১৬ই অগস্ট ১৯৪৬ : সেদিন গোপাল মুখোপাধ্যায়রা রুখে না দাঁড়ালে কী হতে পারত?

সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর সময়টায় বিশেষরূপে সংগঠিত ও “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” শপথ–উচ্চারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুসলিম লীগের আক্রমণের মুখে গোপাল মুখোপাধ্যায়রা রুখে না দাঁড়ালে কী কী ঘটতে পারত তা বুঝতে গেলে ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগস্ট তারিখে মহম্মদ আলি জিন্নাহ্‌–র নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা প্রথমে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।

‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান
‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ তথা ছেচল্লিশের দাঙ্গা সংঘটিত হবার বহু পূর্বে, ১৯৪০ সালেই মুসলিম লীগ ভারতবর্ষকে টুকরো ক’রে ‘পাকিস্তান’ গঠনের পক্ষে একটি প্রস্তাব পাশ করে। এরপর ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেনে নবনির্বাচিত লেবার পার্টির সরকার ভারতবর্ষের জন্য একটি গণপরিষদ গঠনের অভিপ্রায় প্রকাশ করে, যে গণপরিষদ স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচনা করবে। এই পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়িত করবার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬–এর মার্চ মাসে ভারতবর্ষে একটি মিশন প্রেরণ করে। এই মিশনই ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামে সমধিক পরিচিত। ক্যাবিনেট মিশনের উদ্দেশ্য সফল করবার পথে প্রধান বাধা ছিল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতদ্বৈধ। মুসলিম লীগের বাসনা ছিল ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে নিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠন – আমরা আগেই দেখেছি যে এই মর্মে তারা ১৯৪০ সালেই একটি প্রস্তাব পাশ ক’রে ফেলেছিল। কিন্তু কংগ্রেস চেয়েছিল ভারতবর্ষ অটুট ও ঐক্যবদ্ধ থেকেই স্বাধীনতা লাভ করুক। অতঃপর ক্যাবিনেট মিশন শিমলায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যেকার মতদ্বৈধের অবসান ঘটাবার চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ মিশন নিজেদের তরফ থেকে একটি প্রস্তাব প্রকাশ করে, যে প্রস্তাব ‘ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান’ নামে খ্যাত। ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে তারিখে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ ও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে এই প্ল্যানটি প্রস্তাব করে, যে সরকারে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য দলের প্রতিনিধিরা থাকবেন।

এই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানে ভারতবর্ষের সংবিধানের একটি প্রাথমিক রূপরেখা দেওয়া হয় এবং এতে স্পষ্টভাবে মুসলিম লীগের তোলা ‘পাকিস্তান’ নামে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবীকে খারিজ করা হয়। এর পরিবর্তে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভারতের ব্রিটিশ শাসনাধীন অঞ্চল ও দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। তবে সেইসঙ্গে এই প্ল্যানে এও বলা হয় যে বিভিন্ন মুসলিম–অধ্যুষিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলি একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে কিছু স্বশাসিত মণ্ডলী গঠনের সুযোগ পাবে, এবং এই মণ্ডলীগুলি নিজেদের আইনসভা ও আমলাতন্ত্র গঠনের মতো স্বায়ত্তশাসনের নানারকম সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই প্ল্যানে আরও বলা হয় যে পনেরো বছর বাদে প্রাদেশিক মণ্ডলীগুলি যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইলে সে অধিকারও তাদের দেওয়া হবে।

কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের অন্তর্গত এই প্রাদেশিক মণ্ডলী গ’ড়ে তোলবার সংস্থানটির বিরোধিতা করে – বিশেষ ক’রে প্রাদেশিক মণ্ডলীগুলির হাতে পনেরো বছর বাদে যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে বেরিয়ে যাবার ক্ষমতাটি দেবার প্রশ্নে। কংগ্রেসের যুক্তি ছিল এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মণ্ডলী নির্মাণের সংস্থান থাকলে তা স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্য অদূর ভবিষ্যতে দেশভাগ–সহ ঘোরতর অস্থিরতা ও অন্য নানান সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এইসময় কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নেহরু একটি সাংবাদিক সম্মেলনে মন্তব্য করেন যে সংবিধান রচনার লক্ষ্যে গঠিত কোনো গণপরিষদ কখনোই আগে থেকে ঠিক ক’রে দেওয়া কোনো ‘সাংবিধানিক ফর্মুলা’ মেনে চলতে বাধ্য থাকতে পারে না। এইসময় মুসলিম লীগ বেঁকে বসে। তারা কিছুতেই ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের কোনো অংশে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটাতে দিতে রাজি ছিল না। জিন্নাহ্‌ নেহরুর মন্তব্যকে এই মর্মে গ্রহণ করেন যে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানটি ‘পত্রপাঠ খারিজ’ করছে। সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ্‌ মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী সমিতির সভা আহ্বান করেন, সেই সভায় ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের প্রতি মুসলিম লীগের পূর্বে প্রদত্ত সম্মতি ফিরিয়ে নেন এবং ‘মুসলিম কৌম’কে ১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ গ্রহণ করবার ডাক দেন।1 সেবছর ১৬ই অগস্ট ভোরবেলা বাংলা প্রদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন সুহ্‌রাবর্দীর তত্ত্বাবধানে2 কলকাতায় শুরু হয় মুসলিম লীগের দ্বারা আহূত, রীতিমতো পুস্তিকা বিতরণ ক’রে ‘কাফের’দের গণহত্যা আয়োজিত করবার নারকীয় কর্মসূচী।

কলকাতা থেকে শুরু হয়ে মুসলিম লীগের ডাকা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ নামক দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারতবর্ষে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ
আধুনিক ভারতের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ তথা ইতিহাসলেখক শ্রী সীতারাম গোয়েল নিজের আত্মজীবনীতে লিখছেন :

“কয়েকদিন বাদেই ১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্ট তারিখে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন সকাল সকাল কফি হাউসে গিয়ে দেখি যে সেটি বন্ধ রয়েছে। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদল উন্মত্ত মুসলিম জনতার হাতে আমি হয়তো মারাই যেতাম। আমার চোস্ত উর্দু এবং পশ্চিমা পোশাক আমাকে সে যাত্রায় রক্ষা করেছিল। এর মাত্র কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী এবং দু’বছর বয়সের শিশুপুত্র আমার সঙ্গে একটি বড় বাড়ির ছোট্ট একটা ঘরে থাকতে এসেছিল, যেটি একটি বিশাল মুসলিম এলাকার লাগোয়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ১৭ তারিখ সন্ধেবেলা আমাদের ঐ বাড়ি ছেড়ে পিছনের দেয়াল টপকে পালাতে হয়েছিল, তার কারণ একদল উন্মত্ত খুনে মুসলিম জনতা হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এর কিছুক্ষণ বাদেই সেনাবাহিনী যদি সেখানে এসে না পৌঁছত, তাহলে আজ যা লিখছি তা লেখবার জন্য আমি আর বেঁচে থাকতাম না।”

এখানে উল্লেখ্য যে সীতারাম গোয়েল আদতে ছিলেন হরিয়ানার মানুষ, তাঁর পিতৃদেব পাটজাত দ্রব্যের ব্যবসার সূত্রে কলকাতায় বাসা বেঁধেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী হ’ল একজন উচ্চশিক্ষিত কমিউনিস্টের নিজেকে নতুন ক’রে খুঁজে পাওয়ার আখ্যান, বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজের সনাতন হিন্দু সত্তাকে আবিষ্কারের আখ্যান। উপরের উদ্ধৃতিতে যে সময়কার কথা তিনি লিখছেন, সেসময় মতাদর্শগতভাবে তিনি সোশ্যালিজমের দিকে ঝুঁকে। ১৯৪৬–এর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র বিভীষিকা সংঘটিত হবার অল্প কিছুকাল পরেই তিনি মার্ক্সবাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং ক্রমশঃ কমিউনিস্ট পার্টির খুব কাছাকাছি চ’লে আসেন। কলকাতায় পার্টির ঘনিষ্ঠ বৃত্তে তাঁর আনাগোনা শুরু হয়, এমনকী তিনি ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়ার দ্বিতীয় দলীয় সমাবেশে অংশগ্রহণও করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর এই পর্বটি পড়লেই বোঝা যায় যে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র গণহত্যার কেবল বাইরের বীভৎসতার দিকটিই তাঁকে নাড়া দিয়েছে, অথচ এই গণহত্যার পিছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে – যে ইতিহাস ভারতবর্ষের মূল চরিত্রটিকে পাল্টে দেবার ও সমগ্র ভারতবর্ষকে একটিমাত্র সম্প্রদায়ের পতাকাতলে জোর ক’রে উপনীত করাবার বিগত বারো শতকব্যাপী লাগাতার প্রয়াসকে ধারাবাহিকতা প্রদান করেছে – সেই ইতিহাস সম্পর্কে তিনি তখনো সজাগ হয়ে ওঠেননি। এই দাবীর সত্যতা শ্রী গোয়েলের নিজের বয়ানে দেখে নেওয়া যাক :

“১৯৪৬–এর ১৬–১৭ অগস্ট জুড়ে যে ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ সংঘটিত হয়েছিল, তার অনেকখানিই আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় ছিল মৃতদেহের স্তূপ। আরো বহুসংখ্যক মৃতদেহ হুগলী নদীতে ভাসছিল। অগ্নিসংযোগ এবং উন্মত্ত জনতার আক্রোশের ফলস্বরূপ প্রভূত ব্যক্তিগত এবং সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস হতেও চাক্ষুষ দেখেছিলাম। চারিদিকে মৃত্যু এবং খাঁ খাঁ শূন্যতা আমার মধ্যে মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে নৈরাশ্য জাগিয়ে তুলল। কিন্তু আমি এই ব্যাপক গণহত্যার প্রকৃত কারণগুলি অনুসন্ধান করবার চেষ্টাই করলাম না – এমনকী যে রাজনৈতিক আন্দোলনটি এই গণহত্যার ইন্ধন জুগিয়েছিল সেটিকেও এর জন্য দায়ী ব’লে ঠাওরানোর কোনোরকম চেষ্টা করলাম না। তার বদলে আমি “দ্য ডেভিল ডান্স ইন ক্যালকাটা” শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলাম, যাতে এই অনর্থক নরসংহারের জন্য আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয় পক্ষকেই সমান দায়ী ব’লে বর্ণনা করেছিলাম। আমার কিছু বন্ধুরা মিলে দিল্লী থেকে সাইক্লোস্টাইল প্রতিলিপির মাধ্যমে ছাপা একটি সংবাদপত্র চালাত, তাতে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ ক’রে জনসমক্ষে প্রচারিত হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন বন্ধু আমার প্রবন্ধটিতে নরসংহারের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, এবং সেটির মধ্যে দিয়ে যে সাহিত্যিক উৎকর্ষ প্রকাশ পেয়েছে, তার তারিফ করেছিল।”

এইসময় তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আধুনিক ভারতের আরেকজন ক্ষণজন্মা চিন্তাবিদ তথা দার্শনিক শ্রী রাম স্বরূপ তাঁকে এই উটপাখিসুলভ আচরণের ব্যাপারে সতর্ক ক’রে দিয়েছিলেন :

“…এর দিনকয়েক বাদে রাম স্বরূপের কাছ থেকে যে চিঠিটি আমি পেলাম তার বয়ান ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সে আমার এই পক্ষপাতহীন অবস্থান এবং মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হিংসার সঙ্গে হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত হিংসাকে এক ক’রে ফেলাটা মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। আমি যাকে উভয়পক্ষের জন্যেই ধ্বংসাত্মক বিরোধ ব’লে বর্ণনা করেছিলাম তার মধ্যে ভালো এবং মন্দের বিচার করাতে সে জোর দিয়েছিল। তার মতে, মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছিল আক্রমণাত্মক, এবং এর পিছনে ছিল একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদগামী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার বাসনা, যে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে ভারতবর্ষের বিভাজন। আর অপরপক্ষে হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত হিংসামূলক কাজকর্ম করতে হয়েছিল আত্মরক্ষার্থে। এটি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তারা একটি অত্যন্ত মহৎ আদর্শ রক্ষা করবার কাজে ব্রতী হয়েছিল, যা হচ্ছে ভারতবর্ষের ঐক্য এবং অখণ্ডতা রক্ষা করা, যার জন্যে গৃহযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়া চলে।”

কিন্তু রাম স্বরূপের চেতাবনী সেই সময় শ্রী গোয়েলের মর্মে প্রবেশ করেনি। তিনি তখনো নিজের সোশ্যালিজম–সঞ্জাত ভাবাবেগে বুঁদ হয়ে ছিলেন। শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী, রাজনৈতিকভাবে অনাথ–অসহায়, নানাপ্রকার জুলুমের দ্বারা সন্ত্রস্ত এবং নিজভূমে একপ্রকার পরবাসী হয়ে যাওয়া একটি সম্প্রদায়ের আত্মরক্ষা করবার মরিয়া চেষ্টাকে সন্ত্রাসের মন্ত্রে দীক্ষিত, তোষণের রাজনীতির প্রশ্রয়পুষ্ট একটি ধর্মোন্মত্ত সম্প্রদায়ের খুনে অভিযানের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে শ্রী গোয়েল ১৬ই অগস্টের হত্যালীলার জন্য দু’দলকেই সমান নৈতিক দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর কথায় :

“আমায় স্বীকার করতেই হচ্ছে যে তার [অর্থাৎ শ্রী রাম স্বরূপের] এই যুক্তিগুলির মধ্যে আমি সেসময় কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। যে হত্যালীলায় হিন্দুরাও অংশগ্রহণ করেছে তার দায় থেকে হিন্দুদের মুক্ত ক’রে তাদের ক্ষমা করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এটা যদি মেনেও নেওয়া হয় যে মুসলিমরাই ব্যাপারটা শুরু করেছিল, তাহলেই বা কীভাবে বলি যে হিন্দুদের অবস্থান নৈতিক দিক দিয়ে উচ্চতর?”

এখানে রাম স্বরূপের চোখ দিয়েও তৎকালীন রাজনীতির চালচিত্রটি দেখে নেওয়া যায়। রাম স্বরূপের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক লেখনীতে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও সেকালের ভারতবর্ষের অন্যান্য মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির অন্তঃসারশূন্যতা এবং তথাকথিত শিক্ষিত ‘সেকুলার’ হিন্দুদের বাস্তবজ্ঞানের অভাবের দিকগুলি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। একদেশদর্শী কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব; কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের মেকি ‘সেকুলারবাদ’–এর নামে খোলাখুলি ও অযৌক্তিক হিন্দু–বিদ্বেষ; শিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী হিন্দুদের রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান ও সাধারণ বাস্তববুদ্ধির অভাব; এবং আকছার পেশীশক্তির আস্ফালন ব্যবহারে অভ্যস্ত একটি ক্ষমতালিপ্সু সাম্প্রদায়িক শক্তির চরণে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ – এই কারণগুলিই যে মিলিতভাবে ১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্টের অভিশপ্ত দিনটিতে এ বঙ্গের তথা ভারতবর্ষের সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের করুণ পরিণতিটি ডেকে এনেছিল, শ্রী গোয়েলের জবানিতে রাম স্বরূপের রচনা সম্পর্কে শুনলে সেকথাই আরও একবার পরিষ্কার হয় :

“এর কয়েক মাস আগে রাম স্বরূপ আমাকে তার বার্নার্ড শ’–এর কায়দায় লেখা একটি দীর্ঘ সংলাপের টাইপ করা প্রতিলিপি পাঠিয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল “লেট আস্‌ হ্যাভ্‌ রায়ট্‌স্‌ : দ্য ফিলজফি অফ দোজ্‌ হু ওয়ন্ট টু ডিভাইড ইন্ডিয়া বাই স্ট্রীট রায়ট্‌স্‌”। এই সংলাপের মধ্যে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভার অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার দেখা মিলেছিল। এমনকী এতে পার্টিশনের বিষয়টিতে ডঃ আম্বেদকরও তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় কিছু অবদান রেখেছিলেন। এটি বারবার ক’রে পড়তে পড়তে আমি খুব হেসেছিলাম। এতে মুসলিম লীগের নেতারা – বিশেষ করে মি. জিন্নাহ্ – নিজেদের যারপরনাই হাসির খোরাক বানিয়ে তুলেছিলেন। এই সংলাপে পণ্ডিত নেহরুরও একই অবস্থা হয়েছিল, যিনি তাঁর নিজের ভাষায় “হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা” ছাড়া আর কিছু দেখতেই পান না; এবং কোনো বিষয়েই একবারে দু–তিনটের বেশি সুসংলগ্ন বাক্য বলতে পারেন না। অনেক নেতারই মুখের কথা তাদেরকে দিয়ে এমনভাবে বলিয়ে নেবার ক্ষমতা রাম স্বরূপের ছিল যাতে ক’রে জনতার সমক্ষে তাদের ভাষণ যে চাকচিক্যে মোড়া থাকে তা সম্পূর্ণ উবে গিয়ে কথাগুলির আসল মূল্য বেরিয়ে পড়ত – এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলির মূল্য হ’ত শোচনীয় রকমের কম। কিন্তু এই সংলাপের ছত্রে ছত্রে যে গুরুতর তাৎপর্যটি প্রকাশ পাচ্ছিল সেটি অনুধাবন করতে আমি আবারও ব্যর্থ হলাম। একদল গুণ্ডা, মস্তান, সং এবং উন্মাদের পদতলে একটি জাতির সমগ্র নেতৃবৃন্দ শুধু তাঁদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই নয়, এমনকী নৈতিক মূল্যবোধ তথা বিচারবুদ্ধিও যেভাবে বন্ধক রেখেছেন, সেই ট্র্যাজিক পরিণতিটি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই ট্র্যাজিক পরিণতিটি আরও বেশি করুণ হয়ে পড়েছিল এই কারণে যে এই জাতীয় নেতৃবৃন্দের একটি বৃহৎ অংশ ছিলেন শিক্ষিত হিন্দুরা, যাঁদেরকে চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অংশ ব’লে গণ্য করা হ’ত।”

এতসব তথ্যপ্রমাণ এবং বারংবার চোখে আঙুল দিয়ে আসল সত্যিটা দেখিয়ে দিতে পারেন এমন একজন স্নেহশীল বন্ধুর সান্নিধ্য থাকা সত্ত্বেও সেসময় মার্ক্সীয় চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত শ্রী গোয়েল কিন্তু বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছিলেন – যেমনটা আজকের দিনেও অনেক তথাকথিত শিক্ষিত ‘সেকুলার’ হিন্দুর ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়। যাইহোক, তাঁর তৎকালীন বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী করা মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য উদ্ঘাটিত হয়। সে সত্যটি হ’ল – ১৯৪৬–এর কিছু আগে থেকেই (বা বলা ভাল, ১৯৪০ সাল নাগাদ মুসলিম লীগ ভারত ভেঙে পৃথক ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের দাবী তোলবার সময় থেকেই) সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে শোষক–নিপীড়ক–প্রবঞ্চক ও সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে বঞ্চিত–নিপীড়িত–প্রতারিত ব’লে চিত্রিত করবার একটা প্রচেষ্টা ভারতবর্ষে রচিত কমিউনিস্ট সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকট হয়ে উঠছিল। সংখ্যালঘু ব’লেই মুসলিম সম্প্রদায় বরাবর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার – এই আখ্যানটি আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে, আমাদের সমসাময়িক রাজনীতির অনুষঙ্গে খুবই চেনা ও চালু আখ্যান। “সাম্প্রদায়িক কারণবশতঃ এদেশের সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের আর্থ–সামাজিক নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার” – ভারত তথা হিন্দুসমাজকে ক্রমাগত কলঙ্কিত করতে থাকা এই ঘৃণ্য আখ্যানরূপী কার্পেটের তলাতেই এদেশের সংখ্যালঘুদের যাবতীয় সাম্প্রদায়িক পেশীশক্তির আস্ফালন, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জুলুম, হিংসাশ্রয়ী ও অসামাজিক কার্যকলাপ, ছলে–বলে–কৌশলে হিন্দু–শিখ–বৌদ্ধ–জৈনদের ধর্মান্তরণের যাবতীয় অন্যায় দুষ্কর্ম লুকিয়ে ফেলবার চেষ্টা করা হয়। এই ট্র্যাডিশন দেশভাগের পর থেকে শুরু ক’রে একেবারে আজকের তারিখ অবধি সমানে চলছে। ১৯৪৬ ও তার অব্যবহিত আগেপরেও যে একই পন্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্যায় জুলুম সহ্য করা এবং এমনকী মূলধারার সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশে বাধা দিয়ে সেসব অন্যায়কে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা হ’ত তার প্রমাণ তৎকালীন জবানবন্দীতে পাওয়া যায় :

“ইতিমধ্যে আমি মানসিকভাবে এবং বৌদ্ধিক বিবেচনায় হিন্দু ও মুসলিমদের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখবার অবস্থানে চলে এসেছিলাম। তবে বলে রাখি যে তখনো আমি হয়তো সামান্য হলেও মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির দিকে কিছুটা ঝুঁকে ছিলাম। পাকিস্তানের দাবীর সমর্থনে যেসব কমিউনিস্ট পুস্তিকা আমি পড়েছিলাম সেগুলি আমার মধ্যে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু সেসময় “নিউ এজ” শীর্ষক যে কমিউনিস্ট সাপ্তাহিক পত্রিকাটি আমি নিয়মিত কিনে পড়তে শুরু করেছিলাম, সেটি আমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করল। এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে সবসময় মুসলিমদের নিপীড়িত কৃষক সম্প্রদায় এবং সর্বহারা গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করা হ’ত; আর হিন্দুদের চিত্রিত করা হ’ত শোষক জমিদার এবং পুঁজিবাদী হিসেবে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে এই পত্রিকায় লাগাতার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে আপস করা, এমনকী দালালি করবার অভিযোগ তুলে আক্রমণ করা হ’ত। অভিযোগটি ছিল এই যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একজোট হয়ে গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার লক্ষ্যে কাজ না ক’রে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ক্ষমতা এবং সম্পদ হস্তান্তরের চুক্তি করছে।”

এইভাবেই সত্যের অপলাপ ঘটাবার একটি বামপন্থী পরম্পরা এদেশে গজিয়ে উঠেছে, যার অঙ্কুরোদ্গমের বারতা আমরা শ্রী গোয়েলের আত্মজীবনীতে পেয়ে যাই। এই বিষবৃক্ষ চারা–অবস্থাতেই ১৬ই অগস্ট, ১৯৪৬–এর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ও তৎপরবর্তী নোয়াখালী–ঢাকা–লাহোর–পেশোয়ারে সংঘটিত হিন্দুমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করবার ও সে দাঙ্গার দায় হিন্দুদেরই ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার মতো শক্তপোক্ত রাজনৈতিক প্রচারের ভিত্তি গড়তে সক্ষম হয়ে থাকলে অধুনা মহীরুহে পরিণত হয়ে গিয়ে দেশ ও সমাজের কতবড় ক্ষতিসাধন করতে পারে তা পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন।

‘গুণ্ডা’ : প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের জবানবন্দী
১৬ই অগস্ট, ১৯৪৬–এর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ সম্পর্কে কী বলছেন এদেশ ও বিদেশের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রথিতযশা ইতিহাসবিদেরা? ক্যামব্রিজের সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রির অধ্যাপিকা জয়া চ্যাটার্জির মতে, মূলতঃ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ও হিন্দু মহাসভাই নাকি ছেচল্লিশের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’–এর জন্যে দায়ী! তাঁর দাবী, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মধ্যবিত্ত সদস্যরাই মূলত সংগঠিত হয়ে দাঙ্গা করেছিল; আর এই পুরো ব্যাপারটি সংঘটিত করতে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় – তাঁরাই নাকি উন্মত্ত হিন্দু জনতাকে সঞ্চালিত করেছেন! এ দাবী কতটা সঠিক, তা তৎকালীন বঙ্গদেশীয় শিক্ষিত, অভিজাত হিন্দু নেতৃবৃন্দের দিকে তাকালেই বোঝা যায় – এক ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বাদ দিলে শরৎচন্দ্র বসু, ডঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত, অভিজাত হিন্দু বাঙালিই কংগ্রেসী রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। কংগ্রেস সেসময় গান্ধী–নেহরুর নেতৃত্বে দাঙ্গা লাগাতে নয়, দাঙ্গা থামাতে তৎপর। এঁরা নাড়বেন দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী হিন্দু জনতার কলকাঠি? এমনতর অদ্ভুত দাবী কী ক’রে অ্যাকাডেমিক ইতিহাসচর্চার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়, তা ভাবলে অ্যাকাডেমিক ইতিহাসচর্চার মাপকাঠির বিষয়েই ঘোর সন্দেহ জাগে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে কমিউনিস্টদের মুখপত্র “নিউ এজ” পত্রিকায় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়দুটির আর্থ–সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণের নামে যে অপপ্রচার চলেছিল, তার কোনো মূলগত পার্থক্য আদৌ আছে কি? চল্লিশ–পঞ্চাশের দশকের কমিউনিস্ট মুখপত্রটি ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের অন্যতম সিদ্ধান্ত শ্রেণী সংগ্রামের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে হিন্দুদের শোষক–নিপীড়ক–প্রবঞ্চক পুঁজিপতি হিসেবে চিত্রিত করত, আর তার উল্টোদিকে মুসলিম সম্প্রদায়কে (স্রেফ সংখ্যালঘুত্বের যুক্তিতে) শোষিত–নিপীড়িত–বঞ্চনার শিকার হিসেবে উপস্থাপিত করত। এর অর্ধশতক সময় অতিক্রান্ত হবার পর ক্যামব্রিজের খ্যাতনামা অধ্যাপিকাও সেই একই বস্তাপচা শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বকে একটু এদিক–ওদিক ক’রে নতুন মোড়কে পেশ করলেন। তাঁর লেখায় হিন্দুরা হয়ে গেল ‘প্রভাবশালী, অভিজাত, শিক্ষিত সম্প্রদায়’, যারা নাকি মুসলিম লীগের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র সুযোগ নিয়ে কয়েকটি ধর্মীয় সংস্থার সঙ্গে আঁতাত ক’রে বাংলার ‘খেটে খাওয়া’ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা পাকিয়ে তুলে তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল, যাতে কলকাতা শহরটার উপর ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ’ নিজেদের হাতে আবার ফিরিয়ে আনা যায়!

গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাত্কার গ্রহণকারী ইতিহাসবিদ সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, গোপাল মুখুজ্যে আর যাই হ’ন, ‘বিভাজনকারী’ চরিত্র তিনি নন। দাক্ষিণাত্য থেকে প্রকাশিত বাম–ঘেঁষা সর্বভারতীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে3 সন্দীপবাবুর মন্তব্য :

“১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিতে গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে সাম্প্রদায়িক বিভেদ–সৃষ্টিকারী আখ্যা দেওয়া অর্থহীন হবে কারণ সেই সময়ের প্রেক্ষিতে‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটির তাৎপর্যই ছিল আলাদা। গোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রথম লক্ষ্য ছিল তাঁর নিজের অঞ্চলটিকে মুসলিম আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। যদিও একথা সত্যি যে গোপাল মুখোপাধ্যায় দাঙ্গার সূচনা করেননি, তবু এটাও ঘটনা যে তিনি হিন্দু বাঙালি যুবকদের একটি বিশাল দলকে সংগঠিত করেছিলেন এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।”

ঐ সাক্ষাৎকারে সন্দীপবাবু আরও বলেন, যে মধ্য কলকাতার একটি মাংসের দোকানের মালিক গোপাল মুখোপাধ্যায় “মুসলমানদের বিরুদ্ধে কখনও বিদ্বেষ পোষণ করেননি”, তার কারণ নিজের ব্যবসার কাজে তাঁকে নিয়মিত মুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে মেলামেশা করতে হ’ত। সন্দীপবাবুর মতে, ছেচল্লিশের দাঙ্গার দিনগুলোতে মুসলিম দাঙ্গাকারীরা উত্তরে দাপিয়ে যখন মধ্য কলকাতায় পৌঁছে গেছে, কেবলমাত্র তখনই গোপাল মুখোপাধ্যায় হিংসার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন যে “মধ্য কলকাতার অনেক মানুষের সঙ্গে আমার কথোপকথন–সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এটা বলতে পারি যে ঐ এলাকায় গোপাল মুখোপাধ্যায় একজন প্রভাবশালী চরিত্র ছিলেন; এবং এইসব কথোপকথনের মাধ্যমে আমি এও জানতে পেরেছিলাম যে দাঙ্গার সময় গোপাল মুখোপাধ্যায় প্রচুর হিন্দু পরিবার এবং বিধবাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।”

আবার অন্যদিকে অধ্যাপক সুরঞ্জন দাসের মতে, হিন্দু–মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণীর মধ্য থেকেই খেটে–খাওয়া মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের আর্থ–সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া কয়েকটি পেশার মানুষজনই নাকি মূলতঃ এই দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কসাই, সাফাইকর্মী প্রভৃতি পেশার লোকেরাই ছিল মুখ্য, অধ্যাপক দাসের এমনটাই অভিমত। অধ্যাপক দাস ও অধ্যাপিকা চ্যাটার্জি উভয়েই কলকাতার ছেচল্লিশের দাঙ্গায় ‘গুণ্ডা’ শ্রেণীর অংশগ্রহণের কথা জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। সেইসূত্রে গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী, যিনি কলকাতার হিন্দু আমজনতার আত্মরক্ষা ও সম্ভ্রমরক্ষার খাতিরে বাহিনী গ’ড়ে তুলে পাল্টা আক্রমণ ক’রে মুসলিম লীগের উন্মত্ত বাহিনীর বুকে ভয় ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি অ্যাকাডেমিক ইতিহাসচর্চায় ‘গুণ্ডা’ নামেই চিহ্নিত হয়ে আছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্ট তারিখে জিন্নাহ্‌–র নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’তে লালবাজারে পুলিশের কন্ট্রোল রুমে ব’সে সরাসরি দাঙ্গা পরিচালন করা হোসেন সুহ্‌রাবর্দীর হিন্দু নিধন যজ্ঞের অভিশপ্ত সেই দিনটিতে গোপাল ‘পাঁঠা’ মুখোপাধ্যায়, যুগলচন্দ্র ঘোষ, গিরিধর বসু, সমর্থ বসুদের মতো তথাকথিত ‘গুণ্ডা’রা না থাকলে ঠিক কী কী ঘটতে পারত?

কী কী ঘটতে পারত তা অনুমান করবার দরকার পড়ে না – মুসলিম লীগের পরিকল্পনা ও খোলা আহ্বানগুলির দিকে চোখ রাখলেই সেকথা স্পষ্ট হয়।

প্যারিস–স্থিত লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞান–সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিয়ঁস–পো’র পত্রিকায় প্রকাশিত ছেচল্লিশের দাঙ্গার একটি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে :

“[T]here may have been very rational calculations at work on the side of the instigators and perpetrators of the killings. It was actually a fight over who was to be master of Calcutta. By organizing huge demonstrations, occupying the Maidan and using whatever State power it had at its disposal, the Bengal Provincial Muslim League was trying to stake its claim to Calcutta as the capital of a Muslim Bengal, which would be part of Pakistan, whose shape was still hazy at the time. A massacre was probably not the League’s goal (although one pamphlet circulating amongst Muslims warned of a “general massacre” of Kafirs, infidels, i.e. Hindus), but the League’s supporters did not shrink from using violence on a significant scale to advance their objectives. Although the use of violence by a minority against the majority could appear irrational to us, in the mindset of many Muslims at the time it was not so, because they considered the Hindus cowardly and effeminate, and thought they were no match for Muslims in an open fight.”

‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ সংঘটিত হবার ঠিক তিনদিন আগে, ১৯৪৬–এর ১৩ই অগস্ট তারিখে প্রকাশিত মুসলিম লীগের মুখপত্র ‘দ্য স্টার অফ ইণ্ডিয়া’তে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন করবার ব্যাপারে স্পষ্ট ও বিস্তারিত নির্দেশিকা দেওয়া হয় :

“Muslims must remember that it was in Ramzan that permission for jehad was granted by Allah. It was in Ramzan that the Battle of Badr, the first open conflict between Islam and heathens, was fought and won by 313 Muslims and again it was in Ramzan that 10,000 Muslims under the Holy Prophet conquered Mecca and established the Kingdom of Heaven and the commonwealth of Islam in Arabia. The Muslim League is fortunate that it is starting its action on this Holy month and day.”4

১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্ট দিনটি বিশেষভাবে ভেবেচিন্তেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। দিনটি ছিল শুক্রবার, এবং সুহ্‌রাবর্দীর পরিচালনায় মুসলিম লীগ প্রতিটি মসজিদের ইমামকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যাতে জুম্মার নমাজের জন্য জড়ো হওয়া প্রত্যেক মুসলিমকে পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন সফল করবার জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে খেপিয়ে তোলা হয়।3

সেদিন গোপাল ‘গুণ্ডা’রা না থাকলে এই পরিকল্পনা অক্ষরে অক্ষরে ফ’লে যেত। উন্মত্ত মুসলিম লীগের জঙ্গিবাহিনী বিধর্মী ‘কাফের’দেরকে কচুকাটা করত, আর জিন্নাহ্‌–র সাধের কলকাতাসহ পূর্ব–পশ্চিম গোটা বঙ্গদেশই মসৃণভাবে চ’লে যেত পাকিস্তানে। কিন্তু জিন্নাহ্‌ আর সুহ্‌রাবর্দীর সে সাধ অপূর্ণই থেকে যায়। ভয়ঙ্করভাবে পাল্টা মার খায় মুসলিম লীগ বাহিনী, যা তাদের কাছে এবং তাদের নেতৃবৃন্দের কাছে ছিল একান্তই অপ্রত্যাশিত, কারণ তারা হিন্দুদের কাপুরুষ ব’লেই মনে করত। কলকাতাসহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে জিন্নাহ্‌–র বৃহত্তর পূর্ব পাকিস্তান গঠন আর হয়ে ওঠেনি। পূরণ হয়নি সুহ্‌রাবর্দীর গোটা বঙ্গদেশে একচ্ছত্র সুলতান হয়ে ওঠবার কামনাও। ইতিহাসের এমনই পরিহাস, সমগ্র বঙ্গদেশকে পাকিস্তানে চালান করতে জিন্নাহ্‌ যার ষড়যন্ত্রের উপর ভরসা করেছিলেন, সেই ‘বাংলার কসাই’ সুহ্‌রাবর্দীর সব ষড়যন্ত্র সেদিন বানচাল ক’রে দেন বউবাজারের একজন আপাত–নিরীহ বাঙালি কসাই। মুসলিম লীগের পাপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে ১৯৪৬–এর ১৬ই অগস্ট কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোপাল ‘পাঁঠা’র ব্যবসায়িক অস্ত্রটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.