বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি

নমষ্কার বুদ্ধবাবু,
আপনার বিবৃতির কপিটি আজই হাতে পেলাম। ওই নিস্ফল বক্তব্যের জবাব দেওয়াটাও দরকার। পড়ে নেবেন।
আপনি লিখেছেন –

“… শিল্প আমাদের ভবিষ্যত”

  • কথাটা যদি বামফ্রন্ট সত্যিই বুঝে উঠতে পারতো তাহলে লালঝান্ডা লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে পঙ্গু করে দিল কে? পাটকল না হয় ছেড়েই দিলাম, হিন্দমোটর, বেঙ্গল ল্যাম্পকে বন্ধ করে দেওয়া হলো কেন? কেন ফিলিপসকে রাজ্য ছাড়তে হ’ল? ৪৫৪টা ফ্যাক্টরীর নাম লেখা যায়না বুদ্ধবাবু।
  • কেন আজ আপনার বামফ্রন্টকে সেই নন্দীগ্রাম/সিঙ্গুর থেকে কথা শুরু করতে হয়? তার আগের ২৫ বছরের হিসেব দিতে এত লজ্জা? আপনাদের জ্যোতি বসু যদি একটু লজ্জা সেদিন পেতেন আজ আপনাদের মুখ লুকানোর দরকার হতো না, বুদ্ধবাবু।
  • সেই অন্ধকারময় ৩৪ বছরে সারাদেশ থেমে থাকেনি, থেমে ছিল শুধু বামশাসিত আমাদের এই দুর্ভাগা পশ্চিমবঙ্গ। থামিয়ে রেখেছিলেন আপনারা। ধ্বংসের সেই মূল এত গভীরে পুঁতে দিয়ে গেছিলেন যে বিগত দশ বছরের শুরুতে নতুন সরকারও তার বাইরে বেরোতে পারলো না আর সিঙ্গুরটা ধ্বংস করে বসলো। খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনাদের ওই চিত্রনাট্যের “কুশীলব” কারা?

আজ যাদের চক্রান্তকারী বা যারা কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে বলছেন তাদের ওই পথ কি আপনারা দেখাননি? কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট আপনারা করেননি? বলছেন, সরকারী ক্ষেত্রে কোনো নিয়োগ নেই। বুকে হাত রেখে বলুন তো বামফ্রন্টের আমলে ক্যাডারের রাজনীতি আপনারা করেননি? সরকারী নিয়োগ কি নিরপেক্ষ ছিল? বাংলার মেধা কর্মদক্ষতা নিয়ে যদি বামেদের এতটুকু মাথাব্যাথা তাহলে বামআমলে ভিনরাজ্যে তা পাড়ি দিল কেন? ব্যাঙ্গালোর, গুরগাঁও, হায়দরাবাদ, হরিয়ানা কি নতুন কথা, ওগুলো বাম আমলে গড়ে ওঠেনি?

আপনারা বলছেন, গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে, মেনে নিলাম। আপনাদের আমলে কোনদিকে এগিয়ে ছিল স্ট্রাইক, লকআউট আর সর্বনাশা বাংলাবন্ধ ছাড়া?

যুবদের স্বপ্ন কি আজ প্রথম ভাঙলো? ধ্বংস ছাড়া আর কোন্ স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন আপনারা?

শিক্ষাঙ্গন নাকি কলুষিত হয়ে গেছে – মানলাম, কিন্তু বাম যুগে তা কলুষিত হয়নি? বিদ্যাসাগরের মাথা কি এই প্রথম কাটা গেল?

স্বাস্থ্যপরিষেবা – দক্ষিণ কলকাতার নিরাময় পলিক্লিনিক, যাদবপুরের যক্ষা হাসপাতাল প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছিল কারা? কাদের আমলে সরকারী স্কুলে পড়াশুনা লাটে উঠে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছিল নার্শারী ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল? শিক্ষার ধ্বংস কি সেদিনই হয়ে যায়নি?

না বুদ্ধবাবু, দুর্নীতি-তোলাবাজি-সিন্ডিকেট টিএমসির আমলে নতুন নয়। বিগত ২৫ বছরে তা আমাদের ধাতে সইয়ে দিয়েছেন আপনারা। মহিলাদের নিরাপত্তাও আপনাদের মুখে মানায় না ভট্টাচার্য্য মশাই, আপনাদের মহামান্য জ্যোতিবসু বানতলা কাণ্ডে বলেছিলেন “এমন তো কতোই ঘটে” যা একদিন কালস্রোতে হয়ে যায় “সাজানো ঘটনা”, তফাৎ শুধু শব্দচয়নে, মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আপনাদের কৃতিত্ব ছিল না বুদ্ধবাবু, ওটা হিন্দুদের হাজার বছরের দাসত্বের অভিশাপ, হিন্দুদের সমস্ত দেবদেবীর হাতেই অস্ত্র ছিল, এখনও আছে, নেই শুধু হিন্দুদের হাতে। কারণ হিন্দুদের বোঝানো হয়েছে তারা টলারেন্ট, হিন্দুদের বোঝানো হয়েছে, এক গালে চড় খেলে অন্য গাল বাড়িয়ে দিতে হয়, হিন্দুদের বোঝানো হয়েছে, লুঙ্গি পড়ে কেউ ধর্ষণ করতে এলে দাঁত দিয়ে জিভ চেপে চোখ বুজে থাকতে হয়। আমরা থেকেছি বুদ্ধবাবু আমরা থেকেছি, থাকেনি অন্যরা। শুধু চোখ বুজে থাকিনি, ৫০০টা পাকিস্তান গড়ে উঠলেও টলারেন্ট সেজে মুখ বুজে থেকেছি, কাশ্মীরে ৫০,০০০ হিন্দুকে নরসংহার করা হলেও বামফ্রন্টের সেই কলকাতা “এই অন্যায় আর না” বলে উঠতে পারেনি, বলতে দেননি আপনারা। বহুদূরের কিউবা বা প্যালেস্তাইনের ঘটনায় আপনাদের চ্ৎিকার শোনা গেলেও শুনতে পাওয়া যায়নি বিজন সেতুতে জীবন্ত জ্বলতে থাকা আনন্দমার্গীদের শেষ চিৎকার, শুনতে দেননি আপনারা। আরও আছে বুদ্ধবাবু আরও আছে। সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি কোথায় লুকোবেন আপনি? কোথায় লুকোবেন তাপসী মালিকের সেই আধপোড়া দেহ? পেটকাটা লাশ, যাতে করে সেগুলো ভেসে না ওঠতে পারে? গড়বেতা, কেশপুর, সাবং, ছোট আঙারিয়া, কোতলপুর, খানাকুল, গোঘাট আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন বুদ্ধবাবু। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে যতদূর দেখা যায় চেষ্টা করে দেখুন ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো শুভমুহূর্ত দেখতে পান কিনা!

আর স্বৈরতন্ত্রের কথা বলছেন? “আই এ্যম দ্য গভর্নমেন্ট”, “লালা বাংলা ছেড়ে পালা” বাঙালি এখনও ভুলতে পারেনি সে ইতিহাস।

মিঃ ভট্টাচার্জ, দয়া করে অর্থনীতির জ্ঞান দেবেন না। ১ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ আপনারা রেখে গেছেন, সর্বনাশ যা হওয়ার তা কি আপনাদের হাতে হয়নি? মরাকান্না কাকে দেখাচ্ছেন? যুবক-যুবতীদের?

হ্যাঁ, নতুন প্রজন্মের হাজার হাজার যুবক-যুবতী যাকে বোঝার তাকে ঠিকই বুঝে গেছে, আর যাকে চেনার চিনেও নিয়েছে তাকে। ওদের ভালোটা ওদেরই বুঝতে দিন। খেলা অনেক খেলেছেন আপনারা, এবারের খেলাটা ওদেরই খেলতে দিন।

পরের কথায় আসি। আবারও মারাত্মক একটা ভুল করে বসলেন মিঃ ভট্টাচারিয়া। সামান্য কটা সিটের লোভে আইএসএফ -এর মতো একটা ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দলকে জড়িয়ে ধরলেন? যারা ১০০ কোটি দেশবাসীর মৃত্যুকামনা অনায়াসে করতে পারে শুধু ধর্মের কারণে। হিন্দুহত্যা, হিন্দুনারী ধর্ষণ যাদের ধর্মের আদেশ, তাদের সঙ্গে হাত মেলালেন? এতটা নীচে তো জ্যোতিবসুও নামেননি কোনদিন। ছিঃ বুদ্ধবাবু, ছিঃ!!! কাফের হত্যা যদি আল্লার আদেশ হয়, বলতে পারেন ঈশ্বরের আদেশে কেন আপনারা নির্বংশ হবেন না?

আপনি ভালো নেই বুদ্ধবাবু, তবু ভালো থাকবেন কথাটা বলতে পারলাম না…

৩০.০৩.২০২১
কলকাতা
প্রজার চোখে

তথাগত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.