দ্বিতীয় ভাগ
২০০০ এর গোড়ার দিকে ব্যবসায়ী সুদীপ্ত সেন সারদা গ্রুপ তৈরি করেন। সারদা গোষ্ঠী ছিল অনেকগুলি কোম্পানিকে নিয়ে তৈরি করা এক কনসোর্টিয়াম, যারা ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করে। একেবারেই ক্লাসিকাল পঞ্জি (ponzi) স্কিমের ধাঁচে কাজ চলতে থাকে, এজেন্টদের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু হয়। এজেন্টদের কমিশন ছিল ২৫ শতাংশের বেশি।
কয়েক বছরের মধ্যেই ২৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলে ফেলে সারদা। ফিল্মস্টারদের এনডোর্স করে, জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবে বিনিয়োগ করে, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের মালিকানার মাধ্যমে, দুর্গাপুজো সহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানের স্পনসরশিপের মাধ্যমে নিজেদের ব্র্যান্ড বানিয়ে ফেলে। সারদার ব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে পৌঁছে যায় ওড়িশা, আসাম এবং ত্রিপুরাতেও। বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ১৭ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
২০১২ সালে আমেরিকার লাস ভেগাসে বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন।
২০০৯ সালে সারদার জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন রাজনীতিবিদরা। ২০১২ সালে সারদাকে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে নিষেধ করে সেবি। ২০১৩ সালে প্রথমবার, সারদায় নগদ আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখনই বিপদঘণ্টি বেজে ওঠে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে গোটা স্কিম ভেঙে পড়ে। বিনিয়োগকারী এবং এজেন্টদের পক্ষ থেকে বিধাননগর পুলিশের কাছে শয়ে শয়ে অভিযোগ জমা পড়ে। সুদীপ্ত সেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে যান। তার আগে ১৮ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে যান তিনি, যে চিঠিতে বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে। অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাঁর হাত মুচড়ে রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত টাকা নিয়ে নেওয়ার ফলেই এই স্কিম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সোনমার্গে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন।সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহযোগী দেবযানী মুখার্জি।
লগ্নিকারী এবং এজেন্ট মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যাটা বেশ কয়েক লক্ষ, তবে ঠিক কত টাকা তাঁরা সারদার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেটা এখনও অজানা৷ কারণ, ওই আমানতের সঠিক কোনও হিসেব নেই৷ হিসেব রাখাই হয়নি৷ তবে সারদা রিয়েলটির মালিক সুদীপ্ত সেন তাঁর এই চিট ফান্ড ব্যবসার সুবাদে যে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বানিয়েছিলেন, টাকার অঙ্কে সেটা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা৷ অবশ্য এটা নেহাতই গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমানভিত্তিক সেই বিরাট অঙ্কের টাকার কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি এখনও৷এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত কাগজপত্র অনুযায়ী সংস্থার মোট ১৫৬ টি ব্যবসার মধ্যে ১৬ টি ব্যবসা লাভে চলত৷শেষ
দুবছরে সারদা গোষ্ঠীর প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা ফেরত দিতে হত, যা তাদের পক্ষে দেওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব৷ জানা গিয়েছে, ১৭ থেকে ২৪ এপ্রিল মোট ১৩
হাজার ভুয়ো পলিসি জমা করা হয়েছিল৷ আবার এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে জমা পড়েছিন ১৪ কোটি টাকার ভুয়ো ৩২ হাজার পলিশি৷ ফেব্রুয়ারি মাসে এক
লক্ষ ৩০ হাজার পলিশি জমা পড়ে যার মূল্য ৬২ কোটি টাকা৷সারদা গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ হিসেব নিকেশ দেখার জন্য সত্যম কাণ্ডে নিযুক্ত হিসাবরক্ষক সংস্থা প্রাইজ ওয়াটার কুপার্সকে দিয়ে অডিট করানো হয়েছিল ৷
এই অডিট অনুযায়ী ১০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ২৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
তদন্তে জানা যায় দুবাই, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সিঙ্গাপুরেও বিনিয়োগ করেছিল সারদা গোষ্ঠী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমস্ত এফআইআর একসঙ্গে তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল তৈরি করে। একই সময়ে আসাম সরকার এ বিষয়ে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পর তদন্ত শুরু করে সিবিআই-ও। ইডি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার জন্য শীর্ষ আদালতে মামলা করেছিলেন প্রতিম সিংহরায়, আবু আব্বাসউদ্দিন এবং সুব্রত চট্টরাজ। একই ভাবে ওড়িশার ৪৪টি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন অলোক জেনা। যার মধ্যে সারদা-সহ ১৭টি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গের।
ওড়িশা, অসম, ত্রিপুরা রাজি হলেও সারদা মামলায় সিবিআই তদন্তে সায় দেয় নি এ রাজ্য। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের আইনজীবীর আর্জি ছিল পশ্চিমবঙ্গে সারদা মামলায় তদন্তভার থাকুক সিটের হাতেই।
সারদা সংস্থার টাকা কোথায় গেল, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ৫০০ পাতার রিপোর্ট জমা দেয় রাজ্য সরকার। তা দিয়েও সুপ্রিম কোর্টকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি রাজ্য।
সুপ্রিম কোর্ট সারদা তদন্তে অসন্তোষের কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল। সারদা কাণ্ডকে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছিল এতে লাভবান কারা হয়েছে?
সারদা-র আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে দায়ের হওয়া মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে সারদা সংস্থা যে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছিল, তা কোথায় গেল? যদি তার তদন্ত না হয়ে থাকে, তা হলে সেটা গাফিলতি হিসেবেই ধরা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৪ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত মামলা সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করে। এক বছর ধরে বিশেষ তদন্ত দল যা তদন্ত করেছিল, সে সমস্ত কাগজপত্র এবং তথ্য প্রমাণ এবং অভিযুক্তদের সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল তাদের।
সিবিআই তদন্ত শুরু করার পর বার বার অভিযোগ ওঠে রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে চরম অসহযোগিতার৷ এই মামলার প্রধান আসামী সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন এবং অন্য এক অভিযুক্ত, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ, পরবর্তীতে দল থেকে সাসপেন্ড হওয়া সাংবাদিক কুনাল ঘোষ – দুই বিচারাধীন বন্দিই বার বার অভিযোগ করেন যে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা তদন্তের নামে কার্যত সারদা দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ লোপাট করতে ব্যস্ত৷ তা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এই তদন্ত সম্পর্কে আদতে কতদূর দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা সম্প্রতি ফের বোঝা গেল সারদা-নথি বোঝাই গোটা একটি আলমারি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায়৷ প্রশাসন তখনও নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল যে, রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নবান্ন ভবনে সচিবালয় সরানোর সময় সম্ভবত আলমারিটি অন্য কোথাও রাখা হয়েছে!
আশ্চর্য যে এর আগে তদন্ত করেও পশ্চিমবঙ্গের সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির মূল প্রশ্নটিরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পুলিশ!
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে মাত্র তিনটি মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ছাড়া পুলিশের কিছু করার ছিল না৷ এক, বাজার থেকে ঠিক কত টাকা তুলেছিল সারদা চিট ফান্ড, দুই, সেই টাকা কোথায় গেল এবং তিন, কে বা কারা এর দৌলতে লাভবান হয়েছিল৷
অথচ টানা এক বছর ধরে তদন্ত করেও এই তিনটি বিষয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারেনি রাজ্য পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডি৷
ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছিল রাজ্যের কয়েক লক্ষ পরিবার। বিক্ষোভ চলছিল রাজ্যজুড়ে। নাম জড়িয়েছিল সাংসদ, রাজনীতিক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। ভুইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, আগামী ছয়মাসের মধ্যেই রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে রাজনৈতিকদেরও।পরবর্তীকালে চিটফান্ড মামলার তদন্তে পুলিসের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন শ্যামল সেন কমিশন। সারদা ছাড়াও বহু চিটফান্ড সংস্থার মামলা চলছিল কমিশনে। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই সমস্ত চিটফান্ড মালিকদের শুনানিতে হাজির করতে ব্যর্থ হ্য়েছিল পুলিস।
চিটফান্ড প্রতারিতদের জন্য গঠিত শ্যামল সেন কমিশনে এক বছরে জমা পড়েছিল লক্ষ লক্ষ অভিযোগ। হিসেব অনুযায়ী, শ্যামল সেন কমিশনে মোট অভিযোগ জমা পড়েছিল প্রায় ১৭ লক্ষ। এর মধ্যে সারদার সঙ্গে জড়িত নয় এমন অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। আমানতকারীদের অভিযোগ, বেশিরভাগ মামলায় চিটফান্ড মালিকদের শ্যামল সেন কমিশনের সামনে আনতেই পারছিল না পুলিস। যুগান্তর পরিবার চিটফান্ডকাণ্ড এমনই একটি মামলার উদাহারণ। এই চিটফান্ড সংস্থার মালিককে হাজির করাতে বহুবার পুলিসকে নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু কোনওবারই তা সম্ভব হয়নি। বরং পুলিসের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মালিকের বাড়িতে তালা। তাঁকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। চিটফান্ড কর্তাদের গ্রেফতার করার বদলে বহুক্ষেত্রে উল্টে আমানতকারীদেরই হেনস্থা করছিল পুলিস, এমন অভিযোগও উঠেছিল ।
সিবিআই তদন্তভার নেওয়ার পর নিম্নলিখিত ধারাগুলিতে সুদীপ্তর বিরুদ্ধে মামলা হয়,
১]৪২০ ধারা অনুসারে প্রতারণা
২]৪০৬ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ
৩]৫০৬ ধারা অনুসারে অপরাধমূলক প্রবণতা
৪ [১২০বি ধারা অনুসারে ষড়যন্ত্র
৫ [চিটফান্ড ও মানি লন্ডারিং আইনের ৪ ও ৭ ধারা। এর সবকটিই ফৌজদারি মামলা।
অন্যদিকে, টাকা ফেরত পেতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত ধারাগুলিতে মামলা হয়,
১. দেওয়ানি বিধির ১৯ ধারা অনুসারে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা ।
২. যেহেতু আমানতকারীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ তাই দেওয়ানি বিধির অর্ডার ১, রুল ৮ অনুসারে ।
৩. অর্ডার ৪০ অনুসারে আদালতে রিসিভার বসানোর জন্য আবেদন ।
৪. দেওয়ানি বিধির অর্ডার ৩৮ রুল ৫ অনুসারে আদালত সন্তুষ্ট হলে মামলার নিষ্পত্তির আগেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ চাওয়া ।
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত চলার মধ্যেই চেক বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। প্রায় চার লক্ষ আমানতকারীকে চেক বিলি করা হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ উঠেছিল এদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত আর টাকা পাননি।
সিবিআই তদন্ত হাতে নেওয়ার পর খুলে যায় প্যান্ডোরার বাক্স। ঝুলি থেকে বেরোতে থাকে একের পর এক বিড়াল। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রাজনীতি অভিনয় ও ক্রীড়া জগতের তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ প্রমাণিত হতে থাকে ।
তবু এই মামলার তদন্তে পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই-এর প্রথম গ্রেপ্তারিটি অনেকেরই ঘুম কেড়ে নিয়েছিল৷ কলকাতার দুই প্রধান ফুটবল ক্লাবের অন্যতম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা দেবব্রত সরকারকে কয়েক দফায় জেরার পর গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই৷ বিতর্কিত এই ক্লাবকর্তা সারদার চিট ফান্ড ব্যবসা অবাধে চলার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক এবং দেশের আর্থিক লেনদেন নিয়ামক সংস্থা সেবি-র কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলে অভিযোগ৷ এবং সারদা-মালিক ফেরার হওয়ার আগে সিবিআই-কে যে চিঠি লিখে গিয়েছিলেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন যে ওই রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করার জন্য দেবব্রত সরকারকে তিনি কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন প্রায় তিন বছর ধরে৷
এছাড়াও সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ ছিল, চিট ফান্ড ব্যবসার মাধ্যমে যে বিপুল অঙ্কের টাকা বাজার থেকে সারদা তুলেছিল, তা বেশিটাই খরচ হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের দিতে, বা চাপে পড়ে অলাভজনক সংস্থা বাজারদরের থেকে অনেক বেশি দামে কিনতে গিয়ে৷ এ ছাড়া মিডিয়া ব্যবসায় লগ্নি করাটাও ভুল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছিলেন সারদা-কর্তা৷ কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এই প্রতিটি অভিযোগ খুঁটিয়ে দেখছে এবং এর মধ্যেই তদন্তে ধরা পড়েছে, রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী, তৃণমূল বিধায়ক শ্যামাপদ মুখার্জি প্রাপ্যের থেকে অনেক বেশি দামে নিজের একটি লোকসানে চলা সিমেন্ট কারখানা সারদা গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করেছিলেন৷ কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই৷
যেমন একইভাবে একটি খবরের কাগজ সুদীপ্ত সেনকে কিনতে বাধ্য করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আর এক রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান৷ তিনি আবার সুদীপ্ত সেনের থেকে টাকা নিয়েছিলেন, কিন্তু কাগজের মালিকানা হস্তান্তর করেননি! তাঁকেও সমন পাঠিয়েছিল সিবিআই, কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায় এখন আদালতে গিয়ে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার কথা ভাবা হচ্ছে৷ তাঁর বাড়িতেও তল্লাসির জন্য হানা দিতে পারেন সিবিআই গোয়েন্দারা৷ এদিকে সুদীপ্ত সেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আদালতে আর্জি জানিয়েছিলেন যে তাঁকে সিবিআই হেফাজতে পাঠানো হোক, কারণ তাঁর অনেক কিছু বলার আছে৷ আদালত সেই আর্জি মঞ্জুর করেছে৷
অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার সিবিআই-এর জেরার জবাবে অনেক তথ্যই ফাঁস করেছিলেন৷ যেমন জানা গিয়েছে যে সুদীপ্ত সেনকে চাপে রেখে নিয়মিত আদায় করা কোটি কোটি টাকার এক বড় অংশ আরও দুই ক্লাবকর্তা নিজেদের ব্যবসায় খাটাতেন৷
শুধু সিবিআই নয় ।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে কলকাতা পুলিসের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছিল ইডি।সারদার ডায়মন্ডহারবার রোডের অফিসে ইডির তল্লাসি ঘিরে উঠেছিল এই অসহযোগিতার অভিযোগ। বেহালার ৪৫৫ নম্বর ডায়মন্ড হারবার রোডের অফিসে সকাল এগারোটা থেকে তল্লাসির কথা ছিল ইডির।
প্রায় একবছর ধরে তালাবন্ধ অফিসের চাবি ছিল বেহালা থানার কাছে। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ পুলিসের থেকে চাবি নিতে বেহালা থানায় পৌছে যান ইডির অফিসাররা।
অভিযোগ, ইডির কর্তাদের সারদার অফিসের চাবি দিতে টালবাহানা করে পুলিস। এগারোটা থেকে তল্লাসির কথা থাকলেও, তা শুরু করতে পেরিয়ে যায় চার ঘণ্টারও বেশি সময়। বিস্তর টালবাহানার পর বিকেল তিনটে নাগাদ ইডির কর্তাদের হাতে অফিসের কিছু চাবি তুলে দেয় পুলিস। সেই চাবিগুলি দিয়ে অফিসের কিছু শাটার খোলা গেলেও, অনেক শাটারই খোলা সম্ভব হয়নি। এরপরই তালাগুলি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় ইডি। তালা ভেঙে তল্লাসি শুরু করতে বিকেল গড়িয়ে যায়। কলকাতার ৪৫৫ নম্বর ডায়মন্ড হারবার রোডে সুদীপ্ত সেনকে উনসত্তরটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা।অভিযোগ উঠেছিল , লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছিল। অনিয়মে মদত ছিল মেয়রের।
পুলিসের অসহযোগিতা সত্ত্বেও সারদার বিপুল অর্থে কারা লাভবান হয়েছে সেবিষয়ে বিস্ফোরক তথ্য পেয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। ইডি গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন,কয়েকজন রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, নাট্যকর্মী ও দুই সাংবাদিক সারদার টাকায় লাভবান হয়েছেন। ইডি-র তদন্তে উঠে এসেছিল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছিল, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নিলামে কয়েক কোটি টাকায় কিনে ছিলেন সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনই।
তাঁর স্ত্রী পিয়ালি সেনের অ্যাকাউন্ট থেকেই সেই টাকা দেওয়া হয়েছিল। পিয়ালি সেনের অ্যাকাউন্ট থেকে এরকম আরও বেশকিছু লেনদেনের তথ্য হাতে এসেছিল ইডি-র গোয়েন্দাদের। একইসঙ্গে খোঁজ মিলেছিল কিছু রহস্যময় অ্যাকাউন্টেরও। লগ্নিকারীদের টাকা সারদার অ্যাকাউন্টে জমা প়ড়ার পরই চলে যেত এই সব অ্যাকাউন্টে। গোয়েন্দাদের সন্দেহ এই বেনামী অ্যাকাউন্টগুলির মাধ্যমেই সারদা কর্তা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে টাকা পাঠাতেন।
সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেন কল রেকর্ড পরীক্ষা করে মিলেছিল চাঞ্চল্যকর তথ্য। ৪০টি বিশেষ নম্বরের হদিশ পেয়েছি ইডি। তারমধ্যে পাঁচটি নম্বর রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তির। ইডি (ED) সূত্রের খবর, সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরেও ৪০টি নম্বরে নিয়মিত ফোন করতেন পিয়ালি সেন। এমনকি নিজে গ্রেফতার হওয়ার আগেও রাজ্যের ওই পাঁচজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নম্বরে ফোন করেছিলেন সারদা কর্তার স্ত্রী।
ব্র্যান্ড তৈরির জন্য রাজনৈতিক সম্পর্ক পোক্ত করে তুলেছিলেন সুদীপ্ত সেন। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমের দখল নিয়েছিলেন তিনি এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও বিনিয়োগ করেছিলেন। টিএমসি সাংসদ তথা চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শতাব্দী রায় এবং রাজ্যসভার সদস্য মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন সারদার ব্র্যান্ড অ্যম্বাসাডর। ২০১৩ সালের মধ্যে সারদা পাঁচটি ভাষায় ৮টি সংবাদপত্র চালাতে থাকে। ১৫০০ সাংবাদিক কাজ করত তাদের অধীনে। গোটা সংবাদগোষ্ঠীর সিইও ছিলেন টিএমসি সাংসদ কুণাল ঘোষ। তাঁর বেতন ছিল মাসে ১৬ লক্ষ টাকা।
তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে নামমাত্র টাকায় চ্যানেল বিক্রি করার অভিযোগ এনেছিলেন সারদা–কর্তা সুদীপ্ত সেন৷
কুণাল ঘোষকে ধরেই তিনি রাজ্য সরকারকে নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন৷ …সারদার কর্ণধার তার মিডিয়া ব্যবসার মাথা হিসাবে কুণালকে মাসে ১৫ লক্ষ টাকা মাইনে দিতেন৷ তৃণমূলের এই রাজ্যসভার সাংসদ-সাংবাদিক সারদা গোষ্ঠীর প্রায় ১০টি খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলের সর্বেসর্বা ছিলেন৷ একদিকে এইসব কাগজ এবং চ্যানেল যেমন সবসময় তৃণমূল সরকারের গুণগান গাইত, সরকারও অন্যদিকে তাদের জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের বরাদ্দ বাড়িয়ে, সরকারি দপ্তর এবং পাঠাগারে ওই কাগজগুলি নিয়মিত কেনার বরাত দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করত৷
…সিবিআইকে লেখা সুদীপ্তর চিঠিতে কুণাল ছাড়াও তৃণমূলের আরও এক রাজ্যসভার সদস্য সৃঞ্জয় বসু সম্পর্কেও বলা হয়েছিল অনেক কথা৷ তাঁর সম্পাদিত বাংলা দৈনিকের (সংবাদ প্রতিদিন) সঙ্গে মাস প্রতি ৬০ লক্ষ টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়৷ সুদীপ্ত এই চিঠিতে দাবি করেছিলেন, কুণাল অ্যান্ড কোম্পানি তাঁকে আশ্বাস দেয়, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দিক থেকে তাঁর ব্যবসাকে পুরো সুরক্ষিত করা হবে৷
এছাড়াও সিবিআই বেশ কিছু তৃণমূল বিধায়ক ও সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র( তৃণমূলের এই মন্ত্রী সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টদের প্রকাশ্য সভায় সুদীপ্ত সেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই সংস্থাকে তাঁরা বুক দিয়ে রক্ষা করবেন)ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে।
এছাড়াও সিবিআই এবং ইডি’র জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল অনেককে। তাদের মধ্যে রয়েচেন মিঠুন চক্রবর্তী, অপর্না সেন, নাট্য ব্যক্তিত্ব ও তৃণমূল সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, রাজ্য সভার তৃণমূল সাংসদ ইমরান হাসান, পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্রের প্রাক্তন অপ্ত সহায়ক বাপী করিম। যার মধ্যে বাপী করিমকে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে গিয়ে সারদা গোষ্ঠীতে কাজ করতেন এমন কিছু কর্মীর কাছ থেকে বাপী করিমের তথ্য পেয়েছিল সিবিআই। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন কলকাতায় সারদার মিডল্যান্ড পার্কের কার্যালয়ে যেতেন বাপী করিম।
সারদা কর্মীরা সিবিআই-কে জানিয়েছিলেন সাধারণত রাতেই সারদা অফিসে যেতেন বাপী করিম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে আলাপ আলোচনা করে বের হওয়ার সময় একটি প্যাকেট নিয়ে বের হতেন।
সুদীপ্ত সেন পূর্ব ভারত ছাড়িয়ে চিটফান্ডের জাল বিস্তার করতে চেয়েছিলেন উত্তর ভারতের গো–বলয়েও৷ সেই পথ প্রশস্ত করতে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল টাকাও ঢেলেছিলেন৷ এবং অভিযোগ, সেক্ষেত্রেও তৃণমূলই ছিল সারদা কর্তার প্রধান ভরসা৷ বস্তুত উত্তরপ্রদেশে তৃণমূল যাতে প্রার্থী দেয়, সেজন্য সবিশেষ আগ্রহী হয়েছিলেন সারদা কর্তা৷ সূত্রের খবর, এর জন্য সমাজবাদী পার্টির এক প্রাক্তন নেতা এবং কংগ্রেসের এক প্রাক্তন এম পি–কে কাজে লাগানো হয়৷ উত্তরপ্রদেশে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃণমূল৷ সারদা কর্তার সমর্থনপুষ্ট হয়েই প্রচারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রার্থীরা৷ ব্যবসার সমস্যা এড়াতে তৃণমূলের এক সর্বভারতীয় শীর্ষ নেতার পরামর্শেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন বলে জেরায় জানিয়েছিলেন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন৷ …পালিয়ে থাকার সময় ঐ নেতা যোগাযোগ রাখার জন্য তাঁকে তিনটি নতুন প্রি–পেড সিমকার্ড কিনে দিয়েছিলেন৷ উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং মণিপুরের তিন তৃণমূল নেতা মারফত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন ঐ নেতা৷
ভারতীয় রেলের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেল মন্ত্রী থাকাকালীন সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি চুক্তির খবরও প্রকাশ্যে এসেছিল। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কে অর্থনৈতিক সাহায্য করাই নয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু কাজেও অর্থনৈতিক সাহায্য করেছিল সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী এবং তৎকালীন আসামের শাসক দল কংগ্রেসের সঙ্গে ও 2011 সালের আগের পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল সিপিএমের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ছিল মধুর ।
কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী।
আসামের এক চ্যানেলের মালিক, কংগ্রেস নেতা মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী মনোরঞ্জনা সিংহ তার কাছ থেকে ২৫ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে সুদীপ্ত অভিযোগ করেছিলেন৷ অভিযোগ অনুযায়ী, মনোরঞ্জনা ও তাঁর আইনজীবী নলিনী চিদম্বরম মনোরঞ্জনার চ্যানেলে ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সুদীপ্তকে চাপ দিচ্ছিলেন৷ চিঠিতে অভিযোগ, মনোরঞ্জনা লোভ দেখান, নলিনীও বলেন তাঁর স্বামী কেন্দ্রে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম সারদার পাশে দাঁড়ালে ব্যবসার উন্নতি অবধারিত৷ নভেম্বর ২০১২ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু) মনমোহন সিং– কে চিঠি পাঠিয়ে সারদা সহ চিটফান্ডগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন৷ তিনি এই অভিযুক্তের তালিকা থেকে সুদীপ্ত সেন ও তার কোম্পানিকে অব্যাহতি দিতে বলেন৷
রাজস্থান ও ওড়িশায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেস এবং বিজু জনতা দলের কয়েকজন নেতাকে ধরে এগোতে চেয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন৷ ওই দুই রাজ্যে, যথাক্রমে উদয়পুর এবং ভুবনেশ্বরে সারদার ব্রাঞ্চ অফিসও খোলা হয়৷ তবে এই দুই রাজ্যে শেষপর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি সারদার কর্তার পরিকল্পনা৷ বাংলার মতো কোনও রাজ্যেই বস্তুত রাজনীতির কারবারিদের হাত ধরে তাঁর ব্যবসার পরিকল্পনা তেমন দাঁড়ায়নি।
জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা সারদার সাম্রাজ্য মসৃণভাবে চালাতে গেলে স্থানীয় থানাগুলিকে ‘রসেবশে’ রাখা যে জরুরি, তা সুদীপ্ত সেন ভালই বুঝেছিলেন৷ তাই নিরাপদে চিটফান্ড ব্যবসা চালাতে বিভিন্ন থানার ওসি– দের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা এজেন্টদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকে আগেই সরিয়ে রাখতেন বলে সিট ( স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম) জানিয়েছিল৷ …. বাছাই করা এক একটি থানায় বছরে কমপক্ষে ১৫ লক্ষ টাকা ভেট পাঠানো হত, এমন তথ্যও উঠে এসেছিল৷ কোথাও কোথাও এই অঙ্ক ছিল ৩০ লাখ, ৪০ লাখ পর্যন্ত৷ টাকার অঙ্ক নির্ভর করত জেলা ও থানার গুরুত্ব অনুসারে৷ এই টাকা থানার অফিসারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত৷ – তদন্তে উঠে এসেছিল প্রাক্তন কিছু পুলিশ কর্তার সারদা ঘনিষ্ঠতার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য৷ দেবেন বিশ্বাসের মতো আই পি এস অফিসাররা ছিলেন সুদীপ্ত সেনের ‘ ক্রাইসিস ম্যানেজার’৷ এ ছাড়া আরও অন্তত ৩০ জন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করতেন, এদের মধ্যে ছিলেন সিআইডি–রও কয়েকজন৷ দেবেনবাবু স্বীকারও করেছেন, তিনি সারদার দু’একটি সভায় গিয়েছিলেন তৎকালীন সিপিএম বিধায়ক হিসেবে৷
বেহালায় জমির কারবার দিয়ে পথ চলা শুরু সুদীপ্ত সেনের৷ সেই পথে পাশে পেয়েছিলেন এলাকার সিপিএম নেতাদেরকে৷ ঐ নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে অন্ধকার জগতের লোকজনের সাহায্যে জোকা–বিষ্ণুপুর এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি হাতিয়েছিলেন সেনবাবু৷ বিষ্ণুপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সারদার উত্থান লগ্নের গোড়ায় ছিল প্রাক্তন শাসক দল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর বদান্যতা৷ সিটুর বাস ইউনিয়নের দাপটে দুই নেতা পীযূষ নস্কর ও প্রশান্ত নস্করের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ৷ দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিষ্ণুপুর এলাকার ভাসা কোনচৌকি অঞ্চলে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সময়ে সারদা সিটি গড়ে তোলার জন্য জমি দখলের ক্ষেত্রে এই দুই নেতা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মস্তানের ভূমিকা পালন করেছে৷সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি সারদা গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রচুর টাকা নিত৷ গণশক্তি পত্রিকায় সারদার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ায় এই সংস্থার পেছনে রাজ্যের তৎকালীন সিপিএম সরকারের মদত জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়৷ সরকারের মদত থাকায় জনগণ নির্ভয়ে টাকা রাখা শুরু করে৷ সুদীপ্ত জেরায় আরও জানিয়েছেন, প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবের ঘনিষ্ঠ অঞ্জন ভট্টাচার্যকে তিনি মাসে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে দিতেন৷
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে রাজ্য–রাজনীতিতে পরিবর্তনের শুরু৷ সুদীপ্তবাবু কারবার বাড়াতে সিপিএমের সঙ্গ ছেড়ে তৃণমূলে ভিড়ে যান৷
ব্যবসায়ী শান্তনু ঘোষের কাছ থেকে ২৬ কোটি টাকা দিয়ে একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম কিনেছিলেন সুদীপ্ত সেন। গ্লোবাল অটোমোবাইলস নামে একটি মোটর গাড়ি নির্মাণ কারখানা ছিল শান্তনু ঘোষের। যদিও তাতে উত্পাদন হত না।ওই কারখানাটিও আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে শান্তনু ঘোষের কাছ থেকে কিনে নেন সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেন। এই ব্যবসায়িক লেনদেনের আড়ালে বড় ধরনের আর্থিক তছরূপ হয়েছিল বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। বিশাল অঙ্কের টাকা বাইরে পাচার হয়ে গিয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছিল। সুদীপ্ত সেনকে কারখানা বিক্রি করে দেওয়ার পরেও ওই সংস্থার ভুয়ো নথি দেখিয়ে শান্তনু ঘোষ ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ।
আমানত সংগ্রহের জন্য সারদা গোষ্ঠী সাফারি নামে একটি সফ্টওয়্যার ব্যবহার করত। সেই সফ্টওয়্যার থেকেই আমানতকারীদের দেওয়া হত রশিদ । সিবিআইয়ের অভিযোগ ছিল, এই সফ্টওয়্যারে মধ্যেই ছিল আমানতকারীদের দেউলিয়া হবার রহস্য। সারদার তৈরি অত্যাধুনিক সফ্টওয়্যারের সাহায্যেই আমানতকারীর টাকা নয়ছয় করা হয়েছে।
আমানতকারীদের জন্য যে জমি বরাদ্ধ করা হত, তা কিছুদিন পর কোম্পানির কাছে ফিরে আসত। এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল সফ্টওয়্যারে কারচুপি করেই।
সফ্টওয়্যার কারচুপির পেছনে রয়েছে গভীর চক্রান্ত, সন্দেহ ছিল তদন্তকারীদের।
আমানতের একটা বড় অংশ নগদে পাচার করে প্রভাবশালীদের লাভবান করেছেন সুদীপ্ত সেন। এমনই অভিযোগ ছিল সিবিআইয়ের। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার করা এফআইআরে লেখা ছিল সুদীপ্ত সেন এবং কিছু অজ্ঞাত পরিচয় অভিযুক্ত রশিদে কারচুপি করে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করেছেন। এই অজ্ঞাত পরিচয় অভিযুক্তরা সমাজের প্রভাবশালী এমনই ইঙ্গিত মিলেছিল এফআইআর থেকে।
সারদা রিয়েলটির বিরুদ্ধে করা প্রথম এফআইআর এর ১২ নম্বর পাতায় সিবিআই তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন, কুনাল ঘোষ সহ ছয় প্রধান অভিযুক্ত নগদ টাকার রশিদে জালিয়াতি করেছেনএবং বিপুল অর্থ নিজেদের এবং কিছু অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন। গোটা জালিয়াতি ঢাকা দিতে কোম্পানীর অডিটররা অডিট রিপোর্টে কারচুপি করেছেন।
কিন্তু শুধুমাত্র নগদে পাচার নয়, সিবিআইয়ের অভিযোগ ছিল সারদা গোষ্ঠীর অলাভজনক কোম্পানীতে টাকা সরিয়ে ব্যক্তিগত লাভ করেছেন অভিযুক্তরা। সেই লাভের ভাগ পেয়েছেন কিছু অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিও।
কিন্তু কারা এই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি যাঁরা সারদার টাকায় লাভবান হয়েছেন ? যে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের কথা বারবার উঠে এসেছে সিবিআইয়ের এফআইআর এ।
From Sanchayita to Saradha, Rose Valley, a dark period in West Bengal – Part 2
During the year 2000, Sarada was formed by Sudipto Sen. Sarada group was actually a consortium of small companies, and these small companies started promising high returns to the investors through its commission agents, who in return earned a high commission of more than 25 percent.
Within a short span, the Sarada group was able to collect 2500 crores of rupees through its agents, and the group started gaining popularity by endorsing film stars, sponsoring popular football clubs and Durga Puja. The group too, owned a media house and a TV channel and was able to spread its tentacles in Assam, Tripura and Odisha with a whopping 17 lac investors.
The popularity of Saradha Group skyrocketed in 2012, when Sudipto Sen organized Bongo Sanmelan at Las Vegas in the USA.
While a handful of politicians started raising questions over the functioning of Saradha Group in 2009, the alarm bells finally started ringing in 2013 when the expenditures of the group surpassed its income substantially.
In April 2013, the schemes of Saradha Group crashed, and Ultadanga Police Station was flooded with complaints from investors and agents.
With complaints flooding the Police Station, Sudipto Sen fled from West Bengal leaving behind a 18 page note where he accused that he was being extorted by top politicians and influential persons of the State.
However, Sudipto Sen was finally arrested from Sonmarg on 20th April, 2013 along with his close aide Debjani Mukherjee.
Though it was assessed that lacs of investors and agents suffered losses, the volume of monetary losses could not be ascertained due to lack of evidence.
It was also estimated by investigating officers that Sudipto Sen’s accumulated huge wealth of a whopping 22 crores of rupees, but his assets too were untraceable as evidence was lacking.
As per an audit report by Pricewater Cooper, it was a scam involving 10,000 crores where 25 lacs investors suffered.
An investigation too revealed that Sarada Group had received funds from foreign investors from Dubai, South Africa and Singapore.
A SIT was formed by the CM Mamata Banerjee to investigate the scam, while Assam and Odisha govts insisted on a CBI enquiry.
The WB govt too submitted a 500 page report to the Supreme Court, but the Hon’ble SC ruled out the report as unsatisfactory.
In 2014, CBI started investigations into the scam on being directed by the Hon’ble Supreme Court. And, it was directed that all investigation documents by the SIT were to be handed over to the investigating CBI officials. But, the CBI officials often alleged of non-cooperation from the local police.
The Administration too displayed their apathy when a cupboard containing important documents of Sarada Scam went missing, and issued a statement that it was misplaced while shifting their office from Writers Building to Nabanna, while no attempts were made to trace it back.
Investors and agents too alleged that they were being harassed by the police whenever they tried to lodge a complaint.
The Pandora box was open and the cat was out of the bag, as CBI proceeded with their investigations.
It was revealed that politicians, film stars, and sports personalities too were in close touch with Sudipto Sen.
The first arrest by CBI which made ripples was of the East Bengal Club official Debabrata Sarkar.
TMC leader and MLA, Shyamapada Mukherjee too came under the scanner as he forced Sudipto Sen to buy a loss-making cement factory.
Another TMC heavyweight personality and Rajya Sabha MP Ahmed Hasan Imran too forced Sudipto Sen to buy a Media house, but refused to hand over the ownership and title papers to the Sarada boss.
It was also revealed that Sudipto Sen used to send extortion funds to police stations for smooth functioning of his business and the amounts were no less than 15-30 lac per month.
Investigations by ED revealed that Sudipto Sen even purchased a painting by the CM and paid crores from the account of his wife Piyali Sen.
ED too traced unscrupulous bank transactions from Piyali Sen’s account, and traced her involvement with influential personalities from her call records. It was also traced that Piyali Sen has called at least 5 of these influentials on the date of her arrest.
Sudipto Sen was eager to promote Sarada Group as a brand, and in the process he made inroads in the film industry, and appointed Satapdi Roy a TMC MP, and Mithun Chakraborty as brand Ambassadors.
By the year 2013, Sarada Group owned 8 newspapers in 5 languages and had a team of 1500 reporters with Kunal Ghosh at the helm with a monthly salary of 15 lac rupees.
Attempts were too made by Sudipto Sen to spread his empire in northern India, and in his bid to capture business in Uttar Pradesh, he too had invested heavily in the Uttar Pradesh Assembly Elections. Aided by a leader of the Samajwadi Party, and an ex MP of Congress, arrangements was made for TMC to contest in 20 seats of the State.
Sudipto Sen was also close to CPIM and Congress leaders of West Bengal, and maintained good relations with the police too. The Sarada supremo started making inroads during the leftist regime, and with the help of the leftist leaders he acquired huge properties in Joka and Bishnupur areas near Behala. Leaders of the leftist trade union CITU acted as the muscle men while Sudipto acquired huge parcels of land. During an interrogation, Sudipto revealed CITU leaders Pijush and Prasanta Naskar played stellar roles in his Sarada City project. Sudipto too sponsored the Ganashakti newspaper of the lefts, and paid hefty sums in the form of advertisements. In his statement Sudipto also revealed that he paid hefty amounts to Anjan Bhattacharya who was a close aide of the then Housing Minister Goutam Deb.
With the change in the political scenario, Sudipto shifted his alliance with TMC.
Sudipto Sen, in his statement made allegations that he was forced to pay Rs 25 crores to the TV entrepreneur and ex-wife of Congress leader Monoranjana Singh, and was pressurized by her lawyer Nalini Chidambaram, the wife of the then Home Minister P Chidambaram.
Sudipto Sen used manipulated software to cheat the investors, the names of the depositors and beneficiaries were removed, and funds were fraudulently transferred to unknown influential personalities, however the names of the influential persons are still unknown as records were destroyed.
– Amlan & Jaydeep