ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ঘোড়া কেনা বেচা’ শব্দযূথ যতই পরিচিত হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ততটা পরিচিত নয়। অন্তত গত সাত-আট বছর আগে পর্যন্ত এই ঘোড়া কেনা বেচা, অর্থাৎ দলবদলের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রে তেমনভাবে প্রশ্রয় পায়নি। সেটা যে দলবদলে আইনের বজ্র আঁটুনির জন্য নয়। কারণ ফস্কা গেরোর সুযোগ নিয়ে গোটা দেশেই রাতারাতি রাজনীতিবিদদের একাংশের গিরগিটিসম আচরণে দেশবাসী অভ্যস্ত। বিশেষে করে হিন্দি বলয়ে যেখানে রাজনীতিতে নীতির বাহুল্য কম। দুর্নীতিই বেশি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাস বলে অন্য কথা। ছুটকো ছাটকা দু-চারটে দল বদলের ঘটনা ঘটলেও ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত ঘোড়া কেনা বেচার রাজনীতি এরাজ্যে সত্যিই তেমনভাবে প্রশ্রয় পায়নি। রাজ্যের না বাম না ডান রাজনীতির সূত্রপাত ঘটালেন যিনি সেই চমৎকার রাজনীতির ভাষ্যকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম দেখা গেল কংগ্রেস বিধায়কদের টোপ গেলাতে। কখনও মন্ত্রিত্বের টোপ গিলিয়ে, কখনও নোটভর্তি স্যুটকেশ পাঠিয়ে, কখনও বা সোজাসুজি গায়ের জোরে বাধ্য করে বেশ কিছু কংগ্রেস বিধায়ককে শিবির পরিবর্তন করালেন। উদ্দেশ্য একটাই, যে। কংগ্রেসের নেতৃত্বের কাছে পাত্তা না পেয়ে তিনি নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন, সেই দলে একাধিপত্য কায়েম করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকেবিরোধীশূন্য করে তোলা। প্রথম লক্ষ্যটা যদি হয় প্রতিশোধের রাজনীতি, তাহলে দ্বিতীয় লক্ষ্যটা ছিল অবশ্যই রাজ্য-রাজনীতিতে একাধিপত্য অর্থাৎ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা। প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্যই সফল হয়েছিলেন এবং কংগ্রেস-সি পি আই এম জোটের রাজনীতিকে অনেকটাই ভেঙে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় নিজের দলের বিধায়কের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন অনেকটাই। বিরোধীরা ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড় ছিল পঞ্চায়েতে এবং পুরসভাগুলিতেও। ঘোড়া কেনা বেচার রাজনীতির প্রকোপ পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জোর দেখা যাচ্ছে এখন যখন বঙ্গরাজনীতির নতুন কুশীলব বিজেপি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে ১৮ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ২২টি আসনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এমন একটি আবহাওয়া গড়ে তুলেছে। যখন তৃণমূল কংগ্রেসের মতো ভয়ংকর প্রতিশোধপরায়ণ, স্বৈরতান্ত্রিক এবং সুযোগসন্ধানী, আখের গুছোতে ওস্তাদ রাজনৈতিক দলটিও ভাঙনের ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে, মাত্র এক বছর আগে যেসব পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে একাধিপত্য কায়েম রাখতে সক্ষম হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস, সেইসব পুরবোর্ড এবং পঞ্চায়েতে এখন তাদেরই ‘কুল রাখি না মান রাখি’অবস্থা। গোটা রাজ্য জুড়েই দলবদলের পালাবদল শুরু হয়েছে কারণ রাজনীতিবিদরা ধরেই নিয়েছেন, গেরুয়া ঝড় রাজ্যে পৌঁছে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তা সাইক্লোন হয়ে আছড়ে পড়বে পশ্চিমবঙ্গে। এখন জাত-বেজাতের ঠুনকো লড়াই ছেড়ে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’আপ্তবাক্যটিকে সম্বল করে দ্রুত গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সেটাই চলছে জেলায় জেলায়, আর এই দলবদলের খেলায় জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে চমক দেখাচ্ছেন সেই মানুষটিই— সেই মুকুল রায় যিনি তার প্রাক্তন দল তৃণমূল কংগ্রেসকে সমৃদ্ধ করেছিলেন কংগ্রেস এবং সি পি আই এম থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে। জেলায় জেলায় পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির রং বদল ঘটিয়ে। এখন বিজেপি রাজনীতির অতি বড় ভরসাস্থল হিসেবে সেই একই ফর্মুলায় সমৃদ্ধ করতে শুরু করেছেন রাজ্য বিজেপিকে। যেভাবে প্রতিদিন একজন দুজন করে বিধায়ক শিবির বদলাচ্ছেন, যেভাবে একের পর এক কলকাতা শহরতলির পুরবোর্ডগুলি রং বদলাচ্ছে, তাতে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে যে এই তৃণমূল আর না। ওই দলটির নাভিশ্বাস ওঠার সময় আসন্ন। একটা একটা ইট খুলতে খুলতে মুকুল রায় তার প্রাক্তন দলটির ভিতটুকু অনেকটাই আলগা করে দিয়েছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু সমস্যা হলো, দলটার নাম বিজেপি যা হওয়ার ভাসমান রাজনৈতিক দল নয়। যে দলটির শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মত কঠিন একটি আদর্শবাদী সংগঠন। যে দলটির ভিত্তি সর্বলোভহীন, জাতীয়তাবোধ ও হিন্দুত্বের আলোয় আলোকিত এক বিশাল কর্মীবাহিনী, যে দলটি মনে করে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা বদল করার জন্য সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ এবং দলীয় আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া যায় না। এবং যে দলটির বিশ্বাস—বীর সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো সেনানীদের আদর্শে রঞ্জিত রাজনীতিকে যে কোনও শর্তে বিকিয়ে দেওয়াটা শুধু অন্যায় নয়, ঘোরতর পাপ; ভারতীয় মূল্যবোধের শিকড়ে আঘাত হানা।
মুকুল রায় নিঃসন্দেহে বিজেপি-র রাজ্যস্তরের সংগঠনকে অনেকটাই চাঙ্গা করে তুলেছেন নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার জোরে। এই শক্তিটি তিনি অর্জন করেছিলেন তৃণমূল নেতা এবং সাংসদ হিসেবে। একথাও ঠিক, রাজ্য বিজেপি রাজনৈতিক নেতৃত্বের গয়ংগচ্ছ ঢিলেঢালা ভাবকে বিসর্জন দিয়ে তৃণমূল স্তরে দলীয় শক্তিকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাতকে অনেকটাই মজবুত করে সাহস জুগিয়েছেন মুকুল রায়। কিন্তু এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তাকে আবার প্রমাণ করেছে অদূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে। কারণ তিনি কখনও ক্যাডার নির্ভর রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেননি। হাওয়ার ভাসমান গ্যাস বেলুনের মতো তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে উত্তর ২৪ পরগনায় অর্জুন সিংহের মতো বাহুবলী রাজনীতিবিদকে বিজেপিতে টেনে এনে প্রাথমিকভাবে সমালোচনার ঝড় সামলে নিতে পারলেও, সমস্যায় পড়লেন বীরভূমের কুখ্যাত তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে বিজেপি পতাকার নীচে শামিল করে। কারণ তিনি বুঝতে পারেননি, মানুষের ভোটের ওপর নির্ভরতা ত্যাগ করে হাজারো বেনোজল ঢুকিয়ে চাষের জমিকে উর্বর করে তোলার রাজনীতি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্রে নেতৃত্ব, এমনকী রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বও মেনে নেবে না। কারণ এরাজ্যে গেরুয়া ঝড় তুলতে তাদেরও লড়াই করতে হয়েছে যুগ যুগ ধরে। তাদেরই রক্ত ঝরেছে, প্রাণ গিয়েছে। ঘর-গেরেস্থালি গিয়েছে। আর সেখানে মনিরুল ইসলামের মতো লুম্পেন তৃণমূলি রাজনীতিবিদ যিনি একবছর আগেও বিজেপি কর্মীদের গোড়ালি দিয়ে পিষে মারার হুমকি দিয়েছিলেন, তাকে নেতৃত্বে মেনে নিতে হবে—এই চরম অপমানের তারা প্রতিবাদ করেছেন। নিঃসন্দেহে এই প্রতিবাদযুক্তিযুক্ত এবং অখণ্ডনীয়। কারণ একটা কথা তো মনে রাখতেই হবে—মনিরুল ইসলামের মতো রাজনীতিবিদরা কোনও আদর্শ থেকে দলবদল করছেন না। সুযোগের সন্ধান নিচ্ছেন মাত্র। গিরগিটির মতো রং বদলাতে এদের দু’মিনিটও লাগবে না।
সংখ্যা যেখানে ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি সেখানে বিধায়ক এবং সাংসদ ভাঙিয়ে আনার খেলাটা যে প্রয়োজন, তাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু মাত্রাটা বজায় রাখা জরুরি। সংখ্যা যেমন গণতন্ত্রের ভিত্তি, ঠিক তেমনই আদর্শও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ফলদায়ক। সাধারণ মানুষের চোখে প্রতিটি রাজনৈতিক দল, প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মূল্য এক একরকম। সস্তার রাজনৈতিক দলের মতো আমে-দুধে একাকার করে জনগণকে আঁটি বানাবার বর্ষপ্রাচীন রাজনীতিতে বিশ্বাস করার মতো দলবিজেপি নয়—এটা বিজেপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, এই বেনোজলেরা যেমন কাটা বাঁধের ফাক দিয়ে বিরোধী শিবিরে অনুপ্রবেশ করেছে, তেমনই এরা ব্যক্তিগত আখের গোছাতে যে কোনো মুহূর্তেই ওই কাটা বাঁধ দিয়েই বেরিয়ে যাবেন সর্বনাশ করে দিয়ে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা বা জনসঙ্ঘের নেতৃত্ব পরাক্রমশালী ব্রিটিশ রাজত্বে কোনো আপশের পথে হাঁটেননি। আদর্শকে শিরোধার্য করে তারা রাজনীতিকে গড়ে তুলেছেন। জাতীয়তাবোধ আর হিন্দুত্বের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে। তাদের সেই অবদানকে শুধুমাত্র সাময়িক রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য ত্যাগ করা অসম্ভব। তার মানে অবশ্য এই নয়, সংখ্যাবৃদ্ধির রাজনীতিটাও একটা স্ট্রাটেজি। কিন্তু কাদের নিয়ে বাড়াব সে সম্বন্ধে কতকগুলি দৃষ্টিভঙ্গি অতি আবশ্যিক। সেক্ষেত্রে দলবদলে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য কিছু শর্ত আরোপের প্রয়োজন রয়েছে। দলবদল করতে চাইছেন যারা বা আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে যাঁদের তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, বিজেপি যেমন চাইছে তারা সেরূপ শিবিরে নাম লেখান, তেমনি এটাও ঠিক যে রাজনীতির জগতে ঠিক থাকার জন্য তাদের ডুবন্ত জাহাজ ত্যাগ করতেই হবে। আর তা করতে হবে তাঁর বদলানো শিবিরের ইতিহাস জেনে। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধকে মেনে নিয়েই। যে সমস্ত রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব আজকের এই যুগসন্ধিক্ষণে গুরুদায়িত্বের ভার কাধে তুলে নিয়েছেন, তাদের মনে রাখতে হবে, ভারতীয় সংসদে বিজেপি সদস্যের সংখ্যা ২ থেকে ৩০২ তে পৌঁছানোর রাস্তাটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। অনেক তিতিক্ষা, অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়েই আজ বিজেপি গোটা দেশে ‘এক জাতি এক নাম’-এর আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করতে পেরেছে। সেই ত্যাগের মূল্যকে মনিরুল ইসলামের মত লুম্পেন রাজনীতিবিদকে তুলাদণ্ডে ওজন করার ধৃষ্টতা না দেখালেই মঙ্গল। দলের পক্ষেও। দেশের পক্ষেও। ভালো ফসল ঘরে তুলতে হলে বীজধানটা বেছে নিতেই হবে। নান্য পন্থা: অয়নায়।
সুজিত রায়
2019-06-13