মহর্ষি দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা যেসব উজ্জ্বল মনীষীর আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর একজন অগ্রগণ্য। শিক্ষাবিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখনীয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের একজন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পিতা। প্রথম জীবনে জমিদারি দেখাশোনা করলেও পরবর্তী কালে সংসারজীবন বা ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে নিজেকে নিষ্পৃহ করে তোলেন। পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে অনেকটাই দূরে রাখেন। মহাভারত, উপনিষদ, পাশ্চাত্য দর্শন, ভারতীয় দর্শন সহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু করেন। সেই অধ্যয়ন ও নানাবিধ তত্ত্ব আলোচনার জন্য গড়ে তুলেছিলেন তত্ত্বরঞ্জনী সভা। যা পরে `তত্ত্ববোধিনী সভা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের অনুসারী হয়ে ওঠেন। রামমোহন প্রবর্তিত অ্যাংলো হিন্দু কলেজে পড়তে-পড়তেই ধর্মচর্চা ও দর্শনে গভীর মনোনিবেশ করেন।
ভারতীয় সমাজে যে নতুন এক ধরনের ভাবনায় ব্রাহ্মধর্ম গড়ে উঠেছিল সেই ব্রাহ্মসমাজের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব গ্রহণের পাশাপাশি উদ্যোগী হন পত্রিকা প্রকাশনে। তাঁর অর্থানুকূল্যে এবং অক্ষয় দত্তের সম্পাদনায় বের হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। দীর্ঘদিন এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ব্রাহ্মধর্ম ছিল মূর্তি পূজার বিরোধী। তাই সে সময় ব্রাহ্ম মন্দিরে পূজা-পার্বণাদির পরিবর্তে প্রচলন করেন ‘মাঘোৎসব’, ‘নববর্ষ’, ‘দীক্ষা দিন’ নামে নানা অনুষ্ঠান। ব্রাহ্মসমাজে বা ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন আজও মাঘোৎসব পালন করে থাকেন। উপনিষদ ও অন্যান্য ধর্মীয় ভাবনা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গ সাধনা ও উপাসনার জন্য খুঁজে নিয়েছিলেন বীরভূমের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড যা ভুবনডাঙা নামে খ্যাত। সেই ভুবনডাঙাই বর্তমানে শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ এখানেই গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধী হয়েও বিধবা বিবাহে উৎসাহী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। শিক্ষাবিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৮১৭ সালের ১৫ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মাতা দিগম্বরী দেবী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কনিষ্ঠ পুত্র।
ঠাকুর পরিবারের আদি পদবী কুশারী এবং আদিনিবাস অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কুশ নামক গ্রামে। এঁরা হলেন রাঢ়ী গোত্রীয় ব্রাহ্মণ৷ রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ঠাকুর পরিবারের বংশপরিচয় দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,
“ কুশারীরা হলেন ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত; দীন মহারাজ ক্ষিতিশূরের নিকট কুশ নামক গ্রাম (বর্ধমান জিলা) পাইয়া গ্রামীণ হন এবং কুশারী নামে খ্যাত হন৷ দীন কুশারীর অষ্টম কি দশম পুরুষ পরে জগন্নাথ৷ ”

দেবেন্দ্রনাথ ১৮২৩-২৫ সাল পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। ১৮২৭ সালে তিনি রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি পিতার বিষয়সম্পত্তি ও ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি দর্শন ও ধর্মচর্চা শুরু করেন। ১৮৩৮ সালে পিতামহীর মৃত্যুকালে তাঁর মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ধর্মবিষয়ে আগ্রহী হয়ে মহাভারত, উপনিষদ ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন শুরু করেন। এর ফলে পার্থিব বিষয়ের প্রতি তাঁর বীতস্পৃহ জন্মে এবং তাঁর মধ্যে ঈশ্বরলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। তত্ত্বালোচনার উদ্দেশ্যে তিনি ‘তত্ত্বরঞ্জনী সভা’ (১৮৩৯) স্থাপন করেন, পরে যার নাম হয় তত্ত্ববোধিনী সভা । এ সময় তিনি কঠোপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন (১৮৪০)।
১৮৪২ সালে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরের বছর তাঁরই অর্থে এবং অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকায় দেবেন্দ্রনাথকৃত বৃত্তি ও বঙ্গানুবাদসহ উপনিষদ প্রকাশিত হতে থাকে। দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য সভায় বেদপাঠও শুরু হয়। ১৮৪৪ সালে দেবেন্দ্রনাথ প্রথম ব্রহ্মোপাসনা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন এবং পরের বছর থেকে তা ব্রাহ্মসমাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। দীর্ঘ শাস্ত্রচর্চার ফলে তিনি উপলব্ধি করেন যে, শুধু উপনিষদের ওপর ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব নয়। তাই ১৮৪৮ সাল থেকে তিনি ক্রমাম্বয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ঋগ্‌বেদের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা ব্রাহ্মধর্ম (১৮৬৯) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালে তাঁর অপর গ্রন্থ আত্মতত্ত্ববিদ্যা প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৮৫৯ সালে ব্রাহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন।
দেবেন্দ্রনাথ পূজা-পার্বণাদি বন্ধ করে ‘মাঘ উৎসব’, ‘নববর্ষ’, ‘দীক্ষা দিন’ ইত্যাদি উৎসব প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে তিনি বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামে একটি বিশাল ভূখণ্ড ক্রয় করে আশ্রম স্থাপন করেন। এই আশ্রমই আজকের বিখ্যাত শান্তিনিকেতন । এছাড়াও তিনি হিন্দু চ্যারিট্যাবল ইনস্টিটিউশনের বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ কিছুদিন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৫১ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হলে তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের চৌকিদারি কর মওকুফের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত একটি পত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ বিধবাবিবাহ প্রচলনে উৎসাহী ছিলেন, তবে বাল্য ও বহু বিবাহের বিরোধী ছিলেন। শিক্ষাবিস্তারেও তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতীয় যুবকদের রক্ষার জন্য ১৮৬৭ সালে রাধাকান্ত দেব তাঁকে ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ ও ব্রাহ্ম সমাজ ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তার জীবনাবসান ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.