রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাছে বর্ষপ্রতিপদ দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা সরসঙ্ঘচালক ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৮৮৯ সালের এই বর্ষপ্রতিপদ নাগপুরে এক বিশিষ্ট বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৫০০ বছরের দাসত্বের ফলে যে হিন্দু জাতি তার গৌরবময় সংস্কৃতি, পরম্পরা ও ইতিহাসকে ভুলতে বসেছিল পারস্পারিক কারণে কলহের কারণে, বিদেশিদের প্রভু রূপে স্বীকার করেছিল, সেই জাতিকে তিনি একত্রিত করার জন্য ও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেবল মন্ত্রই দিলেন না – সংগঠনের মন্ত্রস্বরূপ শাখা পদ্ধতির প্রণয়নও করলেন।
প্রাচীনকালে ভারতীয়দের পৌরুষ, রাজ্য, স্বাধীনতা, সম্পদ প্রভৃতি সবকিছুই ছিল কিন্তু একাত্মতা, পরিপূর্ণ স্নেহ ও অনুশাসন যুক্ত সংগঠনের অভাবেই ভারতবাসী শৃঙ্খলিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য ডাক্তারজী তাঁর সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন দেশমাতৃকার চরণে। ভারতমাতার সেবা করার জন্য তিনি কৈশোরে চিরকৌমার্য ব্রত পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন সেই প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর স্কুল জীবনেই। স্কুলে পাঠরত অবস্থায় তিনি তার সহপাঠীদের সংগঠিত করে ‘বন্দেমাতরম্ ধ্বনি’ উচ্চারণ করেছিলেন ইংরেজি পরিদর্শকের সামনে। দক্ষ সংগঠকের মতো তিনি এই ধ্বনি দিয়ে সকল ছাত্রের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগরণের কাজে সফল হয়েছিলেন। ‘বন্দেমাতরম্ ধ্বনি’ তোলার জন্য শাস্তি হিসেবে পরবর্তীতে তিনি স্কুল থেকে বহিস্কৃত হন।
ডাক্তারজী উপলব্ধি করেছিলেন যে একে অপরের যখন হৃদয়ের যোগ স্থাপিত হয়, তখন তা থেকে এক অমোঘ শক্তি সৃষ্টি হয়। তিনি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝেছিলেন মানুষের মনে ত্যাগের বীজ বপন করতে পারলে সেই মানুষ দ্বারা অপর একজনের অন্তরকরণেয় একইভাবে ত্যাগরূপ অগ্নি প্রজ্বলিত করা সম্ভব। এবং এই ভাবেই ধীরে ধীরে আত্মপ্রত্যয়ী লক্ষ লক্ষ দেশ প্রেমিকের সংগঠন গড়ে উঠবে। ডাক্তারজীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ভারতের প্রকৃত মঙ্গল হবে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ও আদ্য সরসঙ্ঘচালক ডঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ছোট-বড় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের সক্রিয় রেখেছিলেন। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে সর্বদা দেশমাতৃকার প্রতি সমর্পিত ছিলেন। যারা বলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো ভূমিকাই পালন করেননি, তারা এই মহান দেশপ্রেমিকের কর্মধারা না জেনেই মন্তব্য করেন।
কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বাংলা থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন সংগঠন শাস্ত্রের ‘বর্ণপরিচয়’। সেই কারণেই তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। পড়াশোনা করার অছিলায় তিনি কলকাতায় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করার সুবাদে এবং বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ থাকার কারণে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন।
কেশব হেডগেওয়ার অত্যন্ত গরিব পরিবারের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁর আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর। কারোর কাছ থেকে হাত পাতার রুচি তাঁর ছিল না। থাকা খাওয়া স্বাচ্ছন্দ্য কেশবজীর জীবন কখনো আসেনি। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত সমস্যাকে আনন্দের সঙ্গে সমাধান করতেন। ডাক্তারি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে মুক্তি আন্দোলনের সৈনিক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘কোকেন’ ছদ্মনামে তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপ চলত।
দামোদরের বন্যার সময় রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তিনি সেবা কাজেও গিয়েছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন যুবক কেশবের সঙ্গে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনকে জহুরীর চোখ দিয়ে দেখে ছিলেন তিনি। এরপর ১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীর দিন তিনি তৈরি করলেন সংগঠন শাস্ত্রের অনবদ্য গ্রন্থ ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’।
জাতির জীবনে চরম হতাশা নিরাশা সময় যুব পুরুষের জন্ম হয় এবং যিনি ওই সমাজকে সঠিক দিশা নির্দেশ করেন, তেমনই একজন ছিলেন ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। ডাক্তারি হিন্দুজাতির অতীত গৌরবের পাশাপাশি দীর্ঘ পরাধীনতার কারণগুলি খুঁজে বের করে হিন্দুদের মধ্যে স্বাভিমান ও আত্মশক্তিকে জাগানোর কাজ করেছিলেন। ‘ভারত হিন্দু রাষ্ট্র’ এবং হিন্দুস্তান হিন্দুদেরই একথা বলার ও উপলব্ধি করানোর জন্য সদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এই জাগরণ শক্তিই পারে ভারতবর্ষকে “জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন” এনে দিতে।
সরোজ চক্রবর্তী