মাঝরাত। উত্তুরে হাওয়া দাঁত ফোটাচ্ছে ক্রমশঃ। ধ্বপ করে একটা শব্দ হতেই বাবরি মসজিদের মুয়েজ্জিন মুহম্মদ ইসমাইলের ঘুম ভেঙে গেল। ইসমাইল মসজিদের মধ্যেই ঘুমোন। বাইরের রামচবুতরার পূজারীদের সঙ্গে তাঁর বেশ সদ্ভাব। রামভক্তদের সমাগম হয় ভালোই, তাই কলাটা মূলোটা বেশ ভালো পরিমাণেই জমা পড়ে রামজ্বির চরণে। এদিকে মসজিদের আয় উপায় তেমন কিছু নয়। লোকজন কম আসে। মাঝেমধ্যে পকেটে টান পড়ে, কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। ইসমাইল সাহেবের অবশ্য চিন্তার কোনো কারণ নেই। রামচবুতরার পূজারীরা তাঁকে খাবারদাবার দেন। হিন্দু – মুসলিম বৈরীতা মন্দির – মসজিদ চত্বরের বাইরে, ভেতরে শুধুই উপাসক।

ধ্বপ — আবার একবার শব্দ হল। এবারে ইসমাইল সাহেব নিজের বিছানায় উঠে বসলেন। জ্বীন কফিলের ভয় তাঁর নেই। মসজিদের পাক মাটিতে ওসব আসার দুঃসাহস করবে না। মাথার ওপরে গম্বুজের দিকে একবার তাকালেন। মধ্যযুগ শেষ হতে – না – হতেই গড়ে ওঠা এই মসজিদের মধ্যে না-জানি কতকালের বাতাস জমে আছে। হাওয়াই কথা বলছে বোধ হয়। একা মানুষ ভয় পায় — এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এমন সময় আবার একটা ভোঁতা শব্দ তাঁর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল।

কনকনে শীতেও ঘেমে উঠেছে মুয়েজ্জিনে কপাল। রইসমাইল সাহেবের মন বলছে, অশরীরী কোনো কিছুর অস্তিত্ব নয়, বরং জাগতিক কোনো বিপদ আসছে। চৌত্রিশ সালের দাঙ্গা দেখেছেন মোয়েজ্জিন ইসমাইল সাহেব। উন্মত্ত কিছু লোক মসজিদের গম্বুজটা ভাঙতে লেগেছিল। একটা বড় গর্ত হয়ে যায়। পরে ইংরেজরা সেটা সারাই করিয়ে দেয়। পনেরো বছর আগের সেই ভয়টা আবার হানা দিয়েছে মনে। অন্ধকারের দিকে বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে ভয়ার্ত চোখে তাকায়, ঠিক সেভাবেই আওয়াজের উৎস খুঁজতে চেয়ে পহেলি বোঝার চেষ্টা করছেন তিনি। উঠে এগিয়ে গেলেন। পরনে লম্বা কুর্তা আর লুঙ্গি। ইসমাইল সাহেবের চেহারাটা ছোটখাটো হলেও বেশ গাঁট্টাগোট্টা। আচমকাই অন্ধকারে কিছুর সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। ইসমাইলের মনে হয়েছিল কিছু নয়, কারো সঙ্গে। লম্বা চওড়া ভাগোয়াধারী এক ব্যক্তিকে নাকি তিনি দেখেছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি ধাতব দেববিগ্রহ। ব্যাপারটা এতক্ষণে মাথায় এসে গেছে। ওইদিন থেকেই মসজিদের বাইরে রামচবুতরায় শুরু হয়েছে ন’দিন ব্যাপী রামচরিতমানস পাঠ — নবপাঠ। বসেছে কীর্তনের আসর। সেই কীর্তনিয়া এবং বৈরাগীরাই মসজিদে ঢুকে পড়েছে, দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে রামজন্মভূমির দাবী ফলাবে বলে।

ইসমাইল সাহেব ওই ব্যক্তির হাত থেকে বিগ্রহ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় যাহোক করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ছুটতে থাকেন। এভাবে প্রায় দু ঘণ্টা পথ চলার পরে গিয়ে পৌঁছান ঘোসিয়ানা মুসলিমদের গ্রামে। সেখানে গ্রামবাসীরা তাঁর সেবা করেন। খাবার আর শীতবস্ত্রের জোগান দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরে ইসমাইল সাহেব আর কখনো বাবরি-মুখো হননি।

লোকমুখে অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে রামভক্ত এবং ঐস্লামিক শাসকদের মধ্যেকার সংঘর্ষের ইতিহাস গোটা উত্তরপ্রদেশে আজও ছড়িয়ে রয়েছে। শোন যায়, এখনো পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। সম্ভবত ১৯৪৯ সালের ২২শে ডিসেম্বরের মতো কূটনৈতিক সংঘর্ষের নজির বাবরির ইতিহাসে না এর আগে কেউ দেখেছে, না এর পরে। ২৩ তারিখ ভোর তিনটে নাগাদ হইচই পড়ে গেল। কারা যেন খবর ছড়িয়ে দিল— বালক রামলাল্লা স্বয়ং বিরাজমান হয়েছেন রামজন্মভূমিতে।

এক সাধু অভিরাম দাস নিজের সঙ্গীদের নিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গাইতে শুরু করলেন ‘ভয়ে প্রকট নিরালা দীন দয়ালা…’। ঈশ্বর নিজের বাল-রূপে আবির্ভূত হয়েছেন মসজিদের মধ্যে। রামজ্বি ফিরে এসেছেন বনবাস শেষে। তিনি রামলাল্লা রূপে ফিরেছেন। রামলাল্লা বিরাজমান!

এবার অভিরাম দাস বাবাজ্বিকে একটু চিনে নেওয়া যাক। এঁকে হয়তো আমরা ভুলে গেছি, কিন্তু ইতিহাস ভোলেনি। অভিরাম দাস কারো কাছে ‘রামজন্মভূমি উদ্ধারক’। কেউ বলে, বিহার থেকে অযোধ্যায় আসা একটা বেকার ছেলে, যার মুখে সবসময় খিস্তিখেউড় চলত, সে ওই রাতে রামলাল্লার মূর্তি মসজিদের মধ্যে রেখে এসে জননায়ক হয়ে গেল — মুহম্মদ ইসমাইল নাকি ২২শে ডিসেম্বরের মধ্যরাতে মসজিদে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিরাম দাসকেই দেখেছিল। অমন লম্বা চওড়া চেহারা আর কারো ছিল না।

সে যাই হোক, আমার কাজ লিখে চলা — বিহঙ্গের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে দেখতে সবকিছু নথিবদ্ধ করা। পাঠক নিজের নিজের কোণ খুঁজে নেবেন এর মধ্যে।

সবই তো হল, এবার বলটা চলে গেল প্রশাসনে কোর্টে। ভারত সরকার এবং তার আধিকারিকদের ভূমিকা কী ছিল?

রামজন্মভূমি – বাবরি মসজিদ নিয়ে তরজা তো কারো অবিদিত নয়। সরকারি পাহারার ব্যবস্থা প্রথম থেকেই করা ছিল। শিফটে ডিউটি চেঞ্জের ব্যবস্থা। রাতে যে দুজন পাহারা দিতেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হিন্দু, অন্যজন মুসলিম। অভিযোগ তোলা হয় যে হিন্দু পাহারাদার নিজের ডিউটিতে কাউকে বা কাদেরকে মসজিদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েছিল, তাই রামলাল্লার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। মসজিদের ভেতরের দেওয়ালে খোদাইগুলোকে অনুপ্রবেশকারীরা ঘষে ঘষে তুলে দিয়ে গেরুয়া – হলুদ রং দিয়ে লিখে দিয়েছিল রামসীতার নাম। আর যিনি মুসলিম পাহারাদার তাঁর বক্তব্য কী ছিল?

ভদ্রলোকের নাম আবুল বরকত। যেহেতু মূল ঘটনাবলী তাঁর ডিউটি পিরিয়ডে ঘটেছিল, তাই তাঁর দেওয়া জবানবন্দীর একটা বড় ভূমিকা ছিল তো বটেই। তিনি কী বলেছিলেন?

আবুল বরকত লিখিত ভাবে বিবৃতি দিয়েছিলেন—

আমার নাম আবুল বরকত। শ্রীরামজন্মভূমি (বাবরি মসজিদ)তে আমাকে ডিউটিতে নিয়োগ করা হয়েছে, যবে থেকে এই ডিউটি দেওয়া হয়েছে তবে থেকেই আমি নিয়মিত ভাবে রিপোর্ট করে গেছি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুরা কোনো ধরণের অনৈতিক কাজ করেননি। ২২-২৩ শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯-এ ভোররাত ২টো নাগাদ যখন আমার ডিউটি চলছিল, তখন বাবরি মসজিদের মাথায় চাঁদের আলোর মতো একটা আলোর ছটা ছেয়ে যায়। আমি অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম, আলোটা আস্তে আস্তে সোনালি হয়ে গেল। মসজিদ আলোয় আলো হয়ে উঠল। আলোর কুয়াশা যেমন হয়। দেখলাম, একটা চার – পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেকে, কী সুন্দর দেখতে তাকে! হৃষ্টপুষ্ট দেহ, কোঁচকানো চুল। জীবনেও অত সুন্দর শিশুর মুখ দেখিনি আমি। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গেল। জ্ঞান হারালাম। যখন সম্বিৎ ফিরল, তখন দেখলাম মসজিদের সদর দরজার তালা ভেঙে অনেক হিন্দু ভক্ত ঢুকে গেছে। ভিড় উপচে পড়ছে। সবাই গান গাইছে — ‘ভয়ে প্রকট নিরালা দীন দয়ালা…’। মসজিদের ভেতরে রূপোর সিংহাসনে বিরাজ করছে একটি দেবমূর্তি। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ঊর্ধ্বতন আধিকারিককে রিপোর্ট করি। এর বাইরে আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।

আর আধিকারিকদের ভূমিকা?

তার আগে পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই শক্তি সিংহের নাম। খেয়াল করেছেন কিনা জানি না শ্রীরামজন্মভূমির ভূমিপূজার আসরে অভ্যাগত হেভিওয়েট ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন শক্তি সিংহ। ইনি ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি হওয়া ছাড়াও এঁর আরো একটি পরিচয় রয়েছে। ইনি ১৯৪৯ সালে ফৈজাবাদের সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরুদত্ত সিংহের পৌত্র।

ডিসেম্বর মাসের রামলাল্লা প্রকটের এই ঘটনার আগে এই গুরুদত্ত সিংহর সঙ্গে দেখা করেই অভিরাম দাস বলেছিলেন — ‘আমি বার বার স্বপ্ন দেখি ওই বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে শ্রীরাম আবির্ভূত হয়েছেন।’

গুরুদত্ত সিংহ এই কথা শুনে বলেছিলেন…

অভীক মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.