আপনারা ভারতীয় জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিশ্বময় ক্ষোভ দেখেছেন। বিশ্বের মিডিয়া জাতিভেদ ও সামাজিক বহিষ্কার প্রথা নিয়ে কীভাবে ভারত ও চীনের মধ্যে বাছাই খবর করে:
সামাজিক স্তরবিন্যাস (hierarchies) ও সামাজিক চ্যুতি/বহিষ্কার (exclusions) সব সমাজেই রয়েছে। পূর্ব–আধুনিক সমাজে সে সব ছিল মূলত জন্ম ও গোষ্ঠী ভিত্তিক। সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসার ও ঔপনিবেশিক দারিদ্রায়ণের ঐতিহাসিক কারণগুলো এই উচ্চ–নীচ স্তরবিন্যাসকে হয় নমনীয় অথবা অনমনীয় করেছে।
কিন্তু একমাত্র ভারতের ক্ষেত্রে এই সামাজিক ভেদাভেদ শুধুমাত্র হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দেখানো হয়, যেন এগুলোই ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি।
নিরপেক্ষ মিডিয়া, অধ্যয়ন ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে দেখা যায় ‘জাতিপ্রথা’ হল সামাজিক স্তরবিন্যাস ও বৈষম্যের নানাবিধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি।
‘জাতি’ ও ‘বর্ণ’ এগুলোর ভালো মন্দের সঙ্গে ঐতিহাসিক গতিবিদ্যার মূলগত অসম্পূর্ণতা নিয়েও আলোচনা করব। এগুলোই আরও হিংসাত্মক এবং বেশ কিছু সংস্কৃতির নির্ধারক, কিন্তু মিডিয়া সেসব সুকৌশলে এড়িয়ে যায়।
এই ঘটনাগুলো বিবেচনা করুন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক জন ফ্লাওয়ার (John Flower) ও তাঁর স্ত্রী এশিয়ার একটি গ্রামীণ উৎসবে গিয়েছিলেন। প্রত্যন্ত এলাকা। ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়ে তাঁদের গাইড হিসাবে নিযুক্ত ছিল।
দিনের শেষে তাঁরা ঠিক করেন গ্রামের পশু পালন কেন্দ্র দেখবেন। সেখানে যেতে আধিকারিকরা তাঁদের চেয়ারে বসতে দিল। সেই দম্পতি গাইড মেয়েটিকেও বসতে বলায় সে কৃতার্থ হয়ে গেল। কিন্তু সে বসা মাত্র একজন আধিকারিক তাকে চেয়ার থেকে তুলে দিয়ে জোর করে দাঁড় করিয়ে রাখল। অফিসার নিজে এমনভাবে কথা বলে যেতে লাগল যেন কিছুই হয়নি।
পরে যখন সেই দম্পতি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন, তারও ভাবান্তর নেই। শেষে বিড়বিড় জবাব দেয়, “আমরা ছোট জাতেরা সবসময় এমন ধারা আচরণ পেয়ে থাকি।”
ঘটনাটা কোথাকার প্রশ্ন করা হলে যে কেউ নির্দ্বিধায় ভারতের নাম করবে এবং হিন্দুত্বকেই দায়ী করবে। কিন্তু ঘটনাটা ছিল ১৯৯২ সালে চীনের পশ্চিম সিচুয়ান প্রদেশের (Western Sichuan province of China) ছোট্ট একটি শহর ইয়ান (Ya’an)-এর। ইয়াও সুহাই (Yao Suhai) ফ্লাওয়ার দম্পতিকে জানিয়েছিল, “আমরা কৃষকরা (nongmin) এমন আচরণই পেয়েই অভ্যস্ত।”
ঘটনাটা কোনও হিন্দু গ্রামে ঘটলে হয়তো Frontline বা Outlook-এর মতো পত্রিকার পাতায় পৌঁছে যেত। ফ্লাওয়ারকে জয়পুর থেকে থিরুবনন্তপূরম পর্যন্ত ডজন ডজন সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হতো ভারতীয় সংস্কৃতির বিশারদ হিসাবে।
কিন্তু ঘটনাটা যেহেতু চীনের, তাই ১৯৯২ সালে শুধুমাত্র ফ্লাওয়ারের ফীল্ড নোটে উল্লিখিত হয় এবং ২০০১ সালে অ্যাকাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয় এই নামে – “Post-Socialist Peasant? Rural and Urban Constructions of Identity in Eastern Europe, East Africa and the Former Soviet Union” (Ed D Kaneff, Springer, 2001).
পরিকল্পিত ব্যবস্থা (The Designed System)
অন্যান্য পূর্ব–আধুনিক সমাজের মতোই চিরাচরিত চীনা সমাজের নিজস্ব সামাজিক বৈষম্যের রীতি আছে। এর নাম ‘হুকোউ’ বা ‘হুজি’ (Hukou/Huji)। এই রীতি অনুযায়ী জন্মসূত্রে কারও স্থান, ভূমিকা ও সম্পদ নির্ধারণ করে দেয় সমাজের কর্তাব্যক্তিরা। ব্যবস্থাটি চরিত্রগতভাবেই কৃষকদের প্রতি বৈষম্যপ্রবণ, যাদের সনাতন ভারতীয় পরিভাষায় ‘শূদ্র’ বলা হয়।
এই রীতি কৃষকদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা পরিষেবা ও ভদ্রস্ত জীবনযাপন নিতান্ত সীমিত করে রাখত। তবে অধিকাংশ চিরাচরিত প্রথার মতোই এই ব্যবস্থাতেও আধুনিকতা আসে। মাও আসার আগে (pre-Mao China) এতেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল।
প্রত্যাশিত ছিল মাও জ়েদং (Mao Zedong)-এর মতো মহান বিপ্লবী বুঝি হুকোউ প্রথার বিলোপ ঘটাবে। কিন্তু মৌখিক সমাজবাদ ও সাম্যবাদের সঙ্গে বেপরোয়া স্টালিনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা সত্ত্বেও মাও আদতে এই হুকোউ প্রথাকে আরও সুদৃঢ় করে তুললেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও পার্টির অভিজাত শ্রেণীর মুনাফার স্বার্থে।
শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে চাষীরা গ্রাম ছেড়ে শহরাঞ্চলে যেতে শুরু করে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সেটা পছন্দ হল না। মাওবাদীরা ঐতিহ্যের প্রতি বাহ্যিক ঘৃণা প্রদর্শন করলেও দলের নেতারা কিন্তু প্রাচীন চীনা পণ্ডিত গুও টিংলিং (Guo Tinglin)-কে নির্দ্বিধায় উদ্ধৃত করে বোঝাতে লাগল, জনগণ গ্রামে থাকলেই সুস্থিতি থাকে, আর শহরে ভিড় করলে অরাজকতা তৈরি হয়: “When the masses dwell in the villages, order prevails; when the masses flock to the cities, disorder prevails”.
প্রাথমিকভাবে এই ব্যবস্থা ছিল একজনের জন্মস্থান কোথায় তার ভিত্তিতে। ১৯৫৯ সাল থেকে এই ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াল জন্মের ভিত্তিতে এবং বসবাসের অধিকার হয়ে দাঁড়াল উত্তরাধিকার ভিত্তিক। মাও জমানার কৃষক–বিরোধী মাস্টারস্ট্রোক হল উত্তরাধিকার আর পৈতৃকসূত্রে (patrilineal) রইল না, হয়ে গেল মাতৃসূত্রে (matrilineal)।
ঐতিহাসিক অধ্যাপক গ্লেন পিটারসন (Professor Glen Peterson) ব্যাখ্যা দিলেন: হুকোউ ব্যবস্থাকে মাতৃ বংশের ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে পরিযায়ী বাপেদের শহরে গিয়ে সন্তানের সামাজিক অবস্থান উন্নত করার সুযোগ দূর করা গেল।… হুকোউ রীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছিল রাষ্ট্র পরিবেশিত যাবতীয় পণ্য ও পরিষেবা যেমন স্কুলে পড়া, খাদ্য, বাসস্থান, পেশা, বিভিন্ন উপভোক্তা পণ্য ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া না দেওয়া নির্ধারণের প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি। ১৯৫৯–৬১ সালের ব্যাপক খরার পর চীনের নেতারা কৃষিকাজকে আইনি ও পাকাপাকিভাবে জমির সঙ্গে যুক্ত করে দেশের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ফেলল। [The Power Of Words: Literacy And Revolution In South China, 1949-95, Pages 121-2]
সুতরাং খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মান থেকে পেশার ধরণ – যাবতীয় পণ্য ও পরিষেবা লাভের শর্ত হয়ে গেল জন্মভিত্তিক, যেখানে কারও জীবনযাত্রার মানে কোনও উন্নতি লাভের কোনও সম্ভাবনা রইল না। পুরো সামাজিক বিভাজনটাই হয়ে দাঁড়াল বংশানুক্রমিক (birth-based division). সবে ১৯৯৮ সাল থেকে হুকোউ উত্তরাধিকার জন্মদাতা বা দত্তক পিতার তরফ থেকে করা হয়েছে (“by the biological or adoptive father’s hukou”)।
কাঙ্খিত প্রভাব (The Intended Impacts)
জন্মসূত্রে সামাজিক বিভাজনের শিক্ষায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভারতে মাওবাদী–মার্কসবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী মনু ও হিন্দুত্বই গণ সাক্ষরতা প্রসারের একমাত্র বাধা, যেটা মোটেও সত্য নয়। চীনে এই মাওবাদীরাই অবিকল একই কাজ করেছিল আরও ভয়াবহভাবে।
পিটারসন (Peterson) লিখেছেন:
১৯৪৯–এর পর শিক্ষা ব্যবস্থার এই চিরাচরিত উপাদানগুলো হয় দূর হয়ে গিয়েছিল কিংবা অনেক চাপা পড়ে গিয়েছিল। (কিন্তু পরে) শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের নিন্দা করে তাদের পূর্বতন সামন্ততান্ত্রিক প্রথার পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়।… হুকোউ ব্যবস্থায় স্কুলগুলো তৈরি করা হতো শহরাঞ্চলে গ্রামের উৎপাদক শ্রেণীর নাগালের বাইরে।
পিটারসন বলেছেন চাষী হুকোউ–এর সন্তানরা মাত্র তিনটি উপায়ে সাক্ষরতা লাভ করতে পারত:
এক যারা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবে, দুই যারা সেনাবিভাগে যোগ দেবে, এবং তিন রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় ব্যবস্থার (state school system) মাধ্যমে। এই তিনটির মধ্যে তৃতীয় পদ্ধতিতে স্কুলে পড়ার নিদর্শন সবচেয়ে বিরল। সাক্ষরতা ও শিক্ষা সমাজ জীবনে অগ্রগতির উপায়, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ রাখা হয় সীমিত উৎপাদক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে। (P.123)
শিক্ষা ব্যবস্থায় এই বর্ণবৈষম্য (apartheid) শাখা বিস্তার করেছে আর একটি ঐতিহাসিক কারণে। ঐতিহ্যগত প্রথায় যেখানে সামাজিক বৈষম্য করা হতো প্রান্তিক ও সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত মানুষদের প্রতি, সামাজিক বহিষ্কার সমগ্র জনসাধারণকে প্রভাবিত করত না। কিন্তু People’s Republic of China (PRC) গণ প্রজাতন্ত্রী চীনে এই ব্যবস্থা পরিকল্পিত ও প্রযুক্ত হল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার জন্যই। Sam Nunn School of International Affairs-এর অধ্যাপক ডঃ ফী–লিং ওয়াং (Dr Fei-Ling Wang), যাঁকে চীন থেকে বেনামে সাক্ষাতকার দিতে হয়েছিল হুকোউ প্রথার ওপর তাঁর লেখা বইটির জন্য দেখিয়েছেন: চীনের প্রাচীন হুকোউ প্রথা কাজ করত আপাত সাংগাঠনিক বৈষম্য (quasi-institutional exclusion) হিসাবে। অবস্থান ভিত্তিক জন স্থবিরতার সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে হুকোউ নির্ধারিত হতো। যেমন উচ্চবর্গের হুকোউ, সাধারণ মানুষ (মূলত কৃষক) এবং দাস, যাযাবর (floaters), হতদরিদ্র বা গণিকা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন অস্পৃশ্য নিম্ন বর্গের মানুষ।
শেষ দুই রাজবংশ মিং ও কুইং (Ming and Qing) এদের আমলে সাধারণ মানুষেরও চার প্রকার বংশানুক্রমিক হুকোউ শ্রেণী ছিল: সেনা, কৃষক, বণিক ও হস্তশিল্পের কারিগর। তাদের সমান আইনি অধিকার ছিল, তবে করের বোঝা, সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার তথা স্থানান্তরণের অধিকারে প্রায়ই পৃথক ও নমনী নীতি গৃহীত হতো। বহু নিম্ন বর্গের শ্রেণীগুলো এই সুবিধা পেত না।… বর্তমান সমাজতন্ত্রী চীনের (PRC) হুকোউ ব্যবস্থার মতো প্রাচীন রীতি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নয়, শুধু সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত সংখ্যালঘু প্রান্তিকদের বঞ্চিত করত। [Organizing Through Division And Exclusion: China’s Hukou System, Stanford University Press, 2005, Page 39]
ভারতে যেখানে সমস্ত স্তরের কাছেই মুক্তি ও সত্যানুসন্ধানের জ্ঞান রয়েছে, সেখানে চীন দেশে তা শুধু সরকারি কর্মী তৈরির কাজে সীমিত, অনেকটা মেকলে (Macaulay)-র “education for creating clerks” নীতির অনুরণন যেন। চীনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও খারাপ। নৃতাত্ত্বিক সুলামিথ পটার (Sulamith Potter) ও জ্যাক পটার (Jack Potter), যাঁদের পিটারসনও উদ্ধৃত করেছেন, নিজেদের “China’s peasants: The anthropology of a revolution” (Cambridge University Press, 1991) নামের বিশদ অধ্যয়নে ব্যাখ্যা করেছেন: সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রতিতে মাওইস্ট জ়েংবু (Maoist Zengbu) ছিল আসলে আমলাতান্ত্রিক সামন্ততন্ত্র (Bureaucratic feudalism), যেখানে পার্টি ক্যাডাররা কৃষকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে একটি স্থবির দলভুক্ত করে ফেলেছিল। আইনি উপায়ে ভৌগোলিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা দ্বারা কৃষকদের শহরবাসীদের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন রাখা হতো। কেউ চাষী হিসাবে জন্ম নিলে তাকে আজন্ম চাষীই থেকে যেতে হতো যার নিজের দল ছেড়ে বেরোনোর উপায় ছিল না।
মাওয়িস্ট আমলাতান্ত্রিক সামন্ততন্ত্রের কৃষি–শ্রমিক (Maoist bureaucratic serfdom) তৈরির সঙ্গে ইওরোপের ধ্রুপদী সামন্ততান্ত্রিক কৃষি–শ্রমিক বা ভূমিদাস (serf) প্রথার কাঠামোগত সাদৃশ্য খুব পরিষ্কার। মাওয়িস্ট কৃষকদের একটি নিজের গোষ্ঠীর সঙ্গে কষে বেঁধে রাখা হতো ঠিক যেভাবে সামন্তযুগে ইওরোপে কৃষি–দাসদের আটকে রাখা হতো। এভাবে কৃষককে তার জমি ও কৃষি গোষ্ঠীর সঙ্গে আটকে রাখার ফলে মাওয়িস্ট রাষ্ট্র কার্যত চাষীদের সামন্তযুগীয় ভূমিদাস তৈরি করেছিল, যেখানে কৃষকের কৃষি উৎপাদন ওপর থাকত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে; যেখানে মুক্ত সমাজের আগেও চাষীর নিজের উৎপাদনের ওপর অধিকার ছিল, অধিকার ছিল গ্রাম ত্যাগ করে যাওয়ার।(Emphasis Not In The Original)
চীনে যেটা হয়েছে তা ভারতের মতো সামাজিক স্তর বিন্যাসের বিবর্তন তথা বিলোপ নয়, যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতিকেই নানা সংস্কার, আইন ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মুক্ত পরিবেশে বদলে ফেলা হয়েছে। চীনে মাওয়ের আমলে যেটা হয়েছে, তা হল সামাজিক বৈষম্যের একটা আরোপিত কাঠামো, যা পরিকল্পিত হয়েছে অভিজাত সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধির জন্য।
বিশ্ব রোষের বিস্ময়কর অভাব (The Curious Case Of Missing Global Outrage)
যদি একই সময়ে, ধরা যাক ১৯৮০–র দশকে ভারত ও চীনের তুলনামূলক অধ্যয়নগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে ভারতীয় জাতিভেদ প্রথাকে বারবার চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে হুকোউ প্রথার উল্লেখ কদাচিত পাওয়া যায়। যেমন Comparative Education Review (August 1984) জার্নালে প্রকাশিত রবার্ট আর্নভের (Robert Arnove) লেখা একটি গবেষণাপত্র “Chinese and Indian education systems”। লেখাটায় ভারতীয় প্রেক্ষিতে জাতিপ্রথা ২৮ বার উল্লিখিত, যেখানে চীনের হুকোউ–এর কোনও উল্লেখই নেই। যদিও সেই প্রবন্ধে ক্যাডার ও নন–ক্যাডারের বিভাজন এমনকি শহরে উন্নততর শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা আছে, কিন্তু জন্মসূত্রে ভূমিদাস করে রাখা ‘হুকোউ’ প্রথার কথা একবারও উল্লিখিত হয়নি।
২০০৮ সালে পল্লবী আইয়ার, যিনি ‘The Hindu’ সংবাদ পত্রটির চীনের ব্যুরো চীফ হিসাবে কর্মরত ছিলেন, তিনিও কোনওদিন হুকোউ নিয়ে একটি কথাও বলননি। ওয়াকিবহাল মহলের খুব ভালোমতো জানা ও যথেষ্ট নথিকৃত এই দানবিক প্রথা নিয়ে দু একটি মিডিয়া রিপোর্ট ছাড়া আর কোনও আলোচনাও হয় না। জাতিভেদ ই ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে অধ্যয়ন তো পশ্চিমী দুনিয়ার ‘দক্ষিণ–পূর্ব এশীয়’ শাখার বলতে গেলে অন্যতম কুটির শিল্প হয়ে গেছে। তেমন উদ্যোগ কিন্তু হুকোউ প্রথা ঘিরে তৈরি হয়নি। অথচ বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে হুকোউ প্রথা জাতিভেদ প্রথার মতোই মানব সম্পদের পক্ষে ক্ষতিকর।
২০১৫–য় করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নীচু তলার হুকোউদের দাবিয়ে রাখার ফলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত মান ও স্থান নেমে যায় (“Social identity and inequality: The impact of China’s hukou system”, Journal of Public Economics, Vol 123, March 2015). এই সমীক্ষার ভিত্তি ছিল আর একটি সমীক্ষা যাতে দেখা যায় নীচু জাতের পরিচিতিকে দমিয়ে রাখলে ভারতে ছাত্র সমাজের মান কমে যায়।
যদিও এই অধ্যয়নগুলো দেখাচ্ছে হুকোউ প্রথা ও জাতিভেদ প্রথা দুটোই মানুষকে সমানভাবে প্রভাবিত করছে, কিন্তু দুটোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফারাক আছে। ভারতে সমাজ সংস্কারকরা, সমাজ নিজে সামগ্রিকভাবে ও রাষ্ট্র জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেখানে চীনে এই ভেদাভেদের নকশা রাষ্ট্র নিজেই বানাচ্ছে ও বাস্তবায়িত করছে। অধ্যাপক ওয়াং দেখিয়েছেন, হুকোউ সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় স্তরে দেশজুড়ে অনমনীয় বৈষম্য পুষে রাখার জন্য। “as the basis for a nationally uniform institutional exclusion with a scope, rigidity, effectiveness, and resilience rarely seen elsewhere.”
ডেক্সটর রবার্টস (Dexter Roberts) তাঁর বই The Myth of Chinese Capitalism–এ দুই দশক ধরে বেজিং কেন্দ্রিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যে পর্যবেক্ষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে কেন্দ্রীয় হুকোউ ব্যবস্থার মাধ্যমে চীনের বর্তমান সাফল্য এসেছে। পরিযায়ীদের শহরে নিম্নবর্গীয় করে রেখে হুকোউ প্রথা চীনের নম্র ও সস্তা শ্রমের প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। স্থানান্তরিত শ্রমিকদের আইনি ও অন্যান্য সম্পদে অধিকার খর্ব করে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় অতি কষ্টে খুব কম পারিশ্রমিকে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিরন্তর খেটে যেতে। এটাই চীনের গত কয়েক দশকে দ্রুত গড় জাতীয় উৎপাদন (GDP) বৃদ্ধির রহস্য। চ্যান (Chan) লিখেছেন চীনের এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে সম্ভবত এ ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখাটাই কারণ।
তাই গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান বলি দিয়ে অভিজাত শহরবাসীর জন্য সস্তায় কাঁচা মাল ও খাদ্য নিশ্চিত করার নীতি, একদা কেন্দ্রীয় শিল্পায়ন বর্তমানে নতুন ভূমিকা খুঁজে পেয়েছে – যাতে বর্তমান যুগের জন্য চীনের হাতে সব সময় শ্রম ভাণ্ডার মজুত থাকে। হুকোউ প্রথা কাজে লাগিয়ে সুদীর্ঘ সময় খাটিয়ে শ্রমিক নিপীড়ন দ্বারাই চীনের রপ্তানি কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সাফল্যের চাবিকাঠি। (Emphasis Not In The Original)
পরিশেষে বলা যায়, মাও এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এনেছিলেন যাতে বিপুল ভূমিদাসত্ব সৃষ্টি করেই পশ্চিমী পুঁজিবাদের জন্য সস্তা সুলভ শ্রম সরবরাহ করা যায়। সম্ভবত এটাই পশ্চিমী মিডিয়ার চীনের অমানবিক হুকোউ প্রথা নিয়ে নীরবতার কারণ। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের হুকোউ ব্যবস্থা যে ভারতের হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা দূর করার মতোই জরুরি, সে ব্যাপারে তাদের কোনও উচ্চবাচ্য নেই। এ জন্যই হুকোউ প্রথা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও খুব সীমিত বৃত্ত ছাড়া হুকোউ ব্যবস্থা বেমালুম গোপন রাখা হয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ এবার মহামারীর রিপোর্টিং–এর দিকে তাকানো যাক। হুকোউ সিস্টেম নিয়ে প্রতিবেদন আছে যেখানে চীনা আধিকারিকরদের নিয়ম শিথিলও করতেও দেখা যাচ্ছে। হুকোউ প্রথার নিপীড়ন নিয়ে কোনও সাহিত্য নেই যদিও এটা বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তৈরি জন্মসূত্রে বা বংশানুক্রমিক বৈষম্য ও দাসপ্রথা। যদি এই বৈষম্যজনিত অত্যাচারের কৌশলগত বাছাই উল্লেখ লক্ষ করা যায়, স্পষ্টত সমগ্র পশ্চিমী মিডিয়া জগতের একপেশে ভূমিকাই চোখে পড়বে।
যেখানে এই পক্ষপাতদুষ্ট একপেশে গল্প ছড়ানো হচ্ছে, সেখানে হিন্দু সংগঠনগুলো এবং ভারত সরকার কিন্তু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।