পরমহংস ও আচার্যদেব ( প্রথম পর্ব )

” আজ ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর তৈলচিত্র উন্মোচন করতে গিয়ে এখানে আপনাদের ” রামকৃষ্ণ ভজন ও মঙ্গলাচরণ” প্রোগ্ৰামে জুড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমার সময় কম আর আপনাদের সঙ্গে এই রকম কাজে সময় দেবার কথা ছিল না। প্রোগ্ৰামে এইসব বিতর্কমূলক অসত‍্য কথা জুড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি । আপনারাই বলুন আমার কথা ঠিক কিনা ? এখানে সত‍্য কথা বলতে গেলে, এটাই সত‍্য যে রামকৃষ্ণ ব্রহ্মানন্দ লাভ করার জন‍্য তাঁকেই চেয়েছিলেন। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র রামকষ্ণের পেছনে ছোটেননি। এই সত‍্য ভুলে যাবার ফলে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি ও হারাতে বসেছি। “

১৯৫২ সালের ১৯শে নভেম্বর ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজে কেশবচন্দ্রের জন্মদিন পালন ও তৈলচিত্র উন্মোচন উপলক্ষ্যে সাধারন ব্রাহ্ম সমাজ সদস‍্যদের রামকৃষ্ণপ্রীতিকে এভাবেই তীব্র তিরস্কার করেছিলেন ইন্ডিয়ান স্ট‍্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।

( তথ‍্যসূত্র ; স্মরণে মননে শ্রীরামকৃষ্ণ; রামকৃষ্ণ মঠ / গদাধর আশ্রম, ২০১২ )

রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন, ভারতবর্ষের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও উন্নয়নযজ্ঞের অন‍্যতম হোতা এই খ‍্যাতনামা ব‍্যক্তিত্বের এই আচরণের ব‍্যাখ‍্যা পাওয়া যায় না।

১২৯৮ সালের পৌষ মাসে ” নব‍্যভারত” পত্রিকাতে একটি আত্মবিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ লেখেন দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী। নিজে ব্রাহ্ম হয়েও তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজপতিদের অনুদার মন, হিন্দু সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা, পান্ডিত‍্যের অহঙ্কার, প্রেমের অভাব ও সাধনার অভাবের কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দুঃখ করে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মরা গুরুবাদ ত‍্যাগ করেছে বটে, কিন্তু দলবাদের সর্বনাশা আবর্ত থেকে বেরোতে পারেনি।

বেদ ও উপনিষদ ব্রাহ্মসমাজের ভিত্তি । তাঁদের ব্রহ্মসঙ্গীত উপনিষদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। অপৌত্তলিক ও সংস্কারপন্থী হিন্দুরাই ব্রাহ্ম হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন।

তাঁদের শ্রেষ্ঠ নেতা কেশবচন্দ্র সেন। উদারহৃদয় কেশবচন্দ্র যতদিন জীবিত ছিলেন, দুই মতের দলাদলি প্রকাশ পায়নি।

১৮৮৪ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কেশবচন্দ্রের প্রয়াণ ঘটে। রামকৃষ্ণদেবের তিরোভাব ঘটে তার আড়াই বছর পরে ( ১৬ই আগষ্ট, ১৮৮৬)।

উভয়ের প্রয়াণ হবার বেশ কিছুকাল পরে কার ওপর কার প্রভাব বেশি, এই নিয়ে অনর্থক বিবাদ ধীরে ধীরে শুরু হয় সাময়িকপত্রে।

১৮৯৬ সালে আচার্য ম‍্যাক্সমূলার ” নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি” পত্রিকায় ” A Real Mahatman ” নামে প্রবন্ধে কেশবকে পরমহংসদেবের শিষ‍্য বলে অভিহিত করে অজ্ঞাতসারে এই বিতর্কে ইন্ধন যোগান।
দীর্ঘ ৩২ বছর পরে ১৯২৮ সালে পরমহংসদেবের জীবনীর ভূমিকায় রমাঁ রলাঁ এই কাদাছোঁড়াছুঁড়ির কথা দুঃখিতভাবে উল্লেখ করেছেন।

কেমন ছিল কেশবচন্দ্র ও রামকৃষ্ণদেবের পারস্পরিক সম্পর্ক ?

” ব্রহ্মানন্দ” কেশব ঈশ্বরভাবে বিভোর, আর রামকৃষ্ণদেব সমাধিস্থ হয়ে করছেন ব্রহ্মানন্দের নিত‍্য আস্বাদন।

” কেহ ( রামকৃষ্ণের কাছে ) উপদেশ প্রার্থনা করিলে বলিতেন, ইহা এ আধারে নয়, সে আধারে, অর্থাৎ কেশবচন্দ্রে।” ( ধর্মতত্ত্ব, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৬ )

শ্রদ্ধেয় অশ্বিনীকুমার দত্তকে রামকৃষ্ণদেব কেশব সম্পর্কে বলেছিলেন,

” ওগো, সে দৈবী মানুষ।’

রামকৃষ্ণ বলতেন, ” দেখ, কেশব এত পণ্ডিত ইংরাজীতে লেকচার দিত, কত লোকে তাকে মানত ; স্বয়ং কুইন ভিক্টোরিয়া তার সঙ্গে বসে কথা কয়েছে । সে কিন্তু এখানে যখন আসত, শুধু গায়ে ; সাধুদর্শন করতে হলে হাতে কিছু আনতে হয়, তাই ফল হাতে করে আসত । একেবারে অভিমানশূন্য । “

কেশবচন্দ্র সেন রামচন্দ্র দত্তকে ঠাকুর সম্বন্ধে বলেছিলেন,

” তোমরা বুঝতে পারছ না উনি কে, তাই অত ঘাঁটাঘাঁটি করছ। ওঁকে মখমলে মুড়ে ভালো একটি গ্লাস কেসের মধ্যে রাখবে, দু চারটি ভালো
ফুল দেবে আর দূর হতে প্রনাম করবে।” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ‍্যান )

……..………………………………………………….

কেশবচন্দ্রের অভ‍্যুদয় হয় এমন একটা সময়ে, যখন দেশের ওপর চলছে সাংস্কৃতিক আক্রমণ। স্বামীজীর ভাই মহেন্দ্রনাথ লিখছেন,

” ধর্মগ্ৰন্থ যাহা কিছু ছিল এবং ধর্ম সম্পর্কে যাহা কিছু শুনিতে পাইতাম, তাহা হইল যীশুখ্রীষ্টর গল্পবিষয়ক।
পাদরীরা,এই সুযোগে, রাস্তার মোড়ে ও বাজারে যাইয়া যীশুর গল্প শুনাইত। বাঙালি পাদরীরা, হেদোর ধারে, কেষ্ট বন্দ‍্যোর গীর্জার কোণটিতে, রবিবার সকালে যীশুখ্রীষ্টের কথা বলিত, আর হিন্দু দেবদেবীদিগকে গাল পাড়িত।…..
এই রূপে খ্রীষ্টান পাদরীরা সকলকে খ্রীষ্টান করিবার জন‍্য বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিল। ইংরেজ পাদরী ও সহকারী দেশীয় পাদরীর সংখ‍্যা খুব অধিক বাড়িয়া গিয়াছিল। …….
হিন্দু ধর্ম যে কি, তাহা অনেকেই তখন বুঝিত না। হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে কাহারো বিশেষ পড়াশোনা ছিল না, এবং হিন্দু ধর্মের বিষয়ে কোনো গ্ৰন্থও পাওয়া যাইত না। এইজন্য পাদরীদের কথার উত্তর দেওয়াও দুঃসাধ‍্য ছিল। …..”

‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি”তে অক্ষয় সেন লিখেছেন,

“ব্রাহ্মধর্ম এ সময় হইয়া প্রবল।
দেশের পক্ষেতে কৈল অপার মঙ্গল। “

“কলকাতার যখন এইরূপ অবস্থা, তখন কেশববাবু বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। কেশববাবুর বিষয়ে কিছু বলিতে হইলে প্রথমেই বলা আবশ‍্যক যে, তাহার চেহারা ও মুখশ্রী কার্যকারিতা বা সফলতা লাভে তাঁহাকে বারো আনা ভাগ সাহায্য করিত, এবং বাকি চার আনা ভাগ সাহায‍্য করিত তাঁহার বাক‍্য বিন‍্যাস। কলিকাতার আ্যলবার্ট ইন্সটিটিউটে রক্ষিত ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের যে তৈলচিত্র দেখা যায়, তাহাতে শুধু একভাব দেখানো হইয়াছে, কিন্তু কেশববাবুর জীবিত অবস্থায় চেহারা আরো সুন্দর ও ও মাধূর্যপূর্ণ ছিল। চোখের চাহনী ও মুখভঙ্গি — ভক্তি, ঈশ্বর বিশ্বাস, ও ওজস্বীভাবে পরিপূর্ণ ছিল। কেশববাবুকে দেখিয়াছেন এমন লোক যদি আজও জীবিত থাকেন তো, তিনি নিশ্চয়ই বলিবেন যে, কেশববাবুর চেহারাতে একটি বিশেষ লাবণ‍্য বা মাধূর্য ছিল, এবং সাধারণ লোক হইতে তাঁহার চেহারার অনেক প্রভেদ ছিল

” পাদরীরা যেমন পাড়ায় পাড়ায় গিয়া বক্তৃতা দিত কেশববাবুও তেমনি পাড়ায় পাড়ায় গিয়া, মধ‍্যে মধ‍্যে সভা করিয়া, হিন্দু ধর্ম প্রচার করিতে লাগিলেন। কেশববাবু প্রথম অবস্থায় ইংরেজীতে বক্তৃতা দিতেন, কিছু দিন পর হইতে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া আরম্ভ করিলেন। …. শিমলাতে মনোমোহনদের এবং নন্দ চৌধুরীর বাড়িতে তিনি সভা করিয়াছিলেন : সমস্ত দেশটা যাতে খ্রীষ্টান না হইয়া যায়, তাহার জন‍্য তিনি বিশেষ প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। প্রথম অবস্থায় তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের মাঝামাঝি একটি সেতু তৈয়ার করিতে চেষ্টা করিলেন। যীশুকে তিনি Oriental Christ —
প্রাচ‍্য দেশীয় যীশু ও তপস্বী যীশু করিয়া দেখাইতে লাগিলেন। তিনি কতকগুলি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতাগুলিতে তিনি এইরূপ মত প্রকাশ করিলেন যে, বিলাতী হ‍্যাট কোট ত‍্যাগ করাইয়া দেশী যীশু করো এবং যীশুবিহীন ধর্ম মানো। কেশববাবু হিন্দু ধর্মের বিগ্ৰহপূজাদি ত‍্যাগ করলেন, কিন্তু ভক্তির পথ অবলম্বন করলেন। ইহাতে শিক্ষিত লোকের ভিতর খ্রীষ্টান হওয়া কিছু পরিমাণে কমিয়াছিল।”

( শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ‍্যান ; মহেন্দ্রনাথ দত্ত; মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি;২০১২ )

………………………………………………………………..

পরাধীন ভারতবর্ষে কেশবচন্দ্র যখন পশ্চিমী ঝঞ্ঝাকে রুখে দিচ্ছেন, তখন ” পরমহংস মশাই” এর গুটিকতক ভক্ত ছাড়া তাঁকে কেউ চেনে না।

রামকৃষ্ণদেব কোন সভায় যেতেন না, বক্তৃতাও দিতেন না, বইপত্রের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতেন না, বর্তমান সভ‍্যতার ধার ধারতেন না।

কেশবচন্দ্র দায়িত্ব নিয়ে ধর্মতত্ত্ব, ইন্ডিয়ান মিরর, সুলভ সমাচার, দি কোয়ার্টারলি রিভিউ ইত‍্যাদী পত্রপত্রিকায় রামকৃষ্ণের সম্পর্কে ক্রমাগত প্রচার করেছেন। তাঁর উদ‍্যোগে প্রকাশ হয়েছে “পরমহংসের উক্তি”। তবে বিস্ময়করভাবে কেশবচন্দ্রের আত্মজীবনীমূলক ” জীবনবেদ” গ্ৰন্থে শ্রীরামকৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

পরমহংসদেবের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলন দিনে দিনে সংগঠিত রূপ পেয়েছে। শক্তিশালী হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন।

রামকৃষ্ণ পেয়েছিলেন বিবেকানন্দকে।

“তখনকার ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের “হিরো ” ছিলেন বাগ্মী ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন। ঠাকুরের দিব‍্যদর্শন থেকে জানা যায় কেশব সেনের চাইতে বড় মাপের চরিত্র নরেন্দ্রর। শ্রীরামকৃষ্ণ থাঁর সেই দর্শন সম্বন্ধে বলেছিলেন, “কেশব যেমন একটা শক্তির বিশেষ উৎকর্ষে জগদ্বিখ্যাত হইয়াছে, নরেন্দ্রর ভিতরে ঐরূপ আঠারোটা শক্তি বিদ‍্যমান। আবার দেখিলাম, কেশব ও বিজয়ের অন্তর দীপশিখার ন‍্যায় জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল রহিয়াছে : পরে নরেন্দ্রর দিকে চাহিয়া দেখি, তাঁহার ভিতরে।জ্ঞানসূর্য উদিত হইয়া মায়ামোহের লেশ পর্যন্ত তথা হইতে দূর করিয়াছে। একথা শুনিয়া নরেন্দ্র তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, উপস্থিত অপর সকল স্তম্ভিত হয়েছিলেন।”

( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ৫ ম ভাগ ; সারদানন্দ; উদ্বোধন কার্যালয় )

ব্রাহ্মরা গুরুবাদের বিরুদ্ধে। কেশবচন্দ্র কোন বিবেকানন্দকে রেখে যেতে পারেনি।

কেশবের মৃত্যুর পরেই তাঁর প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

তাঁর জীবিতকালেই কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজের দলাদলিতে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।

” …..দল দল করছ, এদিকে দল ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। কেশব বললে, মহাশয়, তিন বছর এই দলে থেকে ওই দলে গেল। আবার যাবার সময় গালাগালি দিয়ে গেল। ” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)

… কেশববাবু “যীশুখ্রীষ্ট — ইয়োরোপ ও আসিয়া ” এবং ” গ্ৰেটম‍্যান্” এই দুইটি বিষয়ে বক্তৃতা করিলেন। এই বক্তৃতাদ্বয়ের গূঢ় ভাব হৃদয়ঙ্গম করিতে অসমর্থ হইয়া কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মগণ কেশববাবুকে খৃষ্টান বলিয়া গালি দিতে লাগিলেন। তাঁহাদের অসদ্ভাব এতদূর প্রবল হইয়া উঠিল যে তাঁহারা মিথ‍্যা বলিতে কিছুমাত্র কুন্ঠিত না হইয়া কেশববাবু খৃষ্টান হইয়াছেন বলিয়া ঘোষণা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।” ( ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান অবস্থা এবং আমার জীবনে ব্রাহ্মসমাজের পরীক্ষিত বিষয় ও কয়েকটি উপদেশ ; শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী : নব ভারতী ভবন,১৯৯৭ )

ব্রাহ্মদের cheerless গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক প্রচার সাধারন মানুষের বোধগম‍্যতার বাইরে ছিল।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “তোমাদের ব্রাহ্ম সমাজের এই একটা দোষ, ছেলেবেলা থেকেই হবিষ‍্যি খাবার ধাত।”

আত্মকলহে তাঁদের সংগঠন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েই চলেছিল, কিছুকাল পরে বিংশ শতাব্দীর নব‍্য জাতীয়তাবাদের সামনে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না।

” এখনকার শোচনীয় অবস্থা যে আর সহ‍্য করা যায় না। …. ভ্রাতা ভ্রাতাকে নির্যাতন করিতেছেন, কেহ বা নির্জ্জনে ভ্রাতার নিন্দা করিয়া আমোদ করিতেছেন, কেহ বা ভ্রাতাকে অপদস্থ করিবার জন্য প্রকাশ‍্য পত্রিকায় ভ্রাতার জীবনের সমালোচনা করিতেছেন, প্রচারকদিগকে প্রকাশ‍্য গালি বর্ষণ করিতেছেন। তাঁহারাও তীব্র সমালোচনায় গাত্র জ্বালা নিবারণ করিতেছেন। পবিত্র ব্রাহ্মসমাজের মধ‍্যে এরূপ দুর্দ্দশা কেন হইল? …….

বর্ত্তমান সময়ে দারুন অশান্তি আসিয়া ব্রাহ্মসমাজকে অধিকার করিয়াছে। যাহাদের সহবাসে আনন্দ অনুভব হত, এখন তাঁহাদের সংসর্গে দুঃখের উৎপত্তি সন্দেহ নাই। ভ্রাতৃগণ! ব্রাহ্মসমাজে এই অবস্থা প্রবেশ করিল কেন ?”

( ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান অবস্থা এবং আমার জীবনে ব্রাহ্মসমাজের পরীক্ষিত বিষয় ও কয়েকটি উপদেশ ; শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী : নব ভারতী ভবন,১৯৯৭ )

ব্রাহ্মসমাজ আজ অতীত।

বাঙালি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দকে যে ভাবে মনে রাখে, কেশবচন্দ্র সেনকে সে ভাবে নয়।

স্বামী বিবেকানন্দের ভাই বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
ব্রাহ্ম ধর্মের উদ্ভব ও তার সীমাবদ্ধতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে:

” দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্যের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হিন্দু সমাজের গর্ভ থেকে জন্ম নিল ব্রাহ্ম সংস্কার আন্দোলন। খৃষ্টান আক্রমণের প্রতিরোধ করাই ছিল এর কাজ। তাই এই আন্দোলন ছিল পুরোপুরি বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত দের আন্দোলন।”

অনেকের মত তিনিও মনে করেন বিদেশী ঢঙ এ কৃত্রিম ভাবে বেড়ে ওঠা এই ধর্মের সঙ্গে দেশের মাটির আত্মিক যোগাযোগ ছিল না, ফলে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ছাড়া সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধর্মের প্রভাব ছিল খুব কম।

” ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি যে, জাতীয় আন্দোলন যখন প্রবল আকারে চলছিল তখন ব্রাহ্মসমাজ থেকে কোনো সদস‍্য এতে যোগ দেননি। তবে প্রথম দিকে দু একজন জাতীয় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

ব্রাহ্ম সমাজ প্রবর্তিত সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে স্বদেশের মাটির কোন যোগ ছিল না। সর্বধর্মসার সমন্বয়ে গঠিত ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে স্বদেশের যোগাযোগ না থাকায় তা ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যেতে থাকে। এ কথা দুঃখের হলেও সত‍্য। যাঁরা হিন্দু পুনরুত্থানবাদী এবং স্বামী বিবেকানন্দকে ‘প্রতিক্রিয়াপন্থী’ বলে নিন্দা করে এসেছেন, যদিও তা আসলে ছিল ” রেঁনেসা” বা পুনর্জাগৃতি, তাঁরা একথা উপলব্ধি করেন না যে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজ ছিল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার স্তম্ভ -স্বরূপ।”

( স্বামী বিবেকানন্দ ; ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত; র‍্যাডিকাল ইম্প্রেশন, ২০১৯, পৃষ্ঠা : ১৩৪ )

……………………………………………………………..

রামকৃষ্ণ কেশবচন্দ্রকে প্রথম দেখেন ১৮৬৪ সালে, আদি ব্রাহ্ম সমাজে। ( কথামৃতের মতে ১৮৬৬ সালে )

‘ রামকৃষ্ণ বলিয়াছেন যে, ” বহুকাল পূর্বে আমি একদিন জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্মসমাজ দেখিতে গিয়াছিলাম। তখন দেখিলাম, নবযুবক কেশবচন্দ্র বেদীতে বসে উপাসনা করিতেছেন, দুই পার্শ্বে শত শত উপাসক বসে আছেন। ভাল করে তাকায়ে দেখলাম যে কেশবচন্দ্রের মনটা ব্রহ্মেতে মজে আছে, তাঁর ফাতনা ডুবেছে, সেদিন হইতেই তাঁর প্রতি আমার মন আকৃষ্ট হয়ে পড়িল। আর যে সকল লোক উপাসনা করিতে বসেছিল, দেখলাম তারা ঢাল তলোয়ার বর্শা লইয়া বসে আছে, তাদের মুখ দেখিয়াই বুঝা গেল, সংসারাসক্তি রাগ অভিমান ও রিপুসকল যেন ভিতরে কিলবিল করিতেছে।”

পরমহংসদেবের সেই হইতেই আচার্যদেবের প্রতি অনুরাগের সঞ্চার হইয়াছিল। কিন্তু আচার্যদেব তাহাকে কিছুই জানিতেন না। অনেক বৎসর পরে শুভক্ষণে দুইজনের গাঢ় সম্মিলন হয়। ‘

( ধর্মতত্ত্ব, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৬ )
…………………………………………………………………

বেলঘরিয়ায় জয়গোপাল সেনের বাগানবাড়িতে কেশবচন্দ্র অনুগামীদের নিয়ে সাধন ভজন করতেন। কথাটা ঠাকুরের কানে যেতেই তিনি কেশবকে দেখার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠলেন। একদিন কাপ্তেন ( বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়) গাড়ি করে তাঁকে নিয়ে গেলেন সেখানে। ঠাকুর চিরাচরিত ভঙ্গিতে লালপেড়ে ধুতির কোঁচার কিছুটা অংশ বাঁ কাঁধে তুলে দিয়েছেন। ভাগ্নে হৃদয় ভিতরে গিয়ে মামার পরিচয় দিলেন এবং অনুমতি পেয়ে তাঁরা ভিতরে ঢুকলেন।

তাঁকে দেখে কেশবচন্দ্র ও তাঁর ভক্তরা সাধারণ মানুষ বলেই মনে করলেন। এমনকি তাঁর ভাবাবস্থাকেও মাথার ব‍্যামো ছাড়া কিছু ভাবতে পারলেন না। কিন্তু এই অতি সাধারন মানুষটি যখন অত‍্যন্ত আটপৌরে ভাষায় গূঢ় আধ‍্যাত্মিক তত্ত্ব ব‍্যাখ‍্যা করতে লাগলেন তখন সবাই হতবাক !!

কেশবকে ঠাকুর বললেন, ” তোমার ল‍্যাজ খসিয়াছে।”

“দেখ ব‍্যাঙাচির যতদিন ল‍্যাজ থাকে ততদিন সে জলেই থাকে, স্থলে উঠিতে পারে না। কিন্তু ল‍্যাজ যখন খসিয়া পড়ে তখন জলেও থাকিতে পারে, ডাঙ্গাতেও বিচরণ করিতে পারে — সেইরূপ মানুষের যতদিন অবিদ‍্যারূপ ল‍্যাজ থাকে ততদিন সে সাগরজলেই আবদ্ধ থাকতে পারে, ঐ ল‍্যাজ খসিয়া পড়িলে সংসার এবং সচ্চিদানন্দ উভয় বিষয়েই ইচ্ছামত বিচরণ করিতে পারে। কেশব, তোমার মন এখন এইরূপ হইয়াছে ; উহা সংসারেও থাকিতে পারে এবং সচ্চিদানন্দেও যাইতে পারে।
( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ ; সারদানন্দ ; উদ্বোধন কার্যালয় )

১৮৭৫ সালে বেলঘরিয়ার বাগানে কেমন ছিল উভয়ের সাক্ষাৎকার ?

” গরুর পালে কোন জন্তু আসিয়া ঢুকিলে ,সকল গরুতে মিলিয়া তাহাকে গুঁতাইয়া তাড়াইয়া দেয়, কিন্তু কোন গরু আসিলে প্রথমে গা শোঁকাশুকি করে। পরে আপনার জাতি জানিয়া গা চাটাচাটি করিয়া থাকে, ভক্তে ভক্তে এইরূপ মিলন হয়।”

( আচার্য কেশবচন্দ্র ; উপাধ‍্যায় গৌরগোবিন্দ রায় )

‘সাধু সাধুকে বেশ চিনিতে পারেন। পরমহংসকে দেখিয়া আচার্য মহাশয় মুগ্ধ হন, পরমহংসংও তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তখন হইতে উভয়ের আত্মায় গূঢ় যোগাযোগ হয়।’

( ধর্মতত্ত্ব ; ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৬ )

” মিরর” ( ২৮শে মার্চ, ১৮৭৫ ) পত্রিকায় কেশবচন্দ্র লিখলেন,

“আমরা অল্পদিন হইল দক্ষিনেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসেকে বেলঘরের বাগানে দর্শন করিয়াছি। তাঁহার গভীরতা, অর্ন্তদৃষ্টি, বালকস্বভাব দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হইয়াছি। তিনি শান্তস্বভাব, কোমল প্রকৃতি আর দেখিলে বোধ হয় যোগেতে আছেন। এখন আমাদের বোধ হইতেছে হিন্দু ধর্মের গভীরতম প্রদেশ অনুসন্ধান করিলে কত সৌন্দর্য, সত‍্য ও সাধুতা দেখিতে পাওয়া যায়। তা না হইলে পরমহংসের ন‍্যায় ঈশ্বরীয়ভাবে ভাবিত যোগীপুরুষ কি রূপে দেখা যাইতেছে ? “

…………………………………………………………………..

পরমহংসদেব বলিলেন, ” আমি বেলঘরিয়ায় গিয়া দেখি কেশবচন্দ্র উপাসনা শেষ করিয়াছেন। আমি যাইবামাত্র আমাকে বসিতে অনুরোধ করিলেন এবং আমার আসার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বলিলাম তুমি নাকি ব্রহ্মকে দেখ এবং তাহার কথা শ্রবণ কর। সে কিরূপ ? কেশব বলিতে লাগিলেন। ব্রহ্মদর্শনের কথা, তাঁর কথা, শুনিয়া আমার মনে হইল যে কেশব একজন বিশেষ ব‍্যক্তি, কেশবের কথা শুনিয়া আমার ভাবাবেশ হইল। আমার মর্মকে স্পর্শ করিল। একবার কেশব বলে, আমি শুনি, একবার আমি বলি, কেশব শুনে। এইরূপ চার পাঁচ ঘন্টা কাটিল। ….”

( প্রবাসী ; ফাল্গুন, ১৩৪২ )

………………………………………………………………….

প্রগতিশীল রামকৃষ্ণ গবেষকদের মূল‍্যায়ণ অবশ‍্য একটু আলাদা।

” আধ‍্যাত্মিক তাগিদের থেকেও বাস্তব প্রয়োজন তাঁদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। কেশব সেন তাঁর মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মসমাজের মধ‍্যেই কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। ফলে আত্মরক্ষার কবচ হিসেবে নব আবিষ্কৃত রামকৃষ্ণ কে ব‍্যবহার করতে শুরু করেন। তাঁর লেখা ও বক্তৃতার মধ‍্যে দিয়ে রামকৃষ্ণ কলকাতার বেসরকারি সমাজে পা রাখার খানিকটা জায়গা পেয়ে যান। ক্ষেত্রটি আরো বিস্তৃত হয় প্রাক্তন ব্রাহ্ম রামচন্দ্র দত্ত ও সুরেশ মিত্রর উদ‍্যোগে। এঁরাই কলকাতায় রামকৃষ্ণের পক্ষে সংগঠিত প্রচার করেন। “
( প্রসঙ্গ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ; কনিষ্ক চৌধুরী; কথা, ২০১৬ )
………………………………………………………………….

১৮৮২ সালে কোজাগরী লক্ষীপূজার দিন কেশব সেনের সঙ্গে স্টিমারে ঠাকুর গঙ্গায় বেড়াতে বেরিয়েছেন। স্টিমারে উঠেই পরমহংসদেব সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। একটু প্রকৃতিস্থ হলে তাঁকে কেবিনঘরে একটি চেয়ারে বসানো হয়। চলতে লাগল আলোচনা — জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, সৃষ্টিতত্ত্ব, তন্ত্র। মাঝে মাঝে ঠাকুর গেয়ে উঠছেন রামপ্রসাদী গান।

আলাপ আলোচনার মধ‍্যেই এসে গেছে মুড়ি নারকেল। সকলে কোঁচড়ে নিয়ে খেতে শুরু করেছেন।
ঠাকুরের সঙ্গী কেশবচন্দ্রের প্রাক্তন সহযোগী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, অদ্বৈতাচার্যের বংশধর। প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম প্রচারক বিজয়কৃষ্ণ পরবর্তীকালে প্রখ‍্যাত সাধক হয়েছিলেন, পেয়েছিলেন বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ।
বর্তমানে বিজয়কৃষ্ণ কেশববাবুর দল ছেড়ে সাধারন ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিয়েছেন। রীতিমতো বক্তৃতা দিয়ে কেশবচন্দ্রের আদর্শচ‍্যূতির কথা সকলকে জানাচ্ছেন। নাবালিকা কন‍্যা সুনীতিদেবীর সঙ্গে কুচবেহারের মহারাজার বিবাহ ব্রাহ্মরা মেনে নিতে পারেননি।
কেশব বিজয়ে কথা বন্ধ, ঠাকুর জানতেন। আবহাওয়া সহজ করার জন‍্য বললেন,

” ওগো, এই বিজয় এসেছেন। তোমাদের ঝগড়া বিবাদ যেমন শিব ও রামের যুদ্ধ। রামের গুরু শিব। যুদ্ধও হল, দুজনে ভাবও হল। কিন্তু শিবের ভুতপ্রেতগুলো আর রামের বানরগুলো — ওদের ঝগড়া কিচিরমিচির আর মেটে না।”

কেশবকে বললেন,

” তুমি প্রকৃতি দেখে শিষ‍্য কর না, তাই এইরূপ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।”

( তথ‍্যসূত্র ; শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত ; মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত; রিফ্লেক্ট পাবলিশিং )
…………………………………………………………………..

( শ্রীরামকৃষ্ণ) স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া প্রায়ই কেশবের বাটিতে উপস্থিত হইতেন। এই রূপে উক্ত সমাজস্থ বহু ধর্মপিপাসু ব‍্যক্তির সহিত তিনি ক্রমে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্বন্ধ হইয়াছিলেন এবং কেশব ভিন্ন কোন কোন ব্রাহ্মগণের বাটীতেও কখনও কখনও উপস্থিত হইয়া তাহাদিগের আনন্দবর্ধন করিতেন। সিঁদুরিয়াপট্টির মণিমোহন মল্লিক, মাথা ঘষা গলির জয়গোপাল সেন, বরানগরস্থিত সিঁতি ( সিঁথি ) নামক পল্লীর বেণীমাধব পাল, নন্দবাগানের কাশীশ্বর মিত্র প্রভৃতি ব্রাহ্মমতাবলম্বী ব‍্যক্তিগণের বাটিতে উৎসবকালে এবং অন‍্য সময় গমনাগমনের কথা দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লিখিত হইতে পারে। “

( শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ ; সারদানন্দ; উদ্বোধন কার্যালয় )

…………………………………………………………………..

এপ্রিল ১৮৮২-র এক বিকেলে ওভাবেই কলকাতার কমলকুটির বাড়িটির বৈঠকখানা ঘরে নানা ভক্ত-সহ উপস্থিত হয়েছিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। সেখানে কেশবচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কজন ব্রাহ্ম ভক্তের গাওয়া ভক্তিগীতি শোনার সময় হঠাৎই ঠাকুর দাঁড়িয়ে উঠে, মাতৃনাম নিতে নিতে সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। তখন সবে সন্ধ্যার বাতি জ্বালানো হয়েছে, ঠাকুরকে ঘিরে ঘরে এক অদ্ভুত অলৌকিক পরিবেশ। আর ঠিক এই সময়েই ঠাকুর কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে, আপন লীলায় হঠাৎ নিজেই গান ধরেন—

সুরা পান করি না আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে
মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে।

সংবাদপত্র মাধ্যমে ঠাকুরকে সেই প্রথম প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার মতোই আর একটি অবদানের জন্যও কেশবচন্দ্র সেনের কাছে চিরঋণী থাকবে বাঙালি। তা হল ঠাকুরের প্রথম আলোকচিত্র গ্রহণ। ঐতিহাসিক তারিখটি ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯। স্থান কেশবচন্দ্রের ওই কমলকুটির। ব্রাহ্ম ভক্তজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই সমাধিস্থ ঠাকুরকে এই সময়ে ধরে ছিলেন তাঁরই ছায়াসঙ্গী ভাগনে হৃদয়।
…………………………………………………………………..

” আচার্য কেশবচন্দ্র যে তাঁহার সহসাধক ছিলেন আমরা তাহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি। বেলঘরিয়ায় দেখা হইবার পর মাঘোৎসবের সময় তিনি কীর্তনের দিবস প্রায়ই কমলকুটিরে আসিয়া যোগদান করিতেন এবং কেশবের হাত ধরিয়া নাচিতেন। …. একদিন কেশবচন্দ্র নাচিতে নাচিতে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন যে ,” তুমি শ‍্যাম আমি রাধা,’ অমনি পরমহংসদেবও বলিলেন যে , ‘ তুমি শ‍্যাম, আমি রাধা।’ ……
একদিন কমলকুটিরে আসিয়া শ্রীকেশবচন্দ্রকে বলিলেন, ‘ দেখো কেশব তোমার কাছে এলে আমার চৌদ্দপোয়া কালী নুনের পুতুলের মত গলে যায়, আমি নিরাকারবাদী হই।’ তিনি ব্রাহ্মদের শ্রদ্ধা করিতেন। দু তিনবার পরমহংসদেবকে বলিতে শুনিয়াছি যে ” ব্রাহ্মদের ভিতর কেশব একজন বিশেষ লোক, কেশব বইয়ের কথা বলে না। নিজের ব্রহ্ম দর্শনের ও ব্রহ্মশ্রবণের কথা বলে।”

( কামাখ‍্যানাথ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ; প্রবাসী, ফাল্গুন, ১৩৪২ )
………………………………………………………………….

‘ পরমহংসের জীবন হইতেই ঈশ্বরের মাতৃভাব ব্রাহ্মসমাজে সঞ্চারিত হইল। সরল শিশুর ন‍্যায় ঈশ্বরকে সুমধুর মা নামে সম্বোধন, এবং তাঁহার নিকটে শিশুর মত প্রার্থনা ও আব্দার করা এই অবস্থাটি পরমহংস হইতেই আচার্যদেব বিশেষরূপে প্রাপ্ত হন। পূর্বে ব্রাহ্মধর্ম শুষ্ক তর্ক ও জ্ঞানের ধর্ম ছিল, পরমহংসের জীবনের ছায়া পড়িয়া ব্রাহ্মধর্মকে সরস করিয়া তোলে।
পরমহংসও আচার্যের জীবনের সাহায্য পাইয়া নিরাকার ঈশ্বরের দিকে অধিকতর অগ্ৰসর হন, ধর্মের উদারতা ও কিয়ৎ পরিমাণে সভ‍্যতার নিয়মনিষ্ঠা লাভ করেন। যখন আচার্যদেব দলবলে পরমহংসের নিকটে ও পরমহংসদেব আচার্যের ভবনে পুনঃ পুনঃ গমনাগমন করিতে লাগিলেন, এবং পরমহংসদেবের উচ্চ ধর্মভাব ও চরিত্র পুস্তক ও পত্রিকায় আচার্যদেব প্রকাশ করিতে লাগিলেন, ‘মিরার’ ও ‘ ধর্মতত্ত্বে তাহার বিবরণ সকল লিখা হইল, “পরমহংসের উক্তি” নামধেয় ক্ষুদ্র পুস্তক প্রচারিত হইল, তখন হইতে তিনি সর্বত্র পরিচিত হইলেন। ….. নূতন ধর্ম দান বা সত‍্য প্রচার বা একটা নূতন মন্ডলী স্থাপন করা পরমহংসের জীবনের লক্ষ‍্য ছিল না। কেহ উপদেশ প্রার্থনা করিলে বলিতেন, ইহা এ আধারে নয়, সে আধারে, অর্থাৎ কেশবচন্দ্রে। কিন্তু পরে অনেক লোককে তিনি সাধনভজন সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিয়েছেন। অনেক সুশিক্ষিত যুবক অনুগত শিষ‍্য হইয়া তাঁহা কর্তৃক উপদিষ্ট হইয়াছিলেন। শুনিলাম, ন‍্যূনাধিক পাঁচ শত স্ত্রী পুরুষ তাঁহার শিষ‍্যশ্রেনীভুক্ত হইয়াছে। কিন্তু তিনি কাহাকেও শিষ‍্য বলিতেন না, এবং আপনাকে গুরু বলিয়া স্বীকার করিতেন না। তিনি প্রচলিত পৌরহিত‍্য ও গুরুব‍্যবসায়ের অত‍্যন্ত বিরোধী ছিলেন।

( ধর্মতত্ত্ব, ১ লা আশ্বিন, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৬ )

…………………………………………………………………

দি নিউ ডিসপেনসেশন” (১৮৮২ ৮ই জানুয়ারি) লিখছে,

” যাঁরা লক্ষ‍্য করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়ে দেখেছেন দক্ষিনেশ্বরের শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ কিভাবে হিন্দু ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজের মধ‍্যে সেতু বন্ধনের কাজ করছেন। সম্প্রতি বিশিষ্ট হিন্দুদের গৃহে কতকগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে,তাতে উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ঐক‍্যমত হয়ে চিন্তায় এবং ভক্তিতে এমন ঐক‍্যবদ্ধ হয়েছেন যা বাস্তবিকই বিস্ময়কর এবং আকর্ষণীয় …. “

…………………………………………………………………..

” এইসময়ে ভক্তিভাজন রামকৃষ্ণ পরমহংস মহাশয়ের সহিত কেশববাবুর আলাপ হয়। তাঁহার জীবন্ত বৈরাগ‍্য দর্শনে কেশববাবু বৈরাগ‍্য সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া আমাকে কলিকাতায় আসিতে পত্র লেখেন, আমি কলিকাতায় আসিয়া দেখি কেশববাবু স্বহস্তে রন্ধন করিতেছেন। ব্রাহ্মসমাজে যাহাতে বৈরাগ‍্য প্রবেশ করে তজ্জন‍্য তিনি বাস্তবিক চেষ্টা করিতেছেন। সেই সময় অনেকের মুখে বৈরাগ‍্যের প্রশংসা শ্রবণ করিয়াছি। আবার কতিপয় ব্রাহ্ম বৈরাগ‍্যের ঘোর বিরোধী হইয়া কেশববাবুকে নিন্দা করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মসমাজে বৈরাগ‍্য কেন ? বৈরাগ‍্য যেন ব্রাহ্মসমাজকে স্পর্শ না করে। খাও দাও আমোদ কর, মধ‍্যে মধ‍্যে ঈশ্বরের নাম কর, অত বাড়াবাড়ি কেন ? ” ( ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান অবস্থা এবং আমার জীবনে ব্রাহ্মসমাজের পরীক্ষিত বিষয় ও কয়েকটি উপদেশ ; শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী : নব ভারতী ভবন,১৯৯৭ )

…………………………………………………………………..

একবার কেশবচন্দ্র সদলবলে ষ্টিমার নিয়ে দক্ষিনেশ্বরে এলেন। তাঁকে দেখতে ব‍্যাপক জনসমাগম হল। মানুষের অনুরোধে তিনি বক্তৃতা দিতে লাগলেন।
” হৃদু মুকুজ‍্যে বলিয়াছিলেন, ” কেশববাবুর কি বক্তৃতার ক্ষমতা, মুখ দিয়ে যেন মল্লিকে ফুল বেরতে লাগল। অনর্গল তিনি বলতে লাগলেন। টাউন হলে তিনি লিকচার দিয়ে থাকেন, সেতো কখনও শোনা হয়নি। সেজন্য, কেশববাবুর লিকচার শোনার এত আগ্ৰহ হইয়াছিল।”
পরমহংস মশাইও বক্তৃতা শুনিয়াছিলেন, কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই তিনি বিরক্ত হইয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। …. কেশববাবু ভাবিলেন যে তাহা হইলে বোধ হয় বক্তৃতায় কোন ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু অন‍্যান‍্য শ্রোতারা বলিতে লাগিল, ” লোকটা অশিক্ষিত; মুকখু, কোনো কিছু বোঝে না, তাই চলে গেল।”
…. কেশববাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ” মশাই, কি ত্রুটি হয়েছে ?”
পরমহংসমশাই বললেন, ” তুমি বললেঃ ভগবান, তুমি সমীরণ দিয়েছ, তরু গুল্ম দিয়েছ ! এ সকল তো বিভূতির কথা ! এসব নিয়ে কথা কইবার দরকার কি ? যদি এই সব বিভূতি তিনি নাই দিতেন, তা হলেও কি ভগবান হতেন না ? বড়মানুষ হলেই কি তাকে বাপ বলবে ; যদি তিনি গরীব হতেন, তা হলে কি তাকে বাপ বলবে না ? এইরূপ ‘গুণ’ ও ‘ বস্তু’ র কথা, বিভূতি বা ঐশ্বর্যের অতীত হইলেন ব্রহ্ম, —- এই সকল কথা হইতে লাগিল।

পরদিন সিমলাতে এই কথা রটিয়া যাইল। তখন এত খবরের কাগজ ছিল না,সকল সংবাদ মুখে মুখে আসিত। বেলা নয়টা হইতে অনেক লোক গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রীটে আসিয়া জমা হইতে লাগিল, আর উন্মত্ত হইয়া এই কথা বলাবলি করিতে লাগিল। ….. সকলেই কেবল বলিতে লাগিল, ” বড়মানুষ হলেই কি বাপ হবে, গরীব হলে কি বাপ হবে না ? ” ……

আর সেইসঙ্গে একটা কথা উঠিল ” দক্ষিনেশ্বেরের পরমহংস মশাই কেশব সেনের মাথা ভেঙ্গে দিয়েছেন। কেশব সেন আর মাথা তুলে কথা কইতে পারেন না। “

…… কেশববাবুর যে একচ্ছত্র প্রতিপত্তি ছিল তাহার কিঞ্চিৎ হ্রাস হইল। এই দিন হইতে পরমহংস মশাই এর প্রতি শিমলার লোকের একটু বিশেষ শ্রদ্ধা আসিল এবং তিনি একজন বিশিষ্ট লোক বলিয়া পরিগণিত হইতে লাগিলেন। “

( শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের অনুধ‍্যান ; মহেন্দ্রনাথ দত্ত )

…………………………………………………………………..

তথ‍্যসূত্র ; শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত; মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; রিফ্লেক্ট , ২০০১

সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত; মিত্র ও ঘোষ, ১৯৮৪

পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু

                                              (  ক্রমশঃ )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.