গত মঙ্গলবারের ঘটনা। নজরুল মঞ্চে দলের কাউন্সিলরদের মিটিংয়ে ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর সেখানেই স্বীকার করে নিলেন, তাঁর দলে ‘চোরেরা’ ছিলেন। ঠিক যেমন, কদিন আগে কাঁচড়াপাড়ায় গিয়ে দিদি জনসভায় বলেছিলেন, দলে পচাদের ঢুকিয়েছিলেন এক গদ্দার। মানে দলে পচা লোকজনও ছিল বা আছে।
সেই চোরেরা কেন পালাচ্ছে? দিদি খোলাখুলিই বলছেন, পুরসভাগুলোতে অডিট হচ্ছে। চুরি ধরা পড়ছে। তাই চোরেরা পালাচ্ছে। তা ছাড়া এ-ও বলেছেন, নিচু তলার বহু নেতা সরকারি প্রকল্প থেকে কাটমানি নিচ্ছেন। ২৫ পারসেন্ট। এমনকী মৃত্যুর পর দেহ সৎকারের জন্য সরকার গরিব মানুষকে যে দু’হাজার টাকা দেয়, তার থেকে দু’শো টাকা কেটে নিচ্ছে। ভাবা যায়!
সত্যিই ভাবা যায় না! এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ ভূ-ভারতে কোনও রাজনৈতিক দলে নেই। কোনও আড়াল আবডাল নয়, খোলাখুলি দিদি বলছেন এ সব কথা। চোর, ডাকাত, কাটমানি, পচা….। মা-মাটি-মানুষের পার্টি, তাই খুল্লমখুল্লা সব মানুষের কাছে উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে। টিভিতে তা সরাসরি দেখাচ্ছে। ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে। তাতে লাইক পড়ছে। কর্মী, সমর্থক, অনুগামী, ফ্যানরা কমেন্টে লিখছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’, ‘দিদি তুমি এগিয়ে চলো…।’
প্রতিকূলতা ঠেলে দিদির এগিয়ে যাওয়াটা বাংলার রাজনীতিতে সত্যিই কিংবদন্তী। কলকাতার রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে, গুণ্ডা-হার্মাদদের হাতে দিদির হেনস্থা হওয়া বা মার খাওয়ার ঘটনা দেখিনি। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তাঁর অনশনও খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। তখন সাংবাদিকতা করছিলাম দিল্লিতে।
তবে সংসদে দেখেছি, একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই। তাঁর কৃচ্ছসাধন, নিষ্ঠা ও আপসহীন মনোভাব। দেখেছি, বাংলায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ঘটনা নিয়ে বা অন্য কোনও বিষয়ে লোকসভায় বলতে উঠলে বাংলা, ত্রিপুরা ও কেরল সিপিএমের সাংসদরা একযোগে কেমন তাঁকে বিব্রত করতেন। প্রকৃত অর্থে ‘আওয়াজ দিতেন’ তাঁকে।
সেই দিদি এখন ক্ষমতায়। আট বছর হয়ে গেল। এ বার আপনার কাছে প্রশ্ন দিদি। পুরসভাগুলোর তো অডিট হচ্ছে। আপনার সরকারের অডিট হবে কবে? হয়তো হচ্ছে, সেই অডিট রিপোর্ট বিরোধীরা, সাধারণ মানুষ দেখতে পাবেন কবে? কবেই বা তা নিয়ে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে আলোচনা হবে? কোনও অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কি না, বড় সরকারি প্রকল্পে কেউ কাটমানি খেয়েছে কি না, পুকুর চুরি হয়েছে কি না– তা জানা যাবে কী ভাবে?
সে দিন লোকসভায় বাংলার বিরোধী নেত্রীর কথাগুলো এখন বারবার মনে পড়ছে। বাম সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো দিদি করতেন, বাংলার এখনকার প্রশাসনিক সংস্কৃতির সঙ্গে তার ফারাক কোথায় তা নিয়ে ধন্দ হয়। বরং দিব্য দেখা যাচ্ছে, একাধিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ঠুঁটো হয়ে গেছে। নিয়ম-নীতির বালাই নেই। আমার যেমন ইচ্ছা তেমন চালাব। ২১১ জন বিধায়ক সঙ্গে রয়েছে, আরও কিছু ভাঙিয়ে আনা হয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম থেকে। সুতরাং কারও কথা শুনব না।
বাইরে থেকে যা মা-মাটি-মানুষের কাছে উজাড় করে দেওয়া, ভিতর থেকে তা ততই দীর্ণ। অস্বচ্ছ। তৃণমূলের কিছু কাউন্সিলার এখন দল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন, হয়তো তাঁদের ভয় দেখাতেই পুরসভার অডিটের কথা বলা হচ্ছে। অথচ বাস্তব হল, গত চার-পাঁচ বছরে বিধানসভায় সরকারের কোনও অডিট রিপোর্ট জমা পড়তে কেউ দেখেননি। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটরস জেনারেলের রিপোর্ট পেশ হয়নি। তা নিয়ে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে কোনও আলোচনার সুযোগও তাই হয়নি।
ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকেনি। সংসদীয় রাজনীতিতে বরাবরের রীতি হল, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান-বিরোধী দলের কোনও সদস্যই হন। বাংলায় তৃণমূল সেটাও বকলমে নিজের করে নিয়েছে। মানে আমি কাজে ফাঁকি দিয়েছি কি না, তা ঠিক করবে আমারই লোক!
যে হেতু ষোলোর ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট হয়েছিল, তাই কংগ্রেস পরিষদীয় দল চেয়েছিল সিপিএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তীকে পিএসি-র চেয়ারম্যান করে দিতে। কিন্তু বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা না করে এক তরফা কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুইঞাঁকে কমিটির চেয়ারম্যান করে দিয়েছিল শাসক দল।
কেন? কারণ, মানসবাবু ততদিনে তৃণমূলে যাওয়ার ব্যাপারে ইট পেতে ফেলেছেন। তার পর শুভ দিন দেখে যোগও দিয়ে ফেললেন তৃণমূলে। কিন্তু পিএসি-র চেয়ারম্যান পদ তাঁর রয়ে গেল কাছে। তার পর সেই মানসবাবু বাম জমানার অডিট রিপোর্টে ছিদ্র খুঁজতে নেমে পড়লেন। তৃণমূল জমানার কাজকর্ম তাঁর নজরেই পড়ল না।
এর পর মানসবাবু রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন। তার পর কে পিএসি-র চেয়ারম্যান হবেন? কংগ্রেস পরিষদীয় দলের কোনও প্রস্তাব ছাড়াই এ বার চেয়ারম্যান করা হল শঙ্কর সিংহকে। এবং তাঁরও সেই এক কিসসা। কংগ্রেসের বিধায়ক, পিএসির চেয়ারম্যান, কিন্তু চুটিয়ে করে গেলেন তৃণমূল।
এই অনিয়ম, এই ছেলেখেলা সংসদীয় রাজনীতির ধর্মে সইতে পারে?
ভুলে গেলে চলবে না, মনমোহন জমানায় টুজি কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারির কথা অডিট রিপোর্টেই ধরা পড়েছিল। তার পরে সংসদের পাবিলক অ্যাকাউন্টস কমিটি চেপে ধরেছিল সরকারকে। বাংলায় সেই সংসদীয় ব্যবস্থাটাই ভোঁতা করে দেওয়া হয়েছে। সে কথা ক’জন জানতে পারছে। সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া সংবাদমাধ্যমই বা তা ছাপছে কোথায়?
বাইরে থেকে শুধু দেখা যাচ্ছে, দিদির হাতে মাইক। তিনি বলে যাচ্ছেন…