সোভিয়েতের​ স্বৈরাচারী শাসক জোসেফ স্ট‍্যালিনের একমাত্র কন্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন। মৃত‍্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ১৯৬৭ সালে তিনি ভারতে এসে তাঁর ভারতীয় কমিউনিস্ট প্রেমিকের ছাই গঙ্গার​ বুকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সফরের সময় তিনি রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের​ পক্ষ ত‍্যাগ করেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক ইন্দর মালহোত্রা এই কেলেঙ্কারির কথা স্মরণ করলেন।

স্বেতলানা আলিলুয়েভা, যিনি লভানা পিটারস্ নামেও পরিচিত ছিলেন, ভারতের সাথে তাঁর ছিল এক গভীর​ যোগাযোগ।

অলিখিত আইন অনুযায়ী তিনি ছিলেন ব্রজেশ সিংয়ের স্ত্রী। ব্রজেশ সিং ছিলেন ১৯৩০-এর দশকের​ সেইসব ভারতীয় কমিউনিস্টদের​ মধ্যে একজন যাঁরা মস্কোতে নিজেদের বাসভূমি বানিয়ে ফেলেছিলেন।

১৯৬৭ সালের গোড়ার দিকে মিঃ সিং মারা যান। স্বেতলানা দেখেছিলেন​ যে হিন্দু আচার অনুসারে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হচ্ছে এবং তারপরেই তিনি মনস্থির করেন যে মিঃ সিং-এর অস্থি হিন্দুদের পবিত্র নদী গঙ্গাতে বিসর্জন দেবেন।

কিন্তু এই পুরো কাজটি সম্পন্ন হতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল কারণ সোভিয়েত নেতারা তাকে এই যাত্রা থেকে বিরত রাখার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিলেন।

রাজনৈতিক উত্থান

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, ব্যক্তিগতভাবে তাকে বলেছিলেন যে তিনি একটি ভীষণ বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন কারণ তাঁর কাছে প্রমাণ আছে যে গোঁড়া হিন্দুরা কখন কখনও তাদের স্বামীর সাথে বিধবাকেও পুড়িয়ে মেরে ফেলে। তাই স্বেতলানা’র ভারতে যাওয়া একদম ঠিক হবে না।

তবে তিনি এত ঝামেলা সহ‍্য করেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। কোনো বাধানিষেধ তাঁকে তাঁর প্রতিজ্ঞা​ থেকে টলাতে পারেনি।

ভারতীয় ভিসা পাওয়া নিয়ে কোনো​ সমস্যা ছিল না কারণ অন্যান্য সব কিছু বাদ দিলেও ব্রজেশের ভাগ্নে দীনেশ সিং ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একজন অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন মানুষ এবং তার পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্য।

উত্তর প্রদেশে তাঁর প্রয়াত স্বামীর পৈতৃক ভিটেয় সমস্ত আচার অনুষ্ঠান শেষ করার পরে, তিনি দিল্লিতে যান। দিল্লীতে​ তখন সাধারণ নির্বাচনের জন্য চারদিকে সাজো সাজো রব, নির্বাচনের প্রস্তুতিও​ চলছে জোরকদমে কারণ সেই বছরেই প্রথম স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার ছিল।

রাজনৈতিক উত্থান ভারতকে ক্রমেই গ্রাস করেছিল: কংগ্রেস দল ক্ষমতায় ফিরে আসে, যদিও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল এবং ইন্দিরা গান্ধী আর মোরারজি দেশাইয়ের মধ্যে চলছিল নেতৃত্ব নিয়ে এক বিরাট টানাপোড়েন। এই দুই তুখোড় রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্বের মধ‍্যে কে উপ-প্রধানমন্ত্রী হবেন সে নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছিল।

এইসব​ ঘটনাগুলি নিয়ে সবাই তখন এতোটাই মেতে ছিল যে মিডিয়া বা অন্যকোনো​ রাজনৈতিক নেতাই দিল্লিতে স্বেতলানার উপস্থিতিতে কোনও আগ্রহ বা উচ্ছাস দেখায়নি।

এবং তারপরে এক সকালে সেই চাঞ্চল্যকর খবরটি ছড়িয়ে পড়ে যে, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়েই স্ট্র‍্যালিনের কন‍্যা পারমাণবিক শক্তির​ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের​ পক্ষ ত‍্যাগ করলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ঘটনার​ কথা শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল কিন্তু ভারতের​ এতে কিছুই করার ছিল না। অতীতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মস্কো ও দিল্লির মধ্যে কিছু সময়ের জন্য উত্তেজনা বাড়াতে থাকে এবং চলতে থাকে এক ঠান্ডা যুদ্ধ।

আমেরিকায় পলায়ন

দুর্দান্ত পালানোর গল্পটি আর এর থেকে বেশী নাটকীয় হতে পারত না।

স্বেতলানা যখন সোভিয়েত দূতাবাসে থাকছিলেন তখন যেখানকার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই বেনিডিক্টোভ তাঁকে দেশে ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বেতলানা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি নিজের যাওয়ার সমস্ত ব‍্যবস্থা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন এবং তারপর একটি ট্যাক্সি ডেকে তিনি আমেরিকান দূতাবাসে চলে যান।

দূতাবাসটি তারপর কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। তিনি ডিউটি ​​অফিসারকে জানিয়েছিলেন তিনি কে এবং তিনি কী চান।

আতঙ্কিত হয়ে ডিউটি ​​অফিসার রাষ্ট্রদূত চেস্টার বাউলেসকে ফোন করে বলেছিলেন যে তিনি​ যেন ভীষণ তাড়াতাড়ি অফিসে চলে আসেন কারণ অফিসে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটা ফোনে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

মিঃ বোউলস্ অফিসে এসে স্বেতলানার সাথে কথা বলেছিলেন এবং কেন তিনি তাঁর নিজের দেশে না গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান সেই বিষয়ে লেখার জন্য একটি ডোরাকাটা প্যাড দিয়েছিলেন।

যথাযথভাবে সেইসব কিছু করেছিলেন স্বেতলানা এবং একবছর পরে এগুলো তাঁর বইতে প্রকাশিত হয়, যা অকাট্য এবং পাঠযোগ্য দলিলের​ ভূমিকা পালন করেছিল।

স্বেতলানা তার লেখাটি লেখার সময়, সেক্রেটারী অফ স্টেট ডিন রুস্ক’কে সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রদূত বোউলস একটি “আইস্ ওনলি” টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন এবং এই অবস্থায় তাঁর ঠিক কি করা উচিৎ সেই নিয়ে পরামর্শ চেয়েছিলেন।

তিনি তাঁর বেতার বার্তায় এই কথাটি দিয়ে শেষ করেছিলেন যে: “যদি আমি মধ্যরাতের (ভারতীয় সময় অনুযায়ী) মধ্যে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কোনো নির্দেশ না পাই তাহলে তাঁকে ভিসা দেওয়া আমার দায়িত্ব”।

রাষ্ট্রদূতের ঘটনার পরবর্তী বিবরণ অনুসারে, ঠিক যেমনটি তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন তেমনটাই হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেও ওয়াশিংটনের তরফ থেকে কোনও নির্দেশ আসেনি।

তিনি সিআইএ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে স্বেতলানা’কে বিমানবন্দরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং স্বেতলানা সেখান থেকেই রোমের একটি বিমান ধরেন।

তিনি নিরাপদে সেখানে পৌঁছানোর পরেই এই চাঞ্চল্যকর খবরটি ফাঁস হয়ে যায়।

https://www.bbc.com/news/world-asia-india-15936172

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.