যাদুনাথ সরকার: একজন দ্রষ্টা

স্যার যদুনাথ সরকার-এর জীবন হ’ল তপস্যা ও সাধনার (ন‍্যায়নিষ্ঠা এবং সহযোগিতার)। পুরানো প্রবাদ অনুযায়ী “সরল জীবনযাত্রা এবং উচ্চ চিন্তাভাবনা, তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়ে তাঁর জীবনকে পরিপূর্ণতা দিয়েছিল”। জীবনের দুর্দশাগুলি যতই দুর্গম হোক না কেন, তাঁকে ভয় দেখাতে পারেনি, কোনও দুর্ভাগ্যই তাকে হতাশ করতে পারেনি​ এবং কোনও প্রলোভন তাকে বিপথগামী করতে পারেনি। একজন নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রমী, খ্যাতিমান​ মানুষ যাঁর জনপ্রিয়তার প্রতি কোন উন্মাদনা না থাকার জন্য তিনি ইতিহাসের​ গবেষণার অগ্রগতিতে এক অনন্য পরিষেবা প্রদান করে গেছেন। জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল অসীম, কিন্তু সাধারণভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা তাকে ব‍্যথিত করেছিল। তিনি এটা দেখে অত‍্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন যে শিক্ষার্থীদের সাধারণত ঐতিহাসিক জ্ঞান লাভের প্রতি কোনো উৎসাহ নেই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ডিগ্রি অর্জন করা। তিনি ছিলেন স্বভাবগতভাবে মানুষ​ এবং একই সাথে একজন সুবিবেচক। তাঁর কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে হ’ল কর্তব্য, যা তাঁর নেশার উৎস বলা যেতে পারে। কাজ এবং জ্ঞানের প্রতি এই একাত্মতা তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে পারতো এমনকি প্রিয়জনের বিয়োগও। কাজ না করলে তিনি মানসিকভাবে অত‍্যন্ত হতাশাগ্ৰস্থ হয়ে পড়তেন। কাজ এবং জ্ঞানের প্রতি তাঁর প্রগাঢ়​ ভালবাসা তাঁকে একজন বিশিষ্ট পন্ডিত করে তুলেছিল। তাঁর লেখাগুলি ছিল সংক্ষিপ্ত, উদ্ভাসক, সুস্পষ্ট, দৃষ্টান্তমূলক এবং প্রানবন্ত। তাঁর এই সর্বব্যাপী জ্ঞান, গভীর চিন্তাশক্তি, অতল-বিস্তৃত প্রজ্ঞা তাঁর অধ্যয়নের সন্দেহাতীত সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর গবেষণাগুলো ছিল মৌলিক এবং তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সমালোচক। আর তাঁর দুর্দান্ত স্মৃতি ছিল প্রকৃতির এক বিরল উপহার আর সেটা যা এই বরেণ্য ঐতিহাসিকের সবচেয়ে কাছে হয়ে উঠেছিল মূল্যবান সম্পদ তা বলাইবাহুল্য।

স্যার যদুনাথ সরকার ছিলেন একজন দূর্দান্ত মানুষ, একজন অসাধারণ লেখক এবং ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন “সত্যিকারের” ঐতিহাসিক। ইতিহাস শিক্ষার পাঠ তাঁর জ্ঞানের ছটায় হয়ে উঠেছিল আরও বেশী গ্ৰহনযোগ‍্য এবং আকর্ষণীয়। তিনি এ দেশের অতীত ইতিহাসের আলোকে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার যথাযথ সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পূর্বাভাসগুলি তাঁর প্রগাঢ় প্রতিভা, দূরদর্শিতা এবং রাষ্ট্রনায়কত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এইগুলি আসলে ইতিহাসের কালের স্রোত এবং আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অন্তর্দৃষ্টির ফলাফল।

স্বাধীনতা

… এমনকি ১৯২৮ সালে স্যার জে.এন সরকার জানতেন যে ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়েই আসতে চলেছে এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে​ পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল… আমরা আর কিছু না পারি কিন্তু স্যার যদুনাথের দূরদর্শিতার প্রশংসা তো করতেই​ পারি তাই না? ১৯৪৭-এর পরে স্বাধীন ভারতের​ কার্যক্রমের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যাবে যে তাঁর দূরদর্শিতা কতটা সঠিক ছিল। নীচে তেমন ই একটি বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা হ’ল, যা তিনি ১৯২৮ সালে করেছিলেন:

বিদেশি আধিপত্য থেকে মুক্তি পেয়েও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের মানুষেরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনো উপভোগ করতে পারবে না; এটা একটি গোষ্ঠী বা পরিবারের স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকবে।

স্পষ্টতই এই মহান ইতিহাসবিদের অতীতে বলা এই সতর্কবানী , আজও সমানভাবে প্রযোজ্য এবং নির্ভুল ওর বটে।

১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক লড়াই

… যদিও গান্ধীজী মিঃ মহম্মদ আলী জিন্নাহকে পূর্ণক্ষমতা দিয়েছিলেন তবুও কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার নোংরা সমস্যা সমাধান হয়নি। মিঃ জিন্নাহ’র আপোষহীন মনোভাব এবং স্যার স্যামুয়েল হোড়-এর অংশগ্রহণ এই সমস‍্যার নিষ্পত্তি অসম্ভব করে তুলেছিল। গান্ধী প্রচন্ড হতাশায় এবং ক্ষোভে ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন… এই সময় স্যার যদুনাথ সরকার ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্ট ডাঃ জি. এস. সারদেসাইকে একটি চিঠি লিখেছিলেন:

“আমি ভবিষ্যতে নাগরিকদের​ মধ্যে চলা এই সমস্যা কমার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না; অন‍্যদিকে, ইংল্যান্ডে এবং ভারতে ইউরোপীয়দের মধ্যে জনগণের মতামত এতটাই তিক্ততায় পৌঁছেছে যে স্বরাজীরা খুব শীঘ্রই ব্রিটিশ এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের শক্তি পরীক্ষা করতে হবে। হিন্দুরা এত বিভক্ত এবং এতই বোকার মতো স্বার্থপর যে তাদের সংখ্যা প্রকৃত রাজনীতিতে গণনা করাই যাবে না। রক্ত ঝরার পরেই হয়তো আবহাওয়া পরিষ্কার হতে পারে … প্রশাসন অত‍্যন্ত অদক্ষ ও অসাধু এবং এদের থেকে কোনও উন্নতির আশা করা যায় না … এখানকার হিন্দুদের (কলকাতা বা বঙ্গের​) ভবিষ্যৎ অনির্বচনীয়ভাবে অন্ধকার”।

তিনি ১৯৪৭-এ সংঘটিত রক্তাক্ষয়ী ঘটনার পূর্বাভাস দিয়ে ছিলেন… আসন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে তাঁর মতো এমন স্পষ্ট ধারণার প্রমাণ এর আগে বা পরে ভারতের আর কোনো শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি।

নেহরুর পরে কি হবে?

তৎকালীন সময়ে জনগণের মনে​ একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খেয়ে এসেছে আর সেটা হ’ল “নেহরুর পরে, কী হবে?”। এই বিষয়ে স্যার যদুনাথের নিজস্ব কিছু বক্তব্য রয়েছে এবং সে’বছরের প্রজাতন্ত্র দিবসে (১৯৫৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী) তিনি “আফটার নেহরু…?” শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, যার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হ’ল:

“যদি কেবল “ইয়েস ম‍্যান”-দের আমাদের অর্থমন্ত্রীরূপে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় তবে ইতিহাসের পাতায় প্রধানমন্ত্রীর সুনামকে চূড়ান্তভাবে মূল্য দিতে হবে”।

যদুনাথ সরকার ইতিহাসের তরফ থেকে দেশকে সতর্ক করেছিলেন যে অর্থের​ বাজারে ধস এবং মুদ্রার দামের পতন শেষ পর্যন্ত জনগণ তথা পুরো দেশকে দেউলিয়া করে ছাড়বে যা জাতীয় বিপর্যয়ের​ আকার নেবে।

তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীটি কতটা সত্যি​ হবে সেটা তো একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে… তবে এটুকু বলাই যায় যে স্যার যদুনাথ সরকারের মতো একজন শীর্ষস্থানীয় ও বিখ‍্যাত ব্যক্তির উপরোক্ত সতর্কবাণীগুলো সরকার যদি মেনে চলেন তাহলে ক্ষতি কিছু হবে না বরং লাভ ই হবে…. কারন স্যার যদুনাথের ভবিষ্যদ্বাণীগুলির মিথ্যা হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

অতীতের​ জনসাধারণের কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা বর্তমানের সার্বজনীন কার্যক্রম বোঝার সর্বোত্তম উপায় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের নিরাপদ উপদেষ্টা বলা যেতে পারে। ইতিহাসের যথাযথ পঠনপাঠনের মাধ্যমে আমরা সক্রেটিসের পরামর্শ মতো সলোমনের প্রজ্ঞায় যোগ দিতে পারি।

পুনশ্চ

ঘটনা পরবর্তী বোধোদয়ের মাধ্যমে আমরা দৃঢ়তার সাথে এটা বলতেই পারি যে কীভাবে যদুনাথ সরকারের দূরদর্শিতা এবং তাঁর দাবিগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তাঁর বলা সমস্ত কিছুই দুঃস্বপ্নের মতোই সত্যি​ হয়েছিল( অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। অন‍্যদিকে এটাও সমানভাবে সত‍্যি যে আমরা সেই একই ঐতিহাসিক ভুলগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছি যার বিরুদ্ধে তিনি আমাদের অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.