কেনই বা সীতারাম গোয়েল বামপন্থী ইতিহাসবাদীদের কাছে সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন হয়ে গিয়েছিলেন?

২ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে ১২ জন বামপন্থী ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের নেতৃত্বে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কাছে একটি লম্বা চিঠি পাঠিয়ে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হবার অভিযোগ এনেছিলেন। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া সেই চিঠি কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ছেপেছিল। বলা বাহুল্য দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ‘অপরাধ’ ছিল তারা কুতব মিনার ও মথুরার ওপর দুটি প্রতিবেদন ছেপেছিল,যাতে স্পষ্ট করে ইসলামিক শাসকদের দ্বারা মন্দির ভেঙ্গে অপবিত্র করে তাকে ইসলামিক স্থাপত্য বানাবার মত গুরুতর অভিযোগ ছিল। এরকম একটা গুরুতর অভিযোগ পেয়েও তাকে নিয়ে গবেষণা করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের বদলে তাকে ধামাচাপা দিয়ে উল্টে সত্যান্বেষীকে ‘সাম্প্রদায়িক হবার’ মিথ্যা বদনাম দিয়ে হয়রানি করাই হচ্ছে বামপন্থী ইতিহাসবিদদের বিশেষত্ব। বস্তুত এই কাজে তারা চ্যাম্পিয়ন বিশেষ।

বামপন্থী ইতিহাসবিদরা শুরুতে করে কি,বিরোধীকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারপর বিরোধীকে রক্ষণাত্মক করে তুলে তার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করার চেষ্টা করে। যখন তারা দেখে,তাদের দেওয়া যুক্তি বাস্তবের জমিতে দাঁড় করাবার মত মজবুত নয়; সেক্ষেত্রে তারা বিরোধীকে (বিশেষ করে হিন্দুদের) সাম্প্রদায়িক তকমা দিতে শুরু করে। তারা ভালই করে জানে যে,কোনও হিন্দু তাদের ওপর ‘সাম্প্রদায়িক’তকমা লাগা বিশেষ পছন্দ করে না। হিন্দুরা কিছুতেই মানতে চাইবে না তারা সঙ্কীর্ণ,অনুদার,সাম্প্রদায়িক হতে পারে। এমনকি নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেখাবার জন্য হিন্দুরা প্রয়োজনে নিজের বিশ্বাস,যুক্তি ত্যাগ করতে পারে;সেটা বামপন্থী ইতিহাসবিদদের অজানা নয়। ঠিক এই কারণেই তারা চূড়ান্ত অসত্য প্রচারণা সত্ত্বেও জিতে যায়।

যদি কেউ সত্যনিষ্ঠ হতে যায়,তখন বামপন্থী ইতিহাসবিদদের একটাই অস্ত্র থাকে,তার বিরুদ্ধে কঠোর কঠোর সব শব্দ ব্যবহার করে তাকে অপমানিত করা। এক্ষেত্রে রাস্তার গুণ্ডার আচরণের সাথে বামপন্থী ইতিহাসবিদদের কোনও পার্থক্য থাকে না। তাদের মধ্যে যত রকম অসভ্য,অসংস্কৃত আচরণ আছে,সব একেবারে প্রকাশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। প্রাক ইন্টারনেট যুগে তাদের কুকীর্তি প্রকাশ হত না,সবকিছু চার দেওয়ালের আড়ালে হত। কিন্তু এখন সেভাবে লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। নামী ইতিহাসবিদ গুরচরণ দাস তাই বিদ্রূপ করে লিখেছেন,এখনকার দিনে রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, উপনিষদ পাঠ করতে গেলে বোধহয় প্রমাণ করতে হবে যে;তিনি ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িক’ নন। গুরচরণ দাস আরও লিখেছেন যে,আজকের যেকোনো হিন্দু শিক্ষিত ব্যক্তি স্বীকার করতে ভয় পান যে,তিনি সংস্কৃত রচনা পড়েছেন। যেন ওটা পড়লেই প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক কুকর্ম হয়ে যাবে। কেনই বা এরকম পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে,সেটা আমাদের বুঝতে হবে।

কীভাবে কুখ্যাত বামপন্থী ইতিহাসবিদরা একটা বিশ্বাসঘাতক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে?

দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কাছে লেখা চিঠিতে রোমিলা থাপার অ্যান্ড কোং রীতিমত হুমকির সুরে প্রশ্ন করেছেন — “আমরা আর কত পিছনে ফিরে যাব? যিনি দাবি করেছেন যে, কুতুব মিনার আর মথুরা ইসলামিক শাসকদের দ্বারা অপবিত্র ও ধ্বংস হয়েছে,তিনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে; ঐ একই জায়গায় আগে জৈন বা বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপ ছিল না; যা হিন্দু শাসকরা ভেঙ্গে সেখানে মন্দির বানান নি? অথবা কোনও প্রকৃতি পূজারী তীর্থস্থান ছিল না? কীভাবে প্রমাণ করবেন?”

এ হচ্ছে একেবারে টিপিক্যাল বামপন্থী রণনীতি। তারা এই ভাবেই একটা মনগড়া গল্প হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে কিছু একটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে,যদিও তারা জানে সারা দুনিয়ায় তাদের ‘থিওরির’ ঠিক উল্টোটাই জানে। তবুও এরকম রণনীতির আশ্রয় নিয়ে তারা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাতেও সফল না হলে তারা তখন শেষ অস্ত্র হিসাবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হবার অভিযোগ আনে। এইভাবে তারা বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করার অসৎ চেষ্টা করে। প্রাক ইন্টারনেট যুগে তাদের রণনীতি বেশ সফল ছিল।

রোমিলা থাপার একই রণনীতি ব্যবহার করে রোমিলা থাপার ‘প্রকৃতিপূজারী (অ্যানিমিষ্ট)’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। তিনি এইভাবে প্রকৃতিপূজারীদের বৌদ্ধ ও জৈনদের সমগোত্রীয় বানাবার অক্ষম প্রচেষ্টা করেছেন। এই প্রকৃতিপূজারী শব্দটা প্রথমবার ব্যবহৃত হয় খৃষ্টান মিশনারিদের দ্বারা,উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের বিভাজিত করে ধর্মান্তরকরণ করা। উনবিংশ শতকে এই শব্দটা প্রথম ব্যবহৃত হলেও এখনও শুধুমাত্র বামপন্থী ইতিহাসবিদদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। খৃষ্টান মিশনারিদের সাহায্য করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ব্রিটিশ সরকার জনগণনায় অন্যান্য ধর্মের সাথে ‘প্রকৃতিপূজারী’ শব্দটাও রেখেছিল,স্রেফ হিন্দুদের ব্যবহার করতে। কিন্তু পরের দিকে ব্রিটিশ অফিসাররা বুঝতে পারে,তাদের রণনীতি বিফল হচ্ছে। কেননা হিন্দু ধর্ম প্রকৃতিগত ভাবেই একটা প্রকৃতিপূজারী ধর্ম। উদাহরণ হিসাবে হিন্দুদের কর্তৃক গরু,ষাঁড়,সাপ,হনুমান বা হাতি পূজার কথা বলা যেতে পারে। বিংশ শতকের শুরুতে কয়েকজন হিন্দু নেতা এই নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল সাম্প্রদায়িক হবার, ফলে বিব্রত হয়ে তারা জনগণনা থেকে ‘প্রকৃতিপূজারী’ শব্দটা আলাদা ধর্মের শ্রেণীবিভাগ থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের উচ্ছিষ্ট জিনিস এখনও বামপন্থী ইতিহাসবিদরা ব্যবহার করে যাচ্ছেন হিন্দুদের বিভাজিত করার ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।

কিন্তু সীতারাম গোয়েল চ্যালেঞ্জ হিসাবে এলেন

যখন সীতারাম গোয়েল বামপন্থী ইতিহাসবিদদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে এলেন,তখন বামপন্থী ইতিহাসবিদরা সত্যিই সমস্যায় পড়ে গেলেন। কেননা তাদের অভিধানে সত্যান্বেষণ কোনওকালেই ছিল না,যেটা সীতারাম গোয়েলের মধ্যে ছিল। তিনি যখন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে ধারাবাহিক ভাবে কীভাবে ইসলামিক শাসকদের দ্বারা হিন্দু ধর্মস্থানগুলি ধ্বংস হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে শুরু করেন,সারা দেশেই চাঞ্চল্য পড়ে গেল। যখন সীতারাম গোয়েলের বিরুদ্ধে রোমিলা থাপার প্রশ্ন করেন,তার পাল্টা উত্তরে ২৭ জুন ১৯৯১ সালে সীতারাম গোয়েল বেশ কয়েকটা প্রশ্ন রাখেন; এবং চ্যালেঞ্জ করেন তার প্রবন্ধে কোথায় ভুল আছে,খুঁজে বের করে দেখাতে। তিনি ধাপে ধাপে দেখান কীভাবে ইসলামিক শাসকরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়েছিলেন। যার মধ্যে কুতব মিনার ও মথুরা প্রধান। রোমিলা থাপারকে উদ্দেশ্য করে সীতারাম গোয়েলের প্রশ্নগুলি ছিল নিম্নরূপ :

১। বামপন্থী ইতিহাসবিদরা একটা তালিকা বানিয়ে দেখান, যেখানে প্রকৃতিপূজারী,বৌদ্ধ বা জৈন মন্দির ভেঙ্গে হিন্দু ধর্মস্থান বা স্থাপত্য গড়া হয়েছে।

২। হিন্দু পুরাণ ও সাহিত্য থেকে বামপন্থী ইতিহাসবিদ যেন খুঁজে বের করে দেখান যে,হিন্দু শাসকরা কোনও বৌদ্ধ,জৈন বা প্রকৃতিপূজারী স্থাপত্য ভেঙ্গেছে।

৩। হিন্দু দর্শনে কোথাও দেখানো হয়েছে কি যে,বিধর্মী ধর্মস্থান বা ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেওয়া উচিত,যেমনটা আব্রাহামিক ধর্মগুলিতে আছে?

৪। বামপন্থী ইতিহাসবিদ কি এমন উদাহরণ দেখাতে পারবেন,যেখানে কোনও হিন্দু শাসক বা সমরনায়ক কোনও জৈন,বৌদ্ধ বা প্রকৃতিপূজারীদের তীর্থস্থান ভেঙ্গে বা বিধর্মীদের বলপূর্বক হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন? যে উদাহরণ আব্রাহামিক ধর্মে ভুরি ভুরি আছে।

৫। একটা তালিকা বানাতে হবে বামপন্থী ইতিহাসবিদদের দ্বারা,যেখানে বেশী না,তিন চারশো বছর আগেও কোনও বৌদ্ধ,।জৈন বা প্রকৃতিপূজারী তীর্থস্থান ছিল,যা এখন হিন্দু তীর্থস্থান হয়েছে?

৬।এমন একটা উদাহরণ দেখাতে হবে,যেখানে হিন্দু তীর্থস্থানের গায় বৌদ্ধ, জৈন বা প্রকৃতিপূজারী চিহ্ন বা স্মৃতি রয়েছে বা শিলালিপি পাওয়া গেছে।

৭। এমন একটা বৌদ্ধ,জৈন বা প্রকৃতিপূজারী নেতা বা সংগঠন দেখাতে হবে যারা দাবি করেছেন, তাদের ধর্মস্থান ভেঙ্গে সেখানে হিন্দু তীর্থস্থান গড়ে উঠেছে বা সেখানে পুনরায় তাদের তীর্থস্থান গড়ে দিতে হবে। যেমনটা হিন্দুরা নিয়মিত দাবি করে থাকেন।

৮। এমন হিন্দু নেতা বা সংগঠনের নাম খুঁজে বের করে দেখাতে হবে,যারা নিকট অতীতে বা বর্তমানে কোনও বৌদ্ধ, জৈন বা প্রকৃতিপূজারীদের দাবিকে খারিজ করেছেন বা স্ট্যাটাস কুও চেয়েছেন বা ‘হিন্দু ধর্ম বিপদে আছে’ বলে ধর্মের নামে দাঙ্গা করে তাদের দাবিকে বৈধতা দেওয়া ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।

উপরোক্ত প্রশ্নগুলি মন দিয়ে পাঠ করলে যে কোনও বুদ্ধিমান,রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিই মেনে নেবেন,এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের ওপরেই ভারতের ভবিষ্যৎ টিকে আছে। কিন্তু বামপন্থী ইতিহাসবিদরা যে অন্য ধাতুতে গড়া। তারা বুঝলেন এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে নেই,।কোনওদিন ছিলও না। কেবল মিথ্যাচারে ভর্তি প্রোপ্যাগান্ডা তাদের একমাত্র সম্বল। ফলে তারা সীতারাম গোয়েলের নামে কুৎসা আর হুমকি দেওয়া শুরু করলেন।

পাঁচটি ধাপে ভারতের ইতিহাসকে ধ্বংস করেছেন বামপন্থী ইতিহাসবিদগণ

যেমনটা আশা করা ঠিক সেই ভাবেই রোমিলা থাপার অ্যান্ড কোম্পানি সীতারাম গোয়েলের দাবিমত উপরোক্ত আট দফা তালিকা দিতে ব্যর্থ হলেন। তারা যদি সৎ থাকত তবে চাইলেই দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার জায়গায় নিজস্ব পুস্তিকা ছাপিয়ে সীতারাম গোয়েলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। কিন্তু সে ক্ষমতাও রোমিলা থাপারদের ছিল না বলাই বাহুল্য। জওয়াহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোজন ইতিহাস অধ্যাপক দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে রীতিমত স্বাক্ষর করে তালিকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পিছিয়ে গেলেন।

১৯৮৬ সালের পর প্রায় ৩৪ বছর পরেও ঐ বারোজন ‘অধ্যাপক (!)’ আজ অবধি তালিকা দিয়ে উঠতে পারেন নি। যে তালিকায় বৌদ্ধ,জৈন বা প্রকৃতিপূজারী তীর্থস্থান ভেঙ্গে হিন্দু ধর্মস্থানের উল্লেখ থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা কেনই বা এই চৌত্রিশ বছর ধরে এমন নীরবতা পালন করছেন? এমন তো নয় যে, সীতারাম গোয়েল কোনও অসংগত দাবি রেখেছেন বা ঐ বারোজন অধ্যাপকের কোনও যোগ্যতা ছিল না। হাজার হলেও তারা যেহেতু আকাদেমিক ফিল্ডের লোক,তাই একবারের জন্য হলেও সীতারাম গোয়েলের তোলা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে কাজটাও তারা করে উঠতে পারেন নি,বলাই বাহুল্য। এখানে একটা হাস্যকর ব্যাপারের উল্লেখ করা চলে — তারা শেষ চল্লিশ বছরে মাত্র দুটি হিন্দু রাজার দ্বারা বিধর্মী স্থাপত্য ধ্বংসের উল্লেখ করতে পেরেছেন : কাশ্মীরের রাজা হর্ষ এবং বাংলার রাজা শশাঙ্ক। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে হিন্দু বিদ্বেষী বৌদ্ধদের দ্বারা, তাই সেটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য সে নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এখানে বলে রাখা ভাল রোমিলা থাপার অ্যান্ড কোম্পানির পক্ষে অদ্যাবধি সীতারাম গোয়েলের তুলে ধরা ঐতিহাসিক তথ্যাবলীর বিরোধিতা করার মুরোদ হয়নি। কেননা সীতারাম গোয়েল যা লিখেছিলেন, তার পেছনে খোদ ইসলামিক ইতিহাসবিদদের দেওয়া রেফারেন্স আছে — নিজামি,আল-বিরুনি,ফেরিস্তা ইত্যাদি। উল্টোদিকে বামপন্থী ইতিহাসবিদদের হাতে কিছুই ছিল না পাল্টা জবাব দেওয়ার। কাজেই যে কাজ করায় তারা পারদর্শী, সেটাই করলেন — সীতারাম গোয়েলের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা এবং রাজনৈতিক প্রোপ্যাগান্ডা চালানো। তারা পরিষ্কারই বললেন সীতারাম গোয়েল জনসঙ্ঘের (বিজেপির পূর্বসূরি দল) এজেন্ট, তাকে সাম্প্রদায়িক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ ইত্যাদি। এইভাবে তাকে সাইডলাইনে সরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করা হল।

১০ আগস্ট ১৯৯১ সালে রোমিলা থাপার সীতারাম গোয়েলের বিরুদ্ধে অনেক প্রশ্ন তুললেন,কিন্তু দু মাস আগে সীতারাম গোয়েলের তরফে তোলা আট প্রশ্নের জবাব পুরোপুরি এড়িয়ে চললেন। এছাড়া আর কোনও উপায় সম্ভবত তার ছিল না।

রোমিলা থাপার বললেন,।”এই প্রশ্নের উত্তর আমার লেখা লেকচারের সঙ্কলন ‘কালচারাল ট্রান্সস্যাকশন অফ ইন্ডিয়া’ বইতে পাবেন। ওখানে সব উত্তর দেওয়া আছে। আশা করি বইটা পড়া আছে। না থাকলে আলোচনা শুরু করা যাবে না।”

যে কেউ ভাল করে তার প্রত্যুত্তর দেখলে বুঝবেন এতে কি পরিমাণ ঔদ্ধত্য রয়েছে। প্রত্যুত্তরের ভাষা একেবারেই অমার্জনীয় ও অশোভনীয়। এই ভাষায় উত্তর দিলে তাকে আর যাই হল ‘প্রকৃত পণ্ডিত’ বলা যায় না। শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলা চলে। খেয়াল করে দেখবেন,প্রত্যুত্তরের সময়ে রোমিলা থাপার একবারও সীতারাম গোয়েলের বইয়ের কথা উল্লেখ করেন নি,এমনকি এমন কোনও ঐতিহাসিক গ্রন্থের কথাও উল্লেখ করেন নি; যা দিয়ে ৮টি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া যায়। অথচ জওয়াহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হবার দরুন তার পক্ষে এমন কোনও বইয়ের নাম খুঁজে বের করা কঠিন ছিল না, যা দিয়ে সীতারাম গোয়েলের দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। কিন্তু সে কাজটাও তার দ্বারা সম্ভব হয়নি। তার বদলে তার একটা বই সীতারাম গোয়েলকে পড়তে বলা হয়েছিল,যা কিনা এমএ হিস্ট্রিতে পড়ানো হয়! অথচ সীতারাম গোয়েল নিজে ছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরের ইতিহাসবিদ এবং তার বই মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়ানো হত। বোঝাই যায়,তাকে এমএ হিস্ট্রির বই পড়তে বলাটা অপমানজনক প্রস্তাব। কিন্তু রোমিলা থাপার এতটাই নির্লজ্জ,তিনি এমন অদ্ভুত প্রস্তাব দিতে দুবার ভাবেন নি। স্পষ্টই বোঝা যায়,সীতারাম গোয়েলের প্রশ্নের উত্তর তার কাছে ছিল না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে রোমিলা থাপার দাবি করেন যে,অতীতে বৌদ্ধ,জৈন বা প্রকৃতিপূজারী তীর্থস্থান ভেঙ্গে সেখানে হিন্দু তীর্থস্থান তৈরি করা হয়েছিল? এরকম কাজ চুনোপুঁটি রাজনীতিবিদদের মানায়,কোনও ইতিহাস পণ্ডিতের নয়।

ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে তিন চার প্রজন্মের শিশুদের মগজ ধোলাই করাটা বামপন্থী ইতিহাসবিদদের কাছে পবিত্র কর্তব্য বলে পরিগণিত হয় রোমিলা থাপারের কাছে এমন উত্তর পেয়েও সীতারাম গোয়েল অবাক হন নি। তিনি প্রত্যুত্তরে জানান,তার কাছে এমন গ্রন্থ আছে,যাতে প্রকৃতিপূজারী,বৌদ্ধ বা জৈন মন্দির ভেঙ্গে হিন্দু ধর্মস্থান বা স্থাপত্য গড়া হয়েছে এমন সম্ভাবনা থাকতে পারে। বলা বাহুল্য রোমিলা থাপার এমন সুযোগ পেয়েও জবাব দিলেন না। হয়ত বুঝেছিলেন এখন জবাব দিলে তার পাণ্ডিত্য সবার কাছে আরও হাস্যকর হয়ে উঠবে।

এরপর সীতারাম গোয়েল রোমিলা থাপারকে উচিত শিক্ষা দিতে তার লেখা কালচারাল ট্র্যান্সস্যাকশন অফ ইন্ডিয়া বইয়ের কিছু নির্বাচিত অংশ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে তুলে ধরলেন। তাতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঐ গ্রন্থে সীতারাম গোয়েল যে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলন, তা প্রত্যাশিত ভাবেই ছিল না। নির্লজ্জ রোমিলা থাপার এ বিষয়ে পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়ে প্রমাণ করলেন তিনি আদৌ পণ্ডিত নন।

শঙ্কর শরণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.