খাস কলকাতা শহরে অবস্থিত জোড়াসাঁকো চিৎপুরের বিখ্যাত গুটকে কচুরি খেয়ে, আঙুল চেটে শীতের সকালে বা বিকালে গুটি গুটি হাঁটতে হাঁটতে মার্বেলের মূর্তি তৈরির দোকানগুলির ঠিক আগে একটা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ির সামনে নিয়ে সাইনবোর্ডে নজর পড়লে চমকে উঠবেন না যেন

“রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক স্থাপিত / প্রথম ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির

আদি ব্রাহ্ম সমাজ / ইং ১৮৩০ / বাং ১১ ই মাঘ ১২৩৬

রাজা রামমোহন চেয়েছিলেন যে বিদেশীরা বুঝুন হিন্দু ধর্ম কতটা সুমহান, কি বিশাল, কত ব্যাপক তার বিস্তার ….হিন্দুরা পরমব্রহ্মের উপাসনা করেন। “ওম তৎ সৎ একমেবাদ্বিতীয়ম।

রাজা রামমোহন রায়। এ নামটি নিশ্চয়ই পাঠককে স্মরণ করাতে বা নতুন করে পরিচয় দিতে হবেনা। তিনি একাধারে মহান বিদ্দ্বজ্জন, ইতিহাসে বর্ণিত শ্রেষ্ঠতম সমাজ সংস্কারকদের অন্যতম এবং অনেক কিছুই একাধারে – শুধু এটি মনে রাখাই যথেষ্ট মনে হয়, এই ব্যক্তি যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্ধকারের মধ্যে আবির্ভূত না হতেন, যদি তাঁর প্রতিভার অগ্নিশিখা তৎকালীন সমাজকে এক নব চিন্তার স্রোত দর্শন না করাতো তাহলে আপনি ও আমি কোনভাবেই বর্তমানের এই আধুনিকতার সংশ্রবে আসতে পারতাম না। কোনভাবেই নয়।

রামমোহন রায় প্রথম স্থাপন করলেন আত্মীয়সভা। উদ্দেশ্য ধর্মানুশীলন সত্যানুসন্ধান ও ধর্মীয় বিষয় সমূহের খোলাখুলি আলোচনা । সভায় সবাই যে ধর্ম আলোচনার জন্য আসতেন ঠিক তা নয়, অন্য ব্যাপারে রাজা রামমোহনের মত মানুষের পরামর্শ নিতেও আসতেন… আবার অনেকে ছিলেন যাঁরা শুধুমাত্র নামজাদা মানুষটিকে দেখে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করতে আসতেন।

রাজা ফার্সী ভাষায় ছিলেন মহা পারদর্শী, অন্যদিকে সংস্কৃতে মহান পন্ডিত। কিন্তু তিনি ফারসি ভাষায় সবাইকেই সম্বোধন করে বলতেন – বেরাদার।

এহেন আত্মীয় সভার বৈঠক বসত রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে। আপার সার্কুলার রোডের এই গৃহ মানিকতলা গার্ডেন হাউস নামেও পরিচিত ছিল। এই সভার অনুষ্ঠান হতো এইভাবে – পন্ডিত শ্রী শিবপ্রসাদ শাস্ত্রী শাস্ত্র পাঠ করতেন। কোনো বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ রামমোহনের লেখা গান গাইতেন।

এরপর আত্মীয় সভা চলে গেল রামমোহনের অপর একটি গৃহ আমহার্স্ট স্ট্রীটের সিমলা হাউজে। তার পরে চলে গেল বড়বাজারের শ্রী বিহারীলাল চৌবের বাড়িতে।

বিহারীলাল চৌবের গৃহতেই মাদ্রাজের শ্রী সুব্রাহ্মন্য স্বামী ও রামমোহনের সুবিখ্যাত শাস্ত্রীয় তর্কযুদ্ধ হয়েছিল। এই তর্কযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৎকালীন টাউন কলকাতায় একটি শোরগোল পড়ে যায়। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি সেটি প্রত্যক্ষ করার জন্য সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরও ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গোবিন্দদাস, রামমোহনের সম্পত্তির অংশ দাবী করে।

এই সংক্রান্ত মোকদ্দমার কারণে তিনি ব্যস্ত থাকায়, নিয়মিতভাবে ‘আত্মীয় সভা’ চালাতে পারেন নি।

তখনো রামমোহন রাজা উপাধি পাননি। তাঁর অনুরাগীদের এই একটি দল তৈরি হলো । তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সমবেত হলেন রামমোহনের বৈঠকখানায়। সমাজে এখন একটি নবজাগরণের দরকার । নিশ্চিন্ত নিদ্রা থেকে টেনে তুলতে হবে সমাজকে।

এর ভিতরে তিনি ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায় শ্রী গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন।

এই সময় তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুর। পরে তিনি হেদু্য়ার কাছে ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি এ্যাংলো হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ।রামমোহনের একান্ত সহযোগি। চারটি ক্ষেত্র -সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্ম, শিক্ষা ঢেলে সাজাতে হবে …আরও দুই ঠাকুর এলেন – শ্রী প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও শ্রী রমানাথ ঠাকুর ।রমানাথ ঠাকুর সম্পর্কে দ্বারকানাথের ভাই ছিলেন।প্রসন্নকুমার ঠাকুর হলেন পাথুড়িয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর এর পুত্র ।পরবর্তীকালে আইনবিশেষজ্ঞ হিসাবে শ্রদ্ধার আসন পান।

১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন তাঁর ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ বইয়ে প্রমাণ করেন যে, সতীদাহ প্রথা অন্যায় এবং এ বিষয়ে হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রে কোনো বিধান নেই। এ নিয়ে সে সময়ে হিন্দু সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

এর মধ্যেই ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘আত্মীয় সভা’ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউনিটোরিয়ান কমিটি নামে ধর্মসভা স্থাপন করেন। পত্রিকার স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে তিনি মীরাৎ-উল-আখ্‌বার বন্ধ করে দেন।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বরে তিনি নিজ খরচে এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল স্থাপন করেন।

আত্মীয় সভা, ইউনিটারিয়ান কমিটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ইউনিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ব্রাহ্মসমাজ….. শ্রী তারাচাঁদ চক্রবর্তী ও শ্রী চন্দ্রশেখর দেব রামমোহন রায়ের নিকট প্রস্তাব রাখলেন নিজেদের সম্পূর্ণ উপাসনাস্থলের। যা সমস্ত রকম বিদেশি সংস্পর্শ বহির্ভুত হবে।

রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ও টাকি নিবাসী রায়ের কালীনাথ মুন্সির সঙ্গে পরামর্শ করলেন। নিজের একটি সভা ডাকলেন । এলেন দ্বারকানাথ , কালিনাথ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর , মথুরানাথ মল্লিক । এক বাক্যে স্বীকার করলে এটি একটি উত্তম প্রস্তাব।

জোড়াসাঁকো, চিৎপুর রোড । ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট তারিখে ব্রাহ্ম মতাদর্শের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উত্তর কলকাতার বাঙালি শ্রী কমললোচন বোসের বাড়িতে একটি ‘ধর্মসভা’র আয়োজন করেন। যদিও লোকে বলে কমল খ্রিষ্টান ছিল , তবে সে তা ছিল না। পর্তুগিজ কোম্পানিতে কাজ করা কমল কে তার কেতাদুস্তরতার জন্য ফিরিঙ্গি কমল বলত লোকে।

এই সভায় ব্রাহ্মদের জন্য একটি পৃথক ধর্মীয় সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয় এবং এই সমাজের নামকরণ করা হয়, ‘ব্রাহ্মসভা’, মতান্তরে উপাসনা সভা। কমলের বাড়ির সামনের দুইটি ঘর ভাড়া নিয়ে সমাজের কাজ শুরু হয়।

প্রতি শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে নয়টা সভার কার্যকাল । দুজন তেলেগু ব্রাহ্মণ ব্যক্তি বেদ, উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ উপনিষদ পাঠ করতেন ।রামচন্দ্র বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা করতেন। তারপর সংগীত ও সভা-শেষ। কলকাতার বিশিষ্ট হিন্দুরা যোগদান করলেন । ভারী চেহারা, সুন্দর সুন্দর পোশাক, ফিটন গাড়ি , ভেতরে তত্ত্ব আলোচনা সাধু বাংলায় সম্বোধন ….পাশে জোড়া সাঁকো….

কিছুদিনের মধ্যেই যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ হল। কমলের বাড়ির পাশেই কেনা হলো এক খন্ড জমি। নির্মিত হলো নিজস্ব সমাজ গৃহ। চারকাঠা আধপোয়া জমি ।তার সঙ্গে একটি গৃহ । চার হাজার দুশো টাকা দাম । ১৮২৯ সালের ৬ জুন।স্ট্যাম্প বিক্রেতার নাম ব্রজমোহন দত্ত। বিক্রেতার নাম কালিপ্রসাদ কর।জোড়াসাঁকো তখনো সুতানুটি ।রামমোহন রায় রাজা উপাধি পান নি।তখনো ব্রাহ্মসমাজ নাম হয়নি। নাম ছিল ব্রহ্মসভা।

১২৩৬, ১১ মাঘ ( ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ, ২৩ জানুয়ারি) নতুন গৃহে সমাজের কাজ শুরু হলো ….প্রথম প্রথম ভাদ্র মাসের সাম বাৎসরিক উৎসব হত। যা ভাদ্র উৎসব নামে পরিচিত ছিল। প্রচুর ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হতেন । তাদের দক্ষিণা দান করে বিদায় দেওয়া হতো। সমস্ত খরচ সামলাতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর , কালীনাথ আর মথুরনাথ।

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দর ২৩শে জানুয়ারি (১১ই মাঘ), এই বিশেষ দিনটিকে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা ‘মাঘোৎসব’ হিসেবে পালন করে থাকেন।

এখানে একজন মাত্র ইউরোপীয় ছিলেন । কে তিনি? – মন্টোগোমেরি মার্টিন ।হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ কলোনির লেখক। তিনি লিখেছিলেন – ১৮৩০ সালে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়… প্রতিষ্ঠা দিবসে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন । প্রায় ৫০০ মানুষ উপস্থিত ছিল এবং তাদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ দক্ষিণা দেওয়া হয়েছিল।

ইংরেজি সংবাদপত্র জন বুল দুঃখ প্রকাশ করে বললে – ভাবা গিয়েছিল রামমোহন হয়তো খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করবেন! কিন্তু তিনি যে হিন্দু শাস্ত্র মতে ব্রম্ভ জ্ঞান এর প্রচারে মেতে গেলেন….

সেই ব্রাহ্মমন্দির আজ বিপদজনক বাড়ির তকমা পেয়েছে। যে ধর্মান্তর রোখার জন্য রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সমাজকে আদি ব্রাহ্মসমাজ রুপ দিয়ে তাকে জীবনভর আগলে রেখেছিলেন…. সেই ব্রাহ্মসমাজ, সেই ব্রহ্মমন্দির আজ পরিত্যক্ত।

যে বাড়ির পরতে পরতে আজও এক আগ্নেয় ইতিহাসকে স্পর্শ করা যায়, অনুভব করা যায় এক কালকে – যখন প্রজ্ঞা, শ্রম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা একই অঙ্গে লীন হয়েছিল আর যা রচনা করেছিল বাঙ্গালী হিন্দু জাতির উল্কাসম গতিতে উত্থানের প্রথম সোপান – তা আজ কালের ধুলায় উপেক্ষিত। স্বদেশী যুগের পরবর্তী বঙ্গে যে বামপন্থীয় মানবতাবোধের স্রোত আছড়ে পড়ল সমাজের অভ্যন্তরে তার কাছেও এই চিন্তার কোন মূল্য নেই। খোঁজা হয়েছে শুধু তার মধ্যে যবনকেন্দ্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার ঝাঁঝ কত ছিল – তাই আজ সেটি পরিত্যক্ত; খন্ডহরে পরিণত হয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে।

যে হিন্দুত্বের ভাবধারা, যে উপনিষদের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের সূচনা ঘটেছিল ক্রমশ কেশব সেন ও তার পরবর্তী পর্যায়ে সেই ব্রাহ্মসমাজ একটি সর্বধর্ম সমন্বয় সমাজে পরিণত হয়েছিল। যা ধীরে ধীরে ব্রাহ্মদের মধ্যে সেকুলারিজমের সৃষ্টি করেছিল ।

এ ঘটনা আমরা সমাজকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি তে পাই। তারপর কত কত বছর কেটে গেছে কত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের দল এই বাংলায় রাজত্ব করেছেন… কিন্তু এই ব্রাহ্মসমাজের কথা তাদের মনে পড়েনি…সেকুলার বুদ্ধিজীবি মানুষের নিকট এখন সে সমাজ ব্রাত্য…


তথ্যসূত্র – নবজাগরণের নায়কেরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.