চতুর্ভুজে চতুর্বক্ত্র-সংস্তুতে পরমেশ্বরী।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো যহি।।
কৃষ্ণেন সংস্তুতে দেবী শশ্বদ্ভক্ত্যা সদাম্বিকে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো যহি।।
হিমাচলসুতানাথ সংস্তুতে পরমেশ্বরী।
রুপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো যহি ।।
—-অর্গলা স্তত্রোম্,শ্রীশ্রী চন্ডী
বাসন্তী দুর্গা পূজার সূচনা হয়ে গেছে। আজ বাসন্তী ষষ্ঠী। এই দিনটি সনাতনী বঙ্গের গৃহে গৃহে মায়েরা অশোক ষষ্ঠী বা স্কন্দ ষষ্ঠীরূপে পালন করেন। হ্যাঁ , অশোক ষষ্ঠী, ব্রত, বঙ্গের তথা সনাতন ভারতের এক প্রাচীন ব্রত। বর্তমান কালের শিক্ষিত শহুরে সমাজ হয়তো বলে , এসব ব্রত পার্বন মানুষের মন গড়া, এসবের কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু প্রতিটি ব্রত পার্বন নিয়ে যদি সঠিক ভাবে পর্যালোচনা করা যায় তবে , প্রতিটির শাস্ত্রীয় তথা আয়ুর্বেদিক বা কৃষিভিত্তিক ইত্যাদি ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হয়। সুপ্রাচীন সনাতনী সমাজের ঋষিগণ এমনি ত্রিকালঞ্জ ছিলেন না, তাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিজের পরিব্যাপ্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেই সকল ব্রতজুড়ে থাকেন পরম ব্রহ্ম এবং আদি পরাশক্তির অশেষ অবস্থান এবং আশীর্বাদ।
প্রকৃতি তথা নিরাকার ব্রহ্ম ও শক্তি উপাসক সনাতনী সমাজ।
ততোহখিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরা বৃষ্টৈ প্রাণ ধারকৈ।
শাকম্ভরী বিখ্যাতং তদা যাস্যমহং ভূষি।।
ভারতবর্ষে বৃক্ষলতা উর্বরতা বর্ধনে সহায়ক এবং তা কেবল শস্যাদি , খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। অক্সিজেন, ওষধি , জ্বালানী , বাসগৃহ, বস্ত্র, বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী বস্তু সমূহ, সকল কিছু একটি বৃক্ষ প্রদান করতে পারে। তাই ধনজনসন্তান কামনা, রোগশোকপাপ দূরীকরণ ইত্যাদি পার্থিব ও পার্থিব আকাঙ্খা পূরণের জন্যও বটে। তাই নিরাকার পরম ব্রহ্ম রূপে বৃক্ষকে সেই প্রাচীন কাল হতে পূজা করে আসছে সনাতনী মানব। তাই দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন । তাই ব্রহ্ম স্বরূপ নিরাকার প্রকৃতি মহামায়া মা দুর্গা বোধন হয় নবপত্রিকায়। ওই নবপত্রিকা এবং ঘটই পূজা মুখ্য বিষয়। আজও তাই বহু স্থানে নবপত্রিকার সম্মুখে ঘটেপটে পূজা হয়। নবপত্রিকার নয়টি বৃক্ষ হল কদলী, কচ্চি, হরিদ্রা , জয়ন্তী, শ্রীফল, দাড়িম্ব, অশোক, মান্য ও ধান্য। পূজা মন্ত্রগুলোতে দেখা যায় একটি বৃক্ষ বা পত্রিকাকে দেবতা বা তাঁর প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসারে যথোচিত প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
ঠিক একই ভাবে লক্ষ্মী পূজায়ও মহাদেবীকে শ্ৰী হিসাবে এবং ভূমাতা হিসাবে, ধনদায়ীনি হিসাবে পূজার সময় ধান, আখ, সরিষা, নানা প্রকার শাক , কলার ভেলা ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসাবে প্রদান করা হয়। সনাতনী সমাজে মহাবিষ্ণু সংক্রান্তিতে #ফলদান_সংক্রান্তি ব্রত পালন করা হয়। উক্ত দিনে সবস্ত্র , সপাত্র নারিকেল ফল বিষ্ণুকে দান করলে নিখিল পাতক দূর হয়। পুরোহিত দর্পন, ক্রিয়াকান্ড বারিধি ইত্যাদি নানা গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ আছে। এই রূপে একেকটি মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ বিশেষ ফল দান করলে মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং, জনধনউৎপাদন , পাপ দূরীকরণ , মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি জাতীয় কামনা বাসনা বৃক্ষ উপাসনার নেপথ্যলোকে বিরাজিত থাকে। এই সকল কারনে বৃক্ষরোপণ সনাতনী প্রথায় একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
মৎস্য পুরাণে বলা হয় ” একটি বৃক্ষ দশজন সন্তানের সমান। ” বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে , ” একজন সুসন্তান যেমন তাঁর পরিবারকে রক্ষা করে তেমনই পুষ্প ও ফলশোভিত একটি বৃক্ষ তাঁর পিতা সমান রোপনকারীকে নরকগামীতা হতে রক্ষা করে এবং যে ব্যক্তি পাঁচটি আম্রবৃক্ষ রোপন করেন তিনি নরকে যান না।” অর্থাৎ , বৃক্ষ রোপণের পুণ্যফল নরকগমনহতে রোধ করতে পারে।
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের মন্তব্য এইরূপ ” একটি সন্তান যা সম্পাদন করে , কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচর্যাকৃত একটি বৃক্ষও সেইরূপ করে, কেন না এটি তার ফুল দ্বারা দেবতাকে , ছায়া দ্বারা পথচারীকে এবং ফলের দ্বারা ক্ষুধার্তকে তুষ্টি দান করে। ফলে, বৃক্ষ রোপণকারীর নরকগমন হয় না।” সন্তানের চাইতেও বৃক্ষরোপন কর্মটিকে অধিক গুরুত্ব সনাতনী শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
বৃক্ষই সব , তাই তাঁকেই পূজা কর, সেই কারণেই মহাকালী মহামায়া মহালক্ষ্মী মহাবিদ্যা দেবী দুর্গা শাকম্ভরী রূপেও পূজিতা। সুপ্রাচীন গ্রন্থাবলী সমূহ যথা – বেদ, রামায়ণ, মহাভারত , গীতা, নানা পুরাণাদি হতে কালিদাসের রচনাবলী , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী , সকল স্থানে বৃক্ষের প্রশস্তি হতে এই উপলোব্ধি করা যায় যে, ভারতে বৃক্ষোপসনা অতি প্রাচীন আচার ছিল। এই আচার কোনো কালেই লুপ্ত হয়ে নি। পদ্মপুরাণ এবং মৎস্য পুরাণে #বৃক্ষোৎসব বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবৃত হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতা অঙ্কিত নানা মূর্তি এবং পরবর্তী পর্যায়ে নানা ভাস্কর্যাদিতে বৃক্ষোপসনার প্রমাণ প্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী র ভারত স্তূপে বোধি বৃক্ষ, কদলী, ন্যাদ্রোধ , উদুম্বর, শিরীষ, শাল , আম্র, তাল, অশোক , পাটলি , নাগকেশর ,পিপল প্রভৃতি বৃক্ষের পূজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আবার খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সাঁচী ও অমরাবতী এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাগার্জুন কোন্ডার ভাস্কর্যে পিপল ও বোধিবৃক্ষ পূজার দৃশ্য আছে। এছাড়াও খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরা , খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগের দেওঘর, খ্রিস্টীয় সপ্তম হতে নবম শতকের ইলোরা এবং অন্যান্য স্থানের ভাস্কর্যে বৃক্ষের নিম্নে দেবী মূর্তি, ভগবান মহাদেব ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। ভাস্কর্যগুলি প্রমাণ করে বৃক্ষকে পূজা বহু অতীত কাল হতে সুবিশাল ভারতে প্রচলিত হয়ে আসছে।
বাসন্তী দুর্গা পূজার তিনটি কল্প ।তার মধ্যে সপ্তমী অষ্টমী ও নবমীতে যে পূজা হয় তা প্রথম কল্প।
প্রথম কল্প : প্রথমঃ সপ্তম্যাদিঃ কৌমদ্যাং জাবালি
চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে সপ্তম্যাদিনত্রয়ে।
পূজয়েদ্বিবিধৈদ্রব্যৈর্লবঙ্গকুসুমৈস্তথা।।
নানাবিধৈশ্চ বলিভির্মেঘাভৈর্দোষবর্জ্জিতৈঃ।
বিচিত্রাভরণৈঃ পার্থ! পট্টবস্ত্রাদিভিস্তথা।।
এবং যঃ কুরুতে পূজাং বর্ষে বর্ষে বিধানতঃ।
ঈপ্সিতান্ লভতে কামান্ পুত্রপৌত্রাদিকান্ নৃপ!।।
কালকৌমুদী ধৃত জাবালির বচন,চৈত্রমাসে শুক্লেপক্ষের সপ্ত্যাদি তিন তিথিতে নানাবিধ দ্রব্য,লবঙ্গকুসুম, উৎসর্গ বলি,রাশীকৃত নৈবেদ্য,নানাবিধ অলঙ্কার এবং পট্টবস্ত্র প্রভৃতি দ্বারা পরমেশ্বরী দুর্গার পূজা করবে।যে মানুষ প্রতিবছর যথা বিধানে এইরূপ পূজা করবে ,তার অভিলাষিত ফল লাভ হবে।
বাসন্তীপূজা সম্পর্কে শূলপাণিকৃত দুর্গোৎসব বিবেকে ধৃত ভবিষ্যপুরাণীয় বচন-
“মীনরাশিস্থিতে সূর্যে শুক্লপক্ষে নরাধিপ ।সপ্তমীং দশমী যাবৎ পূজয়েদম্বিকাং সদা।
চৈত্রেমাসি সিতেপক্ষে সপ্তম্যাদিদিনত্রয়ে।পূজয়েৎ বিধিবৎ দুর্গাং দশম্যান্তু বিসর্জয়েৎ।।
দ্বিতীয় কল্প : কেবল অষ্টমীতে পূজা,কালিকা পুরাণে
“সিতাষ্টম্যান্তু চৈত্রস্য পুষ্পৈস্তৎকালসম্ভবৈঃ।
অশোকৈরপি যঃ কুর্য্যাৎ মন্ত্রেণানেন পূজনম্।।
ন তথ্য জায়তে শোকো রোগো বাপ্যথ দুর্গতিঃ।”
যে মানব চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে বসন্তকালোৎপন্ন পুষ্পের দ্বারা এবং #অশোক পুষ্পদ্বারা দুর্গামন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক দুর্গার পূজা করবে,তার রোগ,শোক,দারিদ্য হয় না। সেই জন্যই চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীকে অশোকাষ্টমী বলা হয়।
তৃতীয় কল্প : শুক্লা নবমী বা রামনবমীতে যে পূজা হয় তা তৃতীয় কল্প।
কালিকাপুরাণে
“নবম্যাং পূজয়েদ্দেবীং মহিষাসুরমর্দ্দিনীম্।
কুঙ্কুমাগুরুকস্তূরী ধূপান্নধ্বজতর্পণৈঃ।
দমনৈর্মূরপত্রৈশ্চ বিজয়াখ্যপদং লভেৎ।।”
যে লোক নবমীতে কুঙ্কুম,অগুরু,কস্তূরী,ধূপ,অন্ন,তর্পণ,দমনপত্র,ও মুরপত্র দ্বারা দুর্গার পূজা করবে তার সর্ব্বদা বিজয় হবে।
বাসন্তীপূজাতে নিত্যত্ব ও কাম্যত্ব দুইই আছে;শারদীয়ার মতো বাসন্তী দুর্গা পূজায় সকল ব্যবস্থা ।শারদীয়া পূজাতে যেমন উদয়গামিনী তিথির গ্রাহ্যতা ,বাসন্তী পূজাতেও সেই রকম।
হ্যাঁ , অশোক বৃক্ষ ও ফুল দেবীর পূজার এক অন্যতম এবং মূলউপাদান।
দেবীভাগবত পুরানে নবম স্কন্ধের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে-
“ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যে চ সা চ ষষ্ঠী প্রকীর্তিতা ।
বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণুমায়া চ বালদা ।।”
অর্থাৎ – বালকগণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, বালকদায়িনী বিষ্ণুমায়া প্রকৃতির ষষ্ঠকলা , এই জন্য ষষ্ঠী নামে কীর্তিত হয়েছেন । মা ষষ্ঠী ভগবতীর একটি রূপ। যিঁনি দুর্গা তিঁনিই ষষ্ঠী। ষষ্ঠী দেবীর বাহন মার্জার । এবং তাঁর হস্তে বর মুদ্রা ও ক্রোড়ে শিশু থাকে ।
পূজা পার্বণে নৈবদ্য থেকে শুরু করে দেব দেবীদের উপাসনা সহ সকল ক্ষেত্রে বৃক্ষ ও তার অংশ বিশেষ যথাঃ ফুল, ফল, পাতা, বীজ প্রভৃতি অতি প্রাচীনকাল তথা আর্য সভ্যতা থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । যেমন দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত কলাবৌ র শাস্ত্রীয় নাম হচ্ছে নবপত্রিকা । নবপত্রিকা বলতে নয়টি গাছের চারা বুঝায় । এগুলো হচ্ছে
১) কদলী (উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Musa sapientum)
২) কালো কচু (Alocasia sapientum)
৩) হরিদ্রা বা হলুদ (Curcuma domestica)
৪) জয়ন্তী (Sesbania sesban)
৫) বেল বা বিল্ব (Aegle mermelos)
৬) দাড়িম্ব (Punica granatum)
৭) অশোক (Saraca indica)
৮) মানকচু (Alocasia indica)
৯) ধান্য (Orgzasativa)
এই নয়টি গাছের চারাকে শ্বেত অপারাজিতা লতা দিয়ে বেষ্টন করে নবপত্রিকা সাজানো হয় । সমষ্টিগতভাবে মা দূর্গার প্রতিনিধিরূপে এদের অর্চন করা হয় । এজন্য এ বৃক্ষগুলোকে নিয়ে চন্ডিতে একটি শ্লোক আছে আছে ।
“রম্ভা কচ্ছী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নব পত্রিকা”
শুধু তাই নয় এই নয়টি গাছের প্রত্যকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন ।
১) কদলী (কলা) এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হলেন ব্রাক্ষ্মণী
২) কচ্চি (কালো কচু) এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল কালিকা
৩) হরিদ্রা বা হলুদ এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল দুর্গা
৪) জয়ন্তী এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল কার্তিকা
৫) বেল বা বিল্ব এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল শিবা
৬) দাড়িম্ব এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল রক্তদন্তিকা
৭) অশোক এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল শোকরহিতা
৮) মানকচু এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল চামুন্ডা
৯) ধান্য এর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হল লক্ষ্মী
কেন অশোক বৃক্ষে দেবী শোকরহিতা রূপে বাস করেন ? কেনই বা সনাতনী গৃহের মাতারা অশোক ষষ্ঠী পালন করেন ?
বহুযুগ আগে অশোকবনের মধ্যে এক ঋষির পর্ণকুটীর ছিল ।
একদিন সেই ঋষি স্নান সেরে ফেরার পথে অশোকগাছের নীচে এক সদ্য প্রসূতা কন্যাকে কাঁদতে দেখলেন । দৈবযোগে ধ্যানের মাধ্যমে ঋষি জানতে পারলেন কন্যাটি এক শাপভ্রষ্টা হরিণী মায়ের । ঋষি মেয়েটিকে আশ্রমে এনে লালন করতে লাগলেন । তার নাম দিলেন অশোকা । ঋষিকন্যা বড় হতে লাগল । যৌবনে উত্তীর্ণ হল ।
এক রাজপুত্র মৃগয়ায় বেরিয়ে ঐ পরমাসুন্দরী অশোকাকে একদিন দেখতে পেয়ে তার পরিচয় জানতে পারলেন । ঋষিকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের কথোপকথনের মধ্যেই ঋষির আগমন হল সেই স্থানে । রাজপুত্র অশোকার পাণিপ্রার্থী হয়ে ঋষিকে অনুরোধ জানালে ঋষি যারপরনাই আনন্দিত হয়ে তাতে সম্মতি দিলেন ।
অশোকাকে রাজপুত্রের হাতে সঁপে দিয়ে ঋষি বললেন :
” আজ থেকে তুমি রাজার ঘরণী হ’লে কন্যা । যদি কখনো বিপদে পড় আশ্রমে চলে এস । আর রাজপুরী থেকে চিনে একাএকা এই আশ্রমে যাতে আসতে পারো তাই এই অশোকফুলের বীজ তোমাকে দিলাম । এখন যাবার সময় এই বীজ ছড়াতে ছড়াতে যেও । পরে কখনো প্রয়োজন হলে এই বীজ থেকে উত্পন্ন অশোকগাছ বরাবর চিনে পায়েহেঁটে তুমি চলে আসতে পারবে । আর এই অশোকফুলগুলি শুকিয়ে রেখো।প্রতি বছর চৈত্রমাসে অশোক ষষ্ঠীর দিন ছয়টি করে ফুল দৈ দিয়ে খাবে।”
অশোকফুলের বীজ সযত্নে আঁচলে বেঁধে নিয়ে অশোকা রাজপুত্রের সাথে পতিগৃহে যাত্রা করল । যাত্রাপথে বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলল অশোকা । রাজপুরীতে পৌঁছালে রাজা-রাণী সস্নেহে তাদের বরণ করে ঘরে তুললেন । অশোকা আর রাজপুত্রের বাড়বাড়ন্ত সংসারে সুখের বন্যা । অশোকা ক্রমে সাত ছেলে ও এক মেয়ের মা হল । অশোকার শ্বশুর রাজামশাই মারা গেলেন শ্রাদ্ধের দিন অশোকষষ্ঠীর কথা বিস্মৃত হল অশোকা । ভাত মুখে দিয়েই মনে পড়ল ষষ্ঠীর কথা । রাতে শুয়ে পড়ল মনখারাপ নিয়ে । পরদিন ভোরে উঠে দেখল সাতছেলে-বৌ যার যার ঘরে মরে পড়ে আছে আশোকা তা দেখে ঋষির কথা ভাবলে । রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রম বরাবর চলতে লাগল ।
ততদিনে বীজ থেকে অশোকগাছ মহীরুহের আকার ধারণ করেছে । চৈত্রমাসে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে তার শাখাপ্রশাখা । ঋষির আশ্রমের কাছে এসেই অশোকা ঋষিকে দেখে কেঁদে উঠলো । ঋষি ধ্যানের বলে সব অবগত ছিলেন । কন্যাকে সাথে করে রাজবাড়ী ফিরে গেলেন । কমন্ডুলু থেকে জল ছিটিয়ে দিলেন অশোকার মৃত ছেলে বৌ নাতিপুতির গায়ে । দৈবগুণে সকলে চোখ মেলে চাইল ।
ঋষি বললেন অশোকষষ্টীর ব্রত পালন করলে কখনো শোক প্রবেশ করবেনা সংসারে ।
আসলে , অশোক এমন একটি বৃক্ষ ,যার প্রতি অংশ ঔষধি গুণে পরিপূর্ণ। অশোক গাছ আয়ুর্বেদিক ঔষধ রূপে বহু পূর্ব থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। যা আমাদের রোগ থেকে মুক্ত করেন তাকে আমরা ভগবানতুল্য জ্ঞান করি। সেই জন্যই শাস্ত্রকারেরা ঔষধি বৃক্ষ গুলিকে প্রানদায়িনী ঈশ্বরের স্বরূপ বলে শাস্ত্রে স্থান দিয়েছেন । যেমন তুলসী, বেল, আমলকী, হরিতকী, নিম, ডালিম ইত্যাদি বৃক্ষে ঈশ্বরের অবস্থিত বলে ধরে নেওয়া হয়।
অশোক বৃক্ষ মহিলাদের জন্য একটি বরদান এর চেয়ে কম কিছু নয়। এটি অনিয়মিত রোগ, মেনোপজ, যোনি সংক্রমণ এবং জরায়ুতে সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করতে পারে।
আয়ুর্বেদের মতে অশোক গাছ এর ক্ষীর পাক খাওয়া অনিয়মিত সময়ের সমস্যা দূর করে এবং রক্ত প্রবাহকে ঠিক রাখে। ক্ষার পাক তৈরির জন্য অশোক গাছের ছাল শুকনো করে পিষে নিয়ে, ৬ গ্রাম গুঁড়ো মধ্যে ৫০০ মিলি দুধ এবং জল মিশ্রিত করে ফোটাতে হয়। মিশ্রণটি অর্ধেক হয়ে গেলে সেইটি হল ঔষধি। এর সঙ্গে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খালি পেটে পান করলে অনিয়মিত ঋতুস্রাব ঠিক হয়ে যায়।
কেউ যদি ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত বাধা এবং ব্যথা অনুভব করেন তবে অশোক অশোক বৃক্ষের ছাল সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় । এক গ্লাস জলে ১৫ গ্রাম অশোকের বাকল গুঁড়ো মিশিয়ে এটি ১/৪ পরিমান না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধ করতে হয়। এটি অবিচ্ছিন্নভাবে ৩ দিন পান করলে ঋতুস্রাব এবং সেই সময় যন্ত্রণায় সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।
লিউকোরিয়া সমস্যা কাটিয়ে উঠতে অশোকের ছালের ডোগাও খুব উপকারী। অশোকের ছাল, জল এবং দুধের সম পরিমাণে সিদ্ধ করে নিয়মিত খেলে লিউকোরিয়ার লক্ষণ হ্রাস পায়।
যদি প্রস্রাবের সংক্রমণের সমস্যা হয় তবে অশোক বীজ পিষে এবং প্রতিদিন ২ চামচ জল দিয়ে খেলে, কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়।
অনেক মহিলারই গর্ভধারণে অনেক অসুবিধা হয়। এক্ষেত্রে ২-৩ গ্রাম অশোক ফুল দই মিশিয়ে খেলে এটি গর্ভধারণের সমস্যা দূর হয়।
তাই অশোক ষষ্ঠীর দিন ব্রতিনী দের অশোক ফুল দৈ সহ খাবার বিধান । স্বামী বেদানন্দ মহারাজ রচিত “দুর্গা দুর্গতিনাশিনী” পুস্তকে লিখেছেন – “অশোক গাছের ফুল স্ত্রী রোগের বড় ওষুধ। বাসন্তী ষষ্ঠী তিথিতে এদেশে অনেক সন্তানবতী নারী অশোকের ৬টি ফুলের কুঁড়ি খান। একে অশোক- ষষ্ঠীও বলা হয়ে থাকে । স্নায়ুগত বাতে, রক্তার্শে , রক্তবন্ধে, হৃদদৌর্বল্যে অশোক গাছের ব্যবহার হয়।”
এই জন্যই অশোক বৃক্ষে দেবী মহামায়া “শোকরহিতা” দেবী নামে বিরাজ করেন । যিঁনি শোক রহিত অথবা যার আরাধনা করলে শোক থাকে না – তিঁনিই দেবী শোকরহিতা দুর্গা দেবী । সন্তান সুখই সব থেকে বড় সুখ। সে সুস্থ থাকলেই তো সব সুখ। নবপত্রিকায় অশোক থাকেন- তাঁর পূজা মন্ত্রে বলা হয় –
ওঁ হরপ্রীতিকরো বৃক্ষোহশোকঃ শোকনাশনঃ ।
দুর্গাপ্রীতিকরো যস্মান্মামশোকং সদা কুরু ।।
এই স্কন্দ ষষ্ঠীও বলা হয়। দেবীর পঞ্চমরূপ হল স্কন্দমাতা। আশ্বিন এবং চৈত্র উভয় দুর্গাপঞ্চমী তিথি পার হলে, পরেরদিন যে ষষ্ঠী হয় তাকে স্কন্দষষ্ঠী বলা হয় । এই দিন দেবসেনাপতি কার্তিক পূজা করলে সংসারের মঙ্গল হয়।
বাল্মিকী রচিত রামায়ণও অরণ্যময়। কেবল অরণ্যময় বললে ভুল হবে। অশোক বৃক্ষময়। রামায়ণ অরণ্যের জন্য বা রামায়ণই স্বয়ং অরণ্য প্রকৃতি, অরণ্যবনবাসকালে রাম , সীতা , লক্ষণ অরণ্যের মধ্য দিয়ে চলার সময় মহর্ষি শরভঙ্গ, মহর্ষি সুতীক্ষ্ণ , মহর্ষি অগস্ত্য , মহর্ষি ভরদ্বাজ প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁদের আশ্রমে কিছু সময়ের জন্য অধিষ্ঠান করেছিলেন।এই যাত্রাপথে আদি কবি বাল্মিকী অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভার কথা বর্ণনা করেছেন। রাম , সীতা এবং লক্ষ্মণ এই সুদীর্ঘ বনপথে যাত্রাকালে বহু বৃক্ষ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করেছিলেন । জলকদম্ব, কাঁঠাল, সাখু, অশোক, তিনিশ, চিরিবিল্ব, মহুয়া, বেল, তেন্ডু এবং আরও অনেক বন্য গাছ দেখতে পেয়েছিলেন।
অশোক বৃক্ষের এতই গুণাগুণ ছিল যে , লক্ষ্মণ আশ্রম নিৰ্মাণ করার নিমিত্ত গোদাবরী তটে এক রম্য স্থান চয়ন করেছিলেন সেখানে অশোক বৃক্ষ এবং অন্যান্য নানা ঔষধি বৃক্ষের সমাহার ছিল। সেখানে বৃক্ষ ও পুষ্পরাজিঅত্যন্ত মনোহর প্রতীত হতো। স্থানটি চারিদিকে পুষ্প, গুল্ম, লতাবল্লরী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল।তথায় শাল, তাল, তমাল, খর্জুর, পনস, জলকদম্ব, তিনিশ, পুংনাগ, আম্র, অশোক, তিলক, কেওড়া, চম্পক, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, কদম্ব, লকুচ ধব, অশ্বকর্ণ , শমি, পলাশ ইত্যাদি বৃক্ষে সমাকীর্ণ ছিল। নিকটস্থ গোদাবরী নদীর বুকে হংস , কারন্ডব ইত্যাদি জলজ পক্ষী খেলা করছে। মৃগের দল গোদাবরীর তটে সকল দিবস জল পানের উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে আসত।
ভগবান শ্রী রামও সীতা অন্বেষণের প্রাথমিক পর্যায়ে বনরাজিকেই প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি কদম্ব ,বিল্ব ,অর্জুন, কুুরুবক, বকুল , অশোক, তাল , জাম , কর্নিকা প্রভৃতি বৃক্ষের কাছে, পদ্মবনের কাছে সীতার খোঁজ নিয়েছেন। রামায়ণে আছে অজস্র বৃক্ষের নাম। যে কয়েকটি বিস্তৃত অরণ্য ও সুসজ্জিত উদ্যানের বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলিতে বহু গাছের নাম আমরা পেয়ে থাকি ।মুগ্ধ করে বিচিত্রসুন্দর চিত্রকূট ও পম্পাসরোবর অঞ্চল। অশোক বনে, অশোক বৃক্ষের নীচে দেবীশক্তির আধার সীতা বন্দিনী ছিলেন চৌদ্দ বৎসর। সেখানে
বিভিন্ন প্রকার ও রঙের অশোক পুষ্প প্রস্ফুটিত হত – সোনালী, টকটকে লাল অন্যন্য গাঢ় বর্ণের।
যো দেবো হগ্নৌ যোহপসু
যো বিশ্বং ভুবনাবিবেশ।
য ওষধিসু যো বনস্পতিষু
তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।
গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন, কাটিয়েছি
কোনোদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা
সমীপেষু করা যায়।
ভেবেছি অরণ্যে যাব-সমগ্র সমাজ থেকে প্রতিভূ বৃক্ষকে খুঁজে নিতে
সেখানে সমস্তক্ষণ ছায়া
সেখানে ছায়ার জন্য কৃতজ্ঞতা নেই
সেখানে রক্তিম আলো নির্জনতা ভেদ করে খুঁজে নেয় পথ….
সত্য , যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে।
মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনূ সবদুর্ঘে ধাপয়েতে সমীচী।
ঋতস্য তে সদসীলে অন্তৰ্মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্।।
জীবনে জল, মৃত্তিকার গুরুত্ব, বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা , জলচক্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় ধারণা সকলই বেদ আমাদের প্রদান করেছেন। সুপ্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিগণ প্রকৃতির বক্ষে যেস্থানেই শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন সেখানেই তাঁকে উপাসনা করেছেন। সেই শক্তিকে সদাই সকল জীবকুলের থেকে ভীষণ এবং অপরাজেয় তা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন।
চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরন্যস্যাগ্নেঃ।
আহ প্রা দ্যাবা পৃথিবী সূর্য আত্মা জাগতস্তস্থুষশচ।।
বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন।
সেই একই আকুতি বঙ্গ তথা ভারতের ব্রতকথা গুলির মধ্য দিয়ে বারবার নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বভূতা সমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনিঃ।
আসুন এই প্রচন্ড সময় আমরাও সকলের মঙ্গল কামনা করে, দেবী আদি পরাশক্তির স্তব করি –
ভূতং ভব্যং ভবিষ্যঞ্চ তৎ পদম পরমং স্মৃতম l
অর্চ্চ্যসে স্তূয়সে চৈব দৈবর্তৈমৎপুরোগমৈ: ll
(দেবীপুরাণ…)
ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সর্বত্র ব্যাপ্ত সেই পরমাদেবীকেই দেবগণ সর্বোৎকৃষ্ট পরমপদ বলে স্মরণ করেন l ঈশানজননী মহামায়ার অর্চনা করেই সমুদয় দেবগণ সহিত সকলেই শুভকার্যে প্রবৃত্ত হোন l
© দুর্গেশনন্দিনী