বিপুল জনসমর্থনকে পাথেয় করে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরেছেন। নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনটি এক কথায় ঐতিহাসিক এবং চমকপ্রদ। ঐতিহাসিক এবং চমকপ্রদ এই কারণেই যে, প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে বাদ দিলে নরেন্দ্র মোদী হচ্ছেন ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রথমবারের থেকেও বিপুল জনাদেশ নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরলেন। এবং তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি এবারের লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। এবার নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বিরোধী দলগুলি এবং সংবাদমাধ্যম শোরগোল ফেলে দিয়েছিল যে, এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বিদায় আসন্ন। বিরোধী দলগুলি সরকার গড়ার ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, ফল ঘোষণার পরদিন দিল্লিতে বৈঠকে বসবে বলেও তারা স্থির করে রেখেছিল। সেই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বিরোধীদের নিম্নস্তরের ব্যক্তি আক্রমণ তো ছিলই। বিরোধীরা যাই বলুন এবং যাই করুন না কেন, সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালীন নরেন্দ্র মোদীর আচারণ ছিল একজন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির মতোই। প্রথমাবধি তাকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী লেগেছে। এবং নির্বাচনী প্রচারের প্রথম লগ্ন থেকেই নরেন্দ্র মোদী বলে এসেছেন ২০১৪-র থেকেও এবার মোদী হাওয়া আরও জোরদার। নরেন্দ্র মোদীর বোঝায় যে কোনো ভুল ছিল না, বরং তিনি যে দেশের মানুষের আবেগটিকে ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিলেন, নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর পর তা আরো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
বিপুল জনাদেশ সম্বল করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বারের জন্য এন ডি এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই, এই সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশাও আকাশছোঁয়া। এই প্রত্যাশার অনেকখানিই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিজেপি, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীকে পূরণ করার চেষ্টা করতেই হবে। যেমন, বেকারত্ব দূর করা, নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। কৃষিক্ষেত্রকে লাভজনক করে তোলা। সামাজিক সাম্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। বনবাসী জনজাতিদের অধিকার সুরক্ষিত করা। পশ্চাদপদ অঞ্চলগুলির উন্নয়ন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি আবার একথাও সত্য একশো শতাংশ প্রত্যাশা পূরণ কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয় না। সম্ভব হয় না একারণেই যে—মানুষের প্রত্যাশার কোনো অন্ত নেই। তবু, ক্ষমতায় এসে যতদূর সম্ভব পূরণ করার প্রচেষ্টাটি অন্তত করতেই হবে। এটুকু করলেই মানুষ বুঝতে পারবে, যে সরকারটিকে তারা নির্বাচিত করল, সেই সরকার তাদের চাহিদাগুলিকে মর্যাদা দিচ্ছে। কাজটি সহজ নয়, অতীব কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই আগামী পাঁচবছরে বিজেপিকে করতে হবে। আগামী দিনগুলিতে এটিই তার পরীক্ষা।
প্রত্যেক নির্বাচনের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের যে নির্বাচনী ইস্তাহারটি প্রকাশ করে, তাতেও নানারকম প্রতিশ্রুতি এবং লক্ষ্যের কথা বলা হয়, যে প্রতিশ্রুতি এবং লক্ষ্যগুলি পরণে নির্বাচনের পর দায়বদ্ধ। থাকে রাজনৈতিক দলগুলি। এই প্রতিশ্রুতি এবং লক্ষ্যগুলি সাধারণত দু’ ধরনের। একটি নির্বাচকমণ্ডলীর মৌলিক অধিকারগুলিকে রক্ষা করা, তাদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান এবং সামাজিক পরিষেবার সুষ্ঠু বণ্টন। অন্যটি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশ এবং দেশের নাগরিকের স্বার্থে করণীয় কিছু কর্তব্য। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার যে নির্বাচনী ইস্তাহারটি প্রকাশ করেছে, তাতেও এই দুটি ক্ষেত্রে নানারকম প্রতিশ্রুতি এবং লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ থেকে শুরু করে দলের নানাস্তরের নেতারাও নির্বাচনী প্রচারে এসে এই প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়ে গিয়েছেন। এবার সেটা তাদের পূরণ করার পালা।
সামাজিক ক্ষেত্রে বিজেপির করণীয় কর্তব্য কী—সে প্রসঙ্গে এখানে আলোচনায় ঢুকছি না। বরং, জাতীয় ক্ষেত্রে দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা যাক—যা আগামী পাঁচবছরে বিজেপির কাছে। অবশ্য করণীয় হয়ে ওঠা উচিত। এবং দেশের মানুষও মনে করছে যে এই কাজগুলি বিজেপিই করতে পারবে, বিজেপিরই করা উচিত। আগামী পাঁচবছর বিজেপির এই অবশ্য করণীয় কর্তব্যগুলির মধ্যে এক নম্বরে থাকা উচিত কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ। আজ যাঁরা বিজেপির কর্ণধার তাদের মনে রাখতে হবে, এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ‘এক নিশান এক বিধানে’-র ডাক দিয়ে কাশ্মীর অভিযান করেছিলেন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্যই কাশ্মীরের জেলখানায় প্রাণ দিয়েছিলেন। সেই পঞ্চাশের দশকেই শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন ৩৭০ ধারা কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপকেই উৎসাহ জোগাবে। ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি বিজেপি নেতৃত্ব অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। জম্মু এবং লাদাখের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরও দাবি এই ধারা অবিলম্বে বিলুপ্ত করা হোক। এছাড়াও, দেশের অন্যান্য অংশের নাগরিকরাও মনে করছেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা জারি রাখা এখন অনর্থক। শুধু কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স, কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং কংগ্রেস-বামপন্থীদের মতো কিছু তথাকথিত সেকুলার বিরোধী দল এই ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষে নয়। বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, তাদের যারা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে, সেই জনগণ কিন্তু কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই দেখতে চায়। তারা কিন্তু কাশ্মীরের জন্য আলাদা কোনো সংগঠন বা আলাদা কোনো নিদান চান না। এছাড়াও কাশ্মীরকে। বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা থেকে মুক্ত করতেও যে ৩৭০ ধারা বিলোপ আশু কর্তব্য সেটাও নতুন সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে।
দ্বিতীয়, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যও বিজেপির পালন করা উচিত। তা হল, সমগ্র দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবিটিও বিজেপির নিজস্ব দাবি। একথাও সত্য, এতদিন তা কার্যকর করার মতো অবস্থায় বিজেপি ছিল না। কিন্তু এবার এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর, অনেকদিনের না করতে পারা কাজগুলিকে এবার করে ফেলবার একটি সুযোগ বিজেপির সামনে এসেছে। যে ঘৃণ্য এবং নগ্ন তোষণের রাজনীতি স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশে চলে আসছে, তাকে বন্ধ করতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলন আশু কর্তব্য। এটাবিজেপি। নেতারা বোঝেন। বোঝেন বলেই আশা করা যায়, ২০১৯-এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে এসে এই বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি পদক্ষেপ করবেন।
এরই পাশাপাশি আর একটি কাজও গুরুত্ব সহকারে করতে হবে নতুন সরকারকে। কাজটি হল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। মনে রাখতে হবে, অনিয়ন্ত্রিত জনবৃদ্ধি যে কোনো দেশের উন্নতির পক্ষে অন্তরায়। দ্বিতীয়ত, এই অনিয়ন্ত্রিত জনবৃদ্ধির ফলে দেশের সামাজিক ভারসাম্যও ক্ষুন্ন হচ্ছে। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের বদলে ইসলামিক ভারত রাষ্ট্র দেখতে হবে—এরকম আশঙ্কা থেকেই যায়। কাজেই ভারতের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের কথা মাথায় রেখেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। দুটির বেশি সন্তান হলে কঠোর সাজা—এই রকম আইন চালু করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণও একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। অসমের মতোই পশ্চিমবঙ্গও অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ভারে ভারাক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলাতেই এই অনুপ্রবেশকারীদের দৌলতে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। আর এর ফলে এই রাজ্যে মৌলবাদী জেহাদি কার্যকলাপের প্রকোপ বেড়েছে, অনেক অঞ্চলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কাজেই অসমের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে অবিলম্বে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শুরু করা প্রয়োজন। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তার নির্বাচনী প্রচার পর্বে এই রাজ্যে এসে বলেও গিয়েছিলেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন করা হবে। এই প্রতিশ্রুতিটি পালন করার সময় এখন এসে গিয়েছে।
সর্বশেষ কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ—অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ। এই প্রতিশ্রুতিটি এবার বিজেপিকে পালন করতেই হবে। এবং এই বিষয়ে বিজেপিকে স্পষ্টবাদিতার পথ বেছে নিতে হবে। রামমন্দির নির্মাণে যদি আর কোনোভাবে কালক্ষেপ হয়—তাহলে নির্বাচকমণ্ডলীর বিরাট অংশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। রামমন্দির দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের আবেগের কেন্দ্র। সে আবেগকে যেন বিজেপি আঘাত না করে।
আগামী পাঁচ বছর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের কাজ করার সময়। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার আত্মপ্রসাদে বিজেপিকে তুষ্ট হলে চলবে না। আত্মতুষ্টি যে অনেক সময় ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। বরং আগামী পাঁচ বছরে নিজের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালন করে বিজেপি চেষ্টা করুক—আগামী কয়েক দশক সরকারে টিকে থাকার ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করতে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-06-07