বরণীয় তাঁরা স্মরণীয় তাঁরা

২০১০-২০১১। তখন আমি বরিশালে। হরিচাঁদ ঠাকুরকে তথাকথিত জলছোঁয়াদের অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। শহরের পুরনো শ্মশান এলাকায় অনেক মন্দির স্থাপন করা হয়। ঠাকুর অনুকুল, অবধূত, শিব কালী, শিতলা, রামঠাকুর..ইত্যাদি; কিন্তু হরিচাদ, গুরুচাদ ঠাকুরের মন্দির স্থাপনে যত ফ্যাসাদ। মতোয়াদের ২ গ্রুপকে ইন্ধন দিয়ে মাথা ফাটাফাটি করানো হল। মন্দির চত্বরের প্রবেশমুখে মন্দির ২ টি অসম্পূর্ণ পড়ে থাকল দিনের পর দিন। আমি উদ্যোগ নিয়ে মন্দির স্থাপন করতে গেলে থলের বেড়াল বের হয়ে পড়ল। শহরের হিন্দু নেতৃত্বদের সভা ডাকি বিষয়টা ফয়সালার জন্য। নেতারা প্রায় সবাই ব্রাহ্মণ কায়েত জলছোঁয়া। তারা আমাকে অনেক তথ্য দিয়ে মন্দির স্থাপনে নিরোৎসাহিত করলেন। তারা যা বললেন, তা এই সভ্য জগতে অতীব লজ্জার হলেও তারা নিদ্বিধায় নির্লজ্জ এই সব কথা বলতেছিলেন।
আমি ময়মনসিংহের মানুষ। নমঃশুদ্র বা মতোয়াদের তেমন দেখিনি। হরিচাঁদ ঠাকুরের নামও শুনিনি। পরে জেনেছি বরিশাল, খুলনা যশোহর, ফরিদপুরের সিংহভাগ হিন্দু নমঃশুদ্র তথা মতোয়া। আমি হরিচাঁদ ঠাকুর ও তৎপুত্র গুরুচাঁদ সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে জানতে শুরু করি। ওড়াকান্দি ২ বার সফর করি। আমি অবাক হই এই ২ মহামানবের কর্ম ও জীবন সংগ্রাম জেনে। তথাকথিত অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে তারা বিশাল হিন্দুগোষ্টীকে উদ্ধার করেছেন, তাদের ধর্ম রক্ষা করেছেন সহজিয়া মতোয়া সমাজ তৈরি করে। শিক্ষা আন্দোলন করেন গুরুচাদ। নমঃশুদ্রদের বিদ্যাসাগর গুরুচাদ। একেশ্বরবাদী মতোয়াদের মূলমন্ত্র সহজ সরল ‘ হরিব্বোল’। হরি বা শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র আরাধ্য। হরিনামে যারা মাতোয়ারা তারাই মতোয়া। পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধায় আমি অবনত মস্তিষ্কে এই ২ মহাপুরুষ অবতারদের প্রণাম জানাই। উল্লেখ্য এই ২ জনের নামের শেষে ঠাকুর পদবি থাকলেও তারা নমঃশুদ্র। আর এই কারণে বর্ণ হিন্দু ও জলছোঁয়ারা তাদের অবতার মানেন না। প্রণাম করেন না। মন্দির স্থাপন করতে দেয় না। ষড়যন্ত্র পাঁকায়। বরিশালে মন্দির করতে দেয় না।

রমনাতেও উনাদের মন্দির স্থাপনে দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধকতা করেছে তারা। পরে জগন্নাথ হলের ছাত্ররা এবং মন্দিরের সভাপতি ডিআইজি সত্যরঞ্জন বারুই মহোদয়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপে মন্দির স্থাপিত হয়েছে। বরিশালে ২০১৪ পর্যন্ত মন্দির হয়নি।

এবার শুনুন বরিশালের বর্ণহিন্দুদের কুযুক্তি :

  • স্যার, এদের মন্দির করে পাপের কাজ করবেন না।
  • পাপ! পাপ কেন?
  • ওনাদের কি আপনি ভগবানের অবতার মনে করেন?
  • অসুবিধা কি? অনুকুল ঠাকুর, রাম ঠাকুর, জগদ্বন্ধু যদি ভগবান হয় তবে হরিচাদ গুরুচাদ হলে দোষ কি?
  • ওরা যে জাতে নমঃশুদ্র, আপনি জানেন?
  • না। নমঃশুদ্র হলেই বা কি?
  • অস্পৃশ্য ছোটজাতের দেহে কখনো ভগবান অবতার হতে পারেন না। এটি শাস্ত্রবিরোধী।

আমি এবার মিশাইল ছুড়ে দিলাম: শুকর খান আপনারা?

  • ছিঃ ছিঃ! এ সব নোংরা কে খায়? গু ময়লা খায়।
  • কচ্ছপ খান?
  • কেউ কেউ খায়। বেশির ভাগ খাই না।
  • মাছ?
  • তা তো সবাই খাই। তবে নিরামিশভোজীরা খায় না।
  • আচ্ছা। শুকর, কচ্ছপ, মাছের দেহে ভগবান অবতার হতে পারলে মানব দেহে হওয়া কি এতই খারাপ। হোক না সেই মানুষ তথাকথিত ছোটোজাত, কিন্তু তারা তো সর্বোপরি মানুষ?

উপস্থিত হিন্দুরা নিরব থাকল।

  • আপনারা বরাহ, কুর্ম্ম, মৎস্য, নৃসিংহ( অর্ধপশু আধামানুষ) অবতার মানেন?
    -তা তো মানি, তা তো মানি। হে হে হে করে তারা হাসল। জবাব দিল না।

এরপর থেকে প্রভাবশালী হিন্দুরা আমাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বয়কট করে। আর আমন্ত্রণ করত না।
আমার এতে দুঃখ হয়নি একটুও। মনে মনে ওদের ছিঃ বলেছি। এরপর থেকে আমি যদ্দিন বরিশালে বিভাগে ছিলাম তদ্দিন জেলায় জেলায় আমি মতোয়াদের ধর্মীয় সভায় গিয়েছি। অসংখ্য বক্তৃতা করেছি। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আমার বিষয়ে নানা কানকথা বলত, পরোয়া করিনি।
আরও পরে আমার পিএইচডি থিসিস করতে গিয়ে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ও বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকার সম্পর্কে পড়াশুনা করি এবং আমার বোধিসত্ত্ব লাভ হয়। ৪০ কোটি মানুষকে ছোটোজাত বলে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও মানবাধিকার থেকে যে ধর্ম হাজার হাজার বছর ধরে বঞ্চিত রেখেছে, এখনো রাখতে চায় সেটি তো অসুরের ধর্ম। মানুষের নয়। সেটির নাম যদি সনাতন হিন্দু হলেও তা আসুরিক। একে সকল হিন্দুর সার্বজনিক ধর্ম না করতে পারলে এর অধঃপতন ও অবক্ষয় ঠেকাবে কে?

ভানুলতা দাস ( বাংলাদেশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.