মেয়েটির নাম “ওয়ারিশ” যার অর্থ মরুর ফুল। ছোটবেলায় ফুলের মতোই হেসে খেলে মরুভূমিকে সুন্দর করে তুলত। ক্রমশ এল একজন আফ্রিকান মুসলিম রমণী হওয়ার অর্থ বোঝার পালা। কীরকম সেই বোঝা? খুব ছোটোবেলাতেই শুরু হয় বিয়ের বাজারে উপযুক্ত ‘মেয়ে হয়ে ওঠার’ প্রথম ধাপ। মরুচারী যাযাবর সমাজে একজন অবিবাহিত মহিলার কোনো স্থান নেই, আর তাই সময় থাকতেই মায়েরা হন্যে হয়ে চেষ্টা শুরু করে পাত্রস্থ করার, সে পাত্র তার জ্যাঠার বয়সী হলেও।
তা পাত্রস্থ করার উপায়? উঁহু, স্বয়ম্বর সভা নয়। সোমালিয়ার প্রচলিত ধারণা, একটি মেয়ের দুই পায়ের ফাঁকে খারাপ জিনিসপত্র থাকে, আর তাই মেয়েরা হল নোংরা, অতিরিক্ত কামপূর্ণ এবং বিয়ের অযোগ্য। তাকে সুযোগ্য করে তুলতে তাই ঐ খারাপ অংশগুলো বাদ দিয়ে সেলাই করে দিতে হবে। দরকারে সেই কাটা চামড়া মাংস শুকিয়ে রেখে দিতে হবে পাত্র পক্ষর কাছে তার পবীত্রতার প্রমাণ স্বরূপ। এই ভয়ানক কাজটা সম্পাদনের জন্য একেকজন ধাইমার মজুরিই একটা সোমালিয়ান পরিবারের কাছে সবচেয়ে বড় খরচ। কিন্তু সেই লগ্নী অপরিহার্য, যেটা ছাড়া বাড়ির মেয়েকে বিয়ের বাজারে তো তোলাই যাবে না।
ভাবছেন সোমালিয়া তো অনেক দূর। তাহলে হিন্দী বা উর্দু ভাষায় শুনুন, ওটি হল ‘হারাম কী বোটী’ (‘source of sin’) অর্থাৎ ‘পাপের উৎস’ বা অবাঞ্ছিত চামড়া। এই অংশটি থাকলে নারী নিজের দেহে সুখের সন্ধান পেয়ে যাবে, আর গেলেই বেপথুগামী হবে। তা যুক্তি বটে! যৌনতার সন্ধানে নারীই তো বিপথগামী হয় – একাধিক বিয়ে করে, ‘অ্যাডাম টিজ়িং’ করে, যৌনদাস রাখে, দশজনে মিলে একজন পুরুষকে ছিঁড়ে খায়, ভোগ করা পুরুষটিকে হত্যা করে নৃশংস উপায়ে।
মেয়েদের জব্দ করতে ধর্ষণ মোক্ষম দাওয়াই হলেও তাতে তাদের বাপ-ভাই বা স্বামী নামক পুংগবটির প্রেস্টিজে ছ্যাঁকা লাগতে পারে। তাই হয়তো ওষুধটা ঠিক আইনি বৈধতা বা সামাজিক স্বীকৃতি পায় না সর্বত্র। তবে মেয়েমানুষকে শাসনে রাখার প্রথাসিদ্ধ অনেক উপায় আছে, যার দ্বারা সমাজকল্যাণের মহৎ ব্রত পালিত হয়। লক্ষ্যণীয় অধিকাংশই প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিকতার চূড়ান্ত বিকৃতি, তীব্র যন্ত্রণার ও বিপজ্জনক হলেও, যদি সেগুলি সৌন্দর্য, ঐতিহ্য, পবিত্রতা, সতীত্ব, মর্যাদা ইত্যাদি মূল্যবোধের নামে, অথবা রুপচর্চার অঙ্গ হিসাবে একবার মেয়েদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তারা নিজেরাই সযত্নে আত্মনিপীড়নে নিমগ্ন হয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েদেরও সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখে।
আগে বলা হোত ‘সুন্নত’ অর্থাৎ circumcision, যেন পুরুষদের বেলা যেমনটা হয়। কিন্তু পুরুষকে সুন্নত করা আর নারীকে করা এক ব্যাপার নয়। লিঙ্গের বহিরাবরণ কিছুটা কেটে বাদ দিলেই পুরুষদের সুন্নত হয়ে যায়, যদিও অপারেশনটা তাদের ক্ষেত্রেও সাময়িক যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু নারীর জননাঙ্গে বাড়তি চামড়াই নেই। তাতে কী? সুখানুভূতি তো আছে। সেটা নষ্ট করতে স্ত্রী অঙ্গ থেকেও স্পর্শকাতর অংশ কেটে বাদ দেওয়া বা তা সেলাই করে জুড়ে দেওয়া বা দুটোই করার উদ্ভট প্রথা চালু আছে সোমালিয়া, সুদান, মিশরসহ আফ্রিকার বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে।
WHO-র সংজ্ঞানুযায়ী স্ত্রী জননাঙ্গচ্ছেদ (Female genital mutilation or FGM) বা স্ত্রী সুন্নত (Female Circumcise) হল চিকিৎসার প্রয়োজন ব্যতীত কোনওভাবে বহিঃস্থ স্ত্রী জননাঙ্গ সম্পূর্ণ বা আংশিক কেটে বাদ দেওয়া। এই বীভৎস অস্ত্রপচারের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞানও করা হয় না। মামুলি ব্লেড দিয়েই চলে এইসব অপারেশন। বালিকা বা কিশোরীকে পেছন থেকে জোর করে চেপে পা ফাঁক করে শুইয়ে বা বসিয়ে চালানো হয় ব্লেড বা ক্ষুর। যদি মনে হয় কম কাটা হয়েছে, তাহলে বাড়ির লোকের পরামর্শে আরো খানিকটা মাংস বা চামড়া খুবলে নেওয়া হয়। রক্তপাত, ছটফটানি ও চিৎকারে দুর্বল হলে চলে না। অসুন্দর গন্ধযুক্ত জায়গাটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে তো।
মোট চার প্রকার স্ত্রী-অঙ্গ-বিকৃতি আছে। কোনও ক্ষেত্রে শুধু ভগাঙ্কুর (clitoris), বহুক্ষত্রে তৎসহ ভেতর ও বাইরের যোনি ওষ্ঠ (inner and outer labia) কেটে বাদ দেওয়া হয়। কতটা কী বাদ যাবে সেটা জায়গা ও জাতিভেদে বদলে যায়। আর একটি পদ্ধতি হল মূত্র ও রজ নির্গমের জন্য ২-৩ মিলিমিটার ব্যাসের সরু ফুটো রেখে পুরো যোনিমুখমণ্ডল (vulva) সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়, যার নাম infibulations, গোদা বাংলায় যাকে ‘স্ত্রী-অঙ্গ সেলাই’ বলা যায়। বিয়ের পর যৌন সঙ্গমের জন্য যোনিছিদ্র সামান্য উন্মুক্ত করা হয়। বিয়ের রাতে এই কাজটা বিবাহিত পুরুষটি নিজের প্রত্যঙ্গ দ্বারা করতে অমসর্থ হলে নিজে বা কোনও বয়স্ক মহিলা ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে সেটি সমাধা করে। অবশ্য ছুরি-চাকুর সাহায্য নিলে গোপনে কাজ সারতে হয়, কারণ তাতে পুরুষটির ‘দৃঢ়তা’ প্রশ্নাতীত থাকে না। পরে প্রসবের প্রয়োজনে আরও কিছুটা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুলে দেওয়া হয়। মেয়েদের বিয়ের আগে যৌনাচারের পথ বন্ধ করে, যৌনসুখ হরণ করে চরিত্র পবিত্র রাখার এই জন্য ব্যবস্থা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর সঙ্গে ধর্মের সমীকরণ রচিত হলেও মেয়েদের স্বস্থ্যোন্নতির কোনও যোগ নেই, বরং অবর্ণনীয় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু, বা বেঁচে থাকলে মূত্র ও রজ নিৎসরণে তীব্র কষ্ট জ্বালা-যন্ত্রণা, রেচন ও জননাঙ্গে সংক্রমণ, বৃক্কে পাথর (kidney stone), জীবনভর পেটে যন্ত্রণা, সন্তানধারণে ও প্রসবকালীন জটিলতা ইত্যাদি মারাত্মক পরিণতির কথাই জানা যায়। আর কামাবেগ ঘুচে যাওয়া বা সঙ্গমসুখ নষ্ট হওয়া মোটেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়, প্রার্থিত প্রতিক্রিয়া।
UNICEF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩-য় আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী অন্তত ১২.৫ কোটি মেয়ের এই নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। জননাঙ্গ কাটার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার সত্ত্বেও ২০১৬-তেও ২৭টি আফ্রিকান দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরাকি কুর্দিস্থান ও ইয়েমেন মিলিয়ে মোট ৩০টি দেশে কমপক্ষে ২০ কোটি (200 million) সুন্নত করা মহিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। এরা হল বীভৎসতা সহ্য করেও যারা জীবিত। যন্ত্রণা রক্তপাত বা পরবর্তী রোগ সংক্রমণে কতজন মারা গিয়েছে, তার হদিশ এই পরিসংখ্যানে নেই।
মালির বম্বারা ভাষায় বলা হয় ‘বোলোকোলি’ (bolokoli) যার অর্থ ‘হাত ধোয়া’। পূর্ব নাইজিরিয়ার ইগবো (Igbo) ভাষায় এই অঙ্গহানির নাম ‘ইসা অরু’ (isa aru) বা ‘ইউ আরু’ (iwu aru) যার মানে ‘স্নান করা’। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের সুন্নতকে আরবী ভাষায় বলা হয় ‘তহুর’ বা ‘তাহারা’ ((tahur and tahara)) যার উৎপত্তি ‘t-h-r’ ধাতু এবং অর্থ পবিত্রকরণ। তাছাড়া ‘খাফদ’ (khafḍ) বা ‘খিফাদ’ (khifaḍ) শব্দদুটিও প্রচলিত। বিভিন্ন আরবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণত স্ত্রী জননাঙ্গ সেলাই করে জুড়ের দেওয়া ‘ফারাওনিক’ “pharaonic” এবং অন্যান্য ধরণের কাটাছেঁড়া ‘সুন্না’ (sunna) নামে পরিচিত। ভারতে এই সুন্না বা ‘সুন্নত’ শব্দটাই বেশি প্রচলিত যার অর্থ ‘পথ’, কিংবা ‘খৎনা’। মোল্লারা সুন্নাকে ইসলামের অঙ্গ বলে দাবি করলেও কোরানে এর নির্দিষ্ট নির্দেশ নেই। এটা ওই অঞ্চলের প্রাচীন প্রথা, যা পুরুষদের লিঙ্গোন্মোচনের সহায়ক হলেও নারীদের পক্ষে যেমন যন্ত্রণাদায়ক তেমনই বিপজ্জনক। সুদান ও মিশরে এই ফারাওনিক সুন্নতের চল বেশি যাকে অনেক সময় ‘সুদানিজ় ইনফ্যাবুলেশন বলা হয়। সোমালিয়ায় আবার এর নাম সোজাসাপটা “qodob” বা ‘সেলাই করা’। এই নারকীয় অত্যাচারের ভিত্তি হল সতীত্ব কৌমার্য ও সৌন্দর্য, যা মেয়েদের বশীভূত করতে অব্যর্থ।
কাজটা সচরাচর কোনও বয়স্ক মহিলাকে দিয়ে বা কখনও কখনও পুরুষ নাপিতকে দিয়েও করানো হয়। বেশিরভাগ পাঁচ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের ওপর এই পৈশাচিক পবিত্রকরণের কাজটি সারা হয়। খবু দেরি হলে আঠেরো। বাড়ির মহিলারা সমাজে একঘরে হওয়ার ভয়ে নিজেরাই কন্যা বা নাতনীর কোমল যৌনাঙ্গের স্পর্শকাতর অংশগুলো নৃশংস কাটাছেঁড়ায় উদ্যোগী হয় – তার আর্তচিৎকার, রক্তপাত, যন্ত্রণা, জীবনহানির আশঙ্কা সবকিছু উপেক্ষা করে।
১৯৮০ পর্যন্ত সুন্না বা সারকামসাইজ়েশন কথাটাই প্রচলিত ছিল, যেন পুরুষের সুন্নত ও মেয়েদের জননাঙ্গ কাটাছেঁড়া সমতুল্য ব্যাপার। ১৯৭৫ সালে আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক রোজ় ওল্ডফিল্ড হেস তাঁর American Ethnologist-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে প্রথম female genital mutilation বা স্ত্রী-জননাঙ্গহানি কথাটা ব্যবহার করেন। পরে অস্ট্রেলীয় আমেরিকান নারিবাদী লেখিকা ফ্র্যান হস্কেন পুনরায় mutilation অর্থাৎ অঙ্গহানি বা অঙ্গচ্ছেদ শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর বিখ্যাত The “Hosken Report: Genital and Sexual Mutilation of Females” রচনায়। ১৯২৯ সালে সোমালিয়ায় খ্রীস্টান মিশনারিদের (Kenya Missionary Council) তরফ থেকে এর প্রথম বিরোধিতা শুরু হলেও এটিকে অঙ্গহানি হিসাবে চিহ্নিত করতে আরও অর্ধ শতাব্দী লেগে গেল।
যদিও ইসলামে নারীর সুন্নত বাধ্যতামূলক নয় এবং স্ত্রী-অঙ্গহানির প্রথম নজির নাকি উত্তর-পূর্ব এশিয়াতেই মিলেছে, তবু মুসলিম বিশ্বেই এই প্রথার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা, যার শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া। UNICEF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী সোমালিয়ায় ৯৮%, মালিতে ৮৯%, সিয়েরা লিওনে ৮৮%, সুদানে ৮৮%, গাম্বিয়ায় ৭৬%, বুরকিনা ফাসোয় ৭৬%, ইথিওপিয়ায় ৭৪%, মউরিতানিয়ায় ৬৯%, লিবিয়াতে ৬৬% এবং গিনি-বিসাউ দেশে ৫০% শিশুকন্যা বা নারী আক্রান্ত। ২০১৩-য় ইন্দোনেশিয়ায় ১৩.৪ মিলিয়ান বা ৪৯% ০-১১ বছরের শিশু ও বালিকাই এই প্রথাগত অত্যাচারের স্বীকার। প্রথাটি কিছুটা কম হলেও প্রচলিত কঙ্গো, মালয়েশিয়া, ওমান, পেরু, সৌদি আরবিয়া, শ্রীলঙ্কা ও সংযুক্ত আরবে। তাছাড়া ইসরায়েলর বেদুইন, জর্ডনের ‘রাহমাহ’ এবং ভারতের ‘দাউদি বোহ্রা’ সম্প্রদায়ের মধ্যেও নারীর অঙ্গের ছেদন বা সেলাইয়ের নিদর্শন রয়েছে। আর পরিযায়ী বা শরণার্থী সম্প্রদায়গুলির মাধ্যমে তো সারা বিশ্বেই এই নৃশংস প্রথা ছড়ি্য়ে পড়েছে।
এদিকে ভারতবর্ষে বোহ্রা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত হলেও তাকে নিষিদ্ধ করার মতো আইন এখনও নেই, ধর্মনিরপেক্ষতার সৌজন্যে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ! উল্টে অন্যান্য দেশগুলোয় স্ত্রী-অঙ্গহানি নিষিদ্ধ হওয়ায় বোহ্রা মুসলিমরা নিজেদের মহান ঐতিহ্য রক্ষার্থে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।
মুসলিম মেয়েদের দীর্ঘদিনের দীর্ঘশ্বাস তাৎক্ষণিক তিন তালাককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও এই নিয়ে গেরুয়া সরকারও নড়েচড়ে বসার সুযোগ পায়নি। এটা সরকারের গাফিলতি নয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আন্দোলন মুসলিম নারীরা করেছিল বলেই তাকে স্বীকৃতি দিয়ে আইন আনা গেছে। কিন্তু এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এখনও মুসলিম মেয়েদের তরফে কোনও আন্দোলন সংগঠিত হয়নি, একজনও কেসও করেছে কিনা সন্দেহ। অথচ বোহরা মুসলিমরা ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ের যাদের আমরা কম কট্টর বলে জানি। আধুনিক পেশা ও পোশাকে বোহরা মেয়েরা অনেকেই পুরুষদের টক্কর দেয়। এদেশের আগমার্কা নারীবাদী প্রগতিশীলরা বাছাই কাঁদুনি ও চিৎকারে অভ্যস্থ; সুতরাং এই নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। বরং আইন করে স্ত্রী অঙ্গে নৃংসতা নিষিদ্ধ করলে হয়তো ধর্মীয় স্বাধীনতা, my body my wish, pluralism ইত্যাদি সবকটি চোরা তাশ আস্তিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে।
তাই গেরুয়া সরকারের হাত পা বাঁধা। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক মতবাদটি মুসলিম নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছেই বেশি অগ্রাধিকার পায়। যারা গতকাল The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Act, 2019 এর মোদী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত ছিল, তাদেরই অনেকে Citizenship Amendment Act, 2019 নিয়ে তাকে যে লোকটা যখন খুশি তালাক দিতে ও পরপুরুষের বিছানায় হালালা করাতে পারে, সেই পুরুষদের উস্কানিতেই প্রতিবাদের নামে দেশময় নাশকতায় অংশগ্রহণ করেছে, দাঙ্গার সময় পেট্রোল বোমা অ্যাসিড পাউচ ইত্যাদি ছুঁড়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী গেরি ম্যাকি মনে করেন পিতৃতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে ইসলাম আগমণের বহু আগে ৮০০-৩৫০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে সুদানের মেরোইট সভ্যতা বিকাশের সময় যৌনাঙ্গচ্ছেদ প্রথাটির উদ্ভব হয়েছিল। প্রাচীন রোমে অস্ত্রোপচার দ্বারা দাসীদের বহিঃস্থ যোনি ওষ্ঠ (labia major) সেলাই করে দেওয়া হোত যাতে তারা স্বাভাবিক যৌনতা ও সন্তানধারণে অক্ষম হয়। সহজে অনুমান করা যায়, অস্বাভাবিক অরুচিকর যৌনতায় তাদের বাধ্য করা হত।
আধুনিক যুগে শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকানরা নয়, ১৯ শতকের খ্রিস্টান স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরাও মহিলাদের মানসিক অসুখ ও আত্মরতির অভ্যাস সারানোর জন্য ক্লিটোরিস কেটে বাদ দিত। আইজ়াক বেকার ব্রাউন নামে এক ব্রিটিশ গাইনি এবং Medical Society of London-এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট সুযোগ পেলেই মেয়েদের ক্লিটোরিস কেটে বাদ দিতেন। তাঁর মতে মেয়েদের হিস্টিরিয়া, স্নায়বিক অস্বস্তি, জ্ঞান হারানো, মৃগী, বোকামি, বাতিক এমনকি মরণরোগের কারণ হল হস্তমৈথুন বা আত্মরতি বা ভগাঙ্কুরে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা। ১৮৫৯-৬৬ সালের মধ্যে কত মেয়ের যে চিরজীবনের মতো কামজ্বালা জুড়িয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর অনুগামী জনৈক মার্কিন ডাক্তার ১৮৬২ সালে অনুরূপ কাণ্ড করার পর ব্রাউনের চিকিৎসা পদ্ধতি সামনে আসতে তাঁকে Obstetrical Society থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তারপরেও ১৯ শতকের শেষের দিকে নিউ অরলিনে একটি দুই বছরের শিশুকন্যা হস্তমৈথুন(!) করেছে অপবাদে নিজের কচি ভগাঙ্কুরটি হারায়! শুধু তাই নয়, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত Obstetrical & Gynecological Survey-র একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে মেয়েদের হিস্টিরিয়া, অতিরিক্ত কামাবেগ (erotomania) ও সমকামের চিকিৎসা হিসাবে এলোপাথাড়ি ক্লিটোরিডেকটমি করা হয়েছে ১৯৫০-৬০-এর দশকেও। মেয়েদের মানসিক ব্যাধির কারণ যে বঞ্চনা অত্যাচার ও অবদমন, তার প্রতিকার যখন সম্ভব নয়, তাদের চাহিদাহীন যান্ত্রিক যৌন-আজ্ঞাপালনকারীতে রূপান্তরিত করাটাই সুবিধা।
ওহিও রাজ্যের এক গাইনি আবার বাপেদের অতিরিক্ত হর্ষোৎপাদনের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সন্তান প্রসবের পর মায়েদের যোনিতে অতিরিক্ত সেলাই, ক্লিটোরিস বাদ ও মূত্রদ্বারের পুনর্বিন্যাস দ্বারা রোগীর বা রোগীপক্ষের মতামত না নিয়ে কমপক্ষে ৪০০০ মহিলার স্ত্রী-অঙ্গে খেয়ালখুশি পরীক্ষা চালান বলে নিজেই গর্ব করেছিলেন। এর নাম দিয়েছিলেন নাকি “love surgery”। তবে এত মহৎ সমাজসেবার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৮৯ সালে তাঁর চিকিৎসার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়।
Council of Europe-এর ইস্তাম্বুল অধিবেশনের ঘোষণার ৩৮ নং ধারায় স্ত্রী-অঙ্গহানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুইডেন প্রথম এই বর্বরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১৬ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে FGM নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও নিয়ন্ত্রণ খুবই শিথিল। উপরন্তু বিশ্বায়নের জোয়ারে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশগুলি আলোকস্নাত না হলেও অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতেও। পশ্চিমি দেশগুলোয় আশ্রয় নেওয়া মেয়েদের অনেক সময় ‘দেশের বাড়ি’ নিয়ে গিয়ে ‘কাটাকুটি’ বা ‘সেলাই-ফোঁড়াই’ করিয়ে আনা হয়। তাই অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, নিউজ়িল্যান্ড, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও স্ত্রী-অঙ্গচ্ছেদের প্রথা ডালপালা ছড়াচ্ছে, কখনও প্রথারূপে কখনও বা চিকিৎসার ছদ্মেবেশে।
আমাদের শাস্ত্রে আছে স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে তার নাভি স্পর্শ করে উচ্চারণ করবে, “প্রসীদ জগন্মাতা”, প্রসন্ন হও জগ্মামাতা। বলা বাহুল্য এখানে নিজের সন্তানের জননীই বিশ্বজননীর প্রতিভূ। তাকেই প্রসন্ন হতে আবেদন জানানো হচ্ছে। ইসলামে যেখানে নারীর জন্য সুখানুভূতিই ‘হারাম’ বা অপবিত্র, সেখানে সনাতন দর্শন শেখাচ্ছে, যার কাছে নিজের দৈহিক সুখ ও সন্তান চাই, তাকে হৃষ্ট পরিতৃপ্ত করাই আদর্শ পুরুষমানুষের কর্তব্য। স্ত্রী-পুরুষের স্বাভাবিক মিলনও আদিম পাপ নয়, ধর্ম অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিধান। জানি হিন্দুত্ব সমান ভয়ানক নারী-বিদ্বেষ সমীকরণ প্রতিষ্ঠার মতো অনেক বিচ্যুতি ও নিষ্ঠুর প্রথার কথা তুলে ধরা যায়। কিন্তু প্রথা এবং শাস্ত্র বা দর্শন তো এক নয়। ব্যাস্! সনাতন ধর্মের সঙ্গে আব্রাহামিক মতবাদগুলোর পার্থক্য বুঝতে এই মন্ত্রটুকুর মর্মার্থ উপলব্ধি করাও অনেক।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়