পাণিহাটি গঙ্গাতীরে স্থাপে ভক্তি ভরে – তৃতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

জমিদারের ব্যাটা রঘুনাথ শ্রীচৈতন্যের কথায় ব্যাথা পেলেন বটে কিন্তু ভেঙে পড়লেন না । বিবাহের পরেও সংসারে তাঁর মন বসলো না । তাঁর স্ত্রী অনুভব করলেন রঘুনাথ সংসারে বেশিদিন থাকবেন না। এদিকে ততদিনে নীলাচলে ফিরে গেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি নিত্যানন্দকে আদেশ করেছিলেন সংসারীদের মধ্যে থেকে সংসারী হয়ে উচ্চনীচ, জাতি বর্ণ , ধনী দরিদ্র, পন্ডিত মূর্খ নির্বিশেষে হরিনাম বিলিয়ে যেতে। নিত্যানন্দ প্রভুর আদেশ শিরোধার্য করে ফিরে এলেন গৌড়ে। পানিহাটি রাঘব ভবনে হলো তাঁর অভিষেক। সুগন্ধি জল ও নানা উপাচারে সম্পন্ন হল অভিষেক পর্ব।

এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। নিত্যানন্দ আদেশ করলেন তাঁকে কদম ফুলের একটি মালা পরিয়ে দিতে। কিন্তু কদম ফুলের মালা পাবে কোথায় ? তখন যে ভরা জ্যৈষ্ঠ মাস , অসময়! নিত্যানন্দ দেখালেন এক অভূতপূর্ব ঘটনা। জাম্বীরের গাছে ফুটে উঠল রাশি রাশি কদমফুল ।

রাঘব পন্ডিত সহ নিত্যানন্দের দ্বাদশ অন্তরঙ্গ অনুগামী বৈষ্ণব ইতিহাসে #দ্বাদশ_গোপাল নামে পরিচিত। তাঁরা একের পর এক মালাচন্দন দিয়ে বন্দনা করলেন নিত্যানন্দকে। সহসা চতুর্দিকে দমনক পুষ্পের সৌরভে ভরে উঠলো। নিত্যানন্দ জানালেন শ্রীচৈতন্যদেব সূক্ষ্ম দেহে বৃক্ষতলে উপস্থিত হয়েছেন। পানিহাটির যে ঘাটে প্রথম চৈতন্যদেব পা রেখেছিলেন,তা শ্রীচৈতন্য ঘাট নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালের ভূমিকম্পে এই ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও বর্তমানে তা সারাই হয়েছে। যে গাছের নিচে চৈতন্যদেব এবং নিত্যানন্দ বসে কৃষ্ণনাম প্রচার করেছিলেন, সেই ‘অক্ষয় বটবৃক্ষ’ এখনও বর্তমান আছে।

সেই অভিষেক সভায় অনেকের সঙ্গে মিশে ছিলেন জমিদার বাড়ির ছেলে রঘুনাথ মজুমদার। দূর থেকে নিত্যানন্দ তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন। অবশেষে কাছে ডাকলেন …. #চোরা বলে সম্বোধন করলেন ।

লোকে বলে – নিতাই যারে দেয় সেই পায় গোরা।

রঘুনাথ সেই “গৌর প্রেমের একমাত্র বেপারী ” নিতাইয়ের অলক্ষ্যে গৌর রণে আশ্রয় ভিক্ষা করে চৌর্যকর্মে অভিযুক্ত হলেন । নিত্যানন্দ বললেন , সেই অপরাধের দণ্ড না স্বীকার করলে রঘুনাথের কোনদিনই গৌরাঙ্গ লাভ হবে না। কি হবে সেই দণ্ড ? কে জানে কিবা করতে বলে এই গৃহীসন্ন্যাসী। ভয়ে , দ্বিধায় রঘুনাথ দণ্ডগ্রহণে জন্য জোড় হস্তে , নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিত্যানন্দ রঘুনাথের এমন অবস্থা দেখে স্মিত হেঁসে বললেন –

” আমি তোমায় শাস্তি দিলাম – দধি চিঁড়া ভক্ষণ করাহ মোর গণে। “

অগণিত বৈষ্ণব ভক্তকে সেবা করার এমন অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে ধন্য হলেন রঘুনাথ । চিঁড়া, দুধ, দই , সন্দেশ , চিনি, কলা রাশি রাশি এনে জড়ো করা হল রাঘব ভবনের দালানে। ছোট ছোট মাটির কলসী , যাকে লোকে বলে গুড়ের নাগরী , তার গলা কেটে বানানো হল মালসা। মালসা করে নিবেদন করা হল ফলার। রাঘব ভবনে সেই অক্ষয় বটবৃক্ষের নীচে সারি সারি আসন পাতা হল। প্রথমে বসলেন নিত্যানন্দ , তারপর তাঁকে ঘিরে বসলেন দ্বাদশ গোপাল। তাঁদের ঘিরে বসলেন নরনারী, উচ্চনীচ, ধনী গরিব নির্বিশেষে ভক্তকুল।

তীরে স্থান না পাইয়া আর কতজন
জলে নামি দধি চিঁড়া করয়ে ভক্ষণ
কেহ উপরে কেহ লে কেহ গঙ্গাতীরে
বিশজন তিন ঠাঁই পরিবেশন করে।

সমস্ত আহার্য একত্রিত হলে তাঁকে ঘিরে নিত্যানন্দ ধ্যানযোগে আহ্বান করলেন শ্রীচৈতন্যদেবকে। তাঁর অমৃতময় সূক্ষ্ম উপস্থিতি অনুভূত হল প্রতিটি ভক্তপ্রাণে। ধন্য হলেন রঘুনাথ , সার্থক হল তার এতদিনের প্রতীক্ষা, উদ্বেগ। এবার প্রব্রজ্যার শুভ যোগ আগত। এবার কেবলই বিদ্যা স্বরূপ মায়ার আলোকের অমৃতের পথে হেঁটে যাওয়া। গৃহত্যাগী হলেন অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী , হেঁটে গেলেন নীলাচলের পথে। শ্রীচৈতন্য সেথায় তাঁকে বুকে টেনে নিলেন সাদরে। এদিকে নিত্যানন্দ রঘুনাথকে অভিনব দণ্ড দিয়ে সূচিত করলেন এক মহোৎসবের , #দণ্ডমহোৎসব। এইদিন হতে বৈষ্ণব সমাজের নিকট মালসা ভোগ বড় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ল।

পাণিহাটির গঙ্গারতীরে দন্ডমহোৎসব এক পবিত্র ঐতিহ্য। প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে এই উৎসব চিঁড়া উৎসব নামেও খ্যাত হয়েছে। এসময় এক বিরাট চিঁড়ার মেলা বসে পানিহাটির গঙ্গার তীরে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসছে সেই উৎসব। শ্রীচৈতন্যদেব চেয়েছিলেন উচ্চ নীচ নির্বিশেষে কৃষ্ণ উপাসনায় সকল মানুষের সমঅধিকার । পন্ডিতেরা যাকে বলে #আধ্যাত্মিক_গণতন্ত্র। নিত্যানন্দের দণ্ডমহোৎসবের পংক্তি ভোজন সেই আধ্যাত্মিক পথকে হোক নতুন করে সুপ্রস্তস্থ করলেন। সনাতন ধর্মকে মুক্তির পথ দেখালেন। বৈদেশিক মরু  আক্রমনে মধ্যযুগীয় সনাতন ধর্ম পচা গলা মৃতদেহ থেকে তিনি নির্মাণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন এক নতুন  সমাজের। এই  আধ্যাত্মিক_গণতন্ত্র স্থাপন করে  নিত্যানন্দ করালেন এমন এক আন্দোলন, যেখানে নিঃশব্দে চুর চুর হয়ে গিয়েছিল উচ্চ নিচ অভিমান।

আঠারোশোতিরাশি খ্রিস্টাব্দে পাণিহাটি দন্ডমহোৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীমের কথামৃত সে বিষয় বিস্তারিত লিখেছিলেন- পেনেটিতে গাড়ি পৌঁছিবামাত্র দন্ডমহোৎসবের দারুন ব্যাপার স্যাপার দিকে ঠাকুর অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । গাড়ির মধ্যে বসেই ঠাকুর বড় আনন্দ করেছিলেন । তারপর একা নেমে তীরের মত ছুটে গিয়েছিলেন মহোৎসবের ক্ষেত্রে। ঠাকুরের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ঠাকুরকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় মরি মরি অবস্থা, তারপর খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন নবদ্বীপ গোস্বামীর কীর্তন দলের মধ্যে ঠাকুর দুহাত তুলে নৃত্য করছেন , মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। পাছে ঠাকুর পড়ে যান, তাই শ্রীযুক্ত নবদ্বীপ গোস্বামী সমাধিস্থ ঠাকুরকে অতি যত্নে ধারণ করছেন। চতুর্দিকে ভক্তেরা হরিধ্বনি করে তাঁর চরণে পুষ্প ও বাতাসা প্রদান করছেন। একবার দর্শন করার সহস্র নরনারী ঠেলাঠেলি করছেন।

এ যেন সেই শ্রীচৈতন্যদেবের পুনরাবির্ভাবের ঘটনা। নর-নারী ভেবেছিলেন এই মহাপুরুষের ভিতরে নিশ্চয়ই গৌরাঙ্গের আবির্ভাব হয়েছে। দুজন তো একই রকম। আঠারশোপঁচাশি খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন শেষবার এই উৎসবে যোগদান করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর অন্যতম সঙ্গী নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ঠাকুরের দিব্যলীলা চৈতন্য নিত্যানন্দ উপস্থিতির অনুরণে অনুপ্রাণিত স্বামী বিবেকানন্দ এই অঞ্চলেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মূল কেন্দ্র স্থাপনের কথা চিন্তাও করেছিলেন । যদিও মন্দির সম্পর্কে নয় , তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বাইরে বেরোনোর প্রথম স্বাদ পেয়েছিলেন পেনেটিতে এসে।

বড়িশা, হালিশহর, উত্তরপাড়া, নিমতা-বিরাটি, খেপুতের মতন পানিহাটিতেও রয়েছে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ সাবর্ণ গোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবারের প্রাচীন ইতিহাস। পানিহাটির রাধাগোবিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বংশতিলক গৌরীচরণ রায় চৌধুরী। তাঁর পুত্র জয়গোপাল রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন রাধাগোবিন্দের মন্দির এছাড়াও সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, সদাশিব মন্দির এবং রাসমঞ্চ সহিত চারটি প্রচীন আটচালা শিব মন্দির।

পানিহাটি একটি ঐতিহ্যের পীঠস্থান, রয়েছে চৈতন্যদেবের পূজিত রাঘব পণ্ডিতের মদনমোহন, রয়েছে রঘুনাথ গোস্বামীর রাধারমন-জিউ বা পাঠবাড়ী ঠিক পানিহাটি আরও বিখ্যাত সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের জন্য-রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী, রাধাগোবিন্দ(পানিহাটি বাজার সংলগ্ন কাছাড়ীবাড়ির দোতলায়)।

প্রাচীন সনাতনী ভূমি পানিহাটি। রাঘব ভবন ব্যতীত এখানে কাঠিয়া বাবার আশ্রম, ভোলানন্দ গৌড়ীয় মঠ, বালক ব্রহ্মচারী আশ্রম যেমন রয়েছে এখানে, তেমন গঙ্গার তীরে অনেক অনেক ঘাট পানিহাটির আরেক আকর্ষণ। জহর সাধুখাঁর ছোটো ঘাট, গৌরীমণি দাসের ঘাট, মালাপাড়া ঘাট, শ্রীগৌরাঙ্গ ঘাট, মদন বসুর ঘাট, তাঁতপটি ঘাট, প্যারি বোষ্টম ঘাট – নাম বলে শেষ করা যাবে না। এত বেশি ঘাট রয়েছে এখানকার গঙ্গায়, যে ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় যতীন্দ্র মোহন দত্ত লিখেছিলেন, পানিহাটির মতো এতগুলো গঙ্গার ঘাট সম্ভবত বারাণসী ছাড়া আর কোথাও নেই।

সমাপ্ত

© দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. Panihati heritage : panihati chida utsav

২. চৈতন্যময় পানিহাটি: রসিক রং

৩. মিথ পঞ্চদশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.