সামগ্রিক দিক থেকে নির্বাচনী সমীক্ষায় যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তাতে অনুমান করা যায় যে এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র সরকার হওয়াটা একপ্রকার নিশ্চিত

পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সমস্যা দেখা দিয়েছে দু’দিক থেকে। একদিকে বিজেপি’র দিকে হিন্দু ভোট কনসোলিডেট করছে আর অন্য দিকে মুসলিম ভোটের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। ত্রিশ শতাংশ মুসলিম ভোট আর পনেরো শতাংশ হিন্দু ভোট পেলেই মমতার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার ফর্মুলায় এখন বড়সড় ছেদ দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ দু’দিক থেকেই তিনি মার খেয়েছেন। এছাড়া অন্য একটি দিক থেকে তিনি আক্রান্ত হয়ে ওনার আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নকে দিবাস্বপ্নে পরিণত করেছে। এই তৃতীয় দিকটি হলো ছাপ্পাভোট দিতে না পারা। এই কারণেই ম্যাডামের সবচেয়ে বড় আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। তিনি এও বলেছেন যে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শা’র অধীনে কাজ করছে এবং ওনাকে নির্বাচনে পরাজিত করার ফন্দি আঁটছে। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এটাও জানেন না যে নির্বাচনের সময়ে যে সিআরপিএফ জোয়ানদের নিয়োগ করা হয় তারা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থেকে কাজে করেন। তাদের দায়দায়িত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যে এটা জানেন না তা তৃণমূলের লজ্জা। আবার যদি তিনি জেনেও মিথ্যাচারে লিপ্ত হোন তাহলেও তা লজ্জার বিষয়।

বাংলার ফুরফুরা শরীফ মূলত একটা সুফি মুসলমানদের ধর্মীয় স্থল। সুফি সন্ত হজরত আবু বকর সিদ্দিকি’র নামে যে ফুরফুরা শরিফ রয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর সাবডিভিশনের অন্তর্গত। এই ধর্মস্থলটি কলকাতা থাকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে। ২০১১ সাল থেকে এই ফুরফুরা শরীফ তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। তাই বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির জয়লাভে এই ফুরফুরা শরীফ বড়সড় ভূমিকা নিয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের অন্তত ১১০টি নির্বাচন কেন্দ্রে মুসলিম ভোটাররা যদি একত্রিত ভাবে কোন দলকে সমর্থন করেন তাহলে সেই দল নির্বাচনে অনেকটাই এগিয়ে থাকে। কিন্তু এবারে এই ফুরফুরা শরীফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি যেভাবে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন এতে তার দল নির্বাচনে কতটা আসন পাবে তা বলা মুস্কিল কিন্তু তৃণমূল প্রার্থীদের জয়লাভে বড়সড় ছেদ করে দেবে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে আসাউওদ্দিন ওয়েসি তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন এবং কিছু আসনে নিজের দলের প্রার্থী দিচ্ছে। তাই উত্তর-দক্ষিণ উভয় দিকেই মুসলমান ভোটারদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেওয়ায় মমতা ব্যানার্জি যে অনেক আসনেই জয়লাভ করতে পারবেন না এটা এক প্রকার নিশ্চিত।

২০১১ সালের জনগণনায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনসংখ্যা দেখা গিয়েছিল ২৭ শতাংশ। ২০১১ সালে এখনও জনগণনার কাজ শুরু হয় নি তবে অনেকেই অনুমান করছেন মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি হবে। এই ৩০ শতাংশ ভোট যাতে কোন ভাবেই বিভাজন না হয় তার জন্য মমতা অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। নমাজ পড়ার ছবি তোলে প্রচার করা। উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া। ভারত যখন পাকিস্তানের জঙ্গিদের ওপর বিমান হামলা চালায় তখন এর সমালোচনা করা, বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু ও বৌদ্ধদের এদেশে আশ্রয় না দেওয়া, ইত্যাদি। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে ভারতের মুসলমানরা কিন্তু বলেন না যে তারা ভারতে থেকেও পাকিস্তানের সমর্থক। এই কথা প্রচার করেন এদেশের সেকুলাররা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একবার বলেছিলেন যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারেন না কারণ এতে করে ভারতের মুসলমানরা খারাপ পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ ভারতের মুসলমানরা এদেশের গদ্দার এটা সেকুলাররাই প্রচার করেন বেশি। বাংলার মুসলমানরা বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা বেশি পছন্দ করেন এটা ভাবে সেকুলার ছাপ তৃণমূল দল। অথচ বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করে বাংলাদেশ হয়েছিল। ইসলামের জন্য লড়াই করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হয় নি। ফুরফুরা শরীফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির হাতে যে প্ল্যাকার্ড থাকে তা বাংলাতেই লেখা থাকে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে অনেক জায়গায় সরকারি সাইনবোর্ড উর্দুতে লেখা হয়েছে মুসলিম ভোটের তাগিতে। সত্যি বলতে কী আমি পিরজাদার ভাষণ শুনেছি। তিনি অনেক ক্ষেত্রে সত্যি কথাই বলেছেন। মমতা ব্যানার্জির এই মুসলিম তোষণে মুসলিম সমাজের লাভের লাভ তো কিছুই হয় নি বরং ক্ষতি হয়েছে অনেক। এছাড়া সুফি সম্প্রদায়ের মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় রিফর্মেশন হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। বাংলার বাউল সঙ্গীত কিংবা সহজিয়া সম্প্রদায় অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন এই সুফি সম্প্রদায়ের দ্বারাই। আমি নিজেও সুফি সঙ্গীত শুনতে ভালোবাসি। শিলঙে আমাদের পাড়ার কাছেই ছিল একজন সুফি পীরের দরগা। সেখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই গিয়ে মোমবাতি চড়াতেন। মুসলিম সমাজে সুফি কিংবা আহমেদীয়া সম্প্রদায় এতটা কট্টরপন্থী নন। ব্যাঙ্গালোরে আমার ভাড়াবাড়ির কাছেই থাকেন এক আহমেদীয়া পরিবার। তারা আবার শিবের ভক্ত।

এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে হিন্দু ভোট পুরোটাই যে বিজেপি পাবে তা যেমন সত্যি নয় তেমনি মুসলিম ভোট পুরোটাই তৃণমূল পাবে এটাও সত্যি নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে মুসলিম ভোটের বড়জোর ৫০-৫৫ শতাংশ ভোট তৃণমূল পেতে পারে এবং বাকিটা বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভাজন হয়ে যাবে। এর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ ভোট বিজেপি পাবে। অন্যদিকে হিন্দু ভোটের মধ্যেও বিভাজন তো হবেই। তবে অধিকাংশ হিন্দু ভোট বিজেপি’র দিকেই যাবে। হিন্দুদের মধ্যে মতুয়া, রাজবংশী কিংবা অন্যান্য অনুসূচিত জাতির ভোট বর্তমানে বিজেপি’র দিকে ঝুঁকেছে ঠিকই তবে এদের ৭৫ শতাংশ ভোট বিজেপি পেতে পারে। বাকি ২৫ শতাংশের মধ্যে তৃণমূলও পাবে অনেকটা। তাই ধর্মের নামে তৃণমূল ও বিজেপি যতটা মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়েছে তার পুরোটাই সফল হবে বলে কেউ যদি মনে করেন তাহলে তা সত্যি হবে না বলেই আমার মনে হয়। নির্বাচনে অন্যান্য ফ্যাক্টর অবশ্যই কাজ করবে।

পরিশেষে যা বলতে চাই সেটা হলো যে তৃণমূলের একটা সুবিধে হলো এই দলের মধ্যে অন্তত একজন মুখ্যমন্ত্রী চেহারা দেখা যাচ্ছে যা বিজেপি দলের মধ্যে নেই। তাই বিজেপি জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এতে করে নির্বাচনী প্রচারে দিদি বনাম মোদী হয়ে যাওয়াতে বিজেপি’র লাভ হয়েছে। কারণ মোদীকে যে অনেক মানুষই ঈশ্বরতুল্য বলে জ্ঞান করেন এই কথা স্বয়ং প্রশান্ত কিশোরের অডিও টেপে ধরা পড়েছে। মমতা ব্যানার্জির এই ভাবমূর্তি নেই। তাই দিদি বনাম মোদী’র প্রচারে বিজেপি যতটা লাভবান হবে তৃণমূল ততটা লাভবান হবে না। আর এই কারণেই বিজেপি নির্বাচনের আগে পার্টির মুখ্যমন্ত্রীর চেহারা জনসমক্ষে নিয়ে আসেনি একটি নির্বাচনী কৌশল হিসেবে। এর আগে উত্তর প্রদেশেও বিজেপি জয়লাভ করেছে কোন মুখ্যমন্ত্রী চেহারা ছাড়াই। নির্বাচনের সময়ে যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে দেখানো হয় নি। তাই সামগ্রিক দিক থেকে নির্বাচনী সমীক্ষায় যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তাতে অনুমান করা যায় যে এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র সরকার হওয়াটা একপ্রকার নিশ্চিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.