কেন মীনাক্ষীরা হারবেন।
মীনাক্ষী মুখার্জি ইদানিং এক বহুচর্চিত নাম। অবশ্য তাতে ওনার নিজস্ব কোনো মহৎকীর্তির বিশেষ ভূমিকা নেই, পাকেচক্রে ওনার দল ওনাকে এমন একটি আসনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেটি নির্বাচনের ভাষায় ‘হেভিওয়েট আসন’, ফলে খানিকটা আলো তাঁর ওপরেও পড়েছে। মীনাক্ষী শিক্ষিতা, ভদ্র, পরিশ্রমী প্রার্থী সন্দেহ নেই এবং সৎ ও নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি নিবেদিতপ্রাণও বটে। একজন জনপ্রতিনিধির যা যা গুন থাকা প্রয়োজন, হয়তো ওনার মধ্যে তার অনেকটাই আছে, বাকিটা অভিজ্ঞতার দ্বারা অর্জন করবেন। যে তরুণ প্রজন্মকে বামেরা এবার ভোটের ময়দানে নামিয়েছেন তাঁরা মীনাক্ষীর মতন পাদপ্রদীপের আলো না পেলেও, সায়নদীপ মিত্র, প্রতিকুর রহমান, দ্বীপসীতা ধর বা ঐশী ঘোষরা সবাই মোটামুটি সমগোত্রীয়।
সমস্যা একটাই। ভারত ধীরে ধীরে welfare State হয়ে ওঠার ফলে, গরিব মানুষ বিনাপয়সায় বাসস্থান থেকে নিয়ে রান্নার চুলা এবং মেয়ের বিয়ের খরচ পর্য্যন্ত পেতে শুরু করার পরে, এখন তো আর তেমন কেউ economic Marxism এর কথা বলেন না, বেশিরভাগই cultural Marxism এর কথা বলেন। বামেদের পক্ষে এ এক ভয়ানক বিড়ম্বনা যে ওদের কাস্তে আর হাতুড়ি এখন দক্ষিণপন্থীরা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং যে তারাটি এখনো তাঁদের হাতে আছে সেটিও শুধুমাত্র পুঁজিকে ব্যবহার করে বিনিয়োগের রাস্তায় অর্থনৈতিক বিকাশের পথকেই আলোকিত করছে, যা ওঁদের মূল মতাদর্শের একেবারে anti thesis, ফলে বামেদের আমও গেছে, ছালাও গেছে। এমতবস্থায়, এই ভালো ভালো প্রার্থীরা শুধু প্রার্থী হয়েই থাকবেন, প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবেন না কারণ যে মতাদর্শের কথা ওঁরা তুলে ধরতে চাইছেন, সেটির ব্যবহারিক প্রয়োগের যে কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে, ওঁদেরই আগের কয়েক জেনারেশন প্রায় চার দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে হাতেকলমে তা করে দেখিয়ে গেছেন। দক্ষিণপন্থীরা যত সহজে বামেদের অর্থনৈতিক মডেলটি ছিনিয়ে নিয়ে আরামে হজম করে ফেলেছেন, দুর্ভাগ্যবশত বামেরা মুক্ত অর্থনীতিতে দক্ষিণপন্থার রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হয়েও এখনো কেমন যেন খোলা বাজারের ব্যাপারে খানিক দ্বিধাগ্রস্ত, apologetic, কৈফিয়ত দিতে উৎসুক। ফলে তাঁদের প্রচারে সংস্কৃতির গণ্ডিতেই আটকে থাকতে হচ্ছে, ওই ক্যান্টিন, ওই কৌটো নাড়া, ওই সেই মেহনতি মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস আর দক্ষিণপন্থী সরকার দ্বারা রাষ্ট্ৰীয় ব্যবসাগুলো সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের হাতে বেচে দেওয়ার কান্না।
আমার সত্যি সত্যিই মীনাক্ষীদের জন্য দুঃখ হয়। ওঁদের মতো ভদ্র শিক্ষিত তরুণদের কিন্তু ২-৩-৫% ভোট পাওয়ার কথা ছিল না, যদিও সেটাই ওঁরা পাবেন। আসলে যে কারখানার শ্রমিকের পাশে আজ ওঁরা দাঁড়াবার অঙ্গীকার করছেন, তাঁরা তো নিজেদের চাকরিটা ওঁদের দলের পূর্বসূরীদের militant trade unionism এর দৌলতে কল কারখানা লাটে উঠে যাওয়ার ফলেই খুইয়েছিলেন, আজ কি হটাৎ করে ওঁরা সেই নিরন্ন দশকগুলির জ্বালা-যন্ত্রনা ভুলে যাবেন? মীনাক্ষী মুখার্জিরা ভালো প্রার্থী, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পূর্বকীর্তি এবং আদর্শগত দ্বিধাবোধের ফলে ওঁদের দলের এই মুহূর্তে আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই ওঁদের অবস্থা ৮০র দশকের SUCI প্রার্থীদের মতন – আছেন কিন্তু নেই। হয়তো ভালো লাগে কিন্তু ভোট দেওয়া যায় না। আখেরে ওঁরা ভোট কাটুয়া হয়েই রয়ে যান। এই শনির দশা কবে কাটবে কিংবা আদৌ কোনোদিন কাটবে কিনা বলা মুস্কিল। SUCIর তো এখনো কাটেনি, ওঁদের কি হবে জানিনা। তবে একটা কথা বাকি সব দলের পক্ষেই শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয়। দল মত নির্বিশেষে যত বেশি আদর্শবান তরুণ মীনাক্ষী বা দ্বীপসীতারা ভোটে দাঁড়াবেন, তত রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে, মানুষের কল্যাণ হবে। তবে আদর্শটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বৃহত্তর সমাজ তথা রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হতে হবে।
সঞ্জয় সোম