এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা পশ্চিমবঙ্গের লজ্জা

১৭৫৭ সাল। রবার্ট ক্লাইভ সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমিবায়ু যেদিন বৃষ্টি নিয়ে বাংলায় ঢুকবে সেদিনই হবে আক্রমণ। তাই সুন্দরবন থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে পাল তোলা নৌকা আর অভিজ্ঞ স্থানীয় মানুষ। বৃষ্টি আসার খবর যেন কয়েক ঘন্টায় চলে আসে মুর্শিদাবাদে। সেই সঙ্গে সামান্য কয়েক টঙ্কা বীমার পদাতিক। যারা কামানের সামনে মানববর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। তাদের পাওনা টাকা বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হবে। রবার্ট ক্লাইভ, তাঁর দিনলিপির পাতায় এর সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন ।
৷ সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলেছে। যাঁর দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা। রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, তিনি বললেন ভোটের দিনে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরতে। যে সি আই এস এফের হাতে সেমি অটোমেটিক রাইফেল তাদের সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা পেয়ে ১০ এপ্রিল রাতে উত্তরবঙ্গের শীতলকুচির মাথাভাঙার থানার লালবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের এক নেতা বিরোধীদের ভোটদানে বিরত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ভোট দিলে কি শাস্তি হবে তারও নিদান দিয়েছেন। সেই অডিও রেকর্ডিং সহ অভিযোগ বিরোধী দল ভোটের দিন নির্বাচন আধিকারিক এবং পুলিশ কর্তাদের বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জমা দিয়েছিলেন।
কুচবিহার জেলার পুলিশ সুপার দেবাশিস ধর ঘটনার বর্ণনা করেছেন। সি আই এস এফ জওনানরা মানবিক কাজ করছিলেন। এক অসুস্থ ব্যক্তিকে তুলে হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড় চলছিল তখন।একদল মিথ্যা প্রচার করে গুজব ছড়িয়ে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১২৬ নম্বর বুথে ৩০০ জনের মতো মানুষ দাঁ, খুন্তি ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে সি আই এস এফ কে আক্রমণ করে। শেষে তাদের আগ্নেয়অস্ত্র ছিনিয়ে নেবার উপক্রম হয়েছিল বলে সি আই এসএফ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতৃত্বের জন্য চলে গেল চারটি তরতাজা প্রাণ।
এই ঘটনাতে সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক ভুমিকা নিয়েছেন বাংলার তথাকথিত এগিয়ে থাকা কাগজের ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রচার। ওইদিন ওই ঘটনার আগেই ভোট দেওয়ার অপরাধে একই বিধানসভা এলাকায় দুষ্কৃতিরা গুলি করে হত্যা করে আনন্দ বর্মন নামে এক ১৮ বছরের ভোটারকে। আগের দিনের নেতার অডিও নির্দেশে ঠিক সেই হুঁশিয়ারি দেওয়া ছিল। কিন্তু প্রচার মাধ্যম সেই ঘটনাকে চেপে দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।
একইভাবে কুচবিহার উত্তর বিধানসভায় পাতলাখাওয়ায় বিজেপি কর্মী অমল দাসকে খুন করে বাঁশ বাগানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অমল বা আনন্দকে নিয়ে কেউ ঘন্টাখানেক আলোচনার ব্যবস্থা করেনি।
যেমন আলোচনার বাইরে থেকে গেল বেহালা পূর্বের একদম একই ধরনের অপরাধ। অনুপ্রেরণায় সাড়া দিয়ে ভোটের দিন বেহালা পূর্বের ১৪২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫০ জন মহিলা সি আই এসএফ জওয়ানদের ঘিরে ধরেছিল। ভগবানের অশেষ কৃপা সেখানে কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটেনি।
এই সব ঘটনার আলোচনা প্রচার মাধ্যমে হওয়ার প্রয়োজন ছিল। রাজ্যের রক্ষকের কি এই ভুমিকা হওয়া উচিৎ? আইনজ্ঞরা বলছেন এইধরনের প্রকাশ্য প্ররোচনা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭, ১২০ আর/ ডাব্লু, ৩৫৩, ১৪৭, ৪৪১ আর ৩৪ মতে অমার্জনীয় ফৌজদারি অপরাধ! অথচ মিডিয়া নিরব!


আসলে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা নেত্রী আর কর্তাভজা প্রচার মাধ্যমের একাংশ এক বিষাক্ত বাস্তুতন্ত্র তৈরী করেছে। পশ্চিমবঙ্গের একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে দাবা খেলার বোড়ের মত ব্যবহার করা হচ্ছে। এঁরা সাধারণ নাগরিকদের মতো যাতে শিক্ষা না পান, শিক্ষায় মূল অংশটাই যেন মৌলবাদ সম্বৃদ্ধ থাকে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বামফ্রন্টের সময়ও একই অন্যায় হয়েছে। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই বীরভূমের নানুরে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটেছিল। অভিযোগের তীর ছিল শাসক দলের দিকে। সেদিন শরণ মেটে ছাড়া বাকি ১০জন মৃত মানুষই ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সেদিনও রাজনৈতিক স্বার্থের দাবাখেলায় পদাতিক বোড়ের ভুমিকায় তাঁদের ব্যবহার করা হয়েছিল।
সারা ভারতে কোথাও রাজনৈতিক কারণে আজ আর এত হিংসা হয় না। এরাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখেছে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় ডায়মন্ডহারবারের মতো বহু জায়গায় গ্রামের পর গ্রামের মানুষকে ভিটে ছাড়া করা হয়েছিল। পুলিশ প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। নির্বাচনের পরেও সন্দেশখলিতে প্রদীপ আর দেবদাসের মতো দু’দুটো তরতাজা প্রাণ চলে গেল রাজনৈতিক হিংসায়। অথচ এই কদিন আগে বিহারে বিধানসভা ভোট হল। রাজনৈতিক হিংসায় একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি। বিহার পারে আর পশ্চিমবঙ্গ পারে না! এই ব্যর্থতার পেছনে সকলের দায় আছে।
কর্তাভজা সংবাদ মাধ্যম, রাজনীতিবীদদের এঁটোকাঁটা খেয়ে সন্তুষ্ট থাকা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী – সকলের। যাঁরা পূর্ববঙ্গ থেকে আশা হিন্দু উদ্দ্বাস্তুদের দুঃখকষ্ট দেখতে পান না। মাসিক ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে সেই ভয়ে রাজনৈতিক প্রভুর গলায় গলা মিলিয়ে “কা-কা” করেন। হয়তো বোঝেনও না রাজ্যবাসী তাদের দেখেই ” ছি! ছি!” করেছেন!
আজ এরাজ্যের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আপামর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ভাবার প্রয়োজন। পরিবর্তন না হলে সমাজ বাঁচবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.