বিক্রম সম্বত – একটি বিজ্ঞানসম্মত ভারতীয় কালপঞ্জী : ক্যালেন্ডার-ঔপনিবেশিকতার ফলস্বরূপ খ্রীষ্টিয়করণের এক উপকরণ

আমাদের জন্মদিন , আমাদের প্রত্যেকের কাছে খুব প্রয়োজনীয় এবং তা আমাদের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজ যদি প্রশ্ন করা হয় , আপনার জন্মদিনের যে তারিখ টি আপনি ব্যবহার করেন সেটি কি ঠিক ? সেই তারিখ যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঠিক করা হয় , তার কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে ?
আমরা সাল,তারিখ উল্লেখ করি খ্রীষ্টাব্দ বলে অর্থাৎ যে কোনো ঘটনার তারিখ নির্ধারণ হয় যীশু খ্রীষ্টের জন্মের সময় কে একটি নির্দিষ্ট দিন ধরে নিয়ে।
কিন্তু যীশুর জন্ম দিনটি কি নির্দিষ্ট ? তার কি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে ? যীশুর জন্মদিন ষষ্ঠ শতাব্দীতে ঠিক করা হয়েছে অর্থাৎ তার তথাকথিত জন্মদিনের ছয়শত বছর পরে , যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিশ্বের কাছে এখনো অজানা! ইংরেজি তে সাল উল্লেখ করতে AD বা BC দেওয়া হয় , যেমন 2020 AD । AD অর্থাৎ Anno Domini যার অর্থ Year of Lord। এইভাবে তারিখ লিখে আমরা কি যীশু কে নিজেদের প্রভু বলে স্বীকার করে নিচ্ছি না ?

যারা ‘সেক্যুলারিজম্’ এর প্রবক্তা তাদের কাছে প্রশ্ন তারিখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কেনো কোনো একটি উপাসনা-পদ্ধতি কে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হবে?
ভারতবর্ষের কাল নির্ণয়ের কোনো নিজস্ব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি নেই ?
আসলে , আমরা যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা আমাদের স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিকতা(Colonization) ও খ্রীষ্টিয়করণ এর সবথেকে বড় প্রমাণ । অন্যদিকে ভারতীয় কালগননা পদ্ধতি একইসাথে ভারতবর্ষের প্রাচীন বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতা ও ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইউরোপে স্থানান্তরণ বা আরো স্পষ্ট করে বললে চৌর্যবৃত্তির এক অকাট্য প্রমাণ।
আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে যে ক্যালেন্ডার আছে তাকে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বলা হয় পোপ গ্ৰেগরির এর নামানুসারে।

গ্ৰিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস এর মতে গ্ৰিকরা তাদের ক্যালেন্ডার মিশরীয়দের থেকে অনুকরণ করেছিলো। কিন্তু গ্ৰিক ও রোমানরা উভয়েই সেই নকল করা ক্যালেন্ডার কে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে নি ।কারণ তাদের পাটীগণিতে অজ্ঞানতা।
গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৪৮ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার মিশর দখল করেন এবং মিশরীয় জ্যোতির্বিদ সসিজিনিস(Sosigenes)এর সহায়তায় ৪৬ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে অনেক ধোঁয়াশা নিয়েও ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন।
সংশোধিত ক্যালেন্ডার কে পৃথিবীর জলবিষুব বা মহাবিষুব(equinox)এর সাথে মেলাতে গিয়ে ৪৪৫ দিনের হেরফের হচ্ছিল।
মিশরীয়রা , রোমানদের পাটীগণিত এর অজ্ঞানতা সম্পর্কে জানতো এবং বুঝতে পেরেছিল যে রোমানরা মাসের হিসেব কে চাঁদের বিভিন্ন দশার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারবে না ‌সেইজন্য তারা রোমানদের একটি সহজ ক্যালেন্ডার দিয়েছিল যাতে মাসের সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক ছিল না।সসিজিনিস এর ক্যালেন্ডারের ৭ মাসের দিনসংখ্যা ৩০ ও অন্য ৫ মাসের দিনসংখ্যা ৩১ রাখা হয়েছিল যেখানে প্রত্যেক ৪ বছর পর একটি লিপ ইয়ারের কথা বলা হয়।
রোমানরা এই ক্যালেন্ডারের কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে জুলিয়াস এর নামে এই ক্যালেন্ডারের নামকরণ করে‌ এবং একটি মাসের নাম জুলাই রাখা হয়। কিন্তু তারা সসিজিনিস এর সাধারণ নির্দেশ বুঝতে না পেরে ৩ বছর পর পর লিপ ইয়ার যুক্ত করতে থাকে।
এই ভুল অগাস্টাস(Augustus) এর সময় ঠিক হয় এবং তার জোরাজুরিতে একটি মাসের নাম অগাষ্ট (August) তার নামানুসারে রাখা হয়।
জুলিয়াস কে অনুসরণ করে তিনিও অগাষ্ট এর দিনসংখ্যা ৩১ করে দিলেন।
জুলাই ও অগাষ্ট এর এই অতিরিক্ত দুইদিন ফেব্রুয়ারি থেকে কাটা হলো।রোমান ক্যালেন্ডারে বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা হলো ২৮ , ২৯ ,৩০ এবং ৩১ যার সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক নেই এবং কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই।এর থেকেই কি গ্ৰিক ও রোমানদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে অজ্ঞতা প্রমাণ হয় না ?
কারণ তারা চাঁদের বিভিন্ন দশার হিসেব রাখতেই জানতো না।
এমনকি রোমানরা সূর্যের ঋতুচক্রের হিসেব রাখতেও জানতো না।
চার বছর পর লিপ ইয়ারের হিসেব অনুযায়ী প্রত্যেক বছর হয় ৩৬৫ ১/৪ দিনে।এটা আদৌ ঠিক নয় যদিও এখনো আমাদের এটাই শেখানো হয়।
দুই জলবিষুব(Autumnal equinox , 22-23 September ) বা মহাবিষুব(Vernal equinox,20-21 March) এর মধ্যের সময় কে ট্রপিক্যাল বছর (Tropical year) বলা হয় এবং এর সময়কাল ৩৬৫.২৪২ দিন , ৩৬৫.২৫ দিন নয়।
তাহলে গ্ৰিক ও পরে রোমানরা কেনো এটিকে ভুল করে ৩৬৫.২৫ দিন করলো?
আসলে , রোমানরা ৩৬৫.২৪২ এর মতো একটি সংখ্যা কে লিখতেই জানতো না কারণ তারা ০.২৪২ এর মতো নিখুঁত ভগ্নাংশ লিখতে পারতো না।
রোমানরা কেবলমাত্র ১২ এর ভগ্নাংশ পর্যন্ত লিখতে পারতো যেমন ১/১২ ,২/১২,৩/১২ ইত্যাদি।
সেইজন্য তারা ৩৬৫.২৫ কেই বছরের দিনসংখ্যা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
৪র্থ শতাব্দীতে চার্চ (Nicene Council) ইস্টার(Easter) এর দিন নির্ণয়ের জন্য জুলিয়ান ক্যালেন্ডার কে নিজেদের উপাসনা সম্পর্কিত কাজের জন্য ব্যবহারের স্বীকৃতি দেয়।তখন খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব ছিল ইস্টার।তখন থেকেই মিশরীয়দের থেকে পাওয়া ক্যালেন্ডার , জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে খ্রীষ্টানদের ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।
চার্চের নির্দেশানুযায়ী মহাবিষুব (Vernal equinox) এর পর ; প্রথম পূর্ণিমার(Full moon)পর , প্রথম রবিবার ইস্টার হিসেবে ধার্য করা হলো।
যদি সেইদিন ইহুদীদের উপাসনার অনুষ্ঠান পাসওভার(Passover)এর সঙ্গে মিলে যায় , তাহলে ইস্টার পরের রবিবারে স্থানান্তরিত হবে।
তাই ইস্টারের দিন ধার্য করতে মহাবিষুব ও চাঁদের দশা সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন হয়ে পড়লো।
রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি ১ বছরে মহাবিষুব বা জলবিষুব এর দিন ০.১ দিন করে পিছিয়ে যেতে থাকে অর্থাৎ ১০০ বছরে ১ দিন।
তাই এক শতাব্দীতে ইস্টার ১ দিন করে সরে যেতে লাগলো।
এইজন্যই পোপ হিলারিয়াস ৫ম শতাব্দীতে ক্যালেন্ডার সংশোধনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিফল হলেন।এই বিফলতা জ্যোতির্বিজ্ঞানে(Astronomy) এবং গণিতে রোমানদের অজ্ঞানতাই প্রমাণ করে।
যদি সেইসময় বহু চর্চিত গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর আকর গ্ৰন্থ Almagest (বলা হয়ে থাকে ২য় শতাব্দীতে Claudius Ptolemy দ্বারা রচিত )এর অস্তিত্ব আদৌ থাকতো , তাহলে
৫ম শতাব্দীতে এই ক্যালেন্ডার সংশোধনের কাজে কেনো ব্যবহার করা হয় নি তা একটি বড় প্রশ্ন।তাই গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান(Astronomy) এ দক্ষতার কল্পকাহিনীকে এই ঘটনা মিথ্যা প্রমাণ করে।
অন্যদিকে ভারতবর্ষে যে কোনো ভগ্নাংশ লেখার সঠিক পদ্ধতি ছিল।
ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই ,নক্ষত্র বর্ষ (Sidereal year )এর দিন সংখ্যা সুনির্দিষ্ট ভগ্নাংশের সাহায্যে ৫ম শতাব্দীতে আর্যভটের গিতীকা(Gitika 3) তে উল্লেখ করা হয়েছে।নক্ষত্র বর্ষের(Sidereal Year) এর দিন সংখ্যা আর্যভট বলেছিলেন ৩৬৫.২৫৮৬ ।নক্ষত্র বর্ষের বর্তমানে গৃহীত দিনসংখ্যা ৩৬৫.২৫৬৩।
আর্যভটের গণনা দশমিকের পর দুই ঘর পর্যন্ত সঠিক ছিল।
মনে রাখতে হবে এটি নক্ষত্র বর্ষ ( Sidereal Year) এর দিনসংখ্যা যা ক্রান্তীয় বছর(Tropical year)(৩৬৫.২৫)এর থেকে বেশী।
তাই ক্যালেন্ডার বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করে যে , গ্ৰিক ও রোমানদের তুলনায় ভারতবর্ষ গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে ছিল।
গ্ৰিকদের বিজ্ঞানের কৃতিত্বের সমস্ত গল্প দ্বাদশ শতাব্দীর পরের বিভিন্ন পুঁথির উপর প্রতিষ্ঠিত যা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
পশ্চিম বিশ্বের গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান এর এই অজ্ঞানতা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রুসেড এর পর থেকে তারা অন্যদেশ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে।
ভারতীয় গণিতের জ্ঞান দশম শতাব্দীতে আরবের আল খোয়ারিজ্মি(Khwarizmi) এর অনূদিত হিসাব-এ-হিন্দ্ (Hisab al Hind) এর মাধ্যমে আরবে পৌঁছায়।
পশ্চিম বিশ্ব রোমান অঙ্ক(Numeral) এর পরিবর্তে আরবের মাধ্যমে ভারতীয় অঙ্ক (Arabic numerals ) গ্ৰহণ করে পাটীগণিতে (Arithmetic) নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করে নেয়।
পোপ সিলভেস্টার (Pope Sylvester) ৯৭৬ সালে কর্ডোবা (Cordoba) থেকে ভারতীয় অঙ্ক(Indian Numerals) ইউরোপে নিয়ে গেলেও তার পদ্ধতি বুঝতে পারেন নি।
ফ্লোরেন্সের বণিকরা ভারতের অ্যালগরিদম(Algorithms) বুঝতে পারলেও খ্রীষ্টান জেসুইট দের পাঠক্রমে ব্যবহারিক গণিত ক্লভিয়াস(Clavius) এর মাধ্যমে ১৫৭২ সালের আগে অন্তর্ভুক্ত হয় নি।
এই ক্লভিয়াস ১৫৮২ সালে ক্রান্তীয় বছর( Tropical year) এর দিনসংখ্যা পরিবর্তন করে গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। প্রতি ১০০ বছরে লিপ ইয়ার কে বাতিল করে প্রতি ১০০০ বছরে লিপ ইয়ার করা হয়।তাই এখন ট্রপিক্যাল ইয়ার এর দিনসংখ্যা দাঁড়ালো ৩৬৫.২৫-০.০১+০.০০১=৩৬৫.২৪১।
ক্লভিয়াস কি করে এই সংশোধন করলেন?
এই সংশোধনের জন্যেও ভারতবর্ষ থেকে আমদানি করা জ্ঞানের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়েছিল।
কোনো প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ছাড়া করা গ্ৰেগরিয়ান সংশোধন কে প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী ব্রিটেন (নিউটন সহ) তৎক্ষণাৎ গ্ৰহণ করে নি। নিউটনের মৃত্যুর পর ব্রিটেনে এই ক্যালেন্ডার গৃহীত হয়। অর্থাৎ , ইউরোপিয়ানরা সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বছরের নির্দিষ্ট দিনসংখ্যা জানতোই না।
১৫৮১ সালে ক্লভিয়াস এর ছাত্র ও জেসুইট গুপ্তচর রিসি (Matteo Ricci) ভারতের কোচি তে ভারতবর্ষের কালগণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে ভারতে এসেছিল।রিসি ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের তথ্যগুলি ইউরোপে পাচার করেছিলো।
ক্লভিয়াস ১৬০৮ সালে ত্রিকোণমিতির সারণি প্রকাশ করেছিলেন যা সেইসময় শুধু ভারতবর্ষে গণনা করা হয়েছিলো। ক্লভিয়াস (Clavius) পৃথিবীর সঠিক ব্যাসার্ধ নির্ণয় এর জন্য প্রয়োজনীয় ত্রিকোণমিতি জানতেন না। ইউরোপে সর্বপ্রথম পৃথিবীর সঠিক ব্যাসার্ধ ১৬৭২ সালে পিকার্ড(Picard) পরিমাপ করেন ।

ক্যালেন্ডারের এই সংশোধনের প্রয়োজনীতা সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।নৌযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যাভিগেশন এর জন্য একটি ভালো ক্যালেন্ডারের খুব প্রয়োজন।
দুপুরে সূর্যের আপাত উচ্চতার (Altitude) মাধ্যমে অক্ষাংশ (Latitude) নির্ণয় করতে একটি ভালো ক্যালেন্ডারের দরকার যা থেকে মহাবিষুব এর সঠিক দিন ও মহাবিষুব এর দিন থেকে সূর্যের বিনতি কোণ (Declination) পাওয়া যাবে।
দুপুরে সূর্যের আপাত উচ্চতা, বিনতি কোণ ও স্থানীয় অক্ষাংশের সূত্র প্রথম ভাস্কর তাঁর ‘লঘু ভাস্করা’ (Laghu Bhaskariya) তে দিয়েছেন।

ইউরোপের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হওয়ার স্বপ্ন সঠিক ন্যাভিগেশন এর পদ্ধতি ছাড়া এতদিন অধরাই ছিল। ন্যাভিগেশন এর প্রথম পদক্ষেপ হলো সমুদ্রে অক্ষাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি জানা।
১৭০৭ সালে এক সামুদ্রিক অভিযানে ব্রিটেনের ২০০০ জন নিখোঁজ হয়ে যায়।১৭১৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ন্যাভিগেশন এর সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।
ভাস্কো-দা-গামা(Vasco da Gama) ও কলম্বাস(Columbus) তা জানতো না।ভাস্কো কে একজন ভারতীয় নাবিক কনক(Kanaka) সমুদ্র পথ দেখিয়ে ভারতে এনেছিলেন এবং কলম্বাস ভারতের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা শুরু করে আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল।এই হচ্ছে সেই সময়কার ইউরোপের বিজ্ঞান এর উৎকর্ষতা!

সমুদ্রে সঠিক অক্ষাংশ নির্ণয়ের জন্যই পোপ গ্ৰেগরি ক্যালেন্ডার সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এখনো গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে মহাবিষুব একই দিনে আসে না।

গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সম্পূর্ণভাবে একটি জাতির আবিষ্কার বলে মেনে নেওয়া যায় না কারণ গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার রোমান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তিত ও সংশোধিত রূপ । আবার রোমানরা এই ক্যালেন্ডার গ্ৰীসের থেকে পেয়েছিল যা গ্ৰীসে পৌঁছেছিল মিশরীয়দের থেকে। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ থেকে মিশরে কালগণনা পদ্ধতি পৌঁছেছিল না মিশরে স্বাধীনভাবে এর বিকাশ হয়েছিল তার উত্তর এখনো অধরা।
রোমান ক্যালেন্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য ইউরোপকে ভারতের দিকেই তাকাতে হয়েছিল।আমরা জানি , বর্তমানে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে উন্নত যন্ত্র রপ্তানি করলে সেই যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের প্রযুক্তি বিক্রেতা দেশটির কাছেই থাকে বা ঐ যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের জন্য ক্রেতা দেশটিকে বিক্রেতা দেশের মুখাপেক্ষি হতে হয়।
ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।আর ভারতবর্ষের কালগণনা পদ্ধতির ক্রমান্বয়ে বিকশিত হওয়ার এক নিজস্ব ইতিহাস আছে যা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধীরে ধীরে উন্নত হওয়ার ইতিহাস।
জ্যোতির্বিজ্ঞান এর গণনার প্রয়োজনে গণিতের বিকাশ হতে থাকে।তাই ভারতীয় কাল গণনা পদ্ধতির বিকাশের ইতিহাসের মধ্যেই ভারতীয় গণিতের ইতিহাস পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে বিকশিত এই কালগণনা পদ্ধতিকে তাই সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় বলা যায়।

ভারতবর্ষে কালপঞ্জি ঋকবেদ ও বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এর সময় থেকে অবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।ঋকবেদ থেকে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এবং তার পরবর্তী কালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট, বরাহমিহির,ভাস্করাচার্য্য পর্যন্ত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং কালপঞ্জীর কয়েক হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে সূর্যের উত্তরায়ণ, দক্ষিনায়ণ অবস্থান (১/২০/৬ ও ১/২০/৮) , ছয়টি ঋতুর (১/১৬৪/১৫ ও ১/৯৫/৩) কথা উল্লেখ আছে। ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ঋকগুলি কমপক্ষে ৯০০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের আগে রচিত। কিন্তু ঋকগুলিতে বর্ণিত কাল গণনা পদ্ধতি ঋকগুলির রচনার আরো আগে শুরু হয়েছিল বলাই যায়।
ঋকবেদের চতুর্থ ,ষষ্ঠ ও নবম মন্ডলের বিভিন্ন ঋকে চাঁদের বিভিন্ন দশা ও স্থির নক্ষত্রের স্বাপেক্ষে সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে জানা যায়।
ঋকবেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্ৰন্থ।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় , ভারতবর্ষের কাল গণনা পদ্ধতি বিশ্বের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন।
নতুন ভাবে সংযোজিত বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এর সময়কাল প্রায় ৩৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্ৰন্থ বলে প্রসিদ্ধ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এর আগে রচিত কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞান এর গ্ৰন্থের কথা বিশ্বের কোনো দেশে নেই।

ভারতবর্ষের পঞ্চাঙ্গ(Panchang) একটি Luni-Solar ক্যালেন্ডার যা বছরকে সূর্যের ঋতুচক্র অনুসারে ও মাসকে চাঁদের দশা অনুযায়ী হিসেব করে।
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে , একমাসে ৩০ টি তিথি থাকে এবং সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে কৌণিক ব্যবধান ১২° হতে যে সময় লাগে তাকে এক তিথি বলে।
যদিও তিথি ও বর্তমানে দিনের সময়কাল এক নয়।সূর্যের ঋতুচক্র অনুযায়ী ১ বছর , চাঁদের দশা অনুযায়ী ১২ মাসের থেকে কিছুটা বেশি হয়।তাই আর কিছু অন্তর্বর্তী মাস(Intercalary month) বা অতিরিক্ত মাস এর প্রয়োজন যাকে আমরা ‘মলমাস’ বলে জানি।
আরবীয়রা , ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর নীতি অনুসরণ করলেও তাদের কালপঞ্জি শুধুমাত্র চাঁদের দশার (Lunar Calendar) ওপর নির্ভরশীল। বৌদ্ধদের মাধ্যমে ভারতীয় কালপঞ্জী চীনে পৌঁছায়।ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর কিছু অংশ দ্বাদশ শতাব্দীতে গ্ৰিকদের Almagest এ সংযোজিত হয়। ভারতীয় ক্যালেন্ডার এর নিয়মাবলীর সঙ্গে মিশরীয় ও মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার এর মিল পাওয়া যায়। ভারতীয় কালপঞ্জী অনুযায়ী কলি যুগের সূচনা খ্রীষ্ট-পূর্ব ৩১০২ থেকে আর মায়া ক্যালেন্ডার শুরু হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৩১১২ থেকে।৫০০০ বছরের মধ্যে ১০ বছরের পার্থক্য নগণ্য।তাই বলা যেতেই পারে যে ক্যালেন্ডারের জন্য মায়া ও ভারতীয়রা একই ধরনের মডেল ব্যবহার করতো।
প্রাচীন ভারতের সম্পদশালী হওয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল , এক কৃষি ও অন্য বৈদেশিক বাণিজ্য।
এই দুই ক্ষেত্রেই সফলতার জন্য একটি ভালো কালপঞ্জীর প্রয়োজন ছিল। কৃষিক্ষেত্রে বর্ষাকাল নির্ণয়ের জন্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার উদ্দ্যেশ্য নেভিগেশনের জন্য। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধশালী অতীত প্রমাণ করে যে এইদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া একটি ভালো কালপঞ্জী নির্মাণ করা সম্ভব হতো না আর ভালো কালপঞ্জি ছাড়া কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সফলতা অলীক কল্পনা ছিল। যদিও পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা এই সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োগ কোনোদিন করেননি। তাইতো তাদের লেখায় বিশ্ব ভারতবর্ষের কাছে কতটা ঋণী তা প্রকাশ পায় না।
ভারতবর্ষ অনেক বড় দেশ।তাই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী কালপঞ্জিকা পরিবর্তন করতে হতো আর তাই পৃথিবীর ব্যাসার্ধ জানা আবশ্যক।
আল-বিরুনী ভারতীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেছিলেন। আল বিরুনীর গণনায় ত্রুটির পরিমাণ ছিল ০.২৫% , যেখানে কলম্বাসের গণনায় ত্রুটির পরিমাণ ছিল ৪০%।
আল বিরুণির ভারতবর্ষের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতি আকর্ষণ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘হিন্দু রসায়ন’ বই তে উল্লেখ করেছেন এইভাবে…
“আলবেরুনি ১০১৭ হইতে ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে অবস্থিতি করেন। আল-বেরুনীর প্রভু গজনীর সুলতান মাহমুদ যখন থানেশ্বর , মথুরা কনৌজ ও সোমনাথের মন্দির নির্বিচারে লুণ্ঠন করিয়া ভারতময় বিভীষিকার সঞ্চার করিয়া ফিরিতেছিলেন তখন এই জ্ঞানলিপ্সু মুসলমান ছাত্রটি তাহার হিন্দু অধ্যাপকদের পদতলে বসিয়া সাংখ্য ও পাতঞ্জলের প্রখ্যাত গ্রন্থ পাঠে আত্মহারা হইতেছিলেন।আলবেরুনির মৃত্যুর পর তাঁহার প্রসিদ্ধ পারিবারিক গ্ৰন্থাগার হইতে আলি-বিন-জৈন(Ali-Ibn-Zain) অনূদিত একখন্ড ‘চরকসংহিতা’ পাওয়া যায়।”
কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষ ঔপনিবেশিকতার ফলস্বরূপ যা কিছু ভারতীয় তার প্রতি অবজ্ঞার মনোভাবে ভরে গেল।
স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষ নিজেদের দেশের দিনপঞ্জি পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাথ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল।
তাঁর মতানুযায়ী , কালপঞ্জির ক্ষেত্রে নক্ষত্র বর্ষ (Sidereal Year) কে ব্যবহার করা অপ্রয়োজন।মেঘনাথ সাহা গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ক্রান্তীয় বছর (Tropical year) ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু ,ভারতবর্ষে বর্ষাকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋতু এবং ভারতীয় দিনপঞ্জিতে শ্রাবণ ও ভাদ্র দুটি মাস বর্ষাকালকে নির্দেশ করে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে বর্ষাকালের জন্য কোনো ধারণা নেই। ক্যালেন্ডার সংশোধনী কমিটি পাশ্চাত্যের পদ্ধতিকেই উৎকৃষ্ট মনে করলো।
গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষা , অতিবৃষ্টি এবং খরার পূর্বাভাস প্রায়ই ভুল হতে দেখা যায়।
তাই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনও করছে কি না প্রশ্ন উঠতেই পারে।ভারতীয় কালপঞ্জি বর্ষার সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারবে কি না তা পরের প্রশ্ন কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়াই এটিকে বাতিল করে দেওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
পরাণুকরণের এ এক লজ্জাজনক ও ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত।
বেশিরভাগ মানুষ ভারতীয় কালপঞ্জি অনুযায়ী নিজেদের জন্মদিন বলতে পারবেন না। ভারতীয় উৎসবগুলির বেশিরভাগই যেমন দোলপূর্ণিমা ,বুদ্ধ পূর্ণিমা,মহাবীর জয়ন্তী , দিওয়ালী(অমাবস্যা) চাঁদের দশার উপর নির্ভরশীল যা আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার দেখে বলতে পারবো না। আমাদের ভারতীয় দীনপঞ্জীর উপর নির্ভরশীল হতেই হয় কারণ গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনগুলি স্থির নয়।
খুব দুঃখের বিষয় , আমাদের দুইটি উপাসনা-পদ্ধতি নিরপেক্ষ উৎসব , স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবস যা একটি খ্রীষ্টান আচারের জন্য প্রবর্তিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী স্থির হয়েছে।
গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার একটি অবৈজ্ঞানিক কালপঞ্জি। শুধুমাত্র এই কারণেই এটিকে বাতিল করা উচিত।
কোনো প্রামাণ্য তথ্য ছাড়াই ক্রুসেড-পরবর্তী কল্প-কাহিনীগুলিতে বিজ্ঞানে গ্রিক ও ইউরোপিয়ানদের উৎকর্ষতার যে দাবি করা হয় তা ভারতীয় কালপঞ্জি সমূলে উৎপাটিত করে এবং একইসাথে ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার এক অকাট্য প্রমাণ আমাদের সামনে তুলে ধরে।
ভারতবর্ষে নক্ষত্র বর্ষ(Sidereal Year) ব্যবহার করে বিভিন্ন কালপঞ্জিকার প্রচলন আছে।এর মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে সৌর মাসের উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক কালপঞ্জিকা প্রচলিত।চান্দ্র মাসের উপর ভিত্তি করে দুটি জনপ্রিয় কালপঞ্জিকা হল বিক্রম সম্বত ও শক সম্বত।
বিক্রম সম্বত এর সাল গণনা শুরু হয় উজ্জয়িনীর রাজা চন্দ্রগুপ্তের(যিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেছিলেন) সময় থেকে (৫৭ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দ) আর শক সম্বত এর গণনা শুরু হয় শক রাজত্বের সময় থেকে।

২২ শে মার্চ , ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের নির্দেশে ‘শক-সম্বত'(Saka Sambat) কে ভারতবর্ষের জাতীয় ক্যালেন্ডার হিসেবে স্বীকার করা হয় এবং যে কোনো সরকারি নির্দেশ , পার্লামেন্টের আইন এ গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখের সাথে শক-সম্বত এর তারিখ উল্লেখ করার আদেশ দেওয়া হয়। ভারত সরকারের এই নির্দেশ অনুযায়ী রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI) ১লা জুলাই ,২০১৫ তে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যে , ব্যাঙ্কে টাকার লেনদেনের সময় চেক-বই তে ‘শক-সম্বত’ অনুযায়ী তারিখ দেওয়া যাবে।এই
‘শকসম্বত’ এ প্রতিমাসের দিনসংখ্যা গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে ৩০ বা ৩১ করা হয়েছে আর প্রত্যেক লিপ ইয়ারে চৈত্র মাসের ৩০ দিনের সঙ্গে অতিরিক্ত ১ দিন যুক্ত করা হয়েছে। ভারতবর্ষের জাতীয় ক্যালেন্ডার ‘শকসম্বত’ এর প্রতি মাসের দিনসংখ্যার সঙ্গে চাঁদের দশার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত ‘শকসম্বত’ এ ভারতীয়ত্বের ছোঁয়া নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে বিক্রম সম্বত এর প্রতি মাসের দিনসংখ্যা চাঁদের দশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা ভারতবর্ষের প্রাচীন পদ্ধতি।আর বিক্রম সম্বত অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন চৌত্র শুক্ল প্রতিপদের সঙ্গে বিক্রমাদিত্যের রাজ্যভিষেক, শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যভিষেক এর মত ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জড়িয়ে আছে।

আমাদের যদি বেশ কিছুদিন একটি নির্জন দ্বীপে রেখে দেওয়া হয় তাহলে আমরা বর্তমানে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রচলিত সাল তারিখ ভুলে যাব আর একবার ভুলে গেলে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সঠিক দিন নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের রীতি অনুযায়ী যে পঞ্চাঙ্গের (পাঁচটি অঙ্গ-তিথি , নক্ষত্র ,বার ,যোগ , কারণ) সাহায্যে কালনির্ণয় করা হয় সেই পদ্ধতিতে সূর্য , চন্দ্র ও নক্ষত্রের অবস্হান জেনে কাল নির্ণয় সহজেই করা যাবে।এই থেকেই প্রমাণিত সূর্য-চন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক গতি ও নক্ষত্রের অবস্হান কে কাজে লাগিয়ে নির্মিত কাল গণনা পদ্ধতি বর্তমানে প্রচলিত ক্যালেন্ডারের থেকে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক।
শুধু তাই নয় , অতীতকালের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সময় সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও বিভিন্ন গ্ৰহের অবস্থান থেকে ঐ ঐতিহাসিক ঘটনা টি বর্তমান সময়ের থেকে কতদিন আগে ঘটেছিল তাও নির্ণয় করা সম্ভব।তাই ভারতীয় কাল গণনা পদ্ধতি ভারতীয় সংস্কৃতির মতোই সনাতন ।
বর্তমানে প্রচলিত গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার প্রমাণ করে যে , উৎকৃষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সারা বিশ্ব তখনই মান্যতা দেয় যখন সেই পদ্ধতির জন্মদাতা সংস্কৃতি সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নতুবা বিজয়ীর পদ্ধতিকেই বিজিত জাতি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষার বিরোধ’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য
“গ্রীস একদিন পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার লুটে নিয়ে গিয়েছিল, রোমও তাই করেছিল। আফগানেরাও বড় কম করেনি,—কিন্তু সেটা সত্যের জোরেও নয়, সত্য হয়েও থাকেনি। দুর্যোধন একদিন শকুনির বিদ্যার জোরে জয়ী হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দীর্ঘকাল ধরে বনে-জঙ্গলে উপবাস করতে বাধ্য করেছিল, সেদিন দুর্যোধনের পাত্র ছাপিয়ে গিয়েছিল, তার ভোগের অন্নে কোথাও একটি তিলও কম পড়েনি, কিন্তু তাকেই সত্য বলে মেনে নিলে যুধিষ্ঠিরকে ফিরে এসে সারা জীবন কেবল পাশাখেলা শিখেই কাটাতে হোতো। সুতরাং সংসারে জয় করা বা পরের কেড়ে নেওয়ার বিদ্যাটাকেই একমাত্র সত্য ভেবে লুব্ধ হয়ে ওঠাই মানুষের বড় সার্থকতা নয়।”
এখন , আমাদের সামনে প্রশ্ন আমরা ঔপনিবেশিকতার প্রতীক , খ্রিষ্টানদের আচার অনুযায়ী তৈরি করা , অবৈজ্ঞানিক গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার কে নিজেদের জীবনের অঙ্গ করবো , না ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতার প্রতীক উপাসনা-পদ্ধতি নিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত ভারতবর্ষের নিজস্ব কালপঞ্জি বিক্রম সম্বত(Vikram Sambat) কে অগ্ৰাধিকার দিয়ে বিশ্বের সামনে এক গর্বিত ভারতবাসী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো ?

পিন্টু সান্যাল
লেখক একটি বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.