১৯৯৯ সালের গরমকাল। বিকেলের দিকটাতে মতিলাল নেহরু মার্গের একটি বাড়িতে বসে এক বিরল রাজনীতিকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন সাংবাদিক শেখর গুপ্তা। বাড়ি বড়সড়, কিন্তু আসবাবের বিলাস নেই। যে ক’টা ফার্নিচার রয়েছে, সেগুলোও বেশ লঝঝড়ে। নড়েচড়ে বসলেই ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হয়। একটা বুড়ো ট্রেডমিল। অজস্র বইপত্র। খবরের কাগজ পড়ে আছে ইতিউতি। আর আছে একখানা কম্পিউটার। এটুকুই সম্পত্তি। শেখর গুপ্তার সামনে বসে আছেন অন্ধ্রপ্রদেশের বৃহস্পতি তথা ভারতীয় রাজনীতির অন্তিম চাণক্য। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ঠাকুরদাদার মতোই তিনি গল্প বলে চলেছেন। কখনো কারগিল যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করছেন, কখনো বা নিজের কপাল নিয়ে। কথার পিঠে কথা এসে পড়ছিল। শেখর গুপ্তা অযোধ্যার বাবরি ধ্বংসের কথা তুললেন — ‘কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গুলি চালানোর অর্ডার আপনি দিলেন না কেন?’
উলটো দিকের মানুষটা কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে একটা প্রশ্নই ছুঁড়ে দিলেন — ‘যারা মসজিদ ভাঙছিল, তারা কী বলে চিৎকার করছিল জানেন?’
ঘাগু সাংবাদিক শেখর। তিনি প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন আশা করেননি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলেন নরসিমা রাওয়ের দিকে। আজ্ঞে হ্যাঁ, শেখরের সামনে তখন পি ভি নরসিমা রাও। এমনি এমনি তাঁকে অন্ধ্রের বৃহস্পতি বলা হতো না — তিনি কুশাগ্র মেধার অধিকারী, হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর বিরল পাণ্ডিত্য, তিনি পনেরোটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা ব্যক্তিত্ব। নরসিমা রাও যখন যুক্তি রাখছেন, প্রশ্ন রাখছেন, তার মানে সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেই এক প্রহেলিকা হবে। সাংবাদিক উত্তর দেওয়ার সাহস দেখালেন না।
নরসিমা রাও বললেন — ‘উয়ো বোল রহে থে…রাম রাম…য়হিঁ না?’
নরসিমা কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। তিনি বলেই চললেন — ‘আচ্ছা, ধরে নিলাম আমার আদেশে বাহিনী গুলিও চালাত। শ’য়ে শ’য়ে লোক মরতো। যারা আদেশ পালন করতে গুলি চালাত, তারাও তো মানুষ — এত মৃত্যু দেখে তারা কী বলত?
রাম রাম…’
শেখর নির্বাক।
‘কারণ তাঁদের মনেও ওই একই রাম। এখন যদি ওই বাহিনীরই কয়েকজন উন্মত্ত জনতার পক্ষ নিয়ে বন্দুক ধরে বেঁকে দাঁড়াত? তাহলে আগুন জ্বলত! আর সেই আগুনে পুড়ে যেত গোটা ভারত…!’
এই হলেন পি ভি নরসিমা রাও, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে নাকি তিনি ধ্বংসের খবর শুনে কোনো পদক্ষেপ নেননি। সুবিখ্যাত সাংবাদিক শ্রী কুলদীপ নায়ার নিজের আত্মজীবনী ‘বেয়ন্ড দ্য লাইন্স’ বইতে লিখেছেন:আমি যদ্দূর জানি, (বাবরি) ধ্বংসের ব্যাপারটাতে রাওয়ের একটা গোপন সম্মতি ছিল। করসেবকরা যখন মসজিদ ভাঙতে ওঠে, তখন তিনি পূজায় বসেন; আর সেই পূজা শেষ হল কখন, না যখন শেষ পাথরটাকে উপড়ে ফেলা হল। মধু লিমায়ে আমাকে বলেছিলেন, পূজা চলাকালীন রাওয়ের এক সহযোগী রাওকে গিয়ে বলেন, মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে — ব্যাস পূজাও তখনই শেষ হয়ে যায়।’
কূলদীপ নায়ার। ভারতীয় সাংবাদিকতার অন্যতম উজ্জ্বল মুখ। এহেন ব্যক্তিত্ব যখন রাও সাহেবকে নিয়ে এমন কথা লেখেন তা অবশ্যই জনমানসে প্রভাব ফেলবে। রাওয়ের বিরোধীরা আজও বলেন, রাও পুজোর নাটক করে মসজিদ ধংসে বাধা দেননি। আর রামমন্দিরের পক্ষধারীরা বলেন, রাও চার ঘণ্টা ধরে পুজো করে মন্দিরের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। যে যার মতো ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু কুলদীপ নায়ার এত বড় কথা কীসের সাপেক্ষে লিখে দিলেন? মধু লিমায়ের কথা শুনে।
কোন মধু লিমায়ে?
সোশ্যালিস্ট লিডার। নরসিমা রাওয়ের বিরোধী ব্যক্তি।
তিনি কি রাওয়ের গৃহে সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন?
না। ছিলেন না।
তিনি কীভাবে রাওয়ের পূজার কথা জানলেন?
মধু লিমায়ে নাকি পি এম ও-এর কারো কাছ থেকে এই কথাটা শুনেছিলেন।
কী মারাত্মক এক তথ্য বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হল। রাওয়ের তৎকালীন মিডিয়া অ্যাডভাইজার শ্রী পি ভি আর কে প্রসাদ লিখছেন, ‘শ্রী রাওয়ের বাসভবনে পূজার জন্য কোনো আলাদা ঘরই ছিল না। তাঁর শয়নকক্ষে প্রভু ভেংকটেশ্বরের একটি ছবি টাঙানো ছিল। প্রতিদিন স্নান সেরে শ্রী রাও ছবির সামনে দশ সেকেন্ডের জন্য প্রার্থনা জানাতেন। তাঁর সহযোগীরা ছবির সামনে ধূপ জ্বেলে দিত।’
কেউ বলে রাও বাবরি ধ্বংসের সময় পূজা করছিলেন, কেউ বলে ঘুমোচ্ছিলেন। অর্জুন সিংহ, রাও – লবির আরেক বিরোধী নেতা। তিনি নিজের আত্মজীবনী ‘আ গ্রেইন অব স্যান্ড ইন দ্য আওয়ারগ্লাস অব টাইম’ বইতে লিখেছেন যে, ওই সময়ে রাও সাহেবকে ফোন করেও তিনি নাকি পাননি। রাও নিজেকে ঘরে ঢুকে বসেছিলেন। নির্দেশ ছিল, কোনো মতেই যেন তাঁকে বিরক্ত না করা হয়। অথচ সেই সময়ে রাওয়ের কাছেই অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটিতে থাকা এক পুলিশ আধিকারিক কিশোর কুণালের বক্তব্য অনুসারে রাও সাহেব পূজাতেও ব্যস্ত ছিলেন না, ঘুমোতেও যাননি। তিনি তৎকালীন ইউনিয়ন হোম সেক্রেটারি মাধব গোড়বলের কাছ থেকে ফোনে সমানে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ নিচ্ছিলেন। মাধব গোড়বলে নিজের বই ‘অ্যান আনফিনিশড ইনিংস’-এ এই কথাকেই সমর্থন করে গেছেন।
সবদিক বিচার করলে বলা চলে, একদা কোনো এক আক্রমণকারীর হাতে হওয়া একটা ভুল কাজকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকা কিছু উন্মত্ত মানুষের ওপরে গুলি চালিয়ে আরেকটা ভুল করে ইতিহাসের পাতায় আরেক আক্রমণকারীর জন্ম দিতে চাননি রাও সাহেব। নিজেও গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। এবং উত্তরপ্রদেশে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকার ফেলেও দেননি। চাইলেই পারতেন। এই নিয়ে শেখর গুপ্তাকে রাও সাহেব বলেছিলেন, ‘করে তো কোনো লাভ হতো না। ওই পরিস্থিতিতে লখনউতে লোক পাঠানো, ক্ষমতা দখল করার জন্য একটা গোটা দিন লাগতই। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল।’
আর কল্যাণ সিংহের বাড়িতে কী চলছিল ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর দুপুরে?
ফাইভ কালিদাস মার্গ। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে বসে লালজি ট্যান্ডন এবং ওমপ্রকাশ সিংহ। বসে আছেন কল্যাণ। সামনে খোলা টিভি সেটে অবস্থার দিকে সমানে নজর রেখে চলেছেন তিনজন। মধ্যাহ্ন ভোজন চলছে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরে উপস্থিত রয়েছেন তাঁর প্রধান সচিব যোগেন্দ্র নারায়ণ। সেখানে বেশ কয়েকজনকে খেতেও দেওয়া হয়েছে। হঠাৎই টিভিতে দেখাতে শুরু করল কয়েকজন করসেবক বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠে পড়ে কোদাল দিয়ে ঘা মারতে শুরু করে দিয়েছে।
মসজিদের সামনে যথেষ্ট সংখ্যায় আধা সামরিক বাহিনী উপস্থিত থাকলেও করসেবকের দল বাবরি মসজিদ আর বাহিনীর মধ্যে এমন একটা মানব-বন্ধনী বানিয়ে রেখেছে যে তাদের পেরিয়ে ভেতরে যেতে পারছে না বাহিনী।
ঠিক সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী নিবাসে দৌড়ে ঢুকলেন উত্তর প্রদেশের পুলিশের মহানির্দেশক এস এম ত্রিপাঠী। ঢুকেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। প্রধান সচিব তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনার খবর ভেতরে পাঠালে মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলেন যে তাঁর খাওয়া শেষ না- হওয়া পর্যন্ত শ্রী ত্রিপাঠী যেন বাইরেই অপেক্ষা করেন।
নির্দিষ্ট সময় পরে শ্রী ত্রিপাঠী ভেতরে ঢুকেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করসেবকদের ওপরে গুলি চালানোর পারমিশন চাইলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন — ‘ম্যায় গোলি চলানে কা আদেশ নহিঁ দুঙ্গা — নহিঁ দুঙ্গা, সরকার জানি হ্যায় তো জায়ে।’
‘লেকিন স্যার, গোলি চালানে সে বাবরি মসজিদ কো গিরনে সে বচায়া জা সকতা হ্যায়।’
‘অগর গোলি চলাই জাতি হ্যায় তো কেয়া বহুত সে করসেবক মারে জায়েঙ্গে?’
‘জ্বি হ্যাঁ, বহুত সে লোগ মরেঙ্গে।’
‘ম্যায় আপকো গোলি চলানে কি অনুমতি নহিঁ দুঙ্গা। আপ দুসরে মাধ্যমোঁ জ্যায়সে লাঠিচার্জ ইয়া আঁসুগ্যাস সে হালাত পর নিয়ন্ত্রণ করনে কি কোশিশ করিয়ে।’
ডিজিপি এই কথা শুনে নিজের দফতরে ফিরে চলে গিয়েছিলেন। বাবরির শেষ ইট খুলে পড়ার পরে নিজের রাইটিং প্যাড টেনে আনিয়ে নিয়ে নিজের হাতে নিজের পদত্যাগপত্র লিখে সন্ধের মধ্যেই রাজ্যপালের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। লোকে বলে — ‘রাম কে নাম পর সরকার কুর্বান কর দি।’ তবে গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। শুরুটাও অবশ্য এখান থেকে হয়নি। এর আগে বা পরে বহুবার স্লোগান উঠেছে — ‘মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে!’
‘মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে!’ কে বলেছিলেন?
হালফিলে বাবরি ধ্বংস নিয়ে আনন্দ পটবর্ধনের তৈরি বিতর্কিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘রাম কে নাম’ বেশ চর্চায় চলে আসে। দেখলে শ্রী আদবানিকেই বিহারে রথ ঢোকার প্রাক্কালে বলতে দেখবেন — ‘ইয়ে জো রথ হ্যায়, লোকরথ হ্যায়, জনতা কা রথ হ্যায়। জো সোমনাথ সে চলা হ্যায় অউর জিসকে মন মে সঙ্কল্প হ্যায়। সঙ্কল্প কিয়া হুয়া হ্যায় কে, তিশ অক্টোবর কো ওঁহা পর পৌঁছ কর কারসেবা করেঙ্গে অউর মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে…’
ব্যাস! সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা ভারতে মীম ছড়িয়ে পড়ল—
মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে,
পর তারিখ নহিঁ বতায়েঙ্গে।
পলিটিক্যাল এজেন্ডা নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি কখনো সত্য ইতিহাসকে মেলে ধরতে পারে না। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। হয় বিদ্যার খামতি, নয় তো বুদ্ধির মন্দদশা দায়ী।
মন্দির ওহিঁ বনায়েঙ্গে… এই স্লোগান কিন্তু শ্রী আদবানিই প্রথম দেননি। দিয়েছিলেন অন্য একজন।

অভীক মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.