শক্তিঃ সাক্ষান্মহাদেবী মহাদেবঃ স শক্তিমান্।
তয়োর্বিভূতিলেশো বৈ সর্ব্বমেতচ্চরাতরম্।।
বস্তু কিঞ্চিদচিদ্রূপং কিঞ্চিদ্বস্তু চিদাত্মবম্।
দ্বয়ং শুদ্ধমশুদ্ধঞ্চ পরাঞ্চপরমেব চ।।
যথা শিবাস্তথা দেবী যথা দেবী তথা শিবঃ।
নানয়োরন্তরং বিদ্যাচ্চন্দ্রচন্দ্রিকয়োরিব।।
শক্তি সাক্ষাৎ মহামায়া মহাদেবী , ব্রহ্ম হলেন মহাদেব। এই উভয়ের বিভূতিকণাই এই চরাচর বিশ্ব। জগতে যাহা কিছু বস্তু দেখা যায় , হয় তা অচিৎ অর্থাৎ জড়, না হয় তা চিৎ অর্থাৎ জ্ঞান স্বরূপ হয়ে থাকে। এর মধ্যে পার্থক্য এই যে , কোনটি শুদ্ধ অর্থাৎ চিৎ, কোনটি বা অশুদ্ধ অর্থাৎ অচিৎ, একে পর এবং অপর সংজ্ঞায় বলা যেতে পারে। কিন্তু তত্ত্বতঃ কোন ভেদ নেই – যেমন শিব তেমনই দেবী, যেমন দেবী তেমনই শিব। যেরূপ চন্দ্র এবং জোৎস্নার মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, সেই রূপ ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বেদান্তের অদ্বৈতবাদ শাক্তদর্শন , শৈবদর্শন একত্রিত হয়েছে। প্রকৃতি ও পুরুষ , আদিপরাশক্তি ও পুরুষ একত্রিত হয়ে স্বীকৃত হয়েছে।
এই সুবিশাল ব্রহ্মান্ডে যা হয় , সকলই তাঁদের ইচ্ছায় হয়। হিরণ্যগর্ভ সৃষ্টির সেই আদি কাল হতে আজ এই বিংশ শতকের বুকে দাঁড়িয়েও সেই বিশ্বাস জীবজগতের মধ্যে হতে একটুও যায় নি।
যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন। তিনি অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন।
বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর। সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব, দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “
সেই কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির নানা বস্তুকে নানা ভাবে পূজা উপাসনা করা হয়ে আসছে। ভালো ফসলের আশায়, রোগ শোক হতে মুক্তি পেতে, পঞ্চভূতকে তুষ্ট করতে সেই উপাসনা আজও আমরা করে থাকি। গাজন, নীলপূজা সেই সুপ্রাচীন কালের প্রকৃতি , কৃষিনির্ভর সমাজেরই সংস্কারজাত।
যিনি জ্বিহা দিয়েছেন , তিনিই আহার দেবেন। তাই অন্নদাতা, অন্নদাত্রীর জন্যই সকল আয়োজন। গাজনও তাই। বঙ্গে মূলত দুই ধরনের কৃষিভিত্তিক উপাচার উৎসব হয় – ১. কৃষি পূর্ববর্তী উৎসব এবং কৃষি পরবর্তী উৎসব গাজন হলো কৃষি পূর্ববর্তী উৎসব চৈত্র মাসের সময় থেকে শুরু করে বর্ষার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকৃতি রুদ্র রূপ ধারণ করে । তখন সেই প্রকৃতিকে এবং নিরাকার রুদ্রকে তুষ্ট করার জন্য, উপযুক্ত বৃষ্টির আশায় কৃষকেরা গাজন উৎসব পালন করে থাকেন। ব্রজমিত্র বলেছেন, “বঙ্গে দারুন গ্রীষ্মের দহনে যখন সমস্ত জল শুকিয়ে, তৃণহীন অগ্নিদগ্ধ প্রান্তর ধুধু করে, তখনই বঙ্গে গ্রামে গ্রামে গাজন উৎসব পালিত হয়।” অর্থাৎ তপ্ত পৃথিবীকে সুজলা সুফলা করে তোলার উদ্দেশ্যেই চৈত্রের নিদাঘে গাজন পালিত হয় ।
মহাদেব ছাড়াও ধর্মঠাকুর, মনসা, মহাকালীর বিভিন্ন রূপ, শীতলা, বলরাম, রতনমালা প্রভৃতি পূজাকে কেন্দ্র করেও গাজন পালিত হয়। চৈত্র মাসে মহাদেবের গাজন পালিত হয়। বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ধর্মের গাজন পালন করা হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমাতেও ধর্মের গাজন পালন করা হয় । শ্রাবণ মাস , ভাদ্র মাসে মনসা গাজন পালন করা হয়। চৈত্রের প্রথমদিকে শীতলা ঠাকুরের গাজন পালন করা হয় । এছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে গেরাম ঠাকুর বা গ্রামদেবতার উদ্দেশ্যে আখ্যান যাত্রার সময় গাজন পালন করা হয়। তাছাড়াও বছরের নানা সময়ে নানা স্থানে এমনিই যে গাজন পালিত হয় , তাকে হুজুগে গাজন বলা হয়।
বেদান্তে বলা হয়েছেঃ
তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং ত্বং দেবতানাম পরমঞ্চ দৈবতম্ ।
পতিং পতিনাং পরমং পরস্তাদ বিদাম্ দেবম্ ভুবনেশমীড্যম্ ।।
তুমি ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর মহেশ্বর। দেবতাদেরও পরম দেবতা। তুমি অধিপতিদেরও অধিপতি মহাধিপতি। তুমি পরমেরও পরম। তুমিই ভূবনের পূজনীয় ইশ্বর।
জ্ঞানসংহিতা বলছেন – অহং ভবানয়ঞ্চৈব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।
একং রূপং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।
তথাপীহ মদীয়ং শিবরূপং সনাতনম্।
মূলভূতং সদা প্রোক্তং সত্যং জ্ঞানমনন্তকম্।।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই শিবের উপাসনা বা লিঙ্গ স্বরূপ নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনা প্রচলিত হয়ে আসছে।মহেঞ্জদারো হরপ্পা সভ্যতা তেও পদ্মাসনে উপবিশিষ্ট, ধ্যানমগ্ন, তিনমথা বিশিষ্ট, তিন শিং বিশিষ্ট এবং পশু পক্ষী দ্বারা পরিবৃত পশুপতি শিবের রূপ পাওয়া গিয়েছে। তেমনি মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতায় কিন্তু শিব লিঙ্গও প্রাপ্ত হয়েছে। বৃষ মূর্তি মুদ্রিত মুদ্রা উক্ত সভ্যতায় সুপ্রচলিত ছিল। বৃষ উক্ত সভ্যতার টোটেম বা প্রতীক স্বরূপ ছিল। কেবল উক্ত সভ্যতাই নয়। উক্ত সভ্যতার পূর্বে এবং সমসাময়িক সভ্যতাগুলিতেও বহু স্থানে বৃষ টোটেম হিসাবে পূজিত হতেন। দেবাদিদেব মহাদেব যিনি স্বায়ম্ভু, আদি, মহাযোগী, মহাজ্ঞানী তাঁর উপাসনা পদ্ধতি বহু প্রাচীনকাল, বেদ হতে পুরান ,শাস্ত্র , সনাতনীধর্মচর্চা হয়ে লোকমানসে প্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর কাছে উচ্চ নীচ নেই, ধনী গরিব নেই , স্ত্রী পুরুষ , মানব বা পশু বিভেদ নেই। তিনি লৌকিক সনাতনী সমাজের কাছে বিপদভঞ্জন। তাই তাঁকে তুষ্ট করতে মানুষের গাজনে মেতে ওঠা।
শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রীপাঠ রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী মহারুদ্রের আরাধনার কথা উল্লেখ আছে । শিবলিঙ্গের উপর দুধ, দই, ঘি, মধু, শর্করা, গঙ্গাজল প্রদান করা হয়ে থাকে । শ্রীঙ্গীর দ্বারা শিবলিঙ্গের উপরে অভিষেক হতে থাকে এবং এই বেদমন্ত্র পাঠ চলতে থাকে। এইটিই রুদ্রাভিষেক শিব পূজা। এই রুদ্র শিব পূজা করাতে পারলে মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হয়ে থাকে সফলতা, রোগমুক্ত, দীর্ঘাযু, অকাল মৃত্যুবরণের হাত থেকে রক্ষা করেন মহারুদ্র মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব।
মনঃ শিব-সঙ্কল্পমস্তু।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ৩৪)
আমার মন শুভ কল্যাণকর সঙ্কল্পযুক্ত হোক।
এই শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রাধ্যায়ী সম্পর্কে একটি ধারণা বেদের মধ্যে ভগবান শিব কে আমরা রুদ্র নামে জানি। পূর্বকালে হইতে শ্রদ্ধালু বেদধ্যায়ী মানুষ গন অাত্মকল্যাণের শুক্লযজুর্বেদ থেকে আট উপযোগী অধ্যায় কে চরণ করে “রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী” নামক গ্রন্থ হয়।
ই রুদ্র শিব হল অন্যতম তাৎপর্যবাহী মন্ত্র। নমঃ শিবায়-এর অর্থ হল “ভগবান শিবকে নমস্কার” বা “সেই মঙ্গলময়কে প্রণাম!”
এই মহারুদ্র শিবকে পঞ্চাক্ষর মন্ত্রও বলা হয় যার মানে “পাঁচ-অক্ষরযুক্ত” মন্ত্র (ওঁ ব্যতীত)। এটি ভগবান মহারুদ্র শিবের প্রতি সমর্পিত হওয়া। এই মন্ত্রে শ্রী রুদ্রম্ চমকম্ ও রুদ্রাষ্টাধ্যায়ীতে “ন”, “মঃ”, “শি”, “বা” এবং “য়” রূপে প্রকাশিত। শ্রী রুদ্রম্ চমকম্, কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ এবং রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী, শুক্ল যজুর্বেদ-এর অংশ।
ত্রিকালজ্ঞ ঋষি হতে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ- ডোম , বাউরি, কোটালদের নিকট তিনি পূজিত হন। গাজন শব্দের অর্থ নিয়ে দুটি ভিন্ন মতামত প্রচলিত – আছে- একমত, অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তরা একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে গর্জন করে শোভাযাত্রা করেন। এই গর্জন শব্দ থেকে গাজন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। অপর মতানুসারে, গাঁ অর্থাৎ গ্রাম এবং গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণ ঈশ্বরের নামে যে ব্রত, পূজা উদযাপন করেন তাই হল গাজন। এই গাজন এক এক জায়গায় একেক নামে পরিচিত । মালদহের গাজন গম্ভীরা নামে পরিচিত , জলপাইগুড়িতে সেই গাজনের নাম হয়ে গিয়েছে গমীরা।
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের বক্তব্য থেকে একটুকু প্রকাশিত হয় যে , পুরাকালে পূর্ব্বভারতের রাজারা অধিকাংশই শৈব ছিলেন। কিরাত, মেচ, কুকি, চাকমা, হাজাং, খস্ প্রভৃতিরা তাঁদের প্রজা ছিলেন। হিমালয়ের নানাভাগে এবং হিমালয়ের নিকটবর্তী স্থানে তাঁদের বাস ছিল। তাঁরা নিজেদের শিবেরগণ বলে মনে করতেন প্রাচীন শৈবমার্গ এসব অঞ্চলে বদ্ধমূল ছিল। উত্তর এবং উত্তর পূর্ব এবং পূর্ব ভারতের রাজা মহারাজাগণ শিবের সঙ্গে নিজের শিষ্যত্বাদির কথা বা মহারুদ্রের ভক্ত হবার কথা গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতেন। উক্ত সকল অঞ্চলে এককালে স্বয়ম্ভুই সম্রাট্ ছিলেন। ত্রিপুররাজ্যের ত্রিলোচনা এবং কোচবিহারের রাজা বিশ্বসিংহ শিবের বরপুুত্র বলে কথিত হয়ে থাকেন। হরিবংশে লিখিত আছে বাণ বা বাণাসুর মহাদেবের এক নিষ্ঠাবান ভক্ত ছিলেন। তাঁর মতো শ্রেষ্ঠ শিব ভক্ত ইতিহাসে খুব কমই আছেন। বাণ-প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ– সর্ব্বপ্রকার শিবলিঙ্গ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং বাণলিঙ্গ নামে অভিহিত। কোনদের সঙ্গে নানারূপ শিবলীলা উপকথার বিষয়ীভূত হয়ে আছে। প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে এ সম্বন্ধে নানা কাহিনী বর্ণিত আছে। জরাসন্ধ, বাণ, ভগদত্ত, নরক ও মুর প্রভৃতিরা শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত এবং তন্ত্রধারক ছিলেন।
রাজা বাণ শিবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভক্ত ছিলেন । প্রত্যহ তিনি শিব লিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করতেন। এইভাবে দীর্ঘদিন শিবপূজার ফলে শিব তাকে দর্শন দিয়ে একটি বর দিতে চান। বাণ বলেন, প্রতিদিন তাকে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করতে বেশ কষ্ট পেতে হয়। তাই বর হিসেবে তিনি উত্তম লক্ষণযুক্ত শিবলিঙ্গ চান। শিব চোদ্দো কোটি শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে বাণকে দেন। বাণ সেগুলি পেয়ে মনে ভাবেন, এগুলি পূজায় যখন বিশেষ ফল পাওয়া যায়, তখন এগুলি সর্বসাধারণের কল্যাণের কাজেই ব্যবহার করা উচিত। এই ভেবে তিনি তিন কোটি লিঙ্গ কালিকাগর্তে, তিন কোটি লিঙ্গ শ্রীশৈলে, এক কোটি কন্যাশ্রমে, এক কোটি মহেশ্বর ক্ষেত্রে এবং অবশিষ্ট লিঙ্গগুলি বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে স্থাপন করেন।
লিঙ্গানাং কালিকাগর্তে সঞ্চিতাস্তু ত্রিকোটিকঃ।
শ্রী শৈলে কোটয়স্তিস্রঃ কোটোকো কন্যকাশ্রমে।।
মাহেশ্বরে চ কোট্যস্তু কন্যাতীর্থে তু কোটিকা।
মহেন্দ্রে চৈব নেপালে একৈকা কোটিরেব চ।।
বাণ নামক অসুরের দ্বারা পূজিত বলে (মতান্তরে শিবের অপর নাম বাণ বলে) এই লিঙ্গগুলি বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত হল।
বাণার্চ্চার্থং কৃতং লিঙ্গং বাণলিঙ্গমতঃ স্মৃতম্ ।
বাণো বা শিব ইত্যুক্তস্তৎকৃতং বাণমুচ্যতে।।
বাণাসুর শিবপূজার জন্য যে লিঙ্গসমূহ নির্মাণ করেছিলেন সেগুলির নাম হয়েছিল বাণলিঙ্গ। এই মতানুসারে বাণাসুরের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ। আরেকটি মতে বলা হয়েছে যে, বাণ শব্দের অর্থ হলো শিব। এই শিব বা বাণের দ্বারা নির্মিত লিঙ্গ হলো বাণলিঙ্গ।
বীরমিত্রোদয়-এও বলা হয়েছে–
বাণঃ সদাশিবো দেবো বাণো বাণান্তরোহপি চ।
তেন যস্মাৎ কৃতং তস্মাদ্বানলিঙ্গমুদাহৃতম্ ।।
স্বয়ং সদাশিবের নাম বাণ। বাণ শব্দে বাণ রাজাও বুঝায়। সেই বাণ রাজা কর্তৃক স্থাপিত হওয়াতে, বাণ-লিঙ্গ বলিয়া খ্যাতি হইয়াছে।
তাই প্রাণতোষিণী তন্ত্রে বলা হয়েছে –
লিঙ্গং হি দ্বিবিধমকৃত্রিমং কৃত্রিমঞ্চ।
অকৃত্রিমং স্বয়ম্ভূতং স্বয়ম্ভূবাণলিঙ্গাদি।।
লিঙ্গ দুই প্রকার, অকৃত্রিম ও কৃত্রিম; স্বয়ম্ভূ ও বাণ-লিঙ্গ প্রভৃতি যে সকল লিঙ্গ মনুষ্য দ্বারা নির্মিত হয় নাই, তাহার নাম অকৃত্রিম লিঙ্গ।
একদা বাণ নিকট অমরত্ব লাভের আশায় কৃচ্ছসাধন করেন এবং শিবকে সন্তুষ্ট করবার নিমিত্ত শিবের গণের ন্যায় নানাবিধ নৃত্যগীতাদি করেন। রাজা বাণ বা বাণাসুরের এই ভক্তিকে স্মৃতিতে রেখে সুপ্রাচীন কাল হতে বঙ্গে চলে আসছে গাজন এবং চরকাদি ব্রত, পূজার পদ্ধতি। এই একই কারণে গাজনে বাণ ফোঁড় , কাঁটা ঝাঁপ ইত্যাদি কৃচ্ছ পালন হয়ে থাকে।
গাজনের মূলত তিনটি ভাগ থাকে – সন্ন্যাস, নীলব্রত এবং চড়ক। ডোম , গোপ , কৈবর্ত ইত্যাদি সম্প্রদায় গাজনে মূল সন্ন্যাসীর ভার গ্ৰহণ করেন। চৈত্রসংক্রান্তির একমাস পূর্বে তাঁরা ক্ষৌরকর্ম দ্বারা পবিত্র হন। তাঁদের ক্ষৌরকর্মের নাম #দশের_কামান। তবে এখন কেউ কেউ চৈত্র সংক্রান্তির সাত বা তিনদিন আগে ক্ষৌরকর্ম দ্বারা পবিত্র হয়ে সন্ন্যাস নিয়ম পালন করেন।
সন্ন্যাস নিয়ম পালনের মূল কাজ হলো মাধুকরী বৃত্তি। সারাদিন উপবাস থেকে গৃহে গৃহে ঘুরে যে ভিক্ষা পাওয়া যায় তাই শিবকে উৎসর্গ করে ,খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। গাজন সন্ন্যাস নিয়মে তারা শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মণের ন্যায় পৈতা গ্রহণ করেন। স্নান করে গৈরিক বসন ধারণ করেন তাঁরা। তারপর মোটা মোটা পৈতে পড়েন। পৈতের নীচে কুশ বাঁধা থাকে। এসকল সন্ন্যাসীদের বলা হয় ভক্ত্যা। নিয়ম পালনের সময় প্রতিটি গাজন সন্ন্যাসী নিজস্ব গোত্র ত্যাগ করে শিব গোত্র ধারণ করেন অর্থাৎ সকল ভক্তের মাঝে এই সময় শিব ভক্তময় এবং ভক্তগণ শিবময় হয়ে ওঠেন। প্রতি গাজন সন্ন্যাসী দলে একজন করে ভক্ত্যা থাকেন। তাঁর নির্দেশে বাকি ভক্ত্যারা আপন আপন পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে গাজনের কয়েকদিন ব্রহ্মচর্য পালন করে থাকেন।
সকাল থেকে গাজনের সন্ন্যাসীরা মাগনে বের হন পোড়া মাটির পাত্র বা গেরুয়া ঝুলি নিয়ে। গৃহস্থ বাড়ির সামনে মাগন প্রাপ্তির জন্য উচ্চৈঃস্বরে বুলি দেন – ” বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে , বাবা মহাদেব। ” দিনান্তে ভিক্ষার অন্ন মহাদেবকে উৎসর্গ করে একপাকে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন সন্ন্যাসীরা।
অনেক জায়গায় হরপার্বতী , নন্দী ভৃঙ্গী সেজে বাণেশ্বরকে কাঁধে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিবের গান গেয়ে, নৃত্য করে মাধুকরী করেন। নারী ,পুরুষ উভয়েই গাজনের ভক্ত্যা হন।
মনে আছে ছোট বেলায় দেখতাম এরকম গাজনের সন্ন্যাসীরা আমাদের বাড়িতে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে আসতেন । সেসব গানের কিছু কিছু শব্দ মনে পড়ে –
আয়রে ছুটে আয়
দেখবি যদি আয়
ভোলাবাবা এসেছে আজ
মোদের আঙিনায়
বাঘছাল পরা বাবার ভস্ম মাখা গায়,
বোবোম্ বোবোম্ বলে বাবা ডমরু বজায়।।….
গাজন মহাদেবের পূজাকেন্দ্রিক পালনীয় কিছু বিধি নিষেধ পূর্ণ অনুশাসনের সংযোগ সমবায়। মহাদেব পরম ব্রহ্ম, প্রাণের প্রতীকস্বরূপ পিতৃসত্তার সংকেত। লিঙ্গ রূপে পূজা শিবের আদিম কৃষিজীবী সত্তাটিকে নির্দেশ করে থাকে। তাম্র প্রস্তর যুগে মহাদেবের প্রথম প্রস্তরমূর্তিটি আবিষ্কৃত হয়। সেই মূর্তি ছিল মূলত লিঙ্গের প্রতিরূপ । শিব হলেন ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষ প্রকৃতির প্রতীক রূপ।
শৈবদর্শনে পরমশিব ও পরাশিব একই । তিনি অব্যক্ত #পরমেশ্বর, নির্গুণ ব্রহ্ম। তিনি আর মাতা পরাপ্রকৃতি #পরমেশ্বরী এক ও অভিন্ন তত্ত্ব । তিনি সহস্রারস্থিত সহস্রদল পদ্মে থাকেন। তিনি কালাতীত। #মহাকাল হচ্ছেন সাকার। যদিও তন্ত্রমতে মহাকালের কালচক্র পরিচালনা করেন মহাকালী। (যত মত তত পথ)
আর #সদাশিব মানে বোঝায় সাকার পঞ্চমুখী , দশভূজ পুরুষ তিনি নিরাকার ব্রহ্মের সগুন প্রকাশ। তাঁর অবস্থান হল #বিশুদ্ধ_চক্রে। তিনি #অর্ধনারীশ্বর রুপে সেখানে অবস্থান করেন।
নিরাকার ব্রহ্ম-শক্তি যুক্ত হলে সেখান থেকে নাদ( শিব-শক্ত্যাত্মক ) আর নাদ থেকে বিন্দু(শিবাত্মক)ও বীজ (শক্ত্যাত্মক) আলাদা হয়ে যায়। এই শিব-শক্ত্যাত্মক নাদই হচ্ছে #হিরণ্যগর্ভ ।
এখান থেকেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের/মহারুদ্র প্রকট হয়। ব্রহ্মা #ইচ্ছাশক্তি(ব্রাহ্মী), বিষ্ণু #ক্রিয়াশক্তি(জ্ঞানশক্তি) আর রুদ্র #জ্ঞানশক্তির(গৌরী) প্রতীক।
ব্রহ্মার প্রার্থনার দরুন অজন্মা সদাশিবই #মহারুদ্র রুপে ব্রহ্মার কপাল হতে পুনারায় আবির্ভূত হন। তাঁর অধীনে একাদশ রুদ্রের বাস।
অ কার (ব্রহ্মা, পৃথিবী তত্ত্ব মূলাধার চক্রে) + উ কার (বিষ্ণু, জল তত্ত্ব স্বাধিষ্ঠান চক্রে) + ম কার(রুদ্র, তেজ তত্ব মণিপুরে) + নাদ (ঈশ্বর, বায়ু তত্ত্ব অনাহত চক্রে + বিন্দু ( অর্ধনারীশ্বর সদাশিব/মহেশ্বর , আকাশ তত্ত্ব বিশুদ্ধ চক্রে) + কলা (পরশিব, চিত্ত/মন আজ্ঞা চক্রে) এবং কলাতীত ( পরমশিব/পরমাত্মা/পরমাপ্রকৃতি সহস্রারে পরব্যোম রুপে) = এই সাতটি অঙ্গ মিলে গঠিত হয় #মহাপ্রণবঔঁকার। তাই পরমেশ্বর শিব হচ্ছেন #সপ্তানন (5 টি ব্যক্ত +2 টি অব্যক্ত) [সূত্র- ব্রাহ্মন কণ্ঠাতরণ ] আর #শিবলিঙ্গ (গৌরী পট্ট বা ব্রহ্ম যোনি সহ) হল সাক্ষাৎ #ওঙ্কার_স্বরুপ , যেখানে সমগ্র দেবদেবী নির্বিশেষে সমস্ত পঞ্চদেবতার পূজাও( পঞ্চায়তন উপাসনা) সম্ভব। ইহাই পরমেশ্বর/পরমেশ্বরী স্বরূপ যাহাকে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্য, সৌর, স্মার্ত সকলে উপাসনা করতে পারে এবং অবশ্যই ভস্মের ত্রিপুন্ড্র লাগিয়ে।
শিবের #সপ্ত_মুখের নাম – তৎপুরুষ ( অ কার স্বরুপ ব্রহ্মা,পূর্ব মুখ) , অঘোর (উ কার স্বরুপ বিষ্ণু দক্ষিণ মুখ) , সদ্যোজাত (ম কার স্বরুপ রুদ্র , পশ্চিম মুখ), বামদেব( নাদ স্বরুপ ঈশ্বর , উত্তর মুখ) , ঈশান /ঈশ্বর (বিন্দু স্বরুপ সদাশিব/মহেশ্বর , উর্ধ্বমুখ), #নীলকন্ঠ( কলা স্বরূপ পরশিব, গুপ্ত অধোমুখ) এবং #চৈতন্য (কলাতীত পরমশিব/পরমাপ্রকৃতি, মধ্যস্থস্থিত অব্যক্ত)।
মহাপ্রণব_ওঙ্কার শিবের মুখ থেকেই প্রকটিত জন্য শিবকে #ওমকারেশ্বর বলে।
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ী , পুরুষ ও নারী সার্থকতা প্রাপ্ত হয় যা কিছু সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। গাজন হল তাই ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর সৃষ্টির প্রতিমূর্তির উপাসনা।
গাজনে ব্রত পালন বা সন্ন্যাস নেওয়ার সময় ভক্ত্যারা জলশুদ্ধি , ক্ষীরশুদ্ধি, অঙ্গুরীশুদ্ধি অনুষ্ঠান পালন করেন । সন্ন্যাস গ্রহণের পর ভক্ত্যারা বুড়ো শিবের সাথে অন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে গান গেয়ে ওঠেন –
উত্তরে আছেন ভীম কেদার, তাঁর চরণে।
করি মোরা পঞ্চ প্রণাম , তাঁর চরণে।
গৃহে আছেন বাস্তুদেবতা , তাঁর চরণে।
করি মোরা পঞ্চ প্রণাম, তাঁর চরণে।
গাজনে আছেন ধর্ম অধিকারী, তাঁর চরণে।
করি মোরা পঞ্চ প্রণাম , তাঁর চরণে ।
শুদ্ধির পর সন্ন্যাস গ্রহণ সম্পন্ন করার সময় আনুষ্ঠানিক কিছু গীতি শোনা যায়-
মন করি ধুতি মোরা পবন করি কাছা
সেই কাছা পড়ে পূজি মোরা সন্ন্যাসী দেবতা।
সেই কাছা পড়ে করি মোরা শিবেরে স্মরণ ,
যত কিছু পাপ মোদের হরে ততক্ষণ ।।
কহেন তবে সদগুরু মহেশের বরে,
উত্তরীয় শুদ্ধ করেন ভোলা মহেশ্বর।।
উত্তরবঙ্গে গাজনের সময় কিছু গীতি গাওয়া হয়, সেগুলি শিব দুর্গার কথোপকথন এবং বেশ একটা হালকা রস চিত্র ফুটে ওঠে –
আমার জাতের কথা শিব তুই কলু ভাঙ্গিয়া
তোমার জাতের কথা কৈলে লাগিবে ঝগড়া।
বাপের বাড়ী যাবরে মুই ভাইয়ের বাড়ী চইল্যা যাব
কাটনি কাটিয়া তবে দুই ছেইলাক পালিব।।
বঙ্গের কোচ সম্প্রদায়ের গাজনের গীতিতে শিবের জীবনের কথা শুনতে পাওয়া যায় –
ভাং খাওয়া ধুতুরা খাও ভাং এর মর্ম জান।
গাঙ পাইড়্যা যত ভাঙ , বুড় বাইন্ধ্যা আন।
বুড় বাইন্ধ্যা আইন্যারে ভাঙ, ঢেঁকি দিয়া কুটে।
বারোখানা ঢেঁকি শিবের , তেরোখানা কুলা
রেতে দিনে কুইট্যা মরে, জউট্যা ভাঙের গুঁড়া।।
হরপার্বতীর দাম্পত্য জীবন বর্ণনা ময়মনসিংহের একটি গাজনের গানে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণিত আছে, গাজনের সময় সেই গান গীত হয় –
ধান লাড় , ধান লাড় , গৌরী , এইলাইয়া মাথার কেশ,
জল চাইলে না দেও জল, এই বা কোন দেশ।।
নেও ঝাড়ি নেও পানি , দিও পানি , দেশ কেন নিন্দ,
এ ভব আলিয়ার মাঝে ঠমক কেন মার।
ঠমক নয় ঠমক নয় ঠমক তোমার হিয়া,
একটি কথা কথা জিগেস করি, ঘাট কোন দিক দিয়া,
হস্তী না হয় ঘোড়া না হয়, গেরা না হয় তল,
তুমি নি খাইতে পার শুকনা শাঁপলা জল।।
টাকি অঞ্চলে গাজনের সময় একটি শিবের গার্হস্থ্য জীবন নিয়ে বেশ একটি গান গাওয়া হয়। –
ভাঙের ভোলা শিবের তোমার , একী মোহন বেশ
মাথাতে পরেছ মুকুট, নেই কো ভোলা জটার লেশ
বাঘছাল কুত্থায় গেল কুত্থায় হাড়ের মালা
মাথার সাপ কি বনে গেইল হইয়ে ঝালাপালা-
জানি এসব গান , সবই খেটে খাওয়া মানুষের গান, পন্ডিতদের চোখে এসবের কৌলিন্য নেই। সমাজের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ শিবকে নিজের মতো করে কখনো চাষা, কখনো জেলে, কখনো বেতের ঝুড়ি বোনা শিল্পী হিসাবে আপন করে নিয়েছেন। সেখানেই তো জয় হয়েছে সনাতনের। সনাতন ধর্ম দর্শন এখানেই শ্রেষ্ঠ। সংসারে যে ঘরে দেবীদেবতার নিত্য পূজা হয়, সেই গৃহই তো ঈশ্বরের গৃহ। সে ঘরের দীপ বা দেউটি ঈশ্বরে ঘরের আলোক, তাই ঘর দেউটি নমস্কার – ঘর ও মন্দির , ঈশ্বর ও মানব একাকার হয়ে আছে সনাতনী জীবনে।
চৈত্র সংক্রান্তির পূর্বের দিনটি হল নীল পূজা। যদিও লৌকিকভাবে বলা হয় এই দিন শিব পার্বতীর ( নীল সুন্দরী) বিবাহের উৎসব বা পূজা, কিন্তু শাস্ত্রীয় মতে এই তিথিতে সমুদ্র মন্থনে হলাহল পানের পর মহাকাল সর্ব বিষ নিজ কণ্ঠে ধারণ করেন। কিন্তু বিষের যন্ত্রনায় কাতর হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মময়ী সেইক্ষণে দেবী তারার রূপ ধারণ করলেন । তিনি তারিণী হয়ে শিবের যন্ত্রণার তারণ ঘটালেন। তাই তিনি দেবী তারা নামে পরিচিত হলেন। বিষ তখন গলাতেই আটকে থাকল এবং মহাদেবের কন্ঠ নীল হয়ে গেল । দেবতা, মানব, দানব সবাই ভগবান শিবের জয় জয়কার করল এবং ব্রহ্মা বিষ্ণু মহাদেবকে নীলকন্ঠ নামে ভূষিত করলেন। তিনি তাই মৃত্যুঞ্জয়।তিনি সকল বিষ ধারণ করে ত্রিলোককে দিয়েছিলেন জীবনের আলোক। ঠিক এই ভাবেই কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ জীবনে অনুর্বর হয়ে থাকা জমির হলাহল খণ্ডন করে নতুন সৃষ্টিকে আগমন জানানোর জন্য উক্ত তিথিতে নীলকন্ঠ মহাদেবের পূজা হয়ে থাকে। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মময়ী উভয়েই প্রজননকে রক্ষা করেন, তাই এই তিথিতে মায়েরা সন্তানের মঙ্গলকামনায় নীলের উপোস করেন।
গাজন শেষে উৎসব হল চড়ক। শিবের উপাসনার সঙ্গে সঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ,অর্থাৎ নীলের দিন সন্ন্যাসীরা গ্রাম লাগানো দিবা পুকুর থেকে চড়কগাছ তুলে নিয়ে আসেন। পূজার দিন যথারীতি পূজা অর্চনা করেন। চড়ক মেলা প্রাঙ্গণে চড়ক গাছ কেটে তার সঙ্গে একটি বাঁশ বেঁধে , সেই বাঁশে ভক্ত্যাদের পিঠে বঁড়শী বিঁধে বা কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘোরানো হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশে বাণফোঁড়া ,জ্বলন্ত কয়লায় হাঁটা, বঁটি ঝাঁপ ইত্যাদি দুঃসাহসিক মূলক ক্রিয়া-কলাপ এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা করে থাকেন। এগুলো সবই শুদ্ধাচার ও কৃচ্ছসাধনের প্রক্রিয়া। অনেক জায়গায় কাঁটাভাঙা বা ফুলভাঙা পর্ব পালন হয়। ভক্তের উপবাস করে বা সংযম পালন করে মন্ডপ বা আটনের মধ্যে রাখা গাছের কাঁটা বুকে ধারণ করেন এবং চিৎকার করে বলেন –
ত্রিশূলধারী চরণে সেবা লাগে , বাবা মহাদেব ব্যোম….হর হর বিশ্বেশ্বর , বাবা মহাদেব ব্যোম… ব্যোম ভোলা ব্যোম ব্যোম , তারপর কণ্টক শয্যায় শয়ন করেন।
গাজন উৎসব উদযাপনের এই পূজা এবং সংযম পালনের মন্ডপগুলি পূর্বে পদ্মফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হতো। এখন কাগজ , প্লাস্টিক এসবের ফুল দিয়ে মন্ডপ সাজানো হয়।
বাণফোঁড়া পর্বে উত্তপ্ত শলাকা , শূল ইত্যাদি কোমর , পীঠ ইত্যাদিতে বিদ্ধ করা হয়। অনেক জায়গায় একটি তৈলাক্ত কাপড় দিয়ে দেহ আবৃত করে ও পরে সেই কাপড়ে আগুন ধরিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। ধারালো বঁটি বা খড়্গের উপর ঝাঁপ বা উবু হয়ে দীর্ঘক্ষন অবস্থান করেন ভক্তেরা। মূল যে প্রক্রিয়াটি চড়ক মেলার প্রধান আকর্ষণ তা পূর্বেই বলেছি, তা হল কোমরে বঁড়শী বিঁধে বা দড়ি বেঁধে চড়কগাছে ঘোরা। এই ভারসাম্য রক্ষার এক অতীব জটিল পদ্ধতি। এই সকল জটিল ক্রিয়া পদ্ধতির সঙ্গে ঢাক ,ঢোল, কাঁসি সহযোগে শিবের নিকট নিবেদিত হয় গাজনের গান ।
জলের ভেতর আঁকাবাঁকা
ফুল ফুটেছে চাপাচাপা
সেই ফুল তুলব
শিব পূজা করব
শিব – ব্যোম্।
বা
ঐ যায় রে ঐ যায়
আমার ঠাকুর ঐ যায়
ফুল ফুটেছে রাঙা পায়
সেই ফুল তুলব, শিব পূজা করব
শিব ব্যোম্….
বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল উত্তর থেকে রাঢ় হয়ে দক্ষিণে গাজন উৎসব পালিত হয় এবং বর্তমানে এটি একটি মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসবের মূল কাঠামো সর্বত্র প্রায় এক থাকলেও অঞ্চল ভেদে এর কিছু নিজস্ব বিশেষত্ব আছে। গাজন উৎসবের সন্ন্যাসীগণ নানা ধরনের শারীরিক ক্লেশ বা নিপীড়ন সহ্য করে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করেন । বিভিন্ন আচার আচরণের মধ্য দিয়ে মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য তাঁরা কৃচ্ছসাধন ও মানসিকভাবে শান্তি লাভ করেন ।
চড়ক অর্থাৎ চক্র। মহাকালের চক্র। দিন , মাস , বছরের ঘূর্ণায়মান সকল সৃষ্টির মাধ্যমে এর সূচনা ও সমাপ্তি ঘটে। শিব গাজনের আরেক নাম নীলের গাজন , কেন বলা হয় তার একটি ব্যাখ্যা আমি উপরে দিয়েছি। গাজনের চৈত্র সংক্রান্তির দিন সারারাত ভক্তেরা শিবের আটনের চারপাশে নেচে গেয়ে গান করেন । গাজনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পর্ব আছে । #খাটুনী পর্বে ভক্তেরা গেয়ে ওঠেন আকুতি নিয়ে –
পূর্বে পূর্বমণি শুকতারা হায়
তিন বরুণ রাজা ভানুভাস্কর
চরণ ছোঁয়াই।
ও তাঁর চরণ সেবি কোন পদ পাই
নাই যাঁর যমপুরী, ধর্মপুরী ঠাঁই
ধর্ম অধিকারী, কর্ম অধিকারী
সাধুলিরে ভাই,
পূর্ব দুয়ার খাটুনী হল পুষ্প জল পাই।
সেই মহাকালের প্রতি আত্ম নিবেদনের মধ্যে দিয়ে গাজন সন্ন্যাসী, বঙ্গের গ্রাম্য জীবনের সুখ দুঃখময় আলেখ্য চিত্রিত হয়। অনুষ্ঠানিক কৃচ্ছসাধন সনাতনী সমাজের একটি বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। এই কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে সনাতনী সমাজ এগিয়ে যেতে চায় এক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের অভিমুখে। সেই জীবনযাত্রায় তাদের প্রতিভাকে অনুমোদন করা হবে। সাধারণ গ্রাম্য সনাতনী মানুষের আত্মবিকাশের প্রতিটি দাবিকে মেনে নেওয়া হবে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে। মহাদেবের চরণে এই সনাতনী মানুষগুলোর একটি মাত্র হৃদয়ার্তি সঞ্চারিত হয় তা হল দুঃখ দারিদ্রময় জীবন থেকে উত্তরণ এবং সামাজিক স্বীকৃতি। এখানেই তো গাজন স্বার্থক। শহুরে বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে এসব গাজন সন্ন্যাসীদের একমাস ধরে ভয়ানক সংযম পালনের কোনো মূল্য নেই। মূল্য নেই সনাতনী সমাজের প্রকৃত ধারক ও বাহক এই গ্রাম্য মানুষগুলির। তাঁদের কাছে মূল্য কেবল সেইসব মানুষদের যারা সন্ধ্যাবেলা উপবাস ভেঙে দামী দামী খাবার খায় আবার ভোরবেলা উপবাস করার আগে পেটপুরে খায়।
বর্ষশেষে উর্বরতা ও কৃষিক্ষেত্রের মঙ্গল কামনায় গাজন বা পূজা পাঠ করার থেকে শহুরে বুদ্ধিজীবী ধনী সমাজ ভোগবাদী জীবনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রঙিন কাঁচের ভিতর থেকে পৃথিবীটাকে আরো রঙীন দেখে। তবে সমস্ত গ্রাস , সমস্ত অবহেলাকে উপেক্ষা করে আজও বঙ্গের গ্রামের দরিদ্র সনাতনী মানুষগুলি অনাবিল আনন্দে গাজন পর্বে মেতে ওঠেন।
এই জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘গ্রাম্যসাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়”।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. বঙ্গের গাজন উৎসব
২. গাজনের লোকনৃত্য ও গান
৩. শিব পুরাণ
বিঃদ্রঃ ছবি – গ্রামের নাম – ফুলুই (Fului) , সেখানের প্রাচীন শিব মন্দির এবং গাজন উৎসব।
কামারপুকুর থেকে ১২ কিমি আর জয়রামবাটি থেকে ৬ কিমি দূরে। অনেক টা ত্রিভুজের মত গ্রামটি।