তখনও স্কুলে ভর্তি হই নি। ‘খাপছাড়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি রাবীন্দ্রিক ছড়া মুখস্থ করেছিলাম, ‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি’, সেখানেই প্রথম পেলাম করমচার কথা।
“চিনেবাজারের থেকে
এনো তো করমচা,
কাঁকড়ার ডিম চাই,
চাই যে গরম চা”।
করমচা চিনতে হবে। মা নিয়ে গেলেন রহড়া, মিশনপাড়ায় পাশের বাড়ি; তাদের উঠোনে একটি করমচার গুল্মে অফুরান ফুল ফুটে আছে। ফুল দেখেই মন ভরে গেলো। এ তো ফুলগাছ বলেই চালানো যায়! গোলাপী বোঁটায় ছোটো ছোটো লম্বাটে সাদা ফুল; ডালগুলির আগায় ডিম্বাকার পাতার কোলে কোলে অপূর্ব সুন্দর থোকা। মা বললেন, সবুর করো, ফল হবে। রোজ রোজ যাই। সেই গাছটিতে তারপর থোকায় থোকায় সাদা ধবধবে গুটি এলো। সবুর সয় না মোটে; একটু বড় হতেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই, ফল ছিঁড়তেই সাদা কষে ছোট্ট আঙুল জড়িয়ে গেলো। তারপর ফল পাকলো, টসটসে লাল তার গা। ‘বেরি’ টাইপের এই ফল, আকারে খানিকটা আয়তাকার (Oblong), প্রশস্ত-ডিম্বাকার (Broad-ovoid) অথবা খানিকটা গোলাকার। টকমিষ্টি এর স্বাদ।
এরপর পানশিলায় আর একটি বাড়ির উঠোনে অন্য জাতের করমচা গাছ দেখলাম। এর ফলগুলি প্রথম থেকেই গোলাপী সাদা; পাকা ফলগুলি লাল, গাঢ় বেগুনি। যে বাড়ির করমচা গাছ, সেই বাড়ির ঠাকুমা সুর করে করে শোনালেন “করমচা রাঙা ঠোঁট দুইখান মুক্তা-পাতি দাঁত,/হাসলে গালে টোল খায়, শঙ্খের মতন হাত।/পানপাত্তি বদন হের ধনুক ব্যাঁকা ভুরু,/তিল ফুলের মতন নাক মোমের নাগান ঊরু।” রসিক ঠাকুমা বলছেন, যৌবনে তারও নাকি এমন রূপ ছিল, তখন তাকে দেখলে নাকি আমার বিয়ে না করে উপায় ছিল না। ছোট্ট ‘আমি’-কে যে কেউ বিয়ে করতে চায়, সেই প্রথম বুঝলুম। এরপর রহড়া পশ্চিমপাড়ায় মুকুল ব্যানার্জীদের বাড়ির প্রাচীরে আরও একটি করমচার জাত দেখলাম। তার সবুজ লম্বাটে ফল, তাতে সামান্য বেগুনি আভা; পাকলে বেগুণী রঙে তুলতুলে গা। প্রাচীরে উঠে কত যে পেরেছি!
বাসাবাড়িতে পড়ার জায়গায় একটি কাঁচের দোয়াতে জল রেখে দিতাম। কতদিন যে করমচার পাতা-সুদ্ধ ফুল সেখানে রেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। বাজার যখন করতে শিখলাম পাকা করমচা কিনে আনলে মা চাটনি করে দিতেন। মা বলতেন, গ্রামে পোয়াতি নারীকে করমচার চাটনি দেওয়া হত, এতে ভালোমাত্রায় লৌহ উপাদান আছে। রাজশাহীর বাড়িতে পাকা করমচার বীজ ফেলে চ্যাপ্টা করে কাঠিতে গেঁথে তা রোদে শুকিয়ে রাখা হত। পরে জেনেছি কেবল লোহা নয়, তামা, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানীজের মতো খনিজ লবণ আর ভিটামিন-সি এর আধার করমচা। পাড়ার মণিদার মা বলতেন বাতের ব্যাথায় নাকি পাকা ফল খাওয়া উপকার, সরষের তেলে খানিকটা ভেজে পাকা ফলের মালিশ বাতের ব্যথা দূর করে। তাঁর ছিল Rheumatoid arthristis. জ্বরের পর মুখে অরুচি হলে করমচার আচার খাওয়ার চল এখনও গ্রামাঞ্চলে আছে। করমচার চাটনি হজমশক্তি বাড়ায়। পাইলসের সমস্যা দূর করতে খাবারের মধ্যে করমচার পদ একটি ভালো পথ্য। আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গৌণ ফলের বাগান যখন রচনা করি, তারমধ্যে করমচার গাছ লাগাতে ভুলিনি। নানান জায়গা থেকে কতগুলো করমচার টাইপ এনেছিলাম। এটি খরা সহনশীল শক্তপোক্ত গুল্ম, মাটির নানান বৈচিত্র্যের মধ্যেও জন্মাতে সক্ষম।
ইংরেজিতে করমচার নাম Christ’s thorn, Carandas plum, Karanda. এটি কাঁটাঝোপ গোছের গুল্ম। উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Carissa carandas . Apocynaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই গাছ। এর আদিনিবাস ভারত-বার্মা-শ্রীলঙ্কার রুখাশুখা এলাকা। বারুইপুরের অনেক পেয়ারা বাগানের চারপাশে করমচার ঘন বেড়া দেখেছি। এর থেকে অতিরিক্ত আয় করেন তারা, বেড়াও দুর্ভেদ্য হয়। ফলের দোকানে চেরী বলে যা বিক্রি হয় রাজ্যে, তা আদতে বীজ ফেলে দেওয়া করমচার ক্যান্ডি, তাতে কৃত্রিম রঙ মেশানো। করমচা চাষ করে তার পোক্ত ফল চিনির ঘন সিরাপে রাখা যেতে পারে। করমচার চাটনি আর আচার তৈরি হয় সিউড়ি, রামপুরহাটের অনেক কুটির শিল্পালয়ে৷ পাকা করমচা থেতলে, বীজ ফেলে শুকিয়ে মালা করে রাখাও চলে। এরমধ্যে প্রচুর আয়রন (প্রায় ৪০ শতাংশ) থাকে। করমচার চারা তৈরি করা সহজ। বর্ষাকালে ভেজা বালিতে তার কাটিং বসালেই শেকড় গজায়, রুট হর্মোন দিলে আরও ভালো। এছাড়া গুটিকলম করে গাছেই শেকড় গজিয়ে নেওয়া যায়। পরে মা গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেই আলাদা চারা প্রস্তুত হয়ে যায়।
কল্যাণ চক্রবর্তী