মমতার তোষণ নীতি রাজ্যকে কোথায় ঠেলেছে এনআরএস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল

এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, তখন রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্যা মেটার পথে। হ্যাঁ, সচেতন ভাবেই ‘রাজ্য প্রশাসন’ জাতীয় শব্দ বা ‘মুখ্যমন্ত্রী’ শব্দটিকে ব্যবহার না করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম লিখছি। কারণ জুনিয়র ডাক্তারদের যাবতীয় ক্ষোভ, রাগ বা অভিমান যাই হোক না কেন, সেটা ছিল স্রেফ ব্যক্তি মমতাকে ঘিরে। ১৭ জুন তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনায় বসে এমন দরদ দিয়ে কথা বললেন, আর বয়সে নবীনরাও যেভাবে মন দিয়ে, একান্ত ভালো মানুষের মতো সব কথা শুনলেন তাতে কে বলবে গত সাত দিন ধরে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কীভাবে ডাক্তারদের হুমকি দিয়েছেন, আর জুনিয়র ডাক্তাররাও তার সঙ্গে বসা তো দূরের কথা, নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি সহ তাদের যাবতীয় রাগ উগরে দিয়েছেন।
অনেকে বলেছেন এনআরএস সমস্যা মেটাতে মমতা সাত সাতটা দিন সময় নিলেন কেন? অনেক আগেই তো আলোচনায় বসতে পারতেন। তাহলে ডাক্তারদের ধর্মঘটে বিনা চিকিৎসায় অনেক মানুষের প্রাণ যেত না। আবার কেউ জুনিয়র ডাক্তারদের ঔদ্ধত্যকেই দায়ী করেছেন, মমতা আলোচনায় ডাক দেওয়া সত্ত্বেও তারা সেই ডাক ফেরালেন কোন সাহসে? এখন সব ব্যপারেই বিজেপি-জুজু দেখানো যাঁদের স্বভাব হয়ে গিয়েছে তারা। কোনো প্রমাণ ছাড়াই বলে দিলেন এই সাহসে নাকি বিজেপির মদত রয়েছে ইত্যাদি।
আসলে মূল সমস্যা থেকে দীর্ঘকাল চোখ ফিরিয়ে আছি বলে, সমস্যা আর সমস্যা থাকবে না। তার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা ভাবলে কি আর চলে? ধরুন, আপনি কোনো সরকারি হাসপাতালে আপনার কোনো নিকট আত্মীয়কে ভর্তি করিয়েছেন, কোনো কারণে তার মৃত্যু হলে প্রাথমিক ভাবে আপনার মনে হতেই পারে চিকিৎসার গাফিলতিতেই হয়তো তার মৃত্যু হয়েছে এবং অনেক সময় এই ধরনের অভিযোগ সত্যও হয়। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ভাবে আপনি উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন, ডাক্তারদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠাও অসম্ভব নয় এবং এরকম হলে আপনার অন্য আত্মীয়রাই আপনাকে শান্ত। করার চেষ্টা করবে। শোক সামলে আপনিও হয়তো একটু শান্ত হবেন। অভিযোগ গুরুতর হলে আদালতের দরজা তো খোলা আছেই।
ইদানীং যাঁরা বাঙ্গালি বাঙ্গালি’ বলে চেঁচিয়ে প্রাদেশিকতা আর ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দেশের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টায় রত, তাদের জেনে রাখা উচিত, চিকিৎসার গাফিলতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটির নিকটাত্মীয়ের সংযত ও ভদ্র আচরণই তার বাঙ্গালিত্ব নির্ণয়ের অন্যতম মাপকাঠি। দু’লরি ভর্তি লোক নিয়ে এসে নির্বিচারে চিকিৎসকদের ঠেঙানো কিংবা দু’চোখে স্বপ্নভরা এক সদ্য যুবকের। স্বপ্নকে চির দুঃস্বপ্নে পরিণত করা কোনো বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে গণ্য হতে পারে না। তসলিমা নাসরিন বিতাড়ন থেকে রাজ্য জুড়ে। দাঙ্গা লাগানো, ঘরবাড়ি লুটপাটকে নিত্য। নৈমিত্তিক ব্যাপার করে তোলা— বাম আমল থেকে তৃণমূল আমলে যারা এই এই সংস্কৃতির আমদানি করেছে তাদের কোনো ‘বাঙ্গালি’ পরিচয় থাকতে পারে না।
জুনিয়র ডাক্তাররা ক্ষমা না চাইলে মৃতদেহ ছাড়তে চায়নি বা মৃতের আত্মীয়দের সঙ্গে দুর্বব্যহার করেছে তার জবাবে পরিবহ মুখোপাধ্যায়কে মেরে প্রায় কোমাতে পাঠিয়ে দেওয়া বা কোনোক্রমে বাঁচিয়ে তুললেও জীবনে আর তার সাঁতার না কাটা, দৌড়তে না পারা, চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্টহওয়ার আশঙ্কা এবং অনার্সে তার স্পেশ্যাল পেপার সার্জারি থাকলেও তিনি আর সার্জেন হতে পারবেন না— এই পরিস্থিতি রাজ্যকে কতটা ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দিতে পারে, যাঁরা জীবন দান করেন তাদের জীবনকে বিঘ্নিত করা কতটা বিপজ্জনক তা যে কেউ বুঝবে না।
যে মুখ্যমন্ত্রী এই গুন্ডাদের (খুব দুঃখিত, হামলাকারীদের বর্ণনায় এর চাইতে আর ভালো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা) সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারেন, কী এমন ইনজেকশন দিল যে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল’,তাঁর কাছে। আক্রান্তরা আর কী আশা করবেন। একটি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাতেও ধর্মঘটের রাস্তায় যেতে হলো তাদের। তবে লক্ষণীয়, মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় এই ‘দুধেল গোরু’-র সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন যেভাবে এককাট্টা হয়ে হামলা চালিয়ে, পরে নামকাওয়াস্তে তার নিন্দা করে। বা না করে অসুস্থ মানুষের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মানুষের। মধ্যে ঘৃণা ছড়াতে ব্যস্ত থাকেন শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে, তখন বোঝাই যায়, রাজ্যের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।
আর হবে নাই বা কেন? যিনি মুখ্যমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকেও ভোটের ফলাফল দেখে বিন্দুমাত্র হায়াবোধ না রেখে বলে দিতে পারেন, যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথি খাওয়াও ভালো’– তোষণনীতির পরিণাম ও ভয়াবহতা এখন পরীক্ষিত সত্য। এই মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যবাসী আর কণামাত্র বিশ্বাস করে না, কারণ তাঁরা বুঝতে পারছেন। রাজ্যে সাধারণ মানুষের লাশের পাহাড় উঠলেও ক্ষমতা বজায় রাখতে ইনি তোষণ চালিয়েই যাবেন। আর জুনিয়র ডাক্তাররা তো ভুক্তভোগী, তারা কেমন করে এনাকে বিশ্বাস করবেন।
এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি যে কতকাল চলবে এখনই প্রেডিক্ট করা সম্ভব নয়। তবে এর নিরসন দ্রুত প্রযোজন, নইলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। আজ জুনিয়র ডাক্তার, কাল পুলিশ, পরশু আইনজীবী কেউ না কেউ আক্রান্ত হবেনই দলমত পেশা নির্বিশেষে।
বিশ্বামিত্রের কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.