১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নেওয়াটা ভারতীয় মুসলিমরা ভালো চোখে দেখেনি[1][2]। ওদিকে জার্মানি ও তুর্কির যুদ্ধকালীন সমঝোতা ব্রিটিশ সরকারের পছন্দ হয়নি। তার ওপর ব্রিটেন মক্কা, মদিনা ও জেরুজ়ালেমের ওপর ‘অটোমান’ (Ottoman) সাম্রাজ্যের অধিপতি তুরস্কের সুলতান বা খলিফার আধিপত্য সমর্থন না করায় ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের ধর্মীয় নিরপেক্ষতার ওপর আরও সন্দিহান হয়ে পড়ে। তুরস্কে মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে উদারপন্থা ও আধুনিকতার জোয়ার এলে খলিফা ক্ষমতাচ্যুত হন, ভেসে যায় ইসলামি কানুনের একাধিপত্য। এরই বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় ‘খিলাফত আন্দোলন’ যার উদ্দেশ্য ছিল খলিফার নেতৃত্বে কোরান অনুসারি ইসলামের শাসন কায়েম করা[5][1]। এই আন্দোলনের জোয়ারে ভেসেছিল ভারতীয় মুসলিমরাও যার অন্যতম কেন্দ্র ছিল আলিগড়।
প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পরে ১৯১৬ সালেও লীগের সমর্থক ছিল মোটে ৫০০ থেকে ৮০০-র মধ্যে। তবে বছরটির একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল।[1] ঐ অধিবেশনেই মহম্মদ আলি জিন্না নামে এক তরুণ মুসলিম উকিল মুসলিম লীগের সমর্থক হয়ে পরবর্তী কালে গোটা দেশটার নিয়তির নিয়ামক হয়ে উঠেছিল। ১৯১৯-এর মন্টেগু চেমস্ফোর্ড সংস্কার (the Montagu-Chelmsford Reforms or the Government of India Act of 1919) প্রথম প্রাদেশিক স্তরে পূর্ণবয়স্ক ভারতীয় পুরুষদের ভোটাধিকার মেনে নিলেও ভোটারের সংখ্যা ছিল মোট পুরুষ জনসংখ্যার মাত্র ১০%, যার মধ্যে অনেকেই অশিক্ষিত[1]। নারীবিহীন সেই ভোটার তালিকা যতই অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হোক, সংস্কার হিসাবে ইতিহাসে অবশ্যই গুরুত্ব আছে।
মুসলিম লীগকে সঙ্গে পেতে জাতীয় কংগ্রেস চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। ১৯১৬-এ লখনৌতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ-এর অধিবেশনে একটা পারস্পরিক সমঝোতা হয়েছিল[1]। লীগ জাতীয়তাবাদী কাজে কংগ্রেসকে সমর্থন দেবে, যার পরিবর্তে তাদের পৃথক ইলেক্টোরেট মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি মেনে নেওয়ার পরেও মুসলিমদের জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে কাছে টানা যাচ্ছিল না। তাই শেষ অস্ত্র হিসাবে খিলাফতের মতো মৌলবাদী আন্দোলন সমর্থন করে সাম্প্রদায়িক তোষণকেই আশ্রয় করতে হল[6]। খিলাফত ব্যর্থ হলে যে ভারতীয় খিলাফতিদের জাতীয়তাবোধ শুকিয়ে যাবে, কংগ্রেসি নেতাদের সেই দূরদর্শিতা ছিল না।
প্রসঙ্গত খিলাফতের পটভূমিকা একটু বলি। তুরস্কে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯) নিজের দেশে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মূল করতে এবং বিদেশী শক্তির আক্রমণ থেকে তাঁর ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে মুসলিম বিশ্বে ‘সুলতান-খলিফা’ হিসাবে নিজের আধিপত্য কায়েম রাখতে খিলাফত তথা ইসলামি একাধিপত্যের ধারণা বিস্তার করতে থাকেন[8]। উনিশ শতকের শেষের দিকে তাঁর দূত জামালুদ্দীন আফগানি প্যান-ইসলাম (Pan Islamism) মতবাদ প্রচারের জন্য ভারত সফর করার পর ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে যথেষ্ট অনুকূল সাড়া জাগে[8]। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) পরাজয়ের পর ১৯১৯ সালে ভার্সেইলিস চুক্তি (Treaty of Versailles) অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের আয়তন ও রাজনৈতিক আধিপত্য বেশ কিছুটা সংকুচিত হয়[11][14]। তবে বিজয়ী ইওরোপীয় শক্তি প্রতিশ্রুতি দেয় অটোমান সম্রাটের ‘খলিফা’ পদমর্যাদা রক্ষা করবে। কিন্তু ততদিনে তুরস্কে পশ্চিমা ভাবধারায় নতুন জাতীয়তাবোধ বিকাশ লাভ করায় ইসলামি একাধিপত্য ধাক্কা খেতে শুরু করে। শুরু হয় খিলাফত আন্দোলন যার দাবি ছিল গোটা ‘জ়ায়ীরাতুল আরব’ অর্থাৎ আরব, ইরাক, সিরিয়িা ও প্যালেস্টাইনের উপর তুরস্ক খলিফার আধিপত্য[7][10]।
১৯১৯-এ ব্রিটিশ সরকারের রাওলাট আইন (Rowlatt Act) দ্বারা রাজনৈতিক মামলার বিচারে জুরি তুলে দেওয়া এবং বিনা বিচারে বন্দী করার স্বৈরাচারী ফরমান জারি করায় দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিল[11]। তার ওপর জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডে সরকারের করাল চেহারায় দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে[6]। মন্টেগু চেমস্ফোর্ড সংস্কার নামক সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়ে ভোলানো যাচ্ছিল না। সুতরাং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করার পক্ষে সময়টা ছিল আদর্শ। কংগ্রেস সেই চেষ্টায় তাই যে কোনও শর্তে মুসলিমদের পাশে পেতে চাইছিল। ওদিকে একই সময় ১৯১৯ সালে শৌকত আলি, তাঁর ভাই মহম্মদ আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ, পির গুলাম মুজাদ্দিদ সরহন্দি, ডঃ মুক্তার আহমদ আনসারি, রইসুল মুহাজিরিন, ব্যারিস্টার জান মহম্মদ জুনেজো, আজমল খান, হসরত মোহানি, সৈয়দ আতাউল্লা শাহ বুখারি ও ডাঃ হাকিম আজমল খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে খিলাফত কমিটি, যার উদ্দেশ্য ছিল তুরক্ষের খলিফার প্রতি বৃটিশদের অবস্থান বদলানো[7][12]। এই সংস্থাটি ছিল লখনৌ ভিত্তিক এবং মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আলি ভাইয়েরাই। গান্ধীজি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর পর ১৭ই অক্টোবর ১৯১৯ প্রথম খিলাফতদিবস পালনের সময় তার সমর্থনে কংগ্রেস হরতালও পালন করে[13]।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার মাটিতে। আবার খিলাফতকে স্বাগত জানাতেও বাঙালি মুসলিমরা দেরি করেনি। বাংলায় এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা মনারুজ্জামান ইসলামাবাদি, মহম্মদ আক্রাম খান ও মুজিবর রহমান খানের মতো কট্টর ইসলামপন্থীরা সোৎসাহে নেতৃত্বের দায়িত্ব তুলে নিলেন। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত কমিটি’ গঠিত হয়। মওলানা আবদুর রউফকে কমিটির সভাপতি, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে সহসভাপতি, মওলানা আকরম খাঁকে সাধারণ সম্পাদক এবং মুজিবুর রহমান ও মজিদ বখশকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। ‘কলকাতা খিলাফত কমিটি’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ যিনি গ্রাম বাংলায় খিলাফতের আদর্শ প্রচারের অন্যতম হোতা[13]। তাঁদের সঙ্গে ‘বঙ্গীয় খিলাফত কমিটি’তে ছিলেন কংগ্রেস নেতা চিত্তরঞ্জন দাস[7] [13]।
১৯১৯ সালের ২৩শে নভেম্বর দিল্লিতে প্রথম খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে প্রথম দিন তাতে সভাপতিত্ব করলেন ‘শের-এ বাংলা’ এ. কে ফজলুল হক[13]। বিস্ময়করভাবে কংগ্রেস নেতৃত্বের উৎসাহ ছিল দেখবার মতো। সম্মেলনে দ্বিতীয় দিন সভাপতি ছিলেন স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ছিলেন মতিলাল নেহেরু এমনকি ভারতে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠাকামী কট্টর হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্যও[17]। ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ ভারতব্যাপী দ্বিতীয় খিলাফত দিবস পালিত হয় এবং খিলাফতের দাবিতে কলকাতা, ঢাকা, চট্টোগ্রাম ইত্যাদি অচল করে পুনরায় হরতাল পালিত হয়! শুধু ব্রিটিশ বিরোধিতার প্রশ্নে মুসলিমদের পাশে পাওয়ার আশায় গোঁড়া মৌলবাদী খিলাফত বিদ্রোহের সঙ্গে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গাঁটছড়া বাঁধার অবাস্তব চেষ্টা চলতে লাগল।
পরে ১৯২০-এর ১ ডিসেম্বর নাগপুরে আয়োজিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজি ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ঘোষণা করতেজাতীয়বাদী আবেগের সঙ্গে সারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষটিও অজানতে ছড়িয়ে পড়ল[8]। ১৯২০-র সার্বিস চুক্তি (Treaty of Sèvres ) অনুসারে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনে ফিরে এলেও তুরস্কের মধ্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার জাতীয়তাবাদীরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠায় খলিফা প্রার্থিত ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন না। উপরন্তু ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত চলা তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনের (Turkish national movemen) শেষে তুর্কি বিপ্লবী মুস্তাফা কামাল পাশা নেতা সার্বিস চুক্তি নাকচ করে ১৯২৩-এ লসানে চুক্তি (Treaty of Lausanne) করেন, যার দ্বারা ১৯২৪-এ নয়া রিপাবলিক অব টার্কি (Republic of Turkey ) দেশে খলিফা পদটাই উঠে যায় এবং তুরস্কের গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি (Grand National Assembly of Turkey)-র ওপর ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়[5][7]। খিলাফত আন্দোলনের সেটাই আনুষ্ঠানিক ইতি; কিন্তু ইসলামি একাধিপত্যের যে বাসনা উস্কে গিয়েছিল, সেটার অবসান হয় না।
১৯১৯-এর আগে ও ১৯২৪-এ খিলাফত আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম উলেমাদের এত বেশি আগ্রহ আর দেখা যায়নি। খিলাফত আন্দোলন প্রত্যাহৃত হতেই মুসলিমদের জাতীয়তাবাদী আবেগও শুকিয়ে গেল। লাভের মধ্যে ১৯২০ সালে ভারতীয় খিলাফতি নেতারা মুসলমান-কূলের স্বাধীন শিক্ষা ও সামাজিক নবজারগণের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (Jamia Millia Islamia ) প্রতিষ্ঠা করেন[12]।
বিপিনচন্দ্র পাল প্রথম থেকেই এতে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের অশনিসংকেত দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ১৯১১-১২-র ইন্দো আফগান যুদ্ধের পর যে ইসলামি ভাবাবেগ বিকশিত হয় বিশেষত ভারতে, তার স্বরূপ ও উদ্দেশ্য ক্রমশ উদ্ঘাটিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল রিফর্মকে বোকা বানানোর পর সৈয়দ আমির আলি এখন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের সহানুভূতি জাগানোর জন্য নিজের অনুগামীদের মধ্যে খোলাখুলি ইসলামি আধিপত্যবাদ প্রচার করছেন। “The Turko-afgan conflict of 1911-12 while giving a new impetus to Pan-Islamism, particularly in India, helped also to bring out its true motive and character before all the world. Encouraged by success of his game of bluff in the matter of the Indian Council Reforms, Sayaed Amir Ali now almost openly avowed his allegiance to Pan-Islamism while his followers commenced to exploit the natural sympathy of the Indian Musalmans with Ottoman Government in their conflit with Italy” [Nationality and Empire: A running study of some Current Indian Problems][17]।
কিন্তু ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই গান্ধীজি খিলাফতকে স্বাগত জানিয়ে দেন। ১৯২০-র ২২ জুলাই আয়োজিত করাচির এক জনসভায় বলেন, “মুসলমানদের সংকটে যদি হিন্দুরা সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তাহলে হিন্দুদের দাসত্ব অবশ্যম্ভাবী”[17]। কার্যক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হয়েছে। আর এই তোষণ নীতি যে ভারতের ইসলামি মৌলবাদের ভিত শক্ত করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করবে, সেটুকু বোঝার মতো দূরদর্শিতা কি গান্ধীজির ছিল না?
ক্ষুব্ধ হয়ে বিপিনচন্দ্র খিলাফতি ও মুসলিম লীগ সম্পর্কে চাঁচাছোলা ভাষায় ভাষায় বলেন, ভারতীয় জাতিয়তাবাদের প্রকৃত শত্রু। “…common enemy of Indian Nationalism in its truest and broadest sense”[17]। অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে মতভেদের ফলে ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রাজনীতি থেকেই সরে দাঁড়ান[15]।
খিলাফতকে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় একই সুর শোনা যায় লালা লাজপত রাইয়ের কণ্ঠেও – কারও অনুভূতিতে ঘা দিতে চাই না, কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিগত তিন বছরে সংকীর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদ যথেষ্ট বেড়ে গেছে। খিলাফত আন্দোলনের ফলেই মুসলমানদের মধ্যে এটা বিকশিত হয়েছে এবং হিন্দু ও শিখদের ওপর তার প্রতিকূল প্রভচাব পড়তে বাধ্য।….এটা আরো দুর্ভাগ্যজনক যে মহাত্মা গান্ধী ও খিলাফতি নেতারা ধর্মকে এমন একটা আন্দোলনের মধ্যে প্রাধান্য দিচ্ছেন, যার সঙ্গে ধর্মের মূলগত কোনও যোগ নেই। “I have no intention of offending anybody’s susceptibilities, but if the existing conditions are properly analysed, it will be seen that sectarianism and narrow minded bigotry have been very much strengthened within the last three years. The Kilafat movement has particularly strengthened it among the Mohammedans, and it has not been without its influence and reaction on Hindus and Sikhs…..It was still more unfortunate that Mahatma Gandhi and the leaders of Khilafat movement have brought religion into such a prominence in connection with a movement which was really and more fundamentally, more political than religious.”[17]।
কবি নজ়রুল ইসলাম প্রথমে ফজ়লুল হকের কাগজ ‘মুক্তি’-তে সাংবাদিকতা করার সময় সোৎসাহে অসহযোগ ও খিলাফতের সঙ্গে যোগ দিলেও পরে নিজের পত্রিকা ‘ধূমকেতু’-তে ‘কামাল পাশা’ কবিতাটির মাধ্যমে খিলাফতের বিরুদ্ধে কামাল পাশার নেতৃত্ব তুরস্কের নবজাগরণ ও গণতন্ত্রের আগমণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আপত্তি জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। অথচ জাতির জনক মুসলিমদের জাতীয়তাবাদী কার্যক্রমে আকৃষ্ট করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদকেই স্বীকৃতি দিয়ে দেন।
আমরা ইতিহাস বইতে গান্ধীজির এই পদক্ষেপকে তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা হিসাবেই পড়েছি। অথচ এই খিলাফত আন্দোলন ক্রমশ উগ্র হয়ে উঠতে থাকে ভারতের মাটিতে সমর্থন পাওয়া মাত্র – “যতক্ষণ না খিলাফত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য”। দুই খিলাফতপন্থী নেতা ফকির কায়ুমুদ্দিন ও মহম্মদ আবদুল বারির লেখা চিঠি তুলে ধরলে ব্যাপারটা প্রাঞ্জল হয়: “…এটা মনে রাখতে হবে যে, আমরা ওঁর (গান্ধী) ওপর ভরসা করে চুপচাপ বসে থাকব না। আমরা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করবই। এটা আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা একমাত্র আল্লাহ্-র ওপর বিশ্বাস রাখব। মুসলমান অথবা অমুসলমান – আমাদের দয়িত্ব পালনে যে বাধা দেবে – তাকেই আমরা শত্রু প্রতিপন্ন করব”17]। বলা বাহুল্য খিলাফত আন্দোলন ক্রমশ হিন্দু বিরোধী মৌলবাদের রূপ পায় যার উত্তরাধিকার আমরা এখনও ভোগ করছি এবং আরও ভয়ানকভাবে[।
জ়াহির আলি নামে জনৈক তাঁর “How Chauri Chaura deepened the Hindu-Muslim divide” শীর্ষক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন চৌরিচৌরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজীর ‘অসহযোগ আন্দোলন’ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভারতে ‘খিলাফত আন্দোলন’ও মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, খিলাফত কমিটির প্রধান নেতারা গ্রেপ্তার হন[16]। এর ফলে গান্ধীর সিদ্ধান্ত ও তাঁর অহিংসা নীতির প্রতি অসন্তোষ থেকে হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়ে ওঠার বদলে ফাটল আরও বেড়ে যায়। অর্থাৎ সব দিক দিয়েই হিতে বিপরীত হয়েছিল এই রাজনৈতিক চালের ফল।
এই অসম ও একতরফা সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টাকে কটাক্ষ করেন শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার অনেক পরেও মুখ খোলেন তিনি – হিন্দু-মুসলিম ঐক্য হিন্দুদের বশ্যতা স্বীকারের মধ্যে দিয়ে হতে পারে না।… সবচেয়ে ভালো সমাধান হল, হিন্দুদের পরস্পর সংগঠিত হতে দেওয়া, আর তাহলে নিজে থেকেই সমাধান বেরিয়ে আসবে। না হলে সমস্যার সমাধান হয়েছে ভেবে মিথ্যে আত্মতুষ্টির ফাঁকে আসলে সমস্যাকে জায়গা করে দেওয়া হবে। “Hindu-Muslim unity should not mean subjugation of Hindus…..The best solution would be to allow Hindus to organise themselves and the Hindu-Muslim unity will take care of itself; it will automatically solve the problem. Otherwise we are lulled into a false sense of satisfaction that we have solved the problem when in fact we have only shelved it”. [Muslim Seperatism, causes and Consequence – Sita Ram Goel][16]।
দেখা যাচ্ছে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা থেকে ভারতে খিলাফত আন্দোলনকে সংগঠিত করায় বঙ্গীয় মুসলিমরা অগ্রণী হলেও ভারতে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদী ভাবাবেগ তথা রাজনীতির রাশ উর্দুভাষী পশ্চিমা মুলমানদের হাতে চলে যায়। এর ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ান মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি নিজে উর্দুর বদলে ইংরিজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। মুসলিম অভিজাতদের জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের উদ্দেশ্যও ছিল অভিন্ন ভারতভূমির মুক্তি নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করা ও বাকি ধর্ম-সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দুদের প্রান্তিক করে দেওয়া। জিন্না হয়ে দাঁড়ান মুসলিম সম্প্রদায়ের সেই উচ্চাশার যথাযথ রূপকার যিনি মৃত্যুর আগে যথা সময়ে দায়িত্ব স্বপ্নটি নিয়ে পূরণও করিয়ে যান।
এই সরল সত্যটা কাঁটাতারের বেড়ার জন্য অশ্রু অপনোদনকারী বাঙালিরা কেন ভুলে থাকতে চান কে জানে? একটা সম্প্রদায় চেয়েছিল বলেই ঐ বেড়ার সৃষ্টি হয়েছিল এবং যার চরম মূল্য ভারতবাসীকেই দিতে হয়েছিল। ভারত ভাগ হল কিন্তু জিন্না কিংবা সুরাবর্দিদের দাবি মেনে বাংলা ভাগ হল না – তার ফল হিন্দু বাঙালিদের জন্য কতটা মারাত্মক হতে পারত, তা কি এরা বোঝে না, নাকি সর্বনাশটাই কামনা করে অথবা এই ভাগাভাগি নিয়ে একদা কংগ্রেস ও এখন গৈরিক দলের ওপর দোষারোপ দ্বারা নিজেদের রাজনৈতিক অস্ত্রে শান দিয়ে রাখে?