মহাকাশে অবস্থিত বায়ু যেমন মহাকাশে সর্বত্র বিরাজমান। তবুও তার পৃথক অস্তিত্ব আছে।ঠিক তেমনই ভগবান বিষ্ণু দশাবতারে ধর্ম কে প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন রুপে মর্তের এই ধরাধামে পূজিত হয়েছেন ভক্তের মাঝে। কখনো হনুমানের কাছে শ্রীরাম রুপে, কখনো মহাভারতে রণক্ষেত্রে পান্ডবের কাছে অর্জুনের রথের সারথী কৃষ্ণ রুপে। আবার কখনো ভক্ত প্রহ্লাদের কাছে নারায়ণ রুপে।গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ধর্ম যখনই গ্লানিযুক্ত হয়ছে, অধর্মের যখন অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নানান রুপে দেহধারণ করি। দুষ্কৃতিদের বিনাশ করে সাধুদের রক্ষা করার জন্য এবং অধর্মকে উচ্ছেদ করে আবার ধর্মকে সংস্থাপন করতে যুগে যুগে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হই। চৈত্র শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ নবমী তিথিতে রাক্ষস রাজা রাবণ কে বধিতে স্বর্গ থেকে মর্তের এই ধরাধামে আবির্ভূত হলেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার প্রভু শ্রীরামচন্দ্র।কারণ রাবণ পূর্বজন্মে ছিলেন অভিশাপগ্রস্ত বিষ্ণুভক্ত বিজয়। তাই চতুকুমারের অভিশাপে এই ধরাধামে মানবের মাঝে ঋষি বিশ্রবা ও রাক্ষসী নিকষার দুই পুত্র কুম্ভকর্ণ ও রাবণ রুপে জন্মগ্ৰহণ করেন কলিদেবের পুত্র বিজয় ও জয় ।হিন্দু পুরাণ অনুসারে, জয় ও বিজয় ছিলেন শ্রী বিষ্ণুর বাসক্ষেত্র বৈকুণ্ঠধামের দুই দ্বাররক্ষী বা দ্বারপাল৷ একদা অভিশাপিত হয়ে উভয়কেই মর্তলোকে একাধিক জন্ম নিয়ে প্রতিবারেই বিষ্ণুর অবতার দ্বারা নিহত হন৷ তারা পৃৃৃথিবীতে সত্যযুগে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু, ত্রেতাযুগে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ এবং শেষ জন্মে দ্বাপরযুগে শিশুপাল ও দন্তবক্র নামে জন্ম গ্রহণ করেন৷
দশহাজার বছর রাবন ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেন এবং বর লাভ করেন যে, দেব,দানব বা ভৌতিক জীব কেউ তাকে বধ করিতে পারিবে না। একমাত্র নর,(মানুষ) ও বানরই তাঁকে বধিতে পারিবে।তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজা। ঋষিদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তিনি বিশেষ আমোদ অনুভব করতেন।ইন্দ্রলোক দানব রাজা রাবণের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এবং হতাশাগ্ৰস্থ হয়ে সমস্ত দেবতা গণ ঠিক করেন, একমাত্র অত্যাচারী পাপী রাবণের হাত থেকে মর্তলোকে শান্তি ফিরিয়ে এনে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে স্বয়ং ভগবান শ্রী বিষ্ণুয় পারবেন।তাই সমস্ত ইন্দ্রলোকের দেবতাগণ শ্রী বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলেন।এবং শ্রী বিষ্ণু তার অষ্টম অবতার রুপ ধারণ করে ব্রহ্মার বরদান এড়িয়ে রাবণ কে হত্যা করার জন্য, মনুষ্য রুপে কৌশল্যার কোল আলোকিত করে রাজা দশরথের জ্যৈষ্ঠ পুত্র সন্তান “রাম” রুপে আবির্ভূত হলেন অযোধ্যা নগরীতে।শিশু রামের মুখের ঈষৎ শুভ্র হাসি ছড়িয়ে পড়লো অযোধ্যা নগরী জুড়ে।সকল দেবতাগণ স্বর্গ থেকে শ্রীরামকে মর্তলোকে অভ্যর্থনা জানালেন পুষ্প বৃষ্টি করে। এদিকে শ্রী বিষ্ণুর সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গিনী মা লক্ষ্মীও তাঁর প্রভু নারায়ণের সাথে পাড়ি দিলেন মর্তলোকে। এবং মিথিলার রাজা জনক কন্যা সীতা রুপে জন্ম গ্ৰহণ করলেন মিথিলা নগরীতে। শিশু,বালক,যুবক,ও তরুণ বয়স চার ভাগ কাটিয়ে প্রভু শ্রীরাম বাড়িতে লাগিলো তিন মাতার চোখের আলয়ে। এটা শুধু ভগবানের লীলা নয়, ধর্ম-অধর্ম,পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের ধর্ম চেতনা জাগিয়ে সমগ্ৰ জগৎকে মনুষ্যত্বের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে স্বধর্ম প্রতিষ্ঠা করাই ভগবানের মূখ্য ভূমিকা ছিল। কারণ স্বয়ং ভগবান জানতেন, জগতে যদি অধর্মের ঘোর অন্ধকার না আসে,তাহলে ধর্মের উত্থান করা কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের কর্মে পাপের ছায়া থাকলে তবেই পুণ্য লাভের মতন স্বর্গ লাভ করা সম্ভব হবে। ঠিক তেমনি, অন্যায় কেউ না করিলে, ন্যায় বিচার করা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই জগতের পালন কর্তা শ্রী বিষ্ণু জানতেন, একমাত্র রাবণের মুক্তির পথ এটাই তাকে ঘোর পাপিষ্ট হয়ে এই প্রাণী জগতে তার পাপের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হতে হবে।আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন স্বয়ং ভগবান শ্রী বিষ্ণু তাঁকে সেই পথের আলো দেখাবেন। তাই তিনি মিথিলার রাজা জনকের রাজগৃহের স্বয়ংবর সভায় শিবের হরধনু ভেঙ্গে মা সীতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।এবং রাবণের পাপ মুক্ত করিতে পিতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাসে গিয়ে, মা সীতাকেই লঙ্কা কান্ডের মূখ্য ভূমিকা পালনের জন্য রাবণের স্বর্ণ লঙ্কায় পাঠালেন “সীতা হরণের” লীলা রচনা করার জন্য। আমার একটি কবিতা “সীতা হরণের” ভাষায়,
রাম নামেতে পাথর ভাসে,
সেনা পার হয় রামশীলা।
ত্রেতা যুগে এসেছিল রাম,
মানবের ভীড়ে করিতে খেলা।
ভারতীয় মনের শাশ্বত প্রেরণা,
মর্যাদা পুরুষোত্তম প্রভু শ্রীরাম।
প্রজাদের দুঃখে হৃদয় কাঁদিলে,
নির্ভয়ে দিত নিজ প্রাণ।
রাম নামেতে জন্ম নিল,
নারায়ণ শঙ্খ চক্র গোদাধারী।
পত্নী রুপে আসিল শ্রীলক্ষ্মী,
জন্ম নিতে মিথিলা নগরী।
ছোট্ট শিশু আসিল ঘরে,
মুখে তাঁর শুভ্র হীরকহাসি।
স্বর্গ থেকে করিল পুষ্পবৃষ্টি,
দেবতা গণ রাশি রাশি।
শিশু, বালক, যুবক,তরুণ,
বয়স চার ভাগ কাটিয়ে।
বাড়িতে লাগিল প্রভু শ্রীরাম,
তিন মাতার চোখের আলোয়ে।
দাণব দেবতা পারিবে না কেউ,
রাক্ষস রাজা রাবণ বধিতে।
মানব ধর্ম নিলো তাই,
নারায়ণ ধর্ম চেতনা জাগাতে।
রামের হাতে মুক্তি তার,
নিছক ছলনা সীতা হরণ।
লক্ষণ গন্ডি পেরিয়ে এসে,
সীতা দিলো রাবণকে দর্শন।
লঙ্কা কান্ড না করিলে,
হতো’না ধর্ম চেতনার জয়।
অধর্মকে বিনাশ করিতে,
ভাগবানকে যুগে-যুগে আসতে হয়।
সীতা হরণে মুক্তি আছে,
রাবণ জানিত সে কথা।
দশাননের পাপ মুক্ত করিতে,
রামকে যেতে হয়েছিল লঙ্কা।
তাই তো ভ্রাতা লক্ষণের দেওয়া গন্ডিকে অবহেলা করে সীতা রাবণ কে ভীক্ষা দিতে গন্ডি পেরিয়ে রাবনের কাছে এসেছিলেন। লক্ষ্মণ গন্ডি এতটাই শক্তিশালি ছিল যে, রাবণের পক্ষে ভেদ করে সীতাকে অপহরণ করা সম্ভব ছিল না। তাই স্বামী বিষ্ণুর আদেশেই লক্ষ্মণ গন্ডি পেরিয়ে স্বয়ং মা সীতা রাক্ষসরাজ রাবণ কে এসে ধরা দিয়ে ছিলেন। আর সীতা অপহরণ নামে এক কাহিনী বর্ণিত হয়েছিল হিন্দু মহাকাব্য বাল্মীকির লেখা রামায়ণে।কারণ, সীতা অপহরণ না করিলে রাবণ কে শাপমুক্ত করিতে শ্রীরামের যাওয়া হতো না লঙ্কাপুরীতে।কেন না, রাবণের পাপের ঘোরা পুণ্য হয়ে এসেছিল এই মর্তলোকে।তাকে যে এবার মর্তের পাপের সাম্রাজ্য ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠপুরীতে যেতে হবে শ্রী বিষ্ণুর চরণতলে। রাবণও জানতো রামের হাতেই তার মুক্তি। তাই তো শ্রীরামের আত্মা,অর্ধাঙ্গিনী সীতাকে হরণ করেও তার শরীর অপবিত্র করেন নি। রাবণ চাইলে সীতার শরীর অপবিত্র করতে পারতো,কিন্তু তিনি তা করেন নি। সীতা যার অবিচ্ছেদ্য রুপ সেই মা লক্ষ্মীর স্বামী শ্রী বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠের বাসগৃহের দ্বাররক্ষী রাবণ রুপে বিজয়। তাই রাবণ চতুকুমারের দেওয়া অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শ্রী বিষ্ণু অবতার শ্রীরামচন্দ্রের স্বর্ণ লঙ্কায় আসার অপেক্ষায় দীর্ঘ বছর পথ চেয়ে বসেছিলেন। তাই প্রভু শ্রীরামচন্দ্র, ভ্রাতা লক্ষণ,ও পরম ভক্ত দ্বিগবিজয়ী শিবাবতার হনুমানের সহিত, নীল, নল,অঙ্গজ, ও বানর সৈন্য নিয়ে ভারতের তামিলনাড়ুর দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে রামেশ্বর দ্বীপ থেকে উত্তর-পশ্চিম উপকূলের মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত রাম সেতু নির্মাণ করে পাড়ি দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায় সীতা উদ্ধারের জন্য। রাম নাম এতটাই সত্য ছিল যে,পাথর পর্যন্ত জলে ভেসে উঠেছিল। এবং রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করে অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে বৈকুণ্ঠে যাওয়ার পথকে সুগম করেছিল। এবং সীতা মা কে উদ্বার করে চৌদ্দ বছর বনবাস কাটিয়ে ভ্রাতা লক্ষণ,ও সীতার সহিত ফিরে এসেছিলেন প্রভু শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যা নগরীতে।
*সমাপ্ত*
কলমে : কৌশিক দাস
তারিখ : ২৩/০৪/২০২১