তখনও শহর কলকাতা বলা যাবেনা কলকাতাকে । শেঠ আর বসাকরা বাণিজ্য করছে জঙ্গলময় সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রামে ।কাছে ছিল শ্যামবাজার। এই নামকরণ বসাকদের কৃত। শোভারাম বসাক ছিলেন বিখ্যাত কালী ভক্ত এবং ধনী । কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে উত্থান হয়েছিল এখানে দেব বংশের।
 মেদনীপুরের জঙ্গলে রামচরন দেব নিহত হলেন লুঠেরা দের হাতে। তার বিধবা পত্নী গোবিন্দপুর এ প্রত্যাবর্তন করেন 3 পুত্র ও 5 কন্যা নিয়ে । যদিও ওদের গোবিন্দপুর বাসগৃহ তে অচিরেই হুগলি নদীর গর্ভে চলে যায় এবং ওরা আরপুলি হয়ে চলে আসেন শোভাবাজার।
“কি হে পন্ডিত ? মুখখানা কেলে হাঁড়ির মতো করেছ কেন ? “
হাউমাই করে পন্ডিত বলল “সব্বনাশ হয়েছে রাজাবাবু ….হিন্দুধর্ম রসাতলে যেতে বসেছে …”
গম্ভীর হয়ে গেলেন রাজা রাধাকান্ত দেব ।
“দেক পন্ডিত , গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল কথা বলো দেকি । ” রাজা বললেন 
পন্ডিত আকুল হয়ে বলে উঠলেন “দেবেন ঠাকুরের অনেক নতুন ব্রাহ্মরা উপবিত ত্যাগ করছে।”
গমগম স্বরে শ্রী রাধাকান্ত বলে উঠলেন “কে কেমন ভাবে ধর্মাচরণ করবে সে তার ব্যাপার । তোমার পাকা ধানে কেউ মই দেয়নি তো।”
 এবার সঙ্গের বামুনের স্বরে বলে উঠলেন ” একি বলছেন রাজা ? ব্রাহ্মরা বেদ উপনিষদকে স্বীকার করে না।  আমরা মেনে নিয়েছি ।যদিও মান্য করা কঠিন। কিন্তু….”
রাজা রাধাকান্ত অত্যন্ত বিরক্ত হলেন …”আপনারা কি গিরিশ ঘোষের নাটকের পাঠ মুখস্ত করে এয়েছেন?  যে সকলে একই কতা বলছেন ? কে বলেছে ব্রাহ্মরা বেদ উপনিষদ স্বীকার করে না?  এ কথা আপনাকে কে বলেছে ?  পরম ব্রহ্ম ও উপনিষদকে তাদের পরম গুরু বলে মনে করে …কেন নিন্দুকের মত নিন্দা করে বেড়াচ্ছেন?”রাজা রাধাকান্ত দেব উচ্চারণ শুদ্ধতায় বিশ্বাস করেন । জনসমক্ষে কখনো তিনি করেচেন, এয়েছেন এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন না ।আজ উদ্বেগের কারণে হয়ে গেল । রামচরনের অনুজ পুত্র মহারাজা নবকৃষ্ণদেবের সময় থেকেই শোভাবাজার শহরের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।
পলাশীর যুদ্ধের পর গোবিন্দপুরে যখন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ হলো সেখানকার অধিবাসীদের পুনর্বাসন দেওয়া হলো তালতলা, কুমোরটুলি,  শোভাবাজারে।  তা হল নবকৃষ্ণ দেবের ত্বতবধানে । নবকৃষ্ণ ততদিনে মহারাজা উপাধি পেয়েছেন ।
তৈরি হয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি। নবকৃষ্ণ দেবের সময় রাজবাড়ী নির্মিত হয়। 1757 রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করে । ব্রিটিশ থেকে শুরু করে নবাব সবাই তার পুজোয় আমন্ত্রিত হতো এবং পুজোয় সম্পূর্ণরূপে অংশগ্রহণ করত বলে জানা যায়। কলকাতায় তখন  বাইজি নাচ আড়ম্বর করে হত । তার আরও বেশি আরম্ভ করেন নবকৃষ্ণ দেব ।
রাজা রাধাকান্ত দেব এর সময় দুর্গাপূজার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। যদিও বাইজি নাচের আড়ম্বর তিনি স্বল্প করেন।  তিনি হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীল গোষ্ঠীর শিরমনি ছিলেন।
একজন সরস বামুন এতেও দমলেন না, তিনি বললেন , “রাজাবাবু ব্রাহ্মরা সব ব্রহ্মদতি  হয়ে গেল। এবার ওরা বক রাক্ষসের মত হিন্দুধর্মকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।”
রাজা বললেন , “আপনারা রামতনু লাহিড়ীর নাম শুনেছেন তিনি বহু বছর আগে উপবীত ত্যাগ করেছেন।”
“উত্তর পাড়ার রামতনু তো ?তাকে তো ভুলি নি। তার আদি নিবাস কৃষ্ণনগরে জল বন্ধ হয়ে গেছিল ।উত্তরপাড়া তো তাই হয়েছিল।”
দীর্ঘশ্বাস করল রাজার,  কোন  মহাত্মা আর হিন্দু ধর্মের পক্ষে রইলেন না । তিনি খুব একা হয়ে যাচ্ছেন। তাকে ঘিরে যে দলটা আবর্তিত হচ্ছে তারা সবকটা আকাট মূর্খ।
“মহা দুর্দৈব”এতক্ষণে সমবেত ব্রাহ্মণদের সমর্থনে একটি শব্দ বের করলেন রাধাকান্ত ….
“আর কি হয়েছে যাকে আপনারা অনাচার মনে করছেন? রাজার গলা অন্যরকম শোনালো।
 সন্ধ্যে হয়ে এসেছে ।বাতি জালানো হচ্ছে ।রাজবাড়ীতে সূর্যর মত ঝাড় বাতি জ্বলে উঠল । স্তবকরা আসতে শুরু করেছে ।তানপুরা আনা হয়েছে। গায়ক এসে গেছে। এরপর এক প্রকার বামুনদের চলে যাওয়া উচিত । 
একজন পন্ডিত বলল , ” হিন্দু কলেজের ছেলেরা অক্ষয় কেড়ে নিচ্ছিলো …এই অক্ষয় তুমি বলোনা ।”অক্ষয় কিছু বলতে পারছিলেন না তার চোখের জল।

রাজা অক্ষয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ,”দেশে আইন আদালত রয়েছে। এর বিহিত হবে কিন্তু আপনি ওদের কারুর নাম জানেন ।””না “অক্ষয় বললেন।
“ঠিক আছে আমি বিষয়টা দেখে নেব ।দেবেন ঠাকুরকে বলবো”

এক পন্ডিত বলে উঠল ” রাজাবাবু দেবেন ঠাকুরকে বলে কি কিছু হবে? “
গর্জে উঠলেন রাজা। নিশ্চয়ই হবে, ” তিনি সজ্জন ব্যক্তি…তিনি নিরাকার পরম ব্রহ্ম এর উপাসক,  তিনি উপবীত ত্যাগ করেননি । তিনি এখনও পর্যন্ত নিয়ম করে উপনিষদ পড়েন । তাকে বললে নিশ্চয়ই কাজ হবে।”
 এদের মধ্যে একজন সুযোগ বুঝে বলে উঠল , “কেশব সেনের লোক হতে পারে”
রাজা বললেন , “নিশ্চিন্ত না হয় কিছু বলা যাবে না । তবে হ্যাঁ যদি এরকম কিছু হয় আমি দেবেন ঠাকুরকে বলব। তিনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবেন। আর আপনাদের ও দোষ কম নয় আপনারা এর ওর পিছনে লাগতে যান কেন ? বামুন গুলো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল রাজা থামিয়ে দিলেন…
কিছু পর রাজা বললেন “নবদ্বীপের  নৈয়ায়িকদের কেউ অশ্রদ্ধা করে না । হিন্দু কলেজের ছাত্র দল ও তাদের কাছে যায় । কেন জানেন ?” বামুনের বুঝতে পারছেন ইঙ্গিত চুপ করে রইলেন …এবার রাজা নিমাই বলে একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি তো জজমানি  করো তাই না?”
সে সহৎসাহে বলে উঠলো , “হ্যাঁ রাজামশাই “
রাজা বললেন , “আমি শব্দকল্পদ্রুম রচনা করছি খবর পেয়েছো ?”
নিমাই বিপদে পড়ল। অশনিসংকেত টের পাচ্ছে।
রাজা বলে চলেছেন , ” তুমি কাল থেকে প্রভাতের সময় আমার সঙ্গে বসবে… শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে আমি তোমার সাহায্য নেব…”

নিমাইয়ের তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইল মুখে কোন রা নেই।
 রাজা আবার বললেন, ” আমি ব্রাহ্মমুহূর্ত উঠে … সকাল সাতটার তোপ দাগার সঙ্গে সঙ্গে  তুমি আসবে আমার কাছে।
 এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো নিমাই।
” ওকি ,কাঁদছো কেন ? জল খাবারের ব্যবস্থা থাকবে… আসা যাওয়ার সময় ব্যয় খরচ তোমায় দেব।”
 এবার রাজা অন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন , “নিমাই কান্নাকাটি করছে …আপনারা কি আমাকে সাহায্য করবেন ?
সবাই জানে রাজা রাধাকান্ত দেবের পান্ডিত্য সুবিদিত। হিন্দু ধর্মকে তিনি রক্ত , অস্থি, মজ্জাগত করেছেন। সেরম তাবর পন্ডিত তার সামনে তর্কে বসতে ভয় পান।তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে চলেছেন। সবাই অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা রেগে চিৎকার করে উঠলেন , ” স্বরস্বতীর বদনা নেই। শুধু  ধর্ম আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। তাকে চর্চা করেন না। আপনাদের কারণেই আমার লজ্জা হয় ।”
হঠাৎ খুব রেগে গেলেন রাজা রাধাকান্ত দেব… আজ সভা জমবে না উঠে দাঁড়ালো গায়ক । স্তবকরা যেতে শুরু করল। রাজা অসময় অন্দরে প্রবেশ করলেন ।
সেখানে বহুজনের ঝাঁকে রাজা এমিলি কে দেখতে পেলেন। এমিলি রাজার ক্রোধ দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। রাজা রাধাকান্ত দেব হিন্দু সনাতন ধর্মের মূর্ত প্রতীক।  নাপ্তানি,  ফুলওলি সবাই দাঁড়িয়ে রইল ।এমিলি পালিয়ে যাওয়া  উপক্রম করলো। রাজা সবাইকে চলে যেতে আদেশ দিলেন। কেবল এমিলিকে বসতে বললেন । এমিলির ভয় করতে লাগলো তবু সে মুখ নিচু করল না রাজার দিকে সোজা তাকিয়ে রইলো।
এমিলির দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন , ” কি পাচ্ছ মা ম্লেছ ধর্মতে?”
এমিলি শক্ত গলায় উত্তর দিল ” এখনো জীবিত আছি..”
“You know Emili life is mortal… তোমার বাইবেলও তাই বলে কিন্তু.”
” I knew it..but may I know ,why only women are sufferer ? “
“এমিলি তোমার ধর্মে কি নারীরা বড্ড স্বাধীন? হিন্দু ধর্ম নিজেকে রেনেসাঁ করে ঠিক করে নেবে। তার ক্ষমতা আছে। তোমার ধর্ম তো গ্যালিলিও কে দগদে মেরেছে। উত্তর কি আছে? ডাইনি বলে কত মেয়ে পুরে মরে এমিলি তোমার ধর্ম তে? নান তৈরি করে তারপর কি হয় এমিলি? আমি মুখ খুলব? তুমি আমার মেয়ের থেকেও ছোট…”
” তাহলে আপনি ধর্মান্তর রুখুন… পারছেন না কেন?”

“হিন্দু ধর্ম জাগ্রত হচ্ছে। মহামানব রা আসছে। সব কলুষ মুছবে।আমি ঠেকা দিচ্ছি। তবে মহামানবের মহামানব আসচ্ছেন  । রাজার রাজা তারা। তারা সব বিষ খেয়ে আমাদের অমৃত দেবেন। সেদিন কেবল হিন্দু থাকবে। উঁচু নিচু স্ত্রী পুরুষ সব ভেদ ঘুচবে।”
তথ্যঃ 
ধর্মান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.