তিনি এলেন। দেখলেন। এবং জয় করলেন।
ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে ঘটেনি। না ২০১৪-য়। না ২০১৯-এ।
২০১৪-য় দেশবাসীর সামনে তিনি এসেছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। কিংবা বলা ভালো স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে। ২০১৯-এ তাঁর দ্বিতীয়বার আগমন স্বপ্নস্রষ্টা হিসেবে। এবার শুধু স্বপ্ন দেখানো নয়। স্বপ্ন পূরণের দুরূহ দায়িত্ব কাঁধে দেশমাতৃকার চরণতলে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী। সেই গুজরাটের ভাবনগর স্টেশনে চায়ের কেটলি আর ভাঁড় হাতে শীতার্ত ভোরে দৌড়ে বেড়ানো এনডি। সতেরো বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে গোটা দেশ ঘুরে ভারতবর্ষের আত্মার সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো নরেন্দর। তারপর জীবনের নানা গোলকধাঁধা অতিক্রম করে, চার-চার বার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রিত্ব করে অবশেষে দিল্লির দরবারে। ২০১৪-র পর এবার আবার। প্রথমবার একাই বিজেপি ২৮৩। তারই নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার একাই বিজেপি ৩০৩। সেই মোদীর নেতৃত্বেই। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাঁটা পার হয়ে এগিয়ে অনেকটাই মোদীজী। আজকের ভারতবর্ষের অপ্রতিরোধ্য শাহেনশা। এক এবং অদ্বিতীয়। প্রতিযোগী কাউকে খুঁজে পেতে হলে দূরবীন দরকার। কিন্তু না, আত্মপ্রসাদে তৃপ্ত নন তিনি। তিনি জানেন স্বপ্নস্রষ্টা মোদীর কাছে এবার প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে। প্রতিটি ভারতবাসীর প্রত্যাশা। দেশে, এমনকী বিদেশেও। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী এবং সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে অনাবাসী ভারতীয়দের প্রত্যাশাও।
কেমন সে সব প্রত্যাশা?
প্রথম প্রত্যাশা ও এক জাতি এক প্রাণ। বহু যুগ পর, বহু দুঃস্বপ্নের বছর কাটিয়ে। ভারতবাসী আজ নিজেকে চিনেছে। আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছে। এবারের নির্বাচন এবং নির্বাচনী ফলাফল দেশের মানুষকে বলতে সাহস যুগিয়েছে। সগর্বে বল, আমি ভারতবাসী’ বলতে উদ্দীপনা যুগিয়েছে—‘সগর্বে বল, আমি হিন্দু, হিন্দুত্ব । আমার আদর্শ। একটা মানুষ ৭০ বছর বয়সে এক মাসেরও কম সময়ে ১,০৫,০০০ কিলোমিটার পরিভ্রমণ করে ১৪২টা নির্বাচনী সমাবেশে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। যতটা তার চেয়ে বেশি জুগিয়েছেন ভারতীয় জাতীয়তাবোধের অনুপ্রেরণা। এবার মানুষ। চাইছে—আর স্লোগান নয়। গোটা দেশের জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে সঙ্গে নিয়ে মোদীজী ‘এক জাতি এক প্রাণনীতির প্রতিষ্ঠা করন। নিপাত যাক সংকীর্ণ আঞ্চলিকতাবাদ। নিপাত যাক আঞ্চলিক রাজনীতি। মানুষ রায় দিয়েছে মোদীর নেতৃত্বে স্থায়ী হোক বিজেপি সরকার। মোদীজীর কথায় যে সরকারের ছাতি চওড়া করার দরকার হবে না। কিন্তু মাথা ছোঁবে আকাশ ‘এক জাতি এক প্রাণ’ ভারতবর্ষ।
দ্বিতীয় প্রত্যাশা : এক জাতি এক আইন।
রাজ্যে রাজ্যে বিবাদ নয়। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত নয়। মানুষে মানুষে বিভেদ নয়। আইনের অনুশাসন হোক এক এবং তা সবার জন্য। কাশ্মীর হোক ভারতবর্ষের মূল স্রোতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাশ্মীরবাসী হোক এক জাতি এক দেশ ভারতবর্ষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশীদার। তাই বিলুপ্ত হোক সংবিধানের ৩৭০ ধারা। বিলুপ্ত হোক সংবিধানের ৩৫-এ ধারা। বিলুপ্ত হোক তিন তালাক প্রথা যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যালঘু মা-বোনেদের বোরখার আড়ালে চোখের জলে ভাসতে বাধ্য করেছে। সংস্কার হোক শরিয়ত আইনের সংখ্যালঘু জনজীবনের সুস্থতার স্বার্থেই। নিয়ন্ত্রিত হোক জনসংখ্যার প্রাবল্য। আর কতকাল একই ভারতবাসী শিকার হবে আইনের দ্বৈত সত্তার।
তৃতীয় প্রত্যাশা : এক দেশ এক দল।
দুঃস্বপ্নই বটে! একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশে ২৪২৬টি রাজনৈতিক দল। কেবল ৭টি সর্বভারতীয়। ৩০৯টি আঞ্চলিক দল স্বীকৃত, বাকি ২০৪৪টি অস্বীকৃত এবং আঞ্চলিকতাবাদে পুষ্ট। ২০১৪য় ইঙ্গিত মিলেছিল কিছুটা। ২০১৯-এ সব ধুয়ে মুছে সাফ। এরা এতকাল রাজ্যে রাজ্যে কেন্দ্রবিরোধী ইস্যু তৈরি করে লেজ নেড়েছে। আর ভারতবর্ষের রাজনীতির গভীরে খুঁড়েছে দুর্নীতির সুড়ঙ্গ—অনেকটা ধানক্ষেতে ইঁদুরের গর্তের মতো। এবার বিজেপি একাই শের। উত্তরপ্রদেশে সপা, বসপার গর্জন শেষ। পশ্চিমবঙ্গে, অসমে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় শেষ তৃণমূল কংগ্রেস আর ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলো। মানুষের। প্রত্যাশা—হাজার দলের দলাদলি শেষ হোক। ক্ষমতায় থাকুক একদল। যে দল মানুষকে সম্মান দেবে। সংবিধানকে সম্মান। দেবে। গণতন্ত্রকে সম্মান দেবে।
চতুর্থ প্রত্যাশা : এক জাতি এক অধিকার
মুখে বলা হবে সংবিধানের মৌলিক অধিকার সবার। নির্দেশমূলক নীতিসমূহ সবার জন্য। সবার অধিকার হাতে হাতে ডিগ্রি, হাতে হাতে কাজ। সব পেটে ভাত। কিন্তু সংরক্ষণের গেরোয় ঝুলতে থাকবে মেধাবী লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ তরুণী শিক্ষাক্ষেত্রে, সরকারি চাকুরিক্ষেত্রে, সামাজিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে। মানুষ চাইছে মোদীজীর কাছে অধিকার সমান হোক সব ভারতবাসীর। ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে যেমন কোনও তরুণ তরুণী অন্যায় করেননি, তেমনি ডোমের সন্তান হয়ে কোনো তরুণ তরুণী মহাপুণ্য করেননি। একই রোদের আলোয়, একই গাছের ছায়ায় বেড়ে ওঠা দুই সন্তান কেন ভোগ করবে পৃথক ফল? অতএব বিলুপ্ত হোক সংরক্ষণ প্রথা।
পঞ্চম প্রত্যাশা : এক জাতি এক নেতা
ইতিহাসে নজিরের অভাব নেই সেই সব নেতার যাঁরা একটি জাতিকে গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষের প্রয়োজন ছিল একজন সঠিক নেতার যিনি গোটা দেশ এবং জাতির চালিকাশক্তি হয়ে পথ দেখাবেন মানব-উন্নয়নের। মানুষ খুঁজছিল এক নেতাকে যিনি শিব গড়তে গিয়ে শিবই গড়বেন, বাঁদর নয়। মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে মুখ ঢেকে নয়, ভারতীয় ত্বকে আত্মার আত্মীয় করে গড়ে তুলবেন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ। এবার বুঝি সত্যিই মিলল সেই নেতা যাকে প্রায় গোটা ভারতবর্ষ সব বিশ্বাস উজাড় করে ঢেলে দিল একটাই প্রত্যাশা নিয়ে একটা ভালো দেশের মানুষ হতে চায় ভারতবাসী।
প্রত্যাশার শেষ নেই। দাবির অন্ত নেই। অভাবী রাষ্ট্রের সমস্যা তো এটাই যে কিছুতেই অভাব মেটে না। তবু প্রত্যাশা। হয়তো এবার মিটবে। কারণ মোদীজী কথা দিয়েছেন সংকল্পপত্রে ঠিক ভোটের আগেই ‘সংকল্প ভারত সশক্ত ভারত। ২০২২-এ ভারতবর্ষের পরাধীনতা মুক্তির ৭৫ বছরে গাঁথা হয়ে যাবে উন্নয়নের ৭৫টি মাইলস্টোন। সময় সারণী নির্দিষ্ট। ২০৩০ এর মধ্যে ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। সময়ের কাজ সময়ে’ ফর্মুলা ধরেই এগোবে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নাগরিক কল্যাণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন, মানব উন্নয়নের কাজ। সব পরিবারে পাকা বাড়ি, সব ঘরে রান্নার গ্যাস, সব ঘরে বিদ্যুৎ, টয়লেট, পানীয় জল,সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। জাতীয় সড়ক বাড়বে দ্বিগুণ, এয়ারপোর্টের সংখ্যা হবে ১৫০। বন্দরের ক্ষমতা বাড়বে। ২৫০০ মেট্রিক টন। সব রেলপথে বিদ্যুতায়ন। ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর। মহিলাদের হাতে কাজ, যুবশক্তির উন্মেষ। খামতি নেই কিছুরই এবং প্রতিশ্রুতি সময়-সরণী মেপে চলার। সরকার কাজ করবে দিনে ১৮ ঘণ্টা। মানুষ প্রত্যাশী, মোদীজী আত্মশক্তিতে বলীয়ান। মানুষ বিশ্বাস করেছে তাকে আবার। স্বপ্নস্রষ্টা না হয়ে উপায় কী!
সুজিত রায়
2019-06-07