মায়ের জেঠিমা, মানে আমার দিদিমাকে বলতে শুনেছি এই কথা, “এক জাইত্যা নারী হায়রে পাড়ায় পাড়ায় যায়,/এর কথা তারে কইয়্যা গুয়া তাম্বুল খায়।” পাড়ার পাড়ায় মাসিপিসিদের জোর আড্ডা বসতো সেকালে। পরনিন্দা পরচর্চার শুরুতে আর শেষে তাম্বুল-সেবনের আয়োজন থাকতো। যিনি বাটাভরা পান রোজ রোজ বিলোতে পারতেন তিনিই হতেন মহিলা মহলের নেত্রী। কিছু কুচুটে মহিলা পাড়া বেড়িয়ে এর-ওর গোপন সংবাদ এনে জড়ো করতেন। আর তা নিয়েই চলতো অলিখিত প্রমীলা-সংসদ। গুয়া তাম্বুল মানে হল সুপারি আর পান। সেই দিদিমা নিঃসন্তান বাল্য বিধবা ছিলেন। তিনি মাঝেসাঝে পান খেতেন, কিন্তু পানের আড্ডা কখনো বসান নি, আর্থিক সংগতিও ছিল না। এই দিদিমার মুখের চিবুনো পান আমার না খেলেই চলতো না। একদিন আদিত্য বাবু (রহড়ার খ্যাতনামা ডাক্তার আদিত্য চক্রবর্তী) অসুস্থ দিদিমাকে বাড়িতে দেখতে এলেন। সেদিনও দিদার মুকসী-পানে আমার ঠোঁট রাঙিয়ে আছে। ডাক্তারবাবুর চোখে পড়ে গেলো। আমায় দিলেন এক ধমক। মা আমার পক্ষ তো নিলেনই না, উল্টে অভিযোগ করলেন, “ছেলে চিবুনো পান মুখে নেয়। বারণ করলে শোনে না” আদিত্য বাবু বলছেন, “ছিঃ ছিঃ, মুখে কতরকমের জীবাণু থাকে, তারমধ্যে তোমার দিদা এখন অসুস্থ! এইরকম এঁটো জিনিস মুখে তুললে জীবাণু সংক্রমণ হবে যে! আর বাচ্চা ছেলে তুমি, দাঁত নষ্ট হবে।” তারপর থেকে দিদা আর পান দেন নি আমায়। মাকেও তেমন পান মুখে দিতে দেখিনি। তার অন্য কারণ ছিল, পানের বাটায় যে অতিরিক্ত খরচ, পারিবারিক স্বচ্ছলতার অভাবে তার যোগান সম্ভব হতো না। তবে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজার জন্য বাড়িতে পান আসতো। ওই প্রসাদী পান মা মুখে নিতেন সুপারি দিয়ে।

পাশের ভাড়াটিয়া দিদা (মায়া পিসির মা) শ্রাবণ মাসে পদ্মপুরাণ পাঠ করতেন। তাঁর পানের নেশা, পানের সুখ্যাতি তাঁর মুখ থেকে কম শুনতাম না। পানের যত ভালো গুণ নিয়ে তাঁর চর্চা। পারিবারিক টোটকা চিকিৎসায় তিনি পানের রকমারি ভেষজ ব্যবহার করতেন। পদ্মপুরাণ ঘেঁটে তিনি একদিন আমায় বললেন, বাংলার পান দূর সমুদ্র দেশে গিয়ে জনপ্রিয় করেছেন চাঁদ সওদাগর। সেইসব অসভ্য দেশে গিয়ে চাঁদ সওদাগর দেখলেন, “কোনো পুরুষেও তারা পান নাহি খায়।/মুখের দুর্গন্ধে কাছে রহন না যায়।” মায়া পিসির মায়ের সাফ কথা — মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে চাইলে দুইবেলা খাবার পর দু’টো পান খেতেই হবে।

কয়েক দশক আগে রহড়ায় বাড়িতে বাড়িতে তখন পিত্তল নির্মিত পানের ডিবা দেখতে পাওয়া যেতে। যারা নিয়মিত পান খেতেন তাদের ‘মিঠাপাতি’ পছন্দের নয়; ছোটোদের মুখে যেই পান ঝাল লাগে — বাংলা পাতা, সাঁচিপান — তেমন পানই তারা ডিবায় ধুয়ে মুছে লাল শালুতে যত্ন করে জড়িয়ে রাখতেন। বাজার থেকে প্রায় রোজই তাদের পান আসে, নইলে গিন্নীর মেজাজ তক্ষুনি তিরিক্কি হয়ে যায়। চিনামাটির পাত্রে রাখা থাকে চুন, তার মধ্যে একটি ছোটো কাঠি। লোহার যাঁতি রেডিই থাকে, শুকনো গোটা সুপারি পান সাঁজায় কেটে নেওয়ার জন্য। চিনামাটির পৃথক ছোটো পাত্রে খয়ের ভেজানো থাকে। কেউ কেউ ভাজা মৌরী, ধোনের চাল রেখে দেন চমনের খালি-কৌটোয়। পান বিলাসীরা মিষ্টি কুমড়োর বীজ খোসা ছাড়িয়ে রেখে দেন; রাখেন যষ্টিমধুর টুকরো, পানে মিষ্টতা এনে দেবার জন্য।

বাংলায় পানের চাষ বড় পুরোনো। খনার বচনে পান চাষের অনেক কথা আছে। “ষোলো চাষে মূলা/তার অর্ধেক তুলা/তার অর্ধেক ধান/বিনা চাষে পান।” বলদে লাঙল জুড়ে চাষ না করে, বরোজের ভেতর কোদলে জমি কুপিয়ে পানের কাটা-কলম সারিতে বসানো হয়। আরও আছে বচন — “খনা ডেকে বলে যান, রোদে ধান, ছায়ায় পান।” “পান পোঁত শ্রাবণে/খেয়ে না ফুরায় রাবণে।” “এক আঘনে ধান, তিন শাওনে পান” ইত্যাদি। পান চাষের জন্য ‘বরোজ’ বানাতে হয়। বাঁশ, পাটকাঠি, খড়, হোগলা, বড় ঘাস দিয়ে তৈরি হয় বরোজের কাঠামো, যেন আংশিক ছায়াচ্ছন্ন, হাওয়া খোলা একটি বৃহৎ ঘর, মাথার উচ্চতা ২ মিটার। এর মধ্যে দশ বছর ধরে পান চাষ করতে হবে, এমন ব্যবস্থা থাকা চাই। বরোজে বেশি ছায়া হলে রোগপোকা বাড়ে, কম হলে পান ঝলসে কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায়।

একসময়ে বঙ্গদেশে যারা পান চাষ করতেন, তাদের ‘তাম্বুলী’ বা ‘বারুজীবী’ সম্প্রদায় বলা হত। তাদের কাছে নিজস্ব বরোজখানা যেন ‘লক্ষ্মীঘর’। পরিচ্ছন্ন, শুদ্ধ পোষাকে বরোজে ঢোকার দিকে তাদের সদাসর্বদা নজর। নিয়মিত গোবরের ঘোটা-জলে বরোজ সিঞ্চন করেন তারা। ধূপধূনো দিয়ে রীতিমতো পূজা করেন বারুজীবী-গৃহিণী। এটাই তাদের আয়ের অন্যতম উৎস, পানচাষেই তাদের লক্ষ্মীর ভান্ডার পূর্ণ হয়। কালীপুজোয়, বাসন্তীপুজোয় তারা বরোজপুজো করে থাকেন বিশুদ্ধাচারে। ভারতবর্ষ বিশ্বের বাজারে উৎকৃষ্ট পান রপ্তানি করে বহু বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি করে। ভারতের পান মূলত কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, ইতালি, বাহারিন, কুয়েত, সৌদি আরব, পাকিস্তান, হংকং, নেপালে যায়। বিশ্বের পাঁচ কোটি মানুষের কাছে ভারতীয় পানের চাহিদা। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে পানের চাষ হয়।

পান-সুপারি সুখ ও সোহাগের প্রতীক। পান-সুপারি দিয়ে প্রেম নিবেদনের প্রথা রয়েছে। পানের আকৃতি হৃদয়ের মতোই, খোসা ছাড়ানো সুপুরিও তাই। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’এ শ্রীকৃষ্ণের প্রেম-নিবেদনের খণ্ডটি ‘তাম্বুল খণ্ড’ নামে পরিচিত। পান ছুঁড়ে প্রেম নিবেদনের প্রথা মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল। পান দিয়ে বিয়ের কনে মুখ ঢাকে। ভালোবাসার প্রতীক পান। তেমন স্নেহের প্রতীকও পান। গুরুজনকে প্রণাম করলে পানপাতা নিয়ে আদর করেন স্নেহের মানুষকে — বিবাহ অনুষ্ঠানে, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায়। দেবতাকে বরণ করা হয় পানপাতার স্পর্শ গালে লাগিয়ে। দেবতার নৈবেদ্যে পান, মোকাম সাজানোয় পান, পুরোহিতের সিধেতে পান, বিবাহের গাঁটছড়ায় পান; পান বাংলার লোকসংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। পান গোলমরিচ গোত্রের (Piperaceae) একটি গাছ, এর উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Piper betle. মালয়েশিয়া পানের আদি বাসভূমি। পান বহুবর্ষজীবী বীরুৎ, মূলারোহী রোহিণী এবং ভিন্নবাসী উদ্ভিদ। পানের বৈদিক নাম ‘সপ্তশিরা’। অথর্ব বেদে পানের পরিচয় আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের গভীরতাকে প্রকাশ করে।

কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.