সততার মুখোশে শতছিদ্র

পরিবারটি টালির ঘরে বাস করত, মাত্র আট/নয় বছরে ৩৫টি প্লট ও ৩৯টি বাড়ী/ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে৷ শোনা যায় বর্তমানে কালীঘাট সংলগ্ন আদি গঙ্গার ধার বরাবর সব জমিই এদের দখলীকৃত৷ শুধু কালিঘাট থানা এলাকায় বাড়ি আছে কুড়ি খানা।
১) ৮০এ, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
২) ৩৭এ, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৩) ৫৬ হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৪) ২৯সি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৫) ২৯ডি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৬) ৩০এ, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৭) ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৮) ৩১ হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
৯) ৪৫ হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
১০) ৪৫ডি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
১১) ৪৪সি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট
১২) ৩৩বি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট,
১৩) ১৮৮এ, হরিশ মুখার্জী স্ট্রীট
১৪) ৮৫/১ হরিশ মুখার্জী স্ট্রীট
১৫) ৩ পার্বতী চক্রবর্তী লেন
১৬) ২৪ রাণী শঙ্কর লেন
১৭) ২৫ রাণী শঙ্কর লেন
১৮) ১২১ কালীঘাট রোড
১৯) ৪৯সি, কালীঘাট রোড
২০) ৭৬/৩ কালীঘাট রোড
আধ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫টি প্লট, কোথাও জমি, কোথাও ফ্ল্যাট বাড়ি। ৩৫টি প্লটের মালিকানাই একটি মাত্র পরিবারের হাতে। এই কলকাতা শহরে এমন কোনও পরিবার আছে যারা জাদুকাঠির ছোঁয়ায় মুড়ি মুড়কির মতো তাদের জমি, বাড়ির সংখ্যা শুধুই বাড়িয়ে যেতে পারে? এই শহরের দক্ষিণ প্রান্তেই এখন দু’টি লেনের সিংহভাগ এলাকা চলে এসেছে একটি মাত্র পরিবারের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই তা একাধিক গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের হাতছাড়া হয়েই ঐ পরিবারের দখলদারিতে এসেছে।
কোন সেই পরিবার? জমি দখলের ইতিবৃত্তেই স্পষ্ট রাজ্যের সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী‘ পরিবারের কীর্তি!
একদিকে কালীঘাট মোড় থেকে কালীঘাট রোডের সপ্তপল্লি ক্লাব পর্যন্ত। অন্যদিকে কালীঘাট মোড় থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ৪৪ কলোনি পর্যন্ত। বিস্তীর্ণ এই এলাকায় এখনও পর্যন্ত ৩৫টি প্লট চলে এসেছে সেই পরিবারের হাতে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ এই পরিবারের দখলেই এখন কার্যত উক্ত অঞ্চলের সিংহভাগ এলাকা। শহরের এই প্রান্তের অনুপ্রেরণার ছোঁয়ায় একের পর এক পরিবার হয় জমি বেচে দিচ্ছেন নতুবা জোর করে উচ্ছেদের মুখে। জমি মাফিয়ার শহুরে সংস্করণ কী হতে পারে তার ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে উঠছে ক্রমেই এই তল্লাট। কালীঘাট মোড় থেকে ৪০০ গজ দূরত্বের মধ্যেই রয়েছে এমন ১৭টি প্লট যার প্রত্যেকটির দখলদারি এই পরিবারের হাতে। ঠিকানা সব পাশাপাশি। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানায় ২৯ সি, ২৯ডি, ৩০ এ, ৪৫ এ, ৪৫ ডি, ১২ নম্বর, ৮২ বি, ৮০ এ। কালীঘাট রোডে ৪৯সি, ৬৩/৮, ৭৬/৩। এছাড়াও ৩ নম্বর পার্বতী চক্রবর্তী লেন, ২৪-২৫ রানি শঙ্করী লেন। এই প্রতিটি প্লটের এই পরিবার সংক্রান্ত আত্মীয়স্বজনদের দখলে। মাত্র ৪০০ গজ দূরত্বেই একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের ১৭টি জমি বা বাড়ি বা ফ্ল্যাট। গোটা রাজ্যে জমি কারবারের ‘অনুপ্রেরণা’ কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে সন্দেহের আর অবকাশ নেই।

৩০/ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের রাজ্যবাসীর কাছে পরিচিত ঠিকানা। ঠিক তার গায়ে লাগানো পাশের জমিটির ঠিকানা ৩০/এ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এর পিছনে দিয়েই বয়ে গেছে আদি গঙ্গা। বন্দরের জমি। বন্দরের জমির সেই পিলার অতিক্রম করেই বেবাক বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে আদি গঙ্গার একাংশ। মুখে কুলুপ পরিবেশবিদদেরও। এতটাই ‘প্রভাবশালী’ পরিবার। সেখানেই উঠেছে দোতলা বাড়ি। বাড়ির ছাদে মোহনবাগানের রঙে কংক্রিটের নৌকা। বাড়ির মালিক কে? সেই পরিবারের এক ভাই। মোহনবাগানের ফুটবল সচিব, বেঙ্গল হকি সংস্থার সচিবও তিনি। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টালিনালার একাংশ বুজিয়ে পোর্ট ট্রাস্টের জমিতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাঁর দোতলা নৌকা বাড়ি।
ঘটনা এখানেই শেষ হচ্ছে না। বরং তা শুরু।

সেই প্রভাবশালী মহিলার বাড়ির গা ঘেঁষে এই ৩০/এ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানা। এই ঠিকানার একটি অংশের মালিকানা জয়ন্ত দাসের। অন্য একটি অংশের মালিকানা সাধন চক্রবর্তীর। এই সাধন চক্রবর্তীর জমি তাঁরই ঘনিষ্ঠ অনুগামীর মাধ্যমে এখন সেই ভাই এর হাতে। এই ঠিকানার পিছনেই আদি গঙ্গা বুজিয়ে তাঁর বাড়ি। এই ৩০/এ ঠিকানার জমিতে এখনও রয়েছে তিনটি পরিবার, ভাড়াটিয়া হিসাবেই। প্রয়াত গণেশচন্দ্র দে’র মেয়ে বুলা দে থাকেন একটি ঘরে ভাড়াটিয়া হিসাবে। কমল হালদারের দুই বিবাহিত মেয়ে থাকেন সেখানে। তিনটিই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। আদিগঙ্গা বুজিয়েও খিদে মেটেনি। এখন এই জমি দখল নিতে উদগ্রীব সেই ভাই, এমনই অভিযোগ ভাড়াটিয়া ও এলাকাবাসীদের। তাঁদের উচ্ছেদের জন্য চলছে প্রতিনিয়ত হুমকি। এই প্লটের এই তিনটি পরিবারকে উচ্ছেদ করতে পারলে সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াবে আরেকটি বহুতল।

ইতিমধ্যে গত মঙ্গলবার ঐ বাড়ি তিনটির জলের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমনই আতঙ্ক যে তাঁরা পুলিশে অভিযোগ করতেও ভয় পাচ্ছেন। যদিও এক স্থানীয় তৃণমূল নেতার কথায়, সমস্যা কোথায় আপনাদের? অযথা সমস্যা বাড়াচ্ছেন। ওই পরিবারগুলিকে তো উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী সেই বিকল্প ব্যবস্থা?
রাস্তার উলটোপ্রান্তেই ৪৫/৪ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানার জমি। দেবোত্তর সম্পত্তি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, কোনও আইন এখানে নেই। দেবোত্তর সম্পত্তিও দখল হয়ে গেছে। আগে এখানে ছিল বড়ুয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি। এখন সেখানে রাতারাতি বহুতল হয়েছে। লম্বা পাইপের মতো সেই বহুতল। সেখানেই এক চিলতে করে জায়গা দিয়ে ঐ তিনটি পরিবারকে ৩০/ এ জমিটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চলছে হুমকি।
ঠিক যেভাবে হয়েছে দীপক হাজরার গ্যারেজ দখলের অভিযান। তা নিয়ে এখনও মামলা চলছে আদালতে। এখানে অভিযোগ সেই মহিলার দাদার বিরুদ্ধে।
হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে আদি গঙ্গার ধারে ১০,১১, ১২,১৩ নম্বর প্রেমিসেস নম্বরের চারটি জমির প্লট। ওখানেই গ্যারেজ চালিয়ে সংসার চালানো, এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা দীপক হাজরা ৮০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা। রাস্তার উলটোদিকে গঙ্গার ধারে তাঁদের দাদু, ঠাকুরদাদের দীর্ঘদিনের জমি রয়েছে। দীপক হাজরার অভিযোগ, ইতিমধ্যে সেই মহিলার দাদা তাঁর দাদার নামের ঠিকা প্রজাসত্ত্বের জমি দখল নিয়েছে। এখন নতুন করে ১৩ নম্বর প্রেমিসেসের জমি দখল করতে চাইছে যা দীপক হাজরার দাদুর নামে কেনা জমি। পাশের ১২ নম্বর দাগের জমিটিও ঠিকা প্রজাসত্ত্বের জমি। ১২ ও ১৩ নম্বর জমির কিছু অংশজুড়ে রয়েছে দীপক হাজরার গ্যারেজ। এখন সেটিও গায়ের জোরে মুখ্যমন্ত্রীর দাদা দখল করতে চাইছেন। জমি দখলে হামলা চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাদা’র বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর’ও হয়েছে। সেই ‘অপরাধে’ পুলিশের মদতেই আরও এক প্রস্থ মার খেতেও হয়েছে দীপক হাজরাকে। এখন সেই জমিতে কাগজে লেখা নোটিস টাঙানো হয়েছে, ‘দিস প্রপার্টি বিলংস টু **’।
সততার মুখোশে শতছিদ্র। একের পর এক জমি চলে আসছে সেই প্রভাবশালী পরিবারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.