নির্বাচন ২০২১: হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় ফলাফল কী হতে চলেছে ?

পশ্চিমবঙ্গের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফার নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়ছে। আট দফা নির্বাচনের বাকি অংশের বিজ্ঞপ্তিও জারি হচ্ছে খেপে খেপে, কবে কি হবে সবই জানানো হয়েছে। নির্বাচন শুরু হচ্ছে ২৭ মার্চ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের মধ্যে দিয়ে এবং শেষ হবে ২৯ এপ্রিল বীরভূম, উত্তর কলকাতা, মুর্শিদাবাদের ৩৫টি আসনে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। সব রাজনৈতিক দলই তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। তবে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে মূলত তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মূলত বাম-কংগ্রেস জোট এবং তৃণমূলের মধ্যে। বিজেপি ছিল তৃতীয় পক্ষ। অনেকের ধারণা ছিল বামেরা ফিরছে, কিন্তু বিজেপি সেটা করতে দেয় নি। তাদের লক্ষ্য ছিল, তৃণমূলকে আর কিছু দিন ক্ষমতায় রেখে, প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার সন্মুখিন করানো। বিজেপি মোট ৫৫ লক্ষ ৫৫ হাজার বা ১০.৩ শতাংশ ভোট পায়। তৃণমুলের ভোট ছিল ২ কোটি ৪৫ লক্ষ এবং বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল ২ কোটি ১০ লক্ষ। ৭৬টি কেন্দ্রে জয়-পরাজয়ের মধ্যে ফারাক ছিল দশ হাজারেরও কম। ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেতেন ২৫ হাজার ভোটে আর সেখানে বিজেপি’র ভোট ছিল ২৬হাজার। অমিত শাহ সেখানে প্রচার না করলে এবং বিজেপির প্রাপ্ত ভোট দীপা দাশমুন্সির পক্ষে গেলে তৃণমূলের বিপদ ঘটতে পারত।

পাঁচ বছরের মাথায় ২০২১ সালে অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট একই কৌশলে তৃণমূল বিরোধী ভোট ভাগ করে দিতে চাইছে, এই ‘খেলায়’ তৃণমূলেরও সায় আছে। তবে এবার বাম-কংগ্রেস জোটে আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টকে যুক্ত করায় সেটা আর হবে না। কারণ, সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হবে, সঙ্গে হবে ধর্মীয় মেরুকরণ, যা বিজেপির পক্ষেই যাবে।

এই নিবন্ধে আমরা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের ভোট নিয়ে কথা বলব না। হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া নিয়েই আলোচনা করব। এই পাঁচটি জেলায় ৭২টি আসন আছে। ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের দাপট ছিল, এই ৭২টি আসনের মধ্যে ৬০টি পায় তারা, বাম-কংগ্রেস ১১টি এবং বিজেপি ১টি।

বাংলা দখলের লড়াইতে বিজেপি জঙ্গলমহলে নিরন্তর প্রয়াস চালায়, সঙ্গে নেয় বনবাসী কল্যাণ সমিতি-সহ বিভিন্ন জনভিত্তিক সংগঠনকে। ভারতের অন্য রাজ্যে আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপি’র জনপ্রিয়তা চোখে পারার মতন। জঙ্গলমহলে বিজেপি’র জনপ্রিয়তা বাড়াতে অন্য রাজ্যের অভিজ্ঞতাকে তারা কাজে লাগায়, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় ৪০টি আসনের মধ্যে ৩১টিতে বিজেপি এগিয়ে ছিল।

বাংলা দখলে এগিয়ে থাকতে গেলে হাওড়া এবং পূর্ব মেদিনীপুরে সংগঠন বাড়ানো অত্যন্ত জরুরী। এই জেলাগুলিতে সুযোগ্য নেতার খোঁজ বহুদিন ধরে চালাচ্ছিল বিজেপি, অনেকে আগ্রহ দেখালেও মমতা সরকারের প্রতিহিংসার ভয়ে তারা অপেক্ষায় থাকেন সঠিক সময়ের। ২০১৬ সালের তৃণমূলের যুদ্ধ জয়ের অন্যতম প্রধান কারিগর শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর নজর রেখেছিল বিজেপি। অবশেষে এই দুই নেতার যোগদানে বিজেপি পূর্ব মেদিনীপুর এবং হাওড়ায় নিজেদের সংগঠন মজবুত করছে।

পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের কেরিশ্মায় তৃণমূলে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরী হয় নি। হাওড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসে ছিল নেতাদের ছড়াছড়ি। দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব আর দুর্নীতি বিক্ষুব্ধ করে তোলে বহু তৃণমূল নেতাকে। এরা সবাই ছিলেন সময়ের অপেক্ষায়। রাজীব বন্দ্যোপাধ়যায়, রথীন চক্রবর্তী, বৈশালী ডালমিয়া, বাণী সিংহ রায় বেরিয়ে যাওয়ায় তৃণমূল এখন যথেষ্ট দুর্বল। টিকিট না পাওয়ায় জটু লাহিড়ী, শীতল সর্দার, বিভাস হাজরার মতন ‘হেভিওয়েট’ নেতারও ছুটছেন বিজেপির দরবারে। তৃণমূল কংগ্রেসের সংসার এখন তাই ছন্নছাড়া। এমত অবস্থায় বাম-কংগ্রেস জোট কতটা বিজেপি’র ভোট কাটবে তারই ভরসায় রয়েছে তৃণমূল। বামেদের যে ভোট বিজেপিতে গেছে, সেটা মমতা বিরোধী ভোট, তাঁর আচার আচরণ, শাসনে তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। মমতা শাসনের অবসান তাঁরা চান, তাই তাদের ভোট বামেদের দিকে ফিরে আসা মুশকিল।

তৃণমূলের অপর ভরসা সংখ্যালঘু ভোট। এই পাঁচ জেলার ৭২টি আসনে মাত্র ২১টি ব্লকে সংখ্যালঘু ভোট ২০ শতাংশের বেশি এবং হাওড়া জেলা ছাড়া অন্য কোথাও সংখ্যালঘু ভোট তেমন ভাবে ছড়িয়ে নেই (টেবিল ৪ আর ৫ )। তবে নন্দীগ্রাম বিধানসভার নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকে মুসলিমরা ২০০১ জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৩২  শতাংশ। নন্দীগ্রামে ২ ব্লকে মুসলিম ১০-১২ শতাংশ। নন্দীগ্রামে আব্বাস সিদ্দীকি প্রার্থী দিলে তৃণমূলের পরাজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু মমতা চাইছিলেন বামফ্রন্ট যদি কোনও হিন্দু প্রার্থী দেয়। হয়েছেও তাই। বামফ্রন্টের তরফে প্রার্থী হয়েছেন সিপিআইএম-এর নতুন মুখ মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। ফলে বোঝা যাচ্ছে কার কি লক্ষ্য! কিন্তু তাতেও মমতা নন্দীগ্রামের বৈতরণী পার করতে পারবেন বলে মনে হয় না। এখন দেখার নন্দীগ্রামে মমতার ‘চোট’ পাওয়ার ঘটনা তাঁকে কতটা ডিভিডেন্ট দেয়। নির্বাচন কমিশন প্রথম দফার নির্বাচনের সবকটি কেন্দ্রকে সংববেদনশীল বলে ঘোষণা করেছে, মনে হয় রাজ্যের প্রায় সব কেন্দ্রেই এই জিনিস ঘটবে। ফলে ক্যাডারদের পক্ষে ভোট নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলার পরিবর্তনশীল মানুষ নতুন শাসকের সন্ধানে,  বিজেপি যে এই পাঁচ জেলায় ৫৫-৬০টি আসন পেতে চলেছে তা অনেকটাই নিশ্চিত।

টেবিল ১: হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার মোট আসন

টেবিল ২:   হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ায় ২০১৬ বিধান সভায় বিভিন্ন দলের আসন প্রাপ্তি

টেবিল ৩:    হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ায় ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে  সংশ্লিষ্ট বিধান সভায় যারা এগিয়ে ছিল

টেবিল ৪ : জেলা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যা , ২০১১

টেবিল ৫:   ৬ জেলার ব্লক  ও বিধান সভা  যেখানে মুসলিম ২০ শতাংশের কাছাকাছি, ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.