কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সূচকের​ সাথে জাতীয় গড়ের তুলনা করা হয়?

এক রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের তুলনা করতে গেলে দেখা যায় যে তাদের সবাই নিজস্ব কিছু চ‍্যালেঞ্জ ও বিভিন্ন লক্ষ‍্যমাত্রা​র সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই চ‍্যালেঞ্জগুলি একে অন‍্যের থেকে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম কষ্টসাধ্য নয়। আর ভারতের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে যে এইধরণের বিভিন্নতা দেখা যাবে সেটা তো বলাইবাহুল্য।

যাইহোক, এই জাতীয় তুলনাগুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল যে এর থেকে আরও ভালোভাবে এবং সহজেই বুঝতে পারা যায় যে কোন নীতিগুলি ঠিকমতো কাজ করেছে আর কোন নীতিগুলি অপছন্দের তালিকায় রইলো।

প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি হ’ল আসলে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির একটি উপজাত ফসল এবং শাসনপ্রক্রিয়ার ফলাফল। সুতরাং, তথ্যগুলিকে কল্পনার থেকে আলাদা করে এবং বেশ কয়েকটি মূল আর্থসামাজিক সূচকের​ নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের কার্যক্ষমতা নিখুঁতভাবে মূল্যায়ন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

রাজ্যে অবশ্যই বিগত বেশ কয়েক বছরে​ যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তবে এই অগ্রগতি জাতীয় গড়ের চেয়ে ভাল কিনা সেটাই আসল প্রশ্ন।

এই জাতীয় তুলনার জন্য প্রথম সূচকটি হ’ল প্রবৃদ্ধির হার(গ্ৰোথ রেট) এবং সেইজন্য, জাতীয় গড়(ন‍্যাশনাল অ‍্যাভরেজ)-এর তুলনায় গ্ৰোথ অফ গ্ৰস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিএসডিপি) বা রাজ‍্যের মোট গার্হস্থ্য পণ্যের গড় বৃদ্ধির তুলনা করা প্রয়োজন।

২০১২/১৩-২০১৭/১৮ এর মধ্যে রাজ্যের গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৫ শতাংশ। সারা দেশের মধ্যে তুলনা করতে গেলে সেই গড় ছিল ৭.১ শতাংশ।

এবার প্রশ্ন হল যে কেন পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার বা গ্ৰোথ রেট জাতীয় গড় বা ন‍্যাশন‍্যাল অ‍্যাভারেজের থেকে কম?

এর একটি প্রধান কারণ, এই সময়ের মধ্যে রাজ্যে খুব কম পরিমাণে ব্যক্তিগত মূলধনের​ বিনিয়োগ হতে পারে।

রাজ‍্যের ঋণ ধারনের ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির গতি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ বর্তমানে ঋণ হ’ল জিএসডিপির ৩৪.৮ শতাংশ।

যদিও বর্তমান সময়ে ঋণের মাত্রা একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ এইরকম একটা সময়ে যখন মুদ্রাস্ফীতির জন্য রাজ‍্যের গ্ৰোথ রেট ক্রমশ কমতে শুরু করেছে তখন দেখা যাচ্ছে যে আমাদের রাজ‍্যের অর্থনীতির উপর সুদের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এটা​ রাজ্য সরকারের উন্নয়নের সংকটপূর্ণ পরিকাঠামো গঠনের ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে।

রাজ্যের ২০২০-২১ বাজেটে অবকাঠামোগত প্রকল্পের ব্যয়ের হার ছিল মাত্র ২.৩ শতাংশ এবং অন‍্যদিকে জাতীয় গড় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪.২ শতাংশে।

আর ঠিক এই কারণেই রাজ‍্যের উচিৎ ব্যয় এবং এই খাতের সাথে সম্পর্কিত কর্মসূচিগুলোকে পুনর্বিবেচনা করা।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কৃষকদের জন্য ৫,০০০ টাকা অনুদানের যে প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী চালু করেছেন তা অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের ৬,০০০ টাকার অনুদান দিচ্ছেন, যারফলে এই অনুদানকে রাজ‍্যের প্রকল্পিত খাতে ব‍্যবহার করে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে।

রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী হওয়া এধরনের বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে যা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলির সাথে একীকরণ করা যেতে পারে, আর তাহলেই অতিরিক্ত ব‍্যয় কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।

ভারতের মতো শ্রম-উদ্বৃত্ত দেশের জন্য, উচ্চতর বৃদ্ধির হার এবং কঠোর শ্রমবাজারগুলি হ’ল সামাজিক সুরক্ষা জালের প্রকৃষ্ট রূপ, যা কাঙ্ক্ষিত নীতিগত উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করবে।

রাজ্য যে জিনিসগুলি সঠিকভাবে পায় তা মধ্যে রয়েছে শিক্ষাখাতের ব্যয়, যা মোট ব্যয়ের ১৭.৬ শতাংশ।

জাতীয় গড় প্রায় ১৬ শতাংশের​ কাছাকাছি। এটা রাজ্যের মানব সম্পদের​ ক্ষেত্রে একধরনের বিনিয়োগ যা হ’ল আসলে দক্ষ শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার ফলাফল।

যাইহোক, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই যে রাজ‍্যের মধ্যে বেশ কিছু ভাল বেতনের কর্মসংস্থান তৈরী করে সেখানে তাদের নিয়োগ করা।

চাকরির সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে, “সেন্টার ফর মনিটরিং অব ইন্ডিয়ান ইকোনমি”(সিএমআইই)- এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে, রাজ্যে বেকারত্বের হার ৬শতাংশের উপরে রয়েছে।

কোভিড -১৯ পরবর্তীকালে বেকারত্বের হার মোটেও সন্তোষজনক নয়। অতিমারী রাজ‍্য তথা দেশের শ্রমশক্তি- কর্মে নিয়োজিত কর্মীর হার এবং বেকারত্বের হারের উপর ভীষণ খারাপ প্রভাব ফেলেছে।

তবে ২০১১ সালের এনএসএসও-এর সার্ভের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাস পেয়ে হয় ১৪.৩ পিপিপি, এবং জাতীয় গড় হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৫.৩ পিপিপি।

সিকিম ও ত্রিপুরার মতো উত্তর-পূর্বের রাজ্যে ২০-পয়েন্টের বেশি হ্রাস পেয়েছে। উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, বিহার এবং অন্ধ্র প্রদেশেও এই সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা মানুষের হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।

এই গণনাগুলি টেন্ডুলকার দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করা মিশ্র রেফারেন্স, যার সাথে বিশ্বব্যাংকের $১.৯ পিপিপি দারিদ্র্য রেখার মিল রয়েছে।

প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের নিজস্ব মতামত এবং লেখকের অধিভুক্ত কোনও প্রতিষ্ঠান এর সাথে দায়বদ্ধ নয়।

করণ ভাসিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.