বাঙ্গালার কমার্শিয়াল থিয়েটার ও নাট্য আন্দোলনের জনক হিন্দুরাষ্ট্রবাদীরা। কৌশিক সেনরা কি তা জানেন ?

আজকাল যেসব বামপন্থীরা থিয়েটার, সিরিয়াল করে পেট চালান, তারা কি জানেন যে বাঙ্গালার প্রথম কমার্শিয়াল থিয়েটার এবং আধুনিক থিয়েটার আন্দোলনের জনক ছিলেন হিন্দু ন্যাশনালিস্টরা।

হ্যাঁ বাঙ্গালার প্রথম পাব্লিক থিয়েটার ও থিয়েটার আন্দোলনের ইতিহাস কিন্তু সে’কথাই বলছে।

প্রথম ভারতীয় হিসেবে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উদ্যোগে ১৮৩১ সালে শুরু হল হিন্দু থিয়েটার। পরবর্তী তিন দশক ধরে এই থিয়েটার, নাটকগুলি প্রদর্শিত হত জমিদার বাড়ির আঙিনায় বা জলসায়।

১৮৬৭ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাঙ্গালার বুকে শুরু হয়েছিলো প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যা পরিচিত নাম হিন্দুমেলা। একবার ভাবুনতো, সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতের অন্যান্য প্রদেশ যখন মোগল না ব্রিটিশ কে দেশ চালাবে ? এই ভেবেই আকুল, বাঙ্গালী কিন্তু তখনই প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে যে বহিরাগত মোগল নয়, ব্রিটিশও নয় ভারতের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেবে এই দেশেরই ভূমিপুত্ররা। আর সেই হিন্দু রিভাইভালিস্ট আন্দোলনেরই নাম ছিল হিন্দুমেলা। যা ছিল একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উত্থানের আন্দোলন।

এর থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাংলা তথা ভারতের প্রথম প্রফেশনাল পাব্লিক থিয়েটার “National theater”। এর পথিকৃত নবগোপাল মিত্র, গিরীশচন্দ্র ঘোষ এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন গর্বিত হিন্দু ন্যাশনালিস্ট।

১৮৭২ সালে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ বাঙ্গালা তথা ভারতের থিয়েটার আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম কমার্শিয়াল থিয়েটার হিসেবে উপস্থাপন করেছিল দীনবন্ধু মিত্রের “নীল দর্পণ” নাটকটি। যার সামগ্রিক প্রভাব সেদিন টলিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশের রাজ সিংহাসনকে।

বাবুদের বাড়ির আঙিনার পাঁচিল টপকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নাটক এই প্রথম প্রদর্শিত হল সর্বসাধারণের ভিড়ে।জনমানসে ‘নীল দর্পণ’ মঞ্চস্থ করার পরই ব্রিটিশ সরকার “ড্রামাটিক পারফরম্যান্স এক্ট” চালু করতে বাধ্য হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল অভিনয় করে ব্রিটিশ অত্যাচার দেখানো বন্ধ করা। যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হিন্দু ন্যাশনালিস্টরা এইভাবেই নাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে সর্ব প্রথম ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক হিন্দুমেলার নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ আচার্য রাজনারায়ণ বসু,সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সহকর্মী, ন্যাশনাল প্রেস ও ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতা সংগ্রামী নবগোপাল মিত্র।

মনমোহন বসু

রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পাব্লিক অ্যপিয়ারেন্স হয়েছিল ১৮৭৫ সালে হিন্দুমেলার মঞ্চে। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশন করলেন “হিন্দুমেলার উপহার” কবিতাটি। যুবক বিবেকানন্দও বেশ কয়েকবার হিন্দুমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা আবশ্যক ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায় “হিন্দুত্ব” এই শব্দবন্ধটিও একজন বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক প্রসূত। তিনি ডেপুটি ম্যাজিসট্রেট শ্রী চন্দ্রনাথ বসু। চন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু ছিলেন এবং বঙ্কিমের “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
যদিও তাঁর পাঁচ দশক আগেই রাজা রামমোহনের হাত ধরে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু স্কুল, হিন্দু কলেজ (প্রেসিডেন্সির পূর্ববর্তী নাম), ও বেদান্ত কলেজ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালার নবজাগরণের কালে এইসব ঘটনাবলি থেকে একটি বিষয় নির্দ্বিধায় প্রমাণিত হয় যে বাঙ্গালাই ছিল হিন্দু ন্যাশনালিজমের আঁতুড় ঘর এবং বাঙ্গালী মনীষীরাই ছিলেন হিন্দুত্বের দিশারি।চলুন আবার ফিরে যাই বাঙ্গালার থিয়েটার আন্দোলনে।

“নীল দর্পনের” সাথে সাথেই “ন্যাশনাল থিয়েটারে” উপস্থাপিত হলো সমাজ সংস্কারমূলক নাটক “সধবার একাদশী” আর হিন্দু রিভাইভাল বা সামাজিক উত্থানমূলক নাটক “রাবণ বধ”। নাটকটি লেখা থেকে শুরু করে রাজা রামচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন থিয়েটার জগতের কিংবদন্তি গিরিশ ঘোষ স্বয়ং।

গিরীশচন্দ্র ঘোষ

লক্ষ্য করে দেখুন। হিন্দু ন্যাশনালিস্টরা সেই সময় যেমন একাধারে “রাবণ বধ” পরিবেশনের মাধ্যমে বাঙ্গালীকে তার সংস্কৃতির শিকড়ে ফেরাতে পেরেছেন অন্যদিকে “বিধবা বিবাহের” মতো অত্যাবশ্যক সমাজ সংস্কারকে সমর্থন ও প্রচারের মাধ্যমে হিন্দু সমাজকে কলুষমুক্ত করে আধুনিক রুপ দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

“রাবণ বধ” নাটকটি সেই সময় এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে প্রখ্যাত নাট্যকার অমৃতলাল বসু লিখেছিলেন “It showed that Bengalis have not forgotten their roots
and the play has appealed to their religious devotion[3]”

‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ আন্দোলন জন্ম দিল কিংবদন্তী “স্টার থিয়েটারের”। সেখানে ১৮৮৪ সালে গিরীশ ঘোষের উপস্থাপনায় “চৈতন্য লীলা” বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের মধ্যে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। “সীতার বনবাস” ও “অভিমন্যু বধ” নাটকদুটি তৎকালীন শিক্ষিত বাঙ্গালী নারী ও যুব সমাজকে মোহিত করে দিয়েছিল বলে জানা যায়।

এই প্রসঙ্গে নাট্যকার অমৃতলাল আবার লিখলেন “Girish Chandra understood the pulse of the society very well…‘There was an audience of all educated and of vintage lineage. They were all
mesmerised by the enactment. The public stage has never been able to impress so many ladies and gentleman before”(4; pp 692-695)

গিরীশ ঘোষের পথ ধরেই এরপর বাঙ্গালী সমাজকে থিয়েটারের মাধ্যমে তার সংস্কৃতির শিকড় চিনিয়ে ছিলেন শিশির কুমার ভাদুড়ীর মতো কিংবদন্তি নাট্যকার। তাঁর নির্দেশনায় জনপ্রিয় নাটকগুলি ছিল চানক্য, সীতা, পল্লী সমাজ ইত্যাদি।

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী থিয়েটারের এই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৫০ এর দশকেও। তারপর ১৯৬০ দশক থেকে কমিউনিস্টদের হাত ধরে শুরু হলো জাতীয়বাদী থিয়েটারগুলিকে ধ্বংস করার সুচতুর প্রয়াস। লক্ষ্য ছিল বহিরাগত রুশ ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর আন্দোলনের আঙ্গিকে বাঙ্গালীকে কমিউনিজম গেলানো। ১৯৭০ এর দশকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্যে অনেকটাই সফল হয়েছিল।
ভারত তথা বাঙ্গালার পাঁচ হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে কলুষিত করাকেই কমিউনিস্টরা নিয়ে গেল শিল্পের পর্যায়ে।

আজকের কবি, লেখক, থিয়েটারজীবীদের একাংশের দ্বারা বাঙ্গালীর আরাধ্য দেবদেবী নিয়ে কুৎসা সেই কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাঙ্গালীর শিবঠাকুরের ত্রিশূল বা মূর্তিকে ঘিরে যৌন কুৎসাকারী কালচারাল মার্ক্সসিস্ট শ্রীজাত, সায়নী অথবা জনসমক্ষে বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর সময় ‘গোমাংস’ রান্নার নাটুকে কমেন্ট করে ফুটেজপিয়াসী দেবলীনা কি জানেন যে বাণিজ্যিক বাঙ্গালা থিয়েটার, সিরিয়ালে অভিনয় করে তাঁরা পেট চালাচ্ছেন সেটা আসলে হিন্দু ন্যাশনালিস্টদেরই দান।

হিন্দুমেলা, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, ন্যাশনাল থিয়েটার, নবগোপাল মিত্র, গিরীশ ঘোষদের প্রতি থিয়েটারজীবী কৌশিক সেনদের আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

তথ্যসূত্র:

1) The Brahmo Samaj and the shaping of the modern Indian mind। Princeton Univerity Press। আইএসবিএন 0691031258

2) Bannerjee, Hiranmay, Thakurbarir Katha, pp.137-138

3) Gangopadhyay, Abinash Chandra – “Girish Chandra”(Pub: Deys 2011, Ed: Swapan
Mazumdar)

4) Ghosh,Binay (Ed.) – ‘Samayik Patre Banglar Samajchitra Vol .IV’ (Pub:Bikkhan
Grantha Bhaban;1965)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.