বিজ্ঞান মানেই অঙ্ক। গণিত ছাড়া বিজ্ঞানের সাধনা অসম্ভব। তাবলে কিন্তু বিজ্ঞান মানে শুধুই অঙ্ক নয়।
অঙ্ক মানেও শুধুই হিসাব নিকাশ নয়।
অঙ্ক হল বিজ্ঞানের ভাষা। ভাষার কাজ কী? মনের ভাব প্রকাশ আর অন্যের সঙ্গে নিজের ভাব বিনিময়।
ভাব বা ভাবনাটা মনের। ভাষাটা মাধ্যম মাত্র।
ঠিক তেমনি, বিজ্ঞানী যখন বিজ্ঞানের কোন থিওরি আবিষ্কার করেন, তখন তিনি গণিতের ভাষায় সেটা প্রকাশ করেন। সাধারণত বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও কলনবিদ্যা ( ক্যালকুলাস) এর মাধ্যমে। বিভিন্ন ইংরেজি ও গ্রীক অক্ষর, সংখ্যা আর সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে গাণিতিক ভাষায় প্রকাশিত ওই বক্তব্য গুলোকে ফর্মুলা বলে।
বিজ্ঞান ও অঙ্ক না জানা মানুষের কাছে ওই ফর্মুলা ও তার প্রমাণ বা ডেরিভেশন গুলো দূর্বোধ্য মনে হয়। ঠিক যেমন আমাকে জাপানি ভাষায় কোন লেখা পড়তে দিলে আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারবো না। কিন্তু আমি শ্রোডিঙ্গার কিম্বা ডিরাক ইকুয়েশন দেখলেই বুঝতে পারবো। কারণ ওই ভাষাটা আমার জানা।
এতক্ষণে আশা করি বোঝাতে পেরেছি যে আমি ঠিক কী বলতে চলেছি।
হ্যাঁ, কোন বিশেষ ভাষা না জানলে যেমন কাউকে অশিক্ষিত বা মূর্খ বলা যায় না, ঠিক তেমনি অঙ্ক ( বিজ্ঞানের ভাষা) না জানলেই কাউকে বিজ্ঞান বোঝার অযোগ্য বলা যায় না।
সমস্যাটা ওই ব্যক্তির বোধশক্তি নিয়ে নয়, বরঞ্চ সমস্যাটা হল ওই ভাষাটা কে নিয়ে।
ইংরেজি ভাষা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই আন্তর্জাতিক ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। জাপানি ভাষা পায়নি।
তাই আমার মতো জাপানি না জানা মানুষের লজ্জার কোন কারণ নেই।
আমি ইংরেজি ভাষাতেই জাপান সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পারি।
ঠিক তেমনি অঙ্ক না জানা মানুষেরও লজ্জার বা কুন্ঠার কোন কারণ নেই।
বিজ্ঞান কে সহজ সরল ভাষায় সবার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমাদের মতো বিজ্ঞানের লোকেদেরই নেওয়া উচিত।
এই পর্যন্ত যাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে, তাদের মনে নিশ্চয়ই একটা প্রশ্ন আসছে। হ্যাঁ, প্রশ্নটা হল- সেটা হচ্ছে না কেন? সহজ সরল ভাষায় লেখা বিজ্ঞানের বই বিরল কেন?
মানুষ কী বিজ্ঞান জানতে আগ্রহী নয়? মোটেই না!
ডিমরালাইজেশন কাকে বলে জানেন তো? হ্যাঁ, নিরুৎসাহিত করা। সেটাই করা হয়। ‘বিজ্ঞান সবার জন্য নয়’- এই বার্তাই কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাই ‘পপ্ সাইন্স’ নামক শব্দবন্ধের সৃষ্টি করা হয়েছে।
কোন বিজ্ঞানের লেখক যখনই সহজবোধ্য ভাবে গাণিতিক জটিলতা এড়িয়ে বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব কে সর্বসাধারণের উপযুক্ত করে লেখার চেষ্টা করে, তখন তাকে পপুলার সাইন্স বা পপ্ সাইন্স আখ্যা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, লেখাটা ঠিক বিজ্ঞান নয়। নিছক জনপ্রিয় হবার উদ্দেশ্যেই লেখক লেখাটা ( বা বইটা) লিখেছেন।
আর তাই, ওটা ঠিক বিজ্ঞান পদবাচ্য নয়।
কেন এমন করা হয়? আরে বাবা তাহলে আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিজ্ঞানের জগতের মানুষের তফাত কী থাকবে? এ হল মৌলবাদ। বিজ্ঞানের মৌলবাদ।
‘তুমি বিজ্ঞানের কী বোঝ হে? ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন সলভ করতে জানো? ডাবল ইন্টিগ্রেশন? নিদেনপক্ষে ভেক্টর এলজেব্রা বোঝ?’- ব্যাস! আর কী? আপনি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। মনে মনে ভাবতে শুরু করলেন ‘বিজ্ঞান আমার জন্য নয়’। হ্যাঁ, ডিমরালাইজেশন। আর সেটা সচেতন ভাবে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে করা হয়।
যাতে করে বিজ্ঞানের জাতটা বজায় থাকে। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন। জাত। ক্লাস যাকে বলে আর কি! বিজ্ঞানের জগতের মানুষের একটা ক্লাস আছে না! একটা স্টেটাস আছে! যে সে হাবলু গাবলু বিজ্ঞান বুঝে গেলে চলে নাকি!
তাই জারগন ব্যবহার করা হয়।
বাপরে! কী সব টার্ম!
- গসিয়ান কার্ভ, সাইনুসয়ডাল ভেরিয়েশন, লগারিদমিক প্রগ্রেসন, কোয়াড্রাটিক ইকুয়েশন, ব্লা ব্লা ব্লা।
না জানি কি সব হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক ব্যাপার! ব্যাস! আপনি গুটিয়ে গেলেন। বিজ্ঞান আপনার কাছে আকাশের চাঁদ হয়েই রয়ে গেল।
তাতে কার কী লাভ হল?
কেন?
“ডাক্তার বলছে ক্যালসিয়াম টা কম” অতএব কম।
“টিউটর বলছে অঙ্কটা কমজোরি” অতএব কমজোরি।
এখন আপনার চোখে হয়তো একটা দৃশ্য ভেসে উঠবে – ‘এক ভিখারিনী মা, প্লাটফর্মে কোলে এক শিশু নিয়ে বসে আছে। হাড় জিরজিরে শরীর। হাত পাততে আপনি যেই কুড়ি টাকার একটা নোংরা নোট হাতে দিলেন, হাসিতে ভরে উঠলো তার মুখ। আপনি দেখলেন ঝকঝকে সাদা দাঁত।’
কোন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন? কোন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট?
কিম্বা ওই মুদির দোকানী, যে কিনা লম্বা ফর্দের পঞ্চাশ টা সংখ্যার যোগটা ক্যালকুলেটরের চেয়েও তাড়াতাড়ি করতে পারে। কোন টিউটর? কোন ব্রেইন টনিক?
আপনার টুথপেষ্ট এ নুন আছে কিনা, আপনার নুনে আয়োডিন আছে কিনা, ভাইরাস টা কত ফুট লাফাতে পারে?, আপনার হার্ট এটাকের রিস্ক কত পার্সেন্ট?, এসব আপনি নিজেই বুঝে গেলে চলবে?
কাঠমান্ডু তে ভূমিকম্প হবার পর পরই ভয়ংকর সব সতর্কবার্তা নিউজ চ্যানেল গুলো দেখাচ্ছিল, মনে পড়ে? ‘অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কলকাতার আশেপাশে! সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। ‘- তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে। কোথায় কি? আর তাছাড়া অমন সতর্কতার মানে কী? কোটি কোটি মানুষ তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাবে? কোথায় যাবে? কতদিনের জন্যেই বা যাবে?
প্রশ্ন তুললেই আপনি মূর্খ।
‘জানেন বিজ্ঞানীরা কত কঠিন কঠিন অঙ্ক কষে এই সব বার করে? সিসমোগ্রাফ, টেকটোনিক প্লেট, এইসব সম্পর্কে কোন ধ্যানধারণা আছে আপনার?’
মানে সোজা কথায় আপনার এসব প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই।
তাহলে আর কি? জ্ঞান শুনতে থাকুন।
রোজ ডিম খেলে কী হয়, লাল মাংস খেলে কিভাবে কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে ধমনিতে চর্বি জমে যাবে, রোদে বেরলে কেন সানস্ক্রিন ব্যবহার না করলে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে, চিনির বদলে কেন স্যাকারিন খাবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্ন করলেই মুশকিল! আপনি ডাক্তারদের চেয়ে বেশী বোঝেন?
তবে হ্যাঁ, আপনি যদি সেলিব্রিটি হন, তাহলে আপনি সব বোঝেন। আপনি খেলোয়াড় বা চিত্রতারকা হলেও কোন ভোজ্যতেল টা স্বাস্থ্যকর, কোন সিমেন্ট বেশি মজবুত, কোন পেইন্টটা বেশিদিন টিকবে, এমনকি কোন লোহার রড বেশি টেঁকসই, সেগুলো আপনি কোন ডিগ্রি কোন বিজ্ঞানচর্চা না করেই অবলীলায় মাস মিডিয়ায় প্রচার করতে পারেন। আপনাকে কোন ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ মানুষ কোন প্রশ্ন করবে না। আপনার জনপ্রিয়তাই আপনাকে বানিয়ে দেবে একাধারে ফুড টেকনোলজিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি ম্যাটেরিয়াল টেকনোলজিস্ট।
এতো গেল বিজ্ঞানের মৌলবাদের একটা দিক। মানে বানিজ্যিক দিকটা।
যদিও অতি সংক্ষেপে, অনেক কিছু বাদ দিয়ে লিখলাম।
এবার আসি আরেকটা দিক নিয়ে। বিশ্বাস যোগ্যতা, ক্ষমতা, আধিপত্য অর্থাৎ সুপ্রিম্যাসির দিকটা।
আচ্ছা বলুন তো? জ্যোতিষ বিদ্যা, হোমিওপ্যাথি, পুনর্জন্ম, ভুত, ভগবান -এই শব্দগুলোর মধ্যে মিল কোথায়?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, এগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়। মানে তথাকথিত বিজ্ঞান এগুলো মানে না। কেন? প্রমাণ নেই তাই!
তাই তো জ্যোতিষী রা জ্যোতিষ শাস্ত্র কে প্রাণপণে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চায়। আর ধর্মের ধ্বজাধারী রা ধর্মগ্রন্থ গুলোকে বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবী করে।
কিন্তু কেন এই প্রবণতা? খুব সহজ। কারণ বিজ্ঞান মানেই প্রমাণিত সত্য।
কোন বিদ্যা, তত্ত্ব কিম্বা মতবাদ কে বিজ্ঞানসম্মত বা বৈজ্ঞানিক আখ্যায়িত করতে পারলেই সেটা সত্য আর বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ কিনা বিজ্ঞান একটা মান্যতার, সত্যতার সীলমোহর।
কিন্তু কোনটা বিজ্ঞান?
কেন? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা বিজ্ঞানী রা কিছু বলছেন মানে সেটাই বিজ্ঞান। আর বিজ্ঞান মানেই প্রমাণিত সত্য। পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্ত।
-কিন্তু কোথায় পরীক্ষা হল? কবেই বা হল? কেই বা দেখতে গেছিল? কে কে সাক্ষী ছিল?
-আরে? আপনি বিজ্ঞানকে অপমান করছেন? অশিক্ষিত, মুর্খ কোথাকার! আপনার দুঃসাহস তো কম নয়? আপনি জানেন? অমুক শহরের তমুক গবেষণাগারে তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা দিনরাত এক করে নাওয়া খাওয়া ভুলে বছরের পর বছর ধরে এইসব গবেষণা করেছে। কত বড় বড় সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণার ফলাফল, সেটা জানেন? কত কোটি ডলার খরচ হয়েছে কোন ধারণা আছে আপনার? আপনি কোথাকার কে হরিদাস পাল এসেছেন প্রশ্ন করতে? যান তো মশাই, ফুটুন।
-ইয়ে মানে হ্যাঁ, মানে তাইতো তাইতো, ঠিকই তো! মানে, তাহলে নিশ্চয়ই ঠিকই হবে ব্যাপার টা।
বোঝা গেল? এই হচ্ছে পদ্ধতি।
বিজ্ঞানের দাদাগিরি। বিজ্ঞানের সুপ্রিম অথরিটি।
আপনি কোন দার্শনিক প্রশ্ন করুন। যেমন- চেতনার স্বরূপ কী?, মহাবিশ্ব কেন অস্তিত্ববান? বিগ ব্যাং এর আগে কী ছিল? কিম্বা জীবনের উদ্দেশ্য কী?
অমনি আপনার প্রশ্নগুলোর ওপর একটা স্ট্যাম্প দিয়ে দেওয়া হবে। প্রশ্নগুলো মেটাফিজিক্যাল। অর্থাৎ ঠিক ঠাক প্রশ্ন নয়, এই আর কি! মানে একটু বাঁকা প্রশ্ন। বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর প্রশ্ন। তাই মেটা-ফিজিক্যাল। ‘মেটা’ মানে জানেন কী? বলে দিচ্ছি। ঘড়িতে যখন আটটা কিম্বা চারটে বাজে, তখন ঘড়ির কাঁটাদুটোর পারস্পরিক অবস্থানকে ‘মেটা’ বলে। এবার ধরুন মিনিটের কাঁটাটার ( মানে যেটা বারোটার ঘরে আছে) অভিমুখ হল বিজ্ঞানের অভিমুখ। তাহলে ঘন্টার কাঁটাটা হল আপনার প্রশ্নের অভিমুখ।
অর্থাৎ, আপনার প্রশ্নটা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মোটেই একমুখী বা এলাইনড নয়। যথেষ্ট বাঁকা, প্রায় উল্টো মুখি। বোঝা গেল?
আর যদি পরজন্ম, ভুত বা ভগবান নিয়ে প্রশ্ন করেন? ওরে বাবা! তাহলে আপনার প্রশ্নটা হয়ে যাবে পুরোপুরি বিজ্ঞান বিরোধী। বিজ্ঞানের ভাষায় প্যারা-নর্মাল। প্যারা মানে বিপরীত মুখী অবস্থান। ঘড়িতে সময় ছটা।
যদি কোন সাইকোলজিস্ট এইসব জন্মান্তর, জাতিশ্বর বা আত্মা নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে যান, তাহলে তাঁকে প্যারাসাইকোলজিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ওনার গবেষণার বিষয়গুলো ঠিক বিজ্ঞান নয়, একটু ট্যাড়া থুড়ি প্যারা।
সাধারণ মানুষের কাছে এইভাবেই বিজ্ঞানের ভাবমূর্তি কে অক্ষুণ্ন রাখা হয়।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়ে গেছে জনসাধারণ বিজ্ঞান বুঝে গেলে বিপদ টা ঠিক কাদের এবং কেন?
ধর্মীয় মৌলবাদের চেয়ে বিজ্ঞানের এই মৌলবাদের বিষ যে কতটা ভয়ঙ্কর তার একটা ট্রেলার আমরা গত বছর দেখে নিয়েছি। বিজ্ঞান কোন জুজু নয়। অঙ্ক গুলোই বিজ্ঞান নয়। নির্ভয়ে প্রশ্ন তুলুন। বুঝতে চান। নইলে এবছর আর ট্রেলার নয়, পুরো পিকচার দেখতে হবে।
সম্বরণ চট্টোপাধ্যায়