৩ মে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় লেখা হয়— “গণিতাধ্যাপক ডাক্তার টাইটলার তাঁহাকে প্রতিভাসম্পন্ন মনে করিতেন এবং তিনি ও রাজনারায়ণ বসাক হিন্দু জাতির মধ্যে সর্বপ্রথমে তাঁহার নিকট নিউটনের প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যপাঠে প্রভূত আনন্দ লাভ করিতেন এবং মাসিক পত্রিকার জন্য প্লুটার্ক ও জেনোফেন লিখিত গ্রন্থ হইতে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি কড়া ধরনের লোক ছিলেন এবং সদ্য সদ্য কর্মনির্বাহ করিতেন এবং কার্যকারণকালে ক্ষিপ্রকারিতার ন্যূনতা তাঁহাতে কখন পরিলক্ষিত হয় নাই। রাধানাথ অসাধারণ লোক ছিলেন ও তাঁহার অনেক সদ্গুণ ছিল।” (বঙ্গানুবাদটি আর্যদর্শন পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত) আক্ষরিক অর্থেই এক বহুমুখী প্রতিভা— একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জরিপবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। তিনি ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষায় নতুন ভোর নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন, কিন্তু আজ কেবল এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা মাপকের পরিচিতিতেই হারিয়ে গিয়েছেন। রাধানাথ শিকদার মানুষটি তার চেয়ে বড়, অনেক অনেক বড়।
রাধানাথ শিকদার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের শিকদার পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তিতুরাম শিকদার ছিলেন সেকালের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ও বিবিধ সদ্গুণের অধিকারী। তাঁর মাতাও ছিলেন জ্ঞানে গুণে পিতার উপযুক্ত সহধর্মিণী। দুই ভ্রাতা ও তিন ভগিনীর সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন রাধানাথ। তাঁর ভ্রাতার নাম শ্রীনাথ। বাড়িতেই পণ্ডিতের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে রাধানাথ ভরতি হন চিৎপুরের ফিরিঙ্গি কমল বসুর বিদ্যালয়ে। পরে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। এখানে অধ্যয়নের সময় তিনি বিখ্যাত শিক্ষক ডিরোজিওর ভাবধারার বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কলেজে গণিতের অধ্যাপক ড.টাইটলারের প্রিয় ছাত্ররূপে তিনি উচ্চগণিতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ১ম ভাগে জরিপ কাজে ব্যবহৃত গণিত বিষয়ে চর্চা প্রয়োগ উদ্ভাবনে তিনি স্বকীয়তার সাক্ষ্য রেখেছেন। এইজন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি জার্মানির সুবিখ্যাত ফিলজফিক্যাল সোসাইটির ব্যাভেরিয়ান শাখার সম্মানীয় সদস্যপদ লাভ করেন ১৮৬২ সালে। গণিতে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য তার এই সম্মান প্রাপ্তি।
রাধানাথ শিকদার ভারতে তদানিন্তন ব্রিটিশ প্রশাসনের জরিপ বিভাগ সার্ভেয়র জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার দপ্তরে কাজ করতেন। তিনি ১৮৪০ সালের মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপ কাজে অংশ নেন। ১৮৫১ সালে ম্যানুয়াল অফ সারভেইং নামক সমীক্ষণ পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। পুস্তিকার বৈজ্ঞানিক অংশ রাধানাথ শিকদারের লেখা। ব্যারোমিটারে সংযুক্ত ধাতব স্কেলের তাপজনিত প্রসারণ এবং পারদের নিজের প্রসারণ জনিত, পরিমাপের ত্রূটি যা আবহমানসংক্রান্ত পাঠ প্রভাবিত করে,সেই ত্রুটি বাতিল করার জন্য ইউরোপে ব্যবহৃত সূত্র, রাধানাথের অজানা ছিল। সুতরাং রাধানাথ তার বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে, ৩২° ফারেনহাইট (০° সেলসিয়াস) এ ব্যারোমিটার পাঠ/রিডিং কমানোর জন্য, নিজের সূত্র উদ্ভাবন করেন। সূত্রটি তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে উপস্থাপন করেন। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬২ অবধি তিনি আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের ‘আবহবিদ্যা এবং পদার্থবিজ্ঞান কমিটিতে’ সদস্য ছিলেন। রাধানাথ ১৮৬২ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন, এবং পরে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজে) গণিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৫৪ সালে তিনি ও তার ডিরোজিয়ান বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্র “মাসিক পত্রিকা” নামক মহিলাদের শিক্ষাবিষয়ক পত্রিকাটি চালু করেন। তিনি প্রথাগত শৈলী ছেড়ে, একটি সহজ এবং বিশৃঙ্খলমুক্ত শৈলীতে লিখতেন।
GTS (গ্রেট ট্রিকনোমেট্রিক সারভে) সংক্রান্ত কার্যক্রমের ব্যাপারে ব্রিটিশ সংসদের বক্তব্য ছিল –
“শুধুমাত্র উপ-সহকারী নয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, উদ্যোগী এবং অনলস পরিশ্রমী মানুষেরা, যারা জরিপ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, নাগরিক প্রতিষ্ঠানের এমন গঠন করেছেন, যা আর কোথাও দেখা যায় না। তাদের সাফল্যের অংশীদার, ভারতের শিক্ষাব্যাবস্থা। এঁদের মধ্যে দক্ষতার জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হিসাবে, উল্লেখ করা যেতে পারে, বাবু রাধানাথ শিকদারের নাম, যিনি একজন ভারতীয়, যার গাণিতিক নিষ্কাশন, সর্বোচ্চ সাফল্য লাভ করেছে।”
২০০৪ সালের ২৭ জুন তারিখে ভারতের ডাক বিভাগ চেন্নাইয়ে ভারতের ত্রিকোণমিতিক জরিপের প্রতিষ্ঠার স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, যাতে রাধানাথ শিকদার ও নইন সিং এর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।
ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষায় নতুন ভোর নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন, কিন্তু আজ কেবল এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা মাপকের পরিচিতিতেই হারিয়ে গিয়েছেন। রাধানাথ শিকদার মানুষটি তার চেয়ে বড়, অনেক অনেক বড়।
রাধানাথের পরিবারের ছিল বিপুল অর্থকষ্ট। কলেজে পড়াকালীন, ১৮ বছর বয়সেই সার্ভে অফিসে চাকরিতে ঢুকলেন রাধানাথ। কলেজ পাশ করলেন পরের বছর। তিনি যোগ দিলেন ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে, পদের নাম ‘কম্পিউটার’, বেতন মাসে ৩০ টাকা। গৌরবের কথা, এই পদে সেই প্রথম কোনও ভারতীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। রাধানাথের বিস্ময়কর প্রতিভা, পড়াশোনার গভীরতা, গবেষণার ব্যাপ্তি, উদ্ভাবনী শক্তির কারণে টাইটলারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। টাইটলারই তাঁর নাম প্রস্তাব করেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্টের কাছে, যাঁর সান্নিধ্য ভবিষ্যতে রাধানাথের কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
এভারেস্ট ছিলেন ‘সার্ভেয়র জেনারেল অব ইন্ডিয়া’র সুপারিনটেনডেন্ট। রাধানাথের কাজকর্মে তিনি একেবারে মুগ্ধ। বস্তুত, রাধানাথের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, তাঁকে নিজের ডান হাত বলতেন। ১৮৩৭ সালে এক বার হিন্দু কলেজের বেশ কিছু প্রথম সারির কৃতী ছাত্র ডেপুটি কালেক্টরের পদে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন। প্রার্থী ছিলেন রাধানাথও। সে কথা জানতে পেরেই প্রমাদ গনেন এভারেস্ট। তিনি বুঝেছিলেন, রাধানাথ চলে গেলে ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের অসুবিধে তো হবেই, তবে এক ভারতীয় প্রতিভারও অপমৃত্যু ঘটবে। তিনি সরকারকে এমন ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন, যাতে এই সব ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনও দেশীয় কর্মচারী বিভাগ পাল্টাতে না পারেন। এই সূত্রে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারি করেন। রাধানাথ রয়ে যান সার্ভেতেই। কোনও কোনও গবেষকের মত, এ সময় তাঁকে চাকরিতে রেখে দিতে বেতনও বাড়ানো হয়েছিল। তবে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, ফলাফল যে তাঁর ও তাঁর দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল, এ নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহ নেই।
অবশ্য এর পরেও সার্কুলার অগ্রাহ্য করে রাধানাথ ভিন্ন চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেটা ১৮৫০ সাল, কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট পদ খালি হয়েছিল। রাধানাথ সম্ভবত কিছুটা বেশি বেতনের আশাতেই সেই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তত দিনে এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করেছেন, সার্ভেয়র জেনারেলের পদে এসেছেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনিও বলতেন, রাধানাথের মতো প্রতিভাধর, পরিশ্রমী গণিতবিদ ও জরিপবিদ পাওয়া দুষ্কর, তিনি বিভাগের সম্পদ। সরকারের কাছে তাঁর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করলেন ওয়া। সঙ্গে এভারেস্টের মতোই লিখলেন একটি প্রশস্তি চিঠি। সে যাত্রাতেও চাকরি পাল্টানো হল না রাধানাথের। এবং তাঁর সম্বন্ধে ওয়া-র এই অসীম শ্রদ্ধা বজায় ছিল চির দিন। ১৮৫০ সালের ২০ অক্টোবর ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ‘হাউস অব কমন্স’-এ একটি দীর্ঘ রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছিল ওয়া-কে। সহকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে রাধানাথের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
আসলে, ভারতে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে জরিপের কাজ করার জন্য নিজস্ব যে সব অভিক্ষেপ পদ্ধতির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন এভারেস্ট, সেগুলিরই কিছু কিছু পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ। তাই তিনি ছিলেন অপরিহার্য। পরে ১৯৫১ সালে এই সংক্রান্ত যুগান্তকারী কাজ ‘A set of Tables for facilitating the computation of Trigonometrical Survey and the projection of Maps for India’ প্রকাশিত হয়। রাধানাথের তৈরি এই টেবল সার্ভের কাজে খুবই ব্যবহৃত হত। এভারেস্ট উদ্ভাবিত ‘রে ট্রেস মেথড’-ও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ।
১৮৪৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেন এভারেস্ট, স্থলাভিষিক্ত হন ওয়া। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শৃঙ্গকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ৩১টি শৃঙ্গের স্থানীয় নামকরণও করে ফেলে সার্ভে বিভাগ। বাকিগুলি তখন সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হত। তেমনই ছিল ১৫ নম্বর শৃঙ্গ।
সালটা ১৮৫২। পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। রাধানাথ তখন ৬০০ টাকা বেতনে প্রধান কম্পিউটার পদে অধিষ্ঠিত। শোনা যায়, হঠাৎ একদিন ছুটতে ছুটতে এসে ওয়া সাহেবকে তিনি বলেন, “স্যর, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আবিষ্কার করে ফেলেছি।” সরকারি ভাবে সেই ঘোষণা হতে আরও বছর চারেক সময় লেগেছিল। বারবার হিসেবের পর ১৮৫৬ সালে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৫ নম্বর শৃঙ্গটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ। নাম দেওয়া হয় ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। বর্তমানে নেপালে অবস্থিত এই শৃঙ্গটির অবশ্য তখনই স্থানীয় একটি তিব্বতি নাম ছিল, ‘চোমোলুংমা’, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর মা’।
১০০ মাইলের মতো দূর থেকে এই শৃঙ্গের উচ্চতার বেশ কয়েকটি পরিমাপ নিয়ে যখন গড় করা হয়, তখন হিসেব আসে ঠিক ২৯,০০০ ফুট। কিন্তু এমন ‘রাউন্ড ফিগার’ সার্ভেয়ারদের ধন্দ জাগায়। তাঁরা এ-ও ভাবেন যে, নিটোল সংখ্যা দেখে জনসাধারণের মনে শৃঙ্গের উচ্চতা সম্পর্কে অবিশ্বাস দানা বাধতে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত ২ ফুট যোগ করে শৃঙ্গের উচ্চতা দাঁড়ায় ২৯,০০২ ফুট; ১৯৫৪ পর্যন্ত যা ছিল সরকারি হিসেব। পরে অবশ্য এভারেস্টের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯,০২৮ ফুট।
কিন্তু বহু দিন যাবৎ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। ১৮৮৪ সালে আর্যদর্শন পত্রিকায় যখন রাধানাথের দিনপঞ্জি ও অন্যান্য তথ্য সাজাচ্ছেন তাঁর জীবনীকার যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন উচ্চতম শিখরটির নাম ও উচ্চতা জ্ঞাত হলেও গণনাকারীর নাম ফাইলবন্দি, অর্থাৎ জনসমক্ষে অপ্রকাশিত। জীবনীকার লিখছেন, “যৌবনের প্রারম্ভে গৃহত্যাগী হইয়া সত্যের অনুসন্ধানে কর্নেল এভারেস্টের সহিত হিমালয় শিখরে শিখরে পর্যটন করিয়াছিলেন।” আর পাদটীকায় জানাচ্ছেন, “উক্ত মহাত্মার নামেই হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘এভারেস্ট শৃঙ্গ’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইনিই রাধানাথের পরম বন্ধু ও শিক্ষক ছিলেন।” রাধানাথের পরবর্তী জীবনীকার শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯০৩ সালে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ বইয়ে ‘নব্যবঙ্গ’-এর নায়ক তথা রামতনুর সুহৃদবর্গের অন্যতম রাধানাথ প্রসঙ্গে অনেক কথা লিখলেও সেখানে শৃঙ্গের কোনও উল্লেখ মেলে না। রাধানাথ প্রধান কম্পিউটারের পদে পৌঁছেছিলেন; সার্ভে সংক্রান্ত গণিতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, কর্নেল থুলিয়ার সার্ভে বিষয়ে যে বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন, তার প্রধান গণনাগুলি রাধানাথই লিখে দিয়েছিলেন— এইখানেই রাধানাথের প্রতিভা-বর্ণন সমাপ্ত হয়। ১৯১৯ সালে প্রবাসী পত্রিকায় সত্যভূষণ সেন লিখছেন, উচ্চতম শিখরের নাম কত দূর সঙ্গত হয়েছে তা বিবেচ্য, কেননা এভারেস্টের সঙ্গে এই শৃঙ্গ আবিষ্কারের সরাসরি কোনও যোগাযোগই নেই। এ প্রবন্ধ উল্লেখ করেছিল, “যে ভাগ্যবান পুরুষ প্রকৃতপক্ষে ইহাকে দেখিয়া, উহার উচ্চতা পরিমাপ করিয়া সর্বপ্রথম ইহাকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার নামানুসারে ইহার নামকরণ করিলেই যথার্থ ও সর্ববাদিসম্মত হইত।” যদিও গণনাকারীর নামটি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি প্রাবন্ধিক। কেবল এক বার প্রসঙ্গ উসকে দিয়ে লিখেছিলেন, “জানি না ঘটনাক্রমে একজন এদেশীয় লোকের পক্ষে সে সৌভাগ্য ঘটিয়াছিল কিনা এবং সে জন্যই সে বেচারার নাম একেবারে বিস্মৃতির সাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল কিনা।” শেষ অবধি ১৯২৮ সালে প্রবাসী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল সেই ‘ভাগ্যবান পুরুষ’-এর নাম। এবং ১৯৩২ সালে যোগেশচন্দ্র বাগল বিস্তারিত আলোচনা করে রাধানাথকে বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গের গণনাকারী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।
একটা দীর্ঘ সময় এভারেস্টের উচ্চতা মাপকের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। আবার সেই তথ্য জনসমক্ষে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর অবশিষ্ট পরিচয়গুলো চাপাই পড়ে গেল। জরিপবিদ রাধানাথ নিশ্চয়ই নমস্য, অগ্রগণ্য। কিন্তু তিনি যে ভারতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চারও পথিকৃৎ, তা ভুলে যাই কী করে?
১৮৭০ সালের ১৭ মে রাধানাথ শিকদার পরলোক গমন করেন।