কল্যাণ চক্রবর্তী।
রহড়ায় যে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম সেখানে একটি বড়সড় জামরুল গাছ ছিল। গাছটি বাথরুম আর নর্দমার কাছাকাছি থাকায় অনেক জামরুল পড়ে নষ্ট হত। গাছে উঠে পাড়তাম, অনেকেই পাড়তেন, তবুও যেন ফুরতো না। গরমের দিনে গাছে এক সঙ্গেই পাকা ফল, ফোটা ফুল আর ফুলের কুঁড়ি দেখা যেতো। জামরুলের ফুলগুলি দেখতে অসাধারণ, রয়েছে মিষ্টি গন্ধও। শীত ফুরোলেই মুকুল বের হতো। বের হতো হালকা সবুজ পাতা। বসন্ত সমাগমে নবপত্রিকার গন্ধ নিতে ভুলতাম না। জামরুলের গন্ধই তার মধ্যে। বেশ বড়সড় পাতা, মনে হয় বোঁটা বিহীন। কুঁড়ি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে — যেমন ম-ম তার গন্ধ, তেমনই অসংখ্য অলির নিত্য আনাগোনা। কখনও জামরুল গুঁড়িতে অজস্র শুঁয়োপোকার গুচ্ছ। এই পোকা প্রথমে যূথবদ্ধ থাকলেও পরে ছড়িয়ে পড়ে, পাতা আর ছাল খেতে শুরু করে এরা। বাড়িওয়ালা কাকু তার আগেই কেরোসিন মশাল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন পোকার গোছ।
দেখতে দেখতে ফল বড় হয়। জৈষ্ঠ্যমাসে এক থোকা জামরুল, বুনো খেজুর, করমচা, পাকা আম, কাঁচা-পাকা জামের গোছা আর বাঁশপাতার কোরকের ডালি সাজিয়ে মা ষষ্ঠীতলায় যান। আমি তখন নিজে পেড়ে দিই জামরুলের থোকাখানা। জাম আর খেজুরের থোকা পেড়ে দেয় পাড়ার সুধীর নামে ছেলেটি। মণিদার বাড়ির কাজের মেয়ে অষ্টমী এনে দেয় একটি করমচার গুছি। ডালিতে জামরুলের শোভা সবচাইতে নজর কাড়ে। নিষ্কলুষ ধবধবে সাদা ফল, একগুচ্ছ ঘন্টার মতো মনে হয়। গাছ ভর্তি ফলগুলিকে কে যেন সবুজ সামিয়ানার মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ মুক্তোর মতো ঝুলিয়ে দিয়েছে! পড়ন্ত সূর্য শেষ আলো দিয়ে যায় তারই মাথায়। সবুজে সাদায় এক অপরূপ সৌন্দর্যে সেজেছে পুরো বাড়িখানা। উঠোনে চেয়ার টেবিল নিয়ে আঁকতে বসি, আর দেখি গাছের মাথা, সেখানে নানান পাখির আনাগোনা। অতঃপর অন্ধকার নামে; পাতাগুলি যদিবা কালচে হয়, সাদা ঘন্টায় মুক্তোশুভ্র হাসি তবু অমলিন। মা শাঁখ বাজিয়ে সন্ধ্যাবাতি দিলে সম্বিত ফেরে। মনে হয় জামরুলের অসংখ্য ফল একত্রে সন্ধ্যারতির নীরব ঘন্টাধ্বনি করে চলেছে। কখনও প্রকৃতি পাঠে মোহিত হয়ে বাবাকে বলি। বাবা কোনো বই থেকে তুলে ধরেন আমারই মনের কথা। একদিন সন্ধ্যায় লাইব্রেরি থেকে একটি বই এনে পড়ালেন। বইয়ের নাম ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’, লেখক রানী চন্দ। তাতে লেখা আছে, “এই বন-বাগানের পথের ধারে আছে একটা বিরাট জামরুল গাছ। জামরুলের দিনে থোকা থোকা সাদা জামরুল ধরে থাকে গাছ ভরে। রাত্রে বাদুড়ে খাওয়া জামরুলে ছেয়ে থাকে তলা। আমরা পেড়ে খাই, পাড়ার ছেলেমেয়েরা পাড়ে, বড়োরা ধামা ভরে পেড়ে নিয়ে যান। এত জামরুল রোজ যায় গাছ থেকে তবু মনে হয় এ যেন আর ফুরোবে না কোনোদিন।”
ইংরেজিতে জামরুলের নাম Bell fruit. তৃষ্ণার্ত মুখে জলে ভরে দেয় এর ফল, তাই এর আরেক নাম Water apple. মিরটেসী পরিবারের এই গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Syzygium samarangense . জাম পরিবারের এই ফলটিকে অনেকে ‘সাদাজাম’ বলে ডাকেন। তবে সাদা ছাড়াও সবুজ, লাল, গোলাপি, নানান রঙের ফল চোখে পড়ে। বাণিজ্যিক ভাবে আজকাল এই ফলের চাষ হয়। কলমের চারা তৈরি করে নিতে হবে ভালো জাতের গাছে, কঠিন নয় সে কাজ। বর্ষায় গুটিকলমে শেকড় গজায়। ঘনভাবে লাগিয়ে এবং গাছগুলিকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় ডালপালা ছেঁটে বেঁধে দিয়ে ফলন বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত পুষ্টির যোগান দিতে হবে। অসময়ে ফলনদায়ী জাত থেকে লাভ বেশি পাওয়া যায়। বাজারে এর ফল ভালোদামে বিকোয়।